বাসন্তীগন্ধা পর্ব -১৮

#বাসন্তীগন্ধা
|১৮|
লাবিবা ওয়াহিদ

মেহেরের মন জুড়ে খচখচানি বিরাজমান। সাইয়ান তাকে আগেও উপহার দিয়েছে, সরাসরি। কখনো সামিরার হাতে দিয়ে পাঠায়নি। তাহলে আজ সাইয়ানের কী এমন হলো যার জন্যে সামিরার হাতে শপিং পাঠালো? এসব আকাশ-পাতাল ভাবার সময় হঠাৎ হুঁশে এলো, সাইয়ান এখন বিবাহিত। রোজাকেও তাকে সময় দিতে হবে। এজন্যে মেহের আর ঘাটলো না।

শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে রুম থেকে বের হতেই শক্ত এক বুকের সাথে ধাক্কা খেলো। মেহের চমকে মাথা উঁচু করে চাইলো। সারিম তাঁর দিকে অদ্ভুত নজরে চেয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে মেহের কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলো। পরক্ষণে চট করে সরে দাঁড়ালো। সারিমের দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে মনে হলো অনেকক্ষণ যাবৎ সে এখানেই দাঁড়িয়ে। মেহের এতক্ষণে খেয়াল করলো সারিমের কানে ফোন। সে মেহেরকে দেখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকলেও মেহের সরে যাওয়ার তার ধ্যান ভাঙে।

অপ্রস্তুত কন্ঠে বললো,
–“পরে কথা হচ্ছে।”

বলে বেশ তাড়াহুড়োয় কল কেটে ফোন পকেটে পুরলো। মেহের চারপাশে এলোমেলো নজর ফেলে সারিমের পাশ কেটে যেতেই নিচ্ছিলো ওমনি চুলে টান খেলো সে। মেহের চাপা আর্তনাদ করে চুলে হাত দিয়ে পিছে ঘুরে চাইলো। চাপা স্বরে বললো,

–“হচ্ছে কী? চুল ছাড়েন ভাইয়া!”

সারিম গরম চোখে চেয়ে মেহেরের উদ্দেশ্যে কাঠ কাঠ গলায় বললো,
–“চুল ছেড়ে বের হওয়ার ফন্দি করেছিস? যদি এমনই কিছু প্ল্যান করে থাকিস তাহলে কেচি দিয়ে ক্যাচক্যাচ করে চুল কেটে দিব।”

মেহের হতভম্ভ হলো। বেশ জোরালো গলায় বললো,
–“আমার মতিভ্রম হয়নি যে আমি চুল ছেড়ে বাইরে বেরোব। আফটার অল, এই বাড়ি ছাড়া আমার থাকার কোনো জায়গা নেই। সামিরা আপুর কাছে কাজে যাচ্ছি। কাজ সেরে রুমে এসে হিজাব বাঁধবো!”

সারিম সঙ্গে সঙ্গে মেহেরের চুল ছেড়ে দিয়ে বলে,
–“তো যা। দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

বলে সারিম লম্বা লম্বা পা ফেলে তাঁর রুমে প্রবেশ করে মেহেরের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো! মেহের বেক্কল বনে গেছে সারিমের আচরণে। অতঃপর বিড়বিড়িয়ে সারিমকে গাল-মন্দ করতে করতে সামিরার রুমের দিকে গেলো। দরজা খুলতেই নিবে ওমনি মেহের ভেতর থেকে স্পষ্ট ফিসফিসানি শুনতে পায়। সামিরা ফিসফিস করে যা বললো তাতে মেহেরের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। সারিম কাউকে বলছে,

–“আরে বাবা আচ্ছা। পাঠাবো ছবি। আগে থেকে জ্ঞান হারানোর প্রয়োজন নেই। ঠিকাছে? এখন রাখো তো!”

পরমুহূর্তে আবার বলে ওঠে,
–“আরেহ! “বাবা” তো কথার কথা বলেছি। তুমি আমার বাবা হতে যাবে কেন? তুমি তো আমার একমাত্র ভালোবা!”

মেহের এবার খট করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পরলো। কেন যেন তার পা জোড়া প্রচন্ড কাঁপছে। হয়তো অজানা ভয়ে। মেহেরকে দেখে সামিরা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কান থেকে ফোন নামিয়ে কল কেটে দিলো। অতঃপর বোকার মতো হাসি দিয়ে বললো,

–“আরেহ তুই। কোনো দরকার?”

