বাসন্তীগন্ধা পর্ব -১১

#বাসন্তীগন্ধা
|১১|
লাবিবা ওয়াহিদ

———————-
–“মিস রোজা এসেছে স্যার। তাকে কী ডেকে দিবো?”

সাইয়ান হেলান দেওয়া থেকে সোজা হয়ে বসলো। মেয়েটির দিকে চাইলো। চমকে গিয়ে বললো,

–“আর ইয়্যু শিওর?”

–“ইয়েস স্যার!”

এরকম এক খবর শুনে সাইয়ান কীরকম পতিক্রিয়া দেখাবে ঠাওর করতে পারলো না। সাইয়ান আলতো স্বরে বলে,
–“কেবিনে আসতে বলুন!”

–“ওকে স্যার।”

————————-
সারিমকে এই সময়ে বাড়িতে একদমই আশা করেনি মেহের। ইলিরা সারিমকে দেখে খুব খুশি হলো। যখন হাত উঠিয়ে সারিমকে হাই জানালো তখন মেহের নিজ হৃদয়ে তীর বিঁধে যাওয়ার মতো কষ্ট অনুভব করলো। কম্পিত হলো তাঁর অধর জোড়া। কারণ, ইলিরা যখন হাত উঠালো তখন তাঁর পাতলা শাড়িটা সরে গিয়ে পেট এবং কোমড়ের কিছু অংশ উম্মুক্ত হলো। যা দেখে মেহেরের মাথা ভনভন করছে। মিনমিন করে মেহের বললো,

–“সারিম ভাই, ইলিরা আপুর দিকে তাকাবেন না প্লিজ!”

মেহের সারিমের দিকে তাকালো। সারিম ইলিরার দিকে চেয়ে আছে। মেহের গভীর ভাবে লক্ষ্য করলো সারিমের চাহনি। একবার ইলিরার দিকে তাকিয়েও পরখ করে নিলো। নাহ, সারিম ইলিরার চেহারার দিকেই তাকিয়ে আছে। নিচের দিকে তাকায়নি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কিন্তু সেই স্বস্তি বেশিক্ষণ রইলো না। ইলিরা লম্বা লম্বা পায়ে সারিমের দিকে গিয়ে সারিমকে জড়িয়ে ধরলো। যা দেখে মেহেরের ভেতরে কালবৈশাখীর ঝড় হানা দিলো। শূণ্য চোখে চেয়ে রইলো ওদের দিকে।

সারিম অবশ্য ইলিরাকে জড়িয়ে ধরেনি। সে এক নজরে মেহেরের মুখ-ভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করছে। মেহের হাতের তালুতে নখের আলতো আচড় কাটছে। সারিম ইলিরাকে নিজে থেকে ছাড়িয়ে বলে,
–“তুই কখন এলি?”

–“অনেকক্ষণ হলো। তোমায় কতবার কল করেছি জানো?”

ইলিরার হঠাৎ “তুই” সম্বোধন থেকে “তুমি” সম্বোধনটা কিছুটা অদ্ভুত লাগলো সারিমের। তাও সে নিজেকে সামলে বললো,
–“স্যরি, মিটিং এ ছিলাম!”
–“ইট’স ওকে। আসো আমরা কিছুক্ষণ আড্ডা দিই!”

মেহের চুপ করে সোফার এক কোণায় গিয়ে বসলো। সামিরার কল আসায় সে উপরে চলে গেলো। ইলিরা সারিমকে নিয়ে সোফায় বসতেই মেহের সারিমকে ধরে টান দিয়ে ইলিরার থেকে কিছুটা দূরত্বে বসিয়ে ধীর কন্ঠে বললো,
–“আপুর সাথে লেগে বসবেন না প্লিজ!”

সারিম মেহেরের দিকে চেয়ে ফিসফিস করে বললো,
–“কেন? কী হয়েছে?”

মেহের ভীষণ লজ্জা অনুভব করলো ইলিরার কথাটা বলার জন্যে। অনেক চেয়েও বলতে পারলো না। পরে নিজের এই অদ্ভুত অনুভূতির কাছে হার মেনে মেহের হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। ধৈর্যেরও একটক সীমা আছে। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে উপরে চলে গেলো। অতঃপর দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো। মিনিট পাঁচেক কাঁদার পর সে নিজেই হতভম্ভ। এভাবে কাঁদছে কেন মেহের? চট করে উঠে বসলো সে! এতদিন তো সে নিজেই চাইতো সারিমের একটা বউ হোক, যে মেহেরকে সারিমের বকাঝকা থেকে বাঁচাবে। কিন্তু মেহের হঠাৎ বিপরীতমুখী আচরণ করছে কেন? আবারও চোখের সামনে ভেসে উঠলো সারিম এবং ইলিরার জড়িয়ে ধরার দৃশ্য। আচ্ছা, আগেও তো তাঁরা মোটামুটি ক্লোজ ছিলো, তখন তো মেহেরের কষ্ট হয়নি। এখন তাহলে কেন কষ্ট পাচ্ছে? ইলিরা সারিমকে ভালোবাসে বলে? কিন্তু তাতে মেহেরের কী? মেহের কেন স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না?

মেহের আবার ধপ করে শুয়ে পরলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও গেলো। বিকালে দরজায় কড়াঘাত পরলে মেহেরের ঘুম ভেঙে যায়। এলোমেলো ভাবে উঠে বসে সে। চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পেলো সামিরা দাঁড়িয়ে আছে। মেহের ঘুম কন্ঠে শুধালো,
–“বলো!”

–“সারিম ভাইয়া ঘুরতে নিয়ে যাবে। রেডি হয়ে নে দ্রুত!”

মেহের এতে সেরকম পতিক্রিয়া দেখালো না। সারিমের নাম শুনে আবারও সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। মেহের দায় সাড়া ভাব নিয়ে বলে,
–“তুমি যাও। আমি আসছি!”

বলেই সামিরার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। দরজার সাথে পিঠ লেপ্টে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। বিকাল হয়ে সন্ধ্যা নামার সময় হয়েছে। এর মানে ইলিরা চলে গেছে৷ আর নিশ্চয়ই সারিম-ই ইলিরাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসেছে। মনঃক্ষুণ্ন হলো মেহেরের। সারিম আসার আগে ইলিরা তাকে এবং সামিরাকে বলেছিলো ইলিরা ইচ্ছাকৃত গাড়ি ছাড়া এসেছে। যাতে ইলিরা সারিমের সাথে বাড়ি যেতে পারে। এতে করে তারা আরও কিছুটা সময় টাইম স্পেন্ড করতে পারবে।

মেহের বিষণ্ণ মনে ওয়াশরুমে ঢুকলো। মনের মাঝে অভিমানের সাথে জেদেরও আলো দেখা গিয়েছে। মেহের একেবারে রেডি হয়ে রুম থেকে বের হলো। বের হতেই দেখলো মাহিম ঘর্মাক্ত হয়ে কোথাও থেকে ফিরছে। মাহিম মেহেরের এই বেশ দেখে কিছুটা ভ্রু কুচকালো। ভ্রু কুচকে বললো,
–“এই কালু আন্টি? কে তুমি? আমার বাড়িতে কী করছো?”

মেহের ধাম করে মাহিমের পিঠে একটা বসিয়ে দিলো। মাহিম আর্তনাদ করে পিঠে হাত বুলানোর চেষ্টা করতে করতে মিনমিন করে বললো,
–“জংলী!”

মেহের হেসে বলে,
–“এবার চিনেছিস?”

–“তোর সাহস তো কম না দেড় মিনিটের বড়ো ভাইয়ের গায়ে এভাবে হাত তুলিস! যখন আমি তোরে ধরবো না, তখন তোর হাল বেহাল করে ছাড়বো!”

মেহের তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
–“এসব ঢং আমার সাথে দেখানো লাগবে না। এত ঘেমে কই থেকে আসছিস? মনে হচ্ছে জমিতে হাল চাষ করে এসেছিস!”

