#বাসন্তীগন্ধা
|১৫|
লাবিবা ওয়াহিদ
———————–
বেলা এগারোটার মাঝেই রোজার সকল জরুরি জিনিসপত্র এবং রোজার মা, ভাই পৌঁছালো সাইয়ানদের বাড়িতে। আজ সারিম এবং সোহেল সাহেব অফিস যায়নি। মেহের’রাও আজকে কলেজ যায়নি। সামিরাও বাড়িতে। রোজার মা নিজেও বিশ্বাস করতে পারছে না তাঁর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।
যেই মেয়ের বিয়ের প্রতি অনীহা ছিলো সেই মেয়ে কী করে পারলো না জানিয়ে বিয়ে করতে? এরকম নানান প্রশ্ন তাকে বিরক্ত করলেও যখন প্রাক্তন স্বামীর সম্পর্কে শুনলো, তখন রোজার মা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। তার উপর এত বড়োলোক মেয়ে জামাই, বিষয়টা বদহজম হচ্ছে তাঁর।
রোকসানা তো ফজর থেকেই মুখ গোমড়া করে বসে আছেন। তাঁর ঘুমের মাঝে এতকিছু ঘটে গেলো আর তিনি কী না জানতে পারলেন ফজরের সময়? তাঁর বড়ো নাতি বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে। ভাবা যায়? নাস্তার সময় রোজাকে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ভুলেনি।
মাহিম রোকসানাকে লক্ষ্য করে তাঁর কানে ফিসফিস করে বলেছিলো,
–“ভাবী অনেক সুন্দরী, ঠিক তোমার মতো!”
মাহিমের প্রসংশা শুনে রোকসানা বেগম কিছুটা গলেছিলো। তবে রোজার সাথে তিনি একটা কথাও বলেনি। আইয়ুব সাহেব মুখ গম্ভীর করে খেয়ে লিভিংরুমে চলে যায়। সোহেলও তাঁর পিছে চলে যায়। ওরা যেতেই রোকসানা গলা খাঁকারি দিয়ে সাইয়ানের উদ্দেশ্যে বলে অভিমানী কন্ঠে বলে ওঠে,
–“আগে তো খুব গীত গেয়ে বলতা আমারে ছাড়া বিয়ে করবা না। এখন তুমি বিয়ে করার পর বুঝলাম তোমার ওই কথা মুখের ছিলো নাকি মনের!”
সাইয়ান খাওয়া বন্ধ করে রোকসানার দিকে মায়াভরা চোখে চেয়ে বললো,
–“স্যরি দাদী। তবে বিশ্বাস করো, বিয়ের আগে তোমার কথা খুব মনে পরেছিলো। তোমার দোয়া ছাড়া দম্পত্তি জীবন শুরু করতে কেমন বেরঙিন লাগছিলো!”
–“থাক। আর মন রাখার কথা বলতে হবে না!”
–“এটা তুমি বলতে পারলে দাদী? আমি মন রাখার কথা কখনো বলেছি?”
মেহের সাইয়ানের কথায় ফোড়ন কেটে বললো,
–“সেটাই তো দাদী। আমার হিরো ভাইয়া কখনো মন রাখার কথা বলতেই পারে না। দেখো না, কীভাবে আমার আবদার পূরণ করে আর সারিম ভাইয়ের ধমকের থেকে আমাকে বাঁচায়!”
বলেই মেহের আড়চোখে সারিমের দিকে চাইলে দেখলো সারিম চিবুতে চিবুতে গরম চোখে মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহের তৎক্ষনাৎ নজর ঘুরিয়ে ফেললো। এরকম খেতে খেতে নানান কথা চললো, যা রোজা ভীষণ উপভোগ করলো।
রোজার মা রোজার পাশে বসে আছে। রাতুল মাহিমের সাথে বাগানে ঘুরতে বেরিয়েছে। রাতুল মাহিমের থেকে এক বছরের ছোট হলেও তাদের মধ্যে ভালোই জমে ওঠেছে। বাড়ির বড়ো’রা সকলে একসাথে বসেছে আলোচনা সভায়। আইয়ুব সাহেব বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরপর বলে,
–“যাক, ছেলে-মেয়ে একে অপরকে পছন্দ করতো বিধায় তাঁরা বিয়ে করে ফেলেছে। সেটা একটু মেনে নেওয়া জটিল হলেও আপনাদের মেয়েকে আমাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আশা রাখছি বাড়ির বড়ো বউ হিসেবে চাপ না নিয়ে সকলকে ভালোবেসে দিন কাটাবে। এখন আত্নীয়-স্বজন, পরিচিত অনেকেই বিয়ের কথা জানে না। তাই আমি চাইছি একটা বড়ো রিসিপশনাল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ওদের বিয়েটার কথা জানিয়ে দিই। এখন তোমার মতামত কী বেয়াইন সাহেবা?”
রোজার মা ভীষণ মুগ্ধ হলো মেয়ের শ্বশুরবাড়ির বিনয়ী ব্যবহার দেখে। তিনি হাসি-মাখা মুখে বললেন,
–“আমার আর আপত্তি কোথায়? তবে আমার অনুরোধ, আপনারা যেই অনুষ্ঠান করবেন সেখানে আমিও কিছু খরচ দিবো!”
সোহেল সাহেব নড়েচড়ে বসে বললো,
–“এটা কী বলছেন বেয়াইন? আপনার থেকে খরচ নিবো কেন? দয়া করে এসব বলে লজ্জা দিবেন না। আলাহ্’র রহমতে আমাদের ভালোই সামর্থ্য আছে!”
রোজার মা হেসে বলে,
–“তা কী করে হয় বলুন? আমারও তো কত স্বপ্ন, মেয়ের বিয়ের সকল খরচ আমি বহন করবো। হাতে হাতে কাজ করবো, দয়া করে একা অনুষ্ঠানের খরচ করবেন না! আমাকেও সুযোগ দিন!”
আইয়ুব সাহেবের সোফার পেছনে দাঁড়ানো সাইয়ান এবার মুখ খুললো,
–“বিয়েটা হয়ে গেছে আন্টি। নিয়ম মোতাবেক রিসিপশনের খরচ আমরাই বহন করবো। আর আপনি অলরেডি এক অমূল্য সম্পদ আমাদের উপহার দিয়েছেন। এ-ই বা কম কিসের? আর আপনি-ই বলুন, এরকম রত্ন টাকা দিয়ে কেনা যায়? আমি ভাগ্যবান বিধায় উপরওয়ালা আমায় আপনার মেয়েকে দিয়েছে।”
রোজা মুগ্ধ হয়ে চাইলো সাইয়ানের দিকে। সাইয়ান তাকে এতটা মূল্য দিবে সেটা রোজা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। মানুষটার হৃদয় কতটা স্বচ্ছ হলে এত সুন্দর কথাগুলো বলতে পারে? অথচ রোজা প্রতিনিয়ত এই মানুষটির সাথে নিজেকে তুচ্ছ ভেবে এসেছে। রোজা অনুতপ্ত হলো নিজের ভাবনায়। নতুন রূপে প্রেমে পরলো তাঁর স্বামী নামক ব্যক্তিটির।
অবশেষে সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিলো আগামী মাসে মেহেরের নির্বাচনী পরীক্ষার পরপরই রিসিপশন রাখবে। এতদিন পর্যন্ত রোজা তাদের বাড়িতেই থাকুক। রোজার মা সম্মতি জানায় তাদের সিদ্ধান্তে। অতঃপর রোজার মা পরিবারের সকলের সাথে ভাব বিনিময় করে, পরিচিত হয়। জ্যুতির সাথে সে ভালোভাবেই মিশে যায়।
রাতুল, মাহিম এবং মেহের একসাথে বাগানের এক কোণে দাঁড়িয়ে। মাহিমের হাত রাতুলের কাঁধে। মাহিম রাতুলের উদ্দেশ্যে বললো,
–“কী বলছো রাতুল? তুমি কখনো প্রেম করোনি? এটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?”
পাশ থেকে মেহের তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,
–“হ্যাঁ, তাইতো। সব তো তোর ক্যারেক্টারের হবে না ভাই! তোমার কত রেকর্ড!”
মেহেরের এহেম কথায় মাহিম চোখ রাঙালো। পরমুহূর্তে হেসে মেহেরকে পচানোর উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করে,
–“জানো রাতুল! আমি মেহেরের দেড় মিনিটের বড়ো ভাই হওয়া সত্ত্বেও আমাকে সম্মান দেয় না। উলটো গলাবাজি করে সারাক্ষণ! কেমন চিপ মেয়ে!”
মেহের রেগে মাহিমের পায়ে পারা দিয়ে হাসি-মুখে বললো,
–“ভাই আমার। তোমার রেকর্ডের কথা আমার মুখ থেকে বের করতে বাধ্য করো না। কারণ, মুখের কথা একবার উচ্চারিত হয়ে গেলে তা ফিরিয়ে নেওয়া মুশকিল!”
রাতুল উৎসাহিত হয়ে বললো,
–“এমন কী কথা মেহের আপু?”