মেহের চেয়েও বলতে পারলো না সামিরার কথাগুলো সে শুনতে পেয়েছে। তাই কিছু না বোঝার ভান করে বললো,
–“কুচিটা ঠিকমতো সেট করতে পারছি না। পিন মে* দাও তো!”

আড়ালে সামিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর কুচি ঠিক করে দিতেই মেহের রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। হিজাব বাঁধতে বাঁধতে সামিরার কথাগুলোই ভাবছে সে। মেহেরের মাথায় ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ অংকটার সূত্র মাথায় আসতে থাকে। সামিরা আগে মোটেও সারাদিন মোবাইল নিয়ে পরে থাকতো না। অথচ ইদানীং সে মোবাইলে খুব চ্যাট করে। যেখানে সকলে মিলে আড্ডা দেয় সেখানেও সামিরার হাতে ফোন থাকে। ফোনের দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসে। কেউ সেটা খেয়াল না করলেও মেহের ঠিক-ই সেটা লক্ষ্য করতো।

ধীরে ধীরে মেহেরের সব হিসাব মিললেও পরক্ষণে নিজের মাথায় চাপড় মে* ভাবতে থাকে, সে এসব কী ভাবছে? সামিরা কেন সম্পর্কে জড়াবে? সারিম বা সাইয়ান কেউ-ই অনুমতি দিবে না। কিংবা দু’জন দামড়া ভাই থাকা অবস্থায় সে কোনো মতেই সম্পর্কে জড়াবে পারবে না। সম্ভব না। তাই মেহের সম্পূর্ণ বিষয়টি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলো।

সকলে একসাথেই বেরিয়ে গেলো ঘুরতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। মেহের, সারিম, মাহিম এবং সামিরা এক গাড়িতে। আর সাইয়ান, রোজা আরেক গাড়িতে। সাইয়ান এবং রোজা নিউ কাপল তাই ওরা ওদের দুজনকে একা ছাড়াটাই ঠিক মনে করলো।

সাইয়ান ড্রাইভিং এর পাশেপাশি কোণা চোখে রোজাকে দেখতে ব্যস্ত। এই প্রথমবার রোজাকে শাড়ি পরতে দেখছে সে। তাও আবার নিজের পছন্দের কেনা শাড়ীতে। রোজা সাইয়ানের দিকে চেয়ে বলে,

–“আপনি সানগ্লাস পরে ড্রাইভ করছেন কেন? ঠিকমতো দেখতে পান তো?”

সাইয়ান অপ্রস্তুত হলো রোজার কথায়। আমতা আমতা করে বললো,
–“বিকেলের রোদ চোখে লাগছে বিধায় সানগ্লাস পরছি। নয়তো ড্রাইভিং-এ ফোকাস করতে পারবো না!”

রোজা কেন যেন সাইয়ানের কথা বিশ্বাস করতে পারলো না। বিকালের রোদ থাকে নরম এবং কোমল। এই রোদে তো সমস্যা হওয়ার কথা না। কতটুকুই-বা এর তীক্ষ্ণতা? তাও রোজা সাইয়ানের জন্যে চুপ করে রইলো। কথার পিঠে আর কথা বাড়ায় না। এদিকে সাইয়ান মূলত চশমাটা পরেছে রোজাকে দেখার জন্য।

রোজা আনমনে বাইরে চেয়ে ছিলো। তখনই হঠাৎ সাইয়ান বলে ওঠে,
–“শাড়িতে তোমায় সুন্দর লাগছে!”

রোজা চমকে ঘাড় বাঁকিয়ে চাইলো সাইয়ানের দিকে। ভেতরে অনুভূতির প্রজাপতি’রা হুট করেই বন্দি খাঁচা ছেড়ে চারপাশে বিচরণ করছে। এলোমেলো ভাবে। সাইয়ান রোজাকে কিছু বলেনি দেখে রোজা কিছুটা মন খারাপ করেছিলো যার কিছুটা আন্দাজ সাইয়ানও করতে পেরেছে। পরমুহূর্তে হেসে বলে,

–“যাও, কিছু লুকালাম না। তোমাকে দেখতেই সানগ্লাস পরেছিলাম, যেন তুমি আমার চোরা নজর দেখতে না পারো। এই নরম রোদের চেয়ে তোমার রূপের তীক্ষ্ণতা বেশি রোজা।”

রোজা এবার ভীষণ লজ্জা পেলো। লজ্জায় কথা বলতে ভুলে গেলো সে। সে দ্রুত আবার ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরে চাইলো। সর্বাঙ্গ জুড়ে কেমন শিরশির অনুভব হচ্ছে তাঁর।

মাহিম সামিরার কানে ফিসফিস করে বলে,
–“আমি এখন প্রাপ্তবয়স্ক। কই আমাকে আমার বাইক দিবে তা না, আমাকে তোমাদের মেয়ে মহলের মাঝে বসে পা নাড়াতে হচ্ছে। এসব মানা যায় সামি আপু?”

সারিম লুকিং গ্লাসে মাহিমের দিকে চেয়ে বলে,
–“তুই এতোও প্রাপ্তবয়স্ক হোসনি যে তোরে ফ্লার্ট করার জন্যে বাইক দিবো। আজকের জন্যে এই মেয়ে মহলের মধ্যে থাকাই তোর জন্যে ব্যাটার!”

সারিমের এহেম কথা শুনে মাহিম গাল ফুলিয়ে সামিরার থেকে সরে বসলো। অতঃপর জানালার কাঁচ ভেদ করে বাইরে চেয়ে বললো,
–“আমার সব কথা তোমার শুনতে হবে কেন সারিম ভাইয়া?”

–“কারণ, তুই-ই আমাকে শুনাস!!”

মাহিমের পাগলামি মাখা কথাবার্তায় মেহের এবং সামিরা দুজনের মুখে হাত চেপে হাসতে লাগলো। সেই হাসির অল্পস্বল্প শব্দ মাহিমের কান অবধি পৌঁছালে তাঁর সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠলো।

ওরা আসলো এক সুন্দর জায়গায়। যেখানে হাঁটাহাঁটির অনেক জায়গা থাকলেও কিছুটা ভেতরে গেলে বিরাট ব্রীজ। ব্রীজের নিচে কৃত্রিম লেক। সেই লেকে বেশ কিছু নৌকায় কাপল’রা ঘুরে বেড়াচ্ছে। জায়গাটি মোহনীয় হলেও আজ প্রচুর মানুষে গিজগিজ করছে। যআ নিতান্তই দম বন্ধকর অবস্থা। তাও মন্দ লাগছে না এই বিকেল। মেহের এবং সামিরা পাশাপাশি হাঁটছে। তাদের পিছে সারিম। মাহিম সারিমকে ফাঁকি দিয়ে ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে। সামিরা এবং মেহের এক পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে সাথে নানান মানুষের দিকে তাকিয়ে খুব হাসছে।

সারিম মেহেরকে বেশ লক্ষ্য করছে। এর মাঝে সামিরার কল আসায় সামিরা মেহেরকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ভীড় ঠেলে দূরে চলে গেলো। মেহের একা দাঁড়িয়ে আর কী করবে? হাঁটতে লাগলো এবং নানান মানুষের কান্ড দেখতে লাগলো। সারিমকে তখনো মেহের খেয়াল করেনি। মেহের কিছু কাপলদের পাশাপাশি হাঁটতে দেখে ভাবছে ইশ যদি সেও সারিমকে পাশে পেত। পাশাপাশি হাঁটতে পারতো! কিন্তু সারিমের-ই যে দেখা নেই। ভাবতেই মেহের চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

কিছু দূর যেতেই মেহের দেখতে পেলো অভি এবং তাঁর বন্ধুমহলকে। অভিকে দেখে মেহের বেশ চমকে উঠলো। সাথে ভীষণ ভয়ও পেলো। মেহেরের সামান্য রূপেই অভি ঘায়েল, তার মাঝে যদি শাড়ি পরিহিত মেহেরকে দেখে ফেলে তাহলে মেহেরকে আস্ত রাখবে না। দিন-রাত জ্বালাবে। এজন্যে মেহের ধীরে সুস্থে ওদের এড়িয়ে ব্রীজের দিকে চলে গেলো। ব্রীজ পার হয়ে ওপাশের এক জনমানবহীন জায়গায় চলে আসলো সে। এদিকে বেশ কিছু কাপলের ঘনিষ্টতা লক্ষনীয়। যা দেখে মেহেরের চোখ কপালে উঠে গেছে। সে তাদের দেখে পিছে ফিরে চলে যেতেই নিবে ওমনি আবার শক্ত বুকের সাথে ধাক্কা খেলো। পরপর শুনতে পেলো পরিচিত সেই কন্ঠস্বর।

–“এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়ানো যায় না? এত তিড়িংবিড়িং করছিস কেন?”