মুখটা গোমড়া করে ফেললো মাহিম। থমথমে সুরে বললো,
–“এমনিতেই আজ জম্মের খেলা খেলেছি, তার উপর এই বাড়িতে আসতে না আসতেই সারিম ভাইয়া হুকুম করলো ওই ইলিরা আপুকে বাড়িতে দিয়ে আসতে। এমতাবস্থায় আবার আপুকে বাড়ি দিয়ে এসে ফিরলাম।”

হঠাৎ মেহেরের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো। এর মানে কী মাহিম ইলিরাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে? সারিম ইলিরার সাথে যায়নি? খুশিতে মেহেরের চঞ্চল হতে ইচ্ছে করলো। চঞ্চলতার প্রমাণস্বরূপ জোরে চিৎকার দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে চাইলো। কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে সামলে মেহের মুচকি হেসে বললো,

–“তাহলে তুই বিশ্রাম কর!”

বলেই মেহের গুণগুণিয়ে গাইতে গাইতে মাহিমকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। মেহের চলে যেতেই মাহিম মুচকি হেসে বললো,
–“ইলিরা আপুর খুব সমস্যা ছিলো আমার সাথে বাইকে বসার। এজন্য-ই তো আপু নিজেই টেক্সি ভাড়া করে চলে গেলো। মাহিম তুই তো বড়োই কুল!”

বলেই শিষ বাজিয়ে ভেতরে চলে গেলো। ইলিরার সমস্যা ছিলো মাহিম অতিরিক্ত ঘেমেছে বলে। ঘামের গন্ধে ইলিরার বমি আসে। এজন্যে বাড়ির বাইরে এসেই ইলিরা মাহিমকে বলেছিলো,
–“থ্যাঙ্কস মাহিম বাট আমি একাই যেতে পারবো!”

মাহিম হেসে বলে,
–“ইট’স ওকে আপু!”

———————–
–“মিস রোজা, আপনি তো দশ দিনের ছুটি নিয়েছিলেন। তাহলে নয় দিনের মাথায় চলে আসলেন যে?”

রোজা অধরে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বলে,
–“এইতো স্যার, বাসায় বসে বোর হচ্ছিলাম তাই চলে এসেছি!”

–“ওহ। ভালো করেছেন। তা আপনার বিয়ে…”

রোজা হাসলো। হেসেই জবাব দিলো,
–“পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিলো। বয়স কিছুটা বেশি বলে রিজেক্টেড!”

সাইয়ান ভারি অবাক হলো রোজার কথা শুনে। বয়স বেশি বলতে কী বুঝালো রোজা? রোজার কোয়ালিফিকেশন অনুযায়ী বয়স হয়তো চব্বিশ, পঁচিশের কোঠায় হবে। সাইয়ান বললো,
–“এত বেশিও বয়স হয়নি আপনার রোজা!”

–“সাধারণ ঘরে বয়স বিশ মানে মেয়ে বুড়ি!”
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়েই বললো রোজা।
সাইয়ান আবার জিজ্ঞেস করলো,
–“তা বিয়ের করার পরিকল্পনা নেই আপনার?”

রোজা সাইয়ানের চোখ-মুখ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আলতো হেসে বললো,
–“আমার জন্যে আমার পরিবার আগে স্যার। রঙিন দুনিয়ায় পা দিলেই কী তাদের পেটে দানা পরবে স্যার? আমিই আমার পরিবারের একমাত্র সম্বল!”

–“তাহলে পাত্রপক্ষ?”

–“মায়ের কঠোর জেদের কাছে হার মেনে রাজি হয়েছিলাম। মা চায় আমি সংসারী হই।”

–“মায়ের এমন ভাবাটা স্বাভাবিক। আপনি মেয়ে মানুষ, আপনার পুরুষ নামক এক ছায়ার প্রয়োজন। নয়তো এই সমাজের কিছু জ্ঞানহীন, নিচু মানসিকতার মানুষ আপনাকে খুবলে খাবে!”

রোজা কিছুক্ষণ চুপ থেকে থমথমে সুরে বললো,
–“অনেকটা সেরকম-ই বলতে পারেন!”

আবার থমকালো সাইয়ান। অবাক সুরে বললো,
–“মানেহ?”

রোজা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। নিজের আবেগ, অস্থিরতাকে সন্তর্পণে সামলে নিয়ে ম্লান হেসে বলে,
–“আমার উপর আমার সৎ ভাইয়ের কুনজর পরেছে স্যার। আজ থেকে নয়, এই ক্ষত আমি অনেকদিন ধরে সহ্য করছি!”

—————
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here