–“প্লিজ রাতুল আপু বলো না। আমরা অনলি এক বছরের বড়ো-ছোট। বেশি এজ ডিফারেন্স না!”
–“শিখ শিখ! এই হচ্ছে সম্মান, যা তুই আমাকে দিতে শিখিসনি?”
মেহের মাহিমকে চিমটি কেটে বলে,
–“তুই থামবি নাকি মুখ খুলবো?”
এর মাঝেই মেহেরের পিছুডাক পরলো। এই কন্ঠস্বর মেহেরের অপরিচিত নয়। ভীষণ চেনা। মএহের পিছে ফিরে তাকাতেই সারিম বললো,
–“আমার জন্যে কড়া চা করে আন। জলদি!”
বলেই সারিম হনহন করে চলে গেলো। সারিমের যাওয়ার দিকে চেয়ে গতকালকের সারিমকে মনে করলো মেহের। কী ভয়া!নক। ভাবতেই গা জুড়ে শিহরণ বয়ে যায়! রাতুল বেশ উৎসাহিত হয়ে বলে,
–“তুমি ভালো চা করতে জানো বুঝি?”
মেহের অধর জোড়া প্রসারিত করে বলে,
–“শিখেছি। বলা বাহুল্য শিখতে বাধ্য হয়েছি!”
–“শিখলেও এর চায়ের টেস্ট পুরোই বিশ্রী! যেন কেউ মাছের রক্ত ঢেলে দিছে। এত গন্ধ!”
মেহের মাহিমের চুল টেনে দিলে মাহিমও মেহেরের চুল টেনে দিলো। মেহের চোখ রাঙিয়ে বলে,
–“অ!সভ্য।”
–“তুই!”
———————-
সারাদিন দুজন দুজনের সম্মুখীন না হলেও রাতে দুজন নিজেদের রুমে মুখোমুখি ছিলো। এছাড়া আর তো কোনো উপায় ছিলো না। একজন লজ্জায় মুখ ঢেকেছে আরেকজন কাজের বাহানায় ব্যস্ত থেকেছে।
রোজা মুখ ঘুরিয়ে বিছানার এক কোণে বসে আঙুলে আঁচল নিয়ে খেলা করছে আর সাইয়ান বিছানার অপরপ্রান্তে বসে আছে। কেউ-ই কারো সাথে কথা বলতে পারছে না। কই, বিয়ের আগে তো এত বিব্রতবোধ ছিলো না।
তাহলে বিয়ের পরপর কেন মাঝে দিয়ে এই অদৃশ্য দেয়াল এলো? সাইয়ান নীরবতা ভেঙে বললো,
–“তোমার যদি অসুবিধা হয় তাহলে শাড়ি পরে থাকার দরকার নেই?”
রোজা আলতো স্বরে বললো,
–“আমার সমস্যা হচ্ছে না। আমি উপভোগ করি!”
সাইয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিব্রত স্বরে বলে,
–“শাড়িতে তোমায় সুন্দর দেখায়!”
মুহূর্তে-ই রোজার গাল জোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। লাজুক স্বরে বলে, “ধন্যবাদ!”
–“ঘুমাবে না?”
রোজা বিনা-বাক্যে শুয়ে পরলো। সাইয়ানও লাইট নিভিয়ে দিয়ে আস্তে-ধীরে শুয়ে পরলো। পুরো ঘর মুহূর্তে-ই নিস্তব্ধ, ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
কারো চোখে ঘুমও নেই। সাইয়ান শূণ্য চোখে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“তুমি কী আমার থেকে দূরে সরে থাকছো কেন?”
রোজা আমতা আমতা করে বললো,
–“কেন দূরে থাকতে যাবো?”
–“সেটাই তোমার কাছে প্রশ্ন। বিয়েটা কী মানতে পারছো না?”
হৃদয়টা হুঁ হুঁ করে ওঠে রোজার। তাও নিজেকে সামলে বললো,
–“তা কেন মনে হলো আপনার?”
সাইয়ান কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললো,
–“না, তেমন কিছু না। ঘুমিয়ে পরো। শুভ রাত্রি!”
———————–
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
বিঃদ্রঃ একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই ছোট পর্ব দিলাম। আশা করছি রাগ করবেন না প্রিয় পাঠকমহল। আর হ্যাঁ, আশানুরূপ মন্তব্য পাচ্ছি না। যা আমার জন্যে খুবই দুঃখজনক। একটু সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করবেন। আমি ধীরে ধীরে রেগুলার হওয়ার চেষ্টা করছি!