মেহের সারিমের থেকে সরে এসে হাত চুলকাতে চুলকাতে চারপাশে এলোমেলো নজর ফেললো। আমতা আমতা করব বললো,
–“স্থির হয়েই দাঁড়াব। তাও এখানে থাকতে চাই না!”

সারিম ভ্রু কুচকে একবার মেহেরের দিকে তো একবার আশেপাশে তাকালো। সবকিছুই স্বাভাবিক। তাহলে মেহের এমন করছে কেন? সারিম ভ্রু কুচকে বললো,

–“কী হলো?”

মেহের কোণা চোখে চাইলো সারিমের দিকে। অতঃপর দূরের একটা গাছের পিছে ইশারা করলো। সারিম সেদিকে তাকিয়ে দেখলো দুটো ছেলে-মেয়ে খুব ঘনিষ্ঠ অবস্থায়। যা দেখে সারিম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে নজর ফিরিয়ে নিলো। মেহেরকে স্বাভাবিক করে বললো,
–“অন্যদিকে চল।”

বলেই সন্তর্পণে মেহেরের হাত নিজের মুঠোতে নিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলো। মুহূর্তে-ই মেহের দেহ জুড়ে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। হৃদপিন্ড ক্রমশ শব্দের সাথে ওঠা-নামা করছে। মেহের গুটিশুটি মে* অনুভূতিকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে লাগলো। পার্কের এক পাশে এসে দেখলো এখানে ফুল বিক্রেতা ফুলের তাজ বানাচ্ছে। সেখান থেকে সারিম একটা ক্রাউন কিনে নিলো। অতঃপর মেহেরকে সেটা পরিয়ে দিতে দিতে বললো,
–“পহেলা বসন্তে এই ফুলে সুরভীত তাজ ছাড়া তোকে বেমানান লাগছে মেরু। এই তাজ তোর মাথায় শোভা না পেলে আমাএ জন্যে এই রঙিন বসন্ত বৃথা।”

সারিমের এই এলোমেলো আবেদনময়ী কথাগুলো মেহেরকে আরও বিনাস করতে উঠে পরে লাগলো যেন। হৃদয়ে তীরের মতো বিঁধলো সারিমের কথাগুলো।

সারিম আবার বললো,
–“পিছের ব্যাকগ্রাউন্ড সুন্দর। ছবি তোলার জন্যে পার্ফেক্ট।”

মেহের হার্টবিট মিস করলো যেন। গোল গোল চোখে মাথা উঁচু করে চাইলো সারিমের দিকে। সারিম মেহেরকে তোয়াক্কা না করে পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোন বের করে মেহেরকে কাছে নিলো। অতঃপর মেহেরের মাথার কাছে কিছুটা ঝুঁকে সেল্ফি তুললো। মেহের তখন মূর্তির ন্যায় ফোনের দিকে চেয়ে রইলো। আশেপাশে কী হচ্ছে তার কিছু মস্তিষ্ক বুঝতে পারছে না।

এর মাঝে সময় পেরোলো আরও কিছুক্ষণ। কোথা থেকে ইলিরা এসে হানা দিলো ওদের দুজনের মাঝে। মেহেরের ভালো লাগার বিনাস ঘটলো ইলিরাকে দেখে৷ ইলিরা আজও শাড়ি পরেছে। চুল ছাড়া, হালকা মেকাপে বেশ আবেদনময়ী লাগছে তাকে। এতে মেহেরের হৃদয় আরও ভেঙে গেলো। মুখ ভার করে চেয়ে রইলো ইলিরার দিকে। ইলিরা হাসি বজায় রেখে সারিমের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। অতঃপর লহু কন্ঠে বললো,

–“হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে সারিম। এখানে আসবে তা কেন আগে জানাওনি?”

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here