বাসন্তী প্রেম পর্ব ১১+১২

#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#একাদশ_পর্ব

ওহে কি করিলে বলো পাইব তোমারে,
রাখিব আঁখিতে‌ আঁখিতে‌
ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ;

ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ
তোমারে হৃদয়ে রাখিতে,,
আমার সাধ্য কি বা তোমারে
দয়া না করিলে কে পারে?
তুমি আপনি না এলে কে পারে;
হৃদয়ে রাখিতে!!

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না?
ওহে মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না?…….

চন্দ্রিকার গলার স্বরের সাথে তাল মিলিয়ে মিলিয়ে সামনে থাকা বাচ্চা গুলোও গাইতে শুরু করে। তার পাশেই এককোণে চুপ করে বসে একমনে মুগ্ধ হয়ে তা শুনে যাচ্ছে সিরাত।
সারাদিন আশ্রমে একা একা থাকার মতো একঘেয়েমি কাটিয়ে উঠতেই বিকেলের দিকে চন্দ্রিকার সাথেই গানের ক্লাস জয়েন করে সে। গানের রেশ কাটে সদর দরজায় উপস্থিত একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের কথায়।
– ” প্রভা?”
পাশ ফিরে তাকায় চন্দ্রিকা। দরজার সামনে আজীজুর সাহেবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে।
– ” আরে আজীজ আঙ্কেল, আপনি?
বাহিরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসুন!”
চন্দ্রিকার কথায় প্রত্যুত্তর হিসেবে আজীজুর সাহেব মুচকি হেসে পাশ ফিরে বলে উঠলেন,
– ” আসুন স্যার, ভিতরে আসুন!”
আজীজুর সাহেবের কথামতো সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো ফাইয়াজ। এদিকে দরজার দিকে উৎসুক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেও পরক্ষণে ফাইয়াজকে দেখতে পেয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেললো চন্দ্রিকা।
হাসিমুখে আজীজুর সাহেবের সাথে ভেতরে প্রবেশ করলেও সামনে কর্ণারে চোখ যেতেই থমকে দাঁড়ায় ফাইয়াজ। কালো শাড়ি পরিহিতা একজন নারীর অবয়ব। হ্যাঁ এটাতো সিরাতই। কালো রঙের শাড়িতে যেন সৌন্দর্য বর্ধিত হয়ে আরো কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে তার। সাথে কপালের মধ্যবিন্দুতে থাকা কালো কুচকুচে রঙের টিপ টাও যেন ফাইয়াজকে তীব্র ভাবে আকর্ষণ করছে। সিরাতের ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়ে থাকার মতো বিষয় চন্দ্রিকার চোখ এড়ায় না।
– ” মিস্টার ফাইয়াজ, আপনি?”
চন্দ্রিকার খানিকটা গম্ভীর কন্ঠস্বরে ঘোর কাটে ফাইয়াজের।
তবে তার পূর্বেই পেছন থেকে আজীজুর সাহেব এগিয়ে এসে বলেন,
– ” স্যার এইযে ইনিই হচ্ছেন মিস প্রভা। আমি এই প্রভারই কথা বলছিলাম একটু আগে আপনার কাছে।
মেয়েটার কন্ঠ অনেক সুন্দর। আর এটাই প্রভার গানের ক্লাস। আপনি চাইলে প্রভার সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দিব।”
– ” তার কোনো প্রয়োজন নেই আজীজ আঙ্কেল।”
– ” কিন্তু স্যার একবার যদি,,”
– ” আমি বললাম তো তার কোনো প্রয়োজন নেই, কেননা আমরা আগের থেকেই পরিচিত। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না আঙ্কেল। আর আপনার বিষয়টা আমি দেখে নিব। ডোন্ট ওয়ারি।
এম আই রাইট মিস চন্দ্রিকা?”

খানিকটা ইতস্তত হলেও হাসিমুখে ফাইয়াজের কথার উত্তরে চন্দ্রিকা বলে উঠলো,
– ” জি ইয়েস!”
আজীজুর সাহেব মিনিট পাঁচেক কথা বলে বেরিয়ে পড়লেন সেখান থেকে। কিন্তু ফাইয়াজ সেখানে উপস্থিত থেকেই বাচ্চাদের সাথে নানা রকম গল্প গুজব শুরু করে দেয়।

– ” মিস্টার ফাইয়াজ, আপনি না হয় বরং এখানে কিছুক্ষণ সিরাত আর বাচ্চাদের সাথে টাইম স্পেন্ড করুন। আমি একটা জরুরী কাজে একটু বাইরের দিকটায় যাচ্ছি।”
চন্দ্রিকার কথায় ফাইয়াজ মাথা নাড়িয়ে আশ্বাস দেয়।
এদিকে সিরাত পড়েছে অস্বস্তিতে। চন্দ্রিকার চলে যাওয়া এবং ফাইয়াজের উপস্থিতি দুটো জিনিসই তাকে বরাবরের মতো অস্বস্তি বোধ করাচ্ছে। তাই চুপচাপ এককোণে শাড়ির আঁচলের এক কোণ হাতের মধ্যে গুটিয়ে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
বাচ্চাদের সাথে কথা বলার একপর্যায়ে কোনায় ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সিরাতের উপর চোখ পড়তেই চুপ হয়ে যায় ফাইয়াজ।

– ” সিরাত আপু, তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এখানে আমাদের সাথে এসে গল্প করো। এই ভাইয়াটাকে শোনাও যে আজকে তুমি কত্ত ভালো গান করে আমাদের শুনিয়েছ!”
খানিকটা অনুরোধের কন্ঠে ছয় থেকে সাত বছর বয়সী ছোট্ট প্রিয়া বলে উঠে। প্রিয়ার কথা শুনে চমকে উঠে সিরাত। সাথে করে বিপাকেও পড়ে যায়। আর কোনো উপায়ন্তর দেখতে না পেয়ে আমতা আমতা করে কিছু বলবে তার আগে ফাইয়াজের কথা কানে ভেসে আসে তার।
– ” বাহ্ মিস সিরাত, আপনি গানও গাইতে পারেন? যতই আপনার সাথে পরিচিত হচ্ছি ততই একেক দফা অবাক হচ্ছি। আর একটা ব্যাপার খুব ইন্টারেস্টিং তাই না?
আপনার সাথে আমার দেখাটা রোজ কোনো না কোনো ভাবেই হয়ে যাচ্ছে। আর সাথে পরিচয়টাও।”

– ” রোজ রোজ নিয়ম করে কি কোয়েন্সিডেন্সলিই আমাদের দেখাটা হয়ে যাচ্ছে নাকি এর পেছনে অন্য কোনো রহস্যও লুকিয়ে আছে রকস্টার সাহেব?”
কথাটা সন্দেহের সুরেই বলে উঠলো সিরাত। আর সিরাতের প্রশ্ন ভড়কে দেয় ফাইয়াজকে।

– ” না, না! ঠিক তেমনটা নয়। আসলে,,,,”
ফাইয়াজের পুরো বাক্য শেষ হয় না। তার মাঝেই পেছন থেকে কেউ সশব্দে চিৎকার করে উঠে,

– ” মুগ্ধ,,,,ওও মাই বেবি!!!”
বলার পর পরই কারো বাহুদ্বয় এসে ফাইয়াজের পিঠ জড়িয়ে ধরে। এতে করে বিব্রত বোধ করে ফাইয়াজ। তড়িঘড়ি করে পেছনে ফিরতেই আপনাআপনি তার মুখ হা হয়ে যায়। অবাক চোখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে তাকাতেই মেয়েটি পুনরায় ন্যাকামোর সুরে বলে উঠল,

– ” ও মাই ডিয়ার মুগ্ধ!! আই মিসড ইউ! কেমন আছো তুমি?”

– ” রিয়া তুমি!! তুমি এখানে কি করছো? তোমার না ফ্লাইট আজ রাতে?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো ফাইয়াজ।

– ” ইটস এ সারপ্রাইজ মুগ্ধ। ইউ নো আই লাভ সারপ্রাইজেস। আর বিডিতে ব্যাক করে সবার ফার্স্ট আমি তোমার সাথে দেখা করে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম তাই ইচ্ছে করেই আমি আমার ফ্লাইটের ম্যাটার টা মিথ্যে বলছি!”
– ” কিন্তু তুমি এখানে কি করছো মুগ্ধ? এমন একটা লো, চিপ মার্কা রুমে কি করছো! আ’ম সো টায়ার্ড! প্লিজ এপার্টমেন্টে নিয়ে ব্যাক করো!”
আশপাশে তাকিয়ে বিরক্তিকর কন্ঠে বলে উঠল রিয়া। ফাইয়াজের দিকে হাত বাড়াতেই পাশ থেকে সিরাত বলে উঠে,

– ” আপনার এখন যাওয়া উচিত রকস্টার সাহেব! আমি না হয় বাচ্চাদের সামলে নিব! আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন।”
– ” কিন্তু,,,!”

– ” হু ইজ শি মুগ্ধ? এই চিপ ক্লাস আন্টি মার্কা মেয়েটার সাথে তোমার পরিচয় কি করে হলো? আর তুমি এখানেই বা কি করছিলে? ”
এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রিয়ার কথা সহ্য করে গেলেও শেষের কথাটা কেন জানি সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায় ফাইয়াজের।

– ” রিয়া!!
হোয়াট হ্যাপেন্ড? তুমি না জেনে শুনে কি সব উল্টা পাল্টা কথা বলছো!
আর তুমি নিজ ইচ্ছায় এখানে এসেছ, কেউ তোমাকে জোর করে নিয়ে আসে নি। তো শুধু শুধু যেচে কাউকে অযথা ইনসাল্ট‌ করার মতো কাজ যে আমি মোটেও পছন্দ করি না সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো রিয়া!”

ফাইয়াজের বলা তিক্ত কথা শুনে রিয়া ভেতরে ভেতরে রাগে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। কটমট দৃষ্টিতে একবার সিরাতের দিকে তাকিয়ে বাইরের দিকে দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করে। আর সেটার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছোট একটা শ্বাস ফেললো ফাইয়াজ।
– ” কিছু মনে করবেন না মিস সিরাত। একচুয়ালি রিয়ার স্বভাবটা এমনি। তাই এসব কথা বলেছে।”

– ” আরে না রকস্টার সাহেব আমি কিছু মনে করিনি! তবে আপনার বোধহয় এখন তার সাথে ফেরা উচিত!”
একপ্রকার বাধ্যবাধকতার কারণে না চাইতেই ছোট্ট করে আচ্ছা বলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়ে ফাইয়াজ।
রিয়া আর ফাইয়াজ বের হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই চন্দ্রিকা উপস্থিত হয় ক্লাসে। সেখানে ফাইয়াজকে দেখতে না পেয়ে সিরাতকে জিজ্ঞেস করল,
– ” মিস্টার ফাইয়াজ কি চলে গিয়েছে, পূরবী?”
– ” হ্যাঁ আপু! একটু আগেই একটা মেয়ে এসেছিল, তার সাথে চলে গিয়েছেন সে!”
– ” ওও আচ্ছা! তবে কি জানিস পূরবী, একটা জিনিস কদিন ধরেই খেয়াল করছি, যে যেখানেই থাকিস না কেন ছেলেটার সাথে ইদানিং কোনো না কোনো ভাবে দেখা হয়েই যাচ্ছে!”

চন্দ্রিকার কথা শুনে সিরাত হতবাক। তার কি বলা উচিত ঠিক বুঝতে পারছে না।
– ” কি বলতে চাইছো তুমি চন্দ্রিকা আপু? ”
– ” তুই জানিস পূরবী আমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে পারি না, তাই সরাসরি ই বলছি! আই থিংক মিস্টার ফাইয়াজ কোনো না কোনো ভাবে তোর প্রতি দুর্বল!”
এই একটা কথাই নিমিষেই সিরাতের চিন্তা ভাবনার জগতকে‌ প্রশমিত করে তোলে।

– ” এটা হতে পারে না আপু! তার মতো এত বড় একজন সেলিব্রিটি রকস্টার দুর্বল হবে আমার প্রতি? এটা কল্পনাও করা যায় না। তার উপর সবচেয়ে সত্যি হচ্ছে আমি একটা দৃষ্টিশক্তিহীন‌ মেয়ে যার চোখের দৃষ্টি আদৌ কোনোদিন ফিরবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
শুধু শুধু অযথা চিন্তা ভাবনা বাড়িয়ে কি লাভ?”
– ” এভাবে বলিস না পূরবী, ডক্টর রূপ তো বলেছে যে রিস্ক থাকলেও চান্স আছে! আর আমি চাই তুই রিস্ক টা নে! যদি রিস্কের ভেতর দিয়েও তোর চোখের দৃষ্টি ফিরে আসে তাহলে?
আর রইলো বাদবাকি ভালোবাসা? সেটা অনুভবের সীমান্ত পেরিয়ে। শুধু উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু হতাশা একটাই আমরা কিছু সময় ভুল মানুষটাকেই ভালোবেসে তার মায়ায় জড়িয়ে যাই। তবে আমি বলছিনা সবাই এক। প্রিন্সেস ডায়ানার উক্তি মনে আছে?

” আমি যাকে ভালোবেসে ছিলাম সে আমি বাদে বাকি সবাইকে ভালোবেসেছিল! ”
তাই সময় নিয়ে, চিন্তা ভাবনা করে তবেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিস! ”

চন্দ্রিকার কথার প্রত্যুত্তরে শুধু একরাশ নীরবতাই পালন করলো সিরাত।
সন্ধ্যে বেলার আগ মুহূর্ত আকাশ জুড়ে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। সূর্যের আলো ফেলে পড়েছে পশ্চিমের শেষ প্রান্তে। সবকিছু ঠিকঠাক করে বাইরে বের হবে এমন সময় বাইরে থেকে হট্টগোলের আওয়াজ কর্ণপাত হতেই কপাল কুঁচকে ফেলে চন্দ্রিকা আর সিরাত উভয়েই। চন্দ্রিকাকে অনুসরণ করে পিছু পিছু দরজার সামনে পৌঁছাতেই বাইরে থাকা লোকজনের কথা শুনতেই বিস্মিত হয় সিরাতে।…………..
#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#দ্বাদশ_পর্ব

বাহির থেকে শোরগোলের‌ আওয়াজ কর্ণপাত হতেই সেদিকে পা বাড়ায় চন্দ্রিকা আর সিরাত দুজনেই। কিন্তু বাইরে পা এগোতেই চিন্তা ভাবনা সব উবে যায় চন্দ্রিকার। প্রেস মিডিয়ার বিভিন্ন রিপোর্টার ভীড় জমেছে সামনের দিকটায়। এদিকে সিরাত আর চন্দ্রিকাকে বাইরে বের হতে দেখামাত্র ক্যামেরা, স্পিকার নিয়ে হুড়মুড় করে এগিয়ে আসে রিপোর্টাররা‌।

– ” ম্যাম আমাদের জানা মতে তো একটু আগে এই খানে রকস্টার মুগ্ধ উপস্থিত ছিলেন, তাহলে প্লিজ আমাদের বলুন উনার বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
পরপর দুবার আপনার সাথে রকস্টার মুগ্ধক একসাথে দেখা গিয়েছে। আমরা জানতে চাই রকস্টার মুগ্ধের সাথে আপনার সম্পর্ক কিসের? যদি একটু বলতেন!”

এমন একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটতেই আঁতকে উঠলো সিরাত। ক্যামেরা, স্পিকার সিরাতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই সিরাত দু কদম পিছিয়ে যায়।
– ” কি শুরু করেছেন আপনারা? আপনাদের এসব প্রশ্ন করার অধিকার কে দিয়েছে? রকস্টার মুগ্ধ এখানে তার প্রফেশনাল কাজের জন্য এসেছিলেন, আপনারা কিসের ভিত্তিতে এসব উদ্ভট কথাবার্তা বলছেন!
আর এজ ফার আই নো মিস্টার মুগ্ধ একবার নিজে লাইভে এসে বলেছেন যে সিরাত এবং তার মাঝে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই? তবুও বারবার আপনারা একই কথা কেন বলছেন?”

রিপোর্টারদের পথ রুখে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো চন্দ্রিকা। তবুও যেন রিপোর্টারদের মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। পরিস্থিতি হিতের বিপরীতে চলে যাওয়ার আশংকা করতেই সিরাতের হাত ধরে ভীড় ভাট্টা‌র পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লো চন্দ্রিকা। চোখ দিয়ে নোনা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে সিরাতের। এমন অপ্রীতিকর ঘটনার সঙ্গে এমনভাবে পুনরায় জড়িয়ে যেতে হবে ভেবেই কান্নার পরিমাণ ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
ক্লাস থেকে বের হয়ে রাস্তায় কয়েক সেকেন্ড তাকাতেই একটা খালি সিএনজি চোখে পড়ে চন্দ্রিকার। সিরাতকে নিয়ে তড়িঘড়ি করে সিএনজি তে গিয়ে বসে পড়ে সে।
– ” এই পূরবী কি হয়েছে কান্না করছিস কেন? দেখ প্লিজ কান্না করা বন্ধ কর। মিস্টার ফাইয়াজের আসার পর যে এভাবে আবারো মিডিয়া প্রেসের লোকজন এসে পড়বে আমি ভাবতেই পারি নি। এমনটা হবে ভাবলে তো মিস্টার ফাইয়াজ কে তো আমি সেখানে আসতেই দিতাম না।
এবার প্লিজ কান্না বন্ধ করে দে। কেউ তোকে এ ব্যাপারে কিছু বলবে না, ভরসা রাখ। ওবারেও তো মিস্টার ফাইয়াজ নিজে বলেছিল তাই না!”
কান্না করতে করতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে সিরাত‌। ফর্সা চেহারায় লালচে বর্ণ স্পষ্ট ধারণ করেছে নাকের ডগা সহ বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে।

– “আবারো পুনরাবৃত্তি ঘটলো সেই ঘটনার! রিপোর্টারদের তিক্ত কথার সম্মুখীন হতে হলো পুনরায় সেই মেয়ে সিরাত আনবার পূরবীকে। যার সাথে বিখ্যাত রকস্টার মুগ্ধকে নিয়ে বেশ কিছুদিন আগেই ট্রল হচ্ছিলো পুরো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে। তাহলে এবারেও কি কোনো নতুন ভাবে রকস্টার মুগ্ধেকে নিয়ে আলোচনার রোল পড়ে যাবে ইন্টারনেট দুনিয়ায়? নাকি উন্মোচিত হবে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল রহস্য!
পরবর্তী আপডেট জানতে চোখ রাখুন *** চ্যানেলের উপর আর থাকুন আমাদের সাথেই।
ফারহান খান, চট্টগ্রাম।”
এক হাতে সিগারেট আর অন্য হাতে মদের গ্লাস নিয়ে মাথা নিচু করে বসে ছিল রিয়ান। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পড়ে থাকলেও টিভির বড় স্ক্রিনে রিপোর্টার এর কথা কর্ণপাত হতেই মস্তিষ্ক আপনাআপনি সজাগ হয়ে ওঠে তার। সাথে করে ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে কিছুটা বাঁকা হাসি।

– ” বলেছিলাম না তোমাকে আমার কাছে ধরা দিতেই হবে সিরাত? দেখো টাইম এসে গিয়েছে! আর কত পালিয়ে থাকবে? ঘুরেফিরে তোমাকে আমার খাঁচাতেই বন্দি হতে হবে আর সেটাও আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে।
এসব ছাইপাশের নেশা আর ধরছে না! আমার তো এখন শুধু তোকেই চাই সিরাত! আমি আসছি!”
বলেই একটা হাসি দিয়ে পুনরায় সিগারেটের শেষাংশ মুখে পুরে দিল রিয়ান।

মেঘাচ্ছন্ন আকাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ চমকানোর হালকা রেশ মেঘেদের ভেতর দিয়ে চোখে পড়ছে। ছাদে থাকা লাইটের মৃদু আলো ছাদের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। আর তার থেকে খানিকটা সামনে এগিয়ে রেলিং ধরে একমনে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে ফাইয়াজ। চোখে শুধু বিকেলে দেখা সিরাতের চেহারা ভেসে উঠছে। কপালে থাকা এলোমেলো চুল গুলো হাত দিয়ে ঠিক করা, ভীত চেহারাটা মনে পড়তেই একাই হেসে উঠে ফাইয়াজ।
– ” দিন দিন যতই অতিবাহিত হচ্ছে ততই অবাক হচ্ছি নিজের এমন পরিবর্তন দেখে। আমি ফাইয়াজ যে কি না আজ পর্যন্ত মেয়েদের থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করেছে আজ সেই আমি কোনো মেয়ের ভাবনায় মগ্ন। হাউ স্ট্রেঞ্জ!
আর একমাত্র সিরাতকে দেখেই এমন ফিলিংস হয় কেন? যেন সিরাত আমার খুব কাছের কেউ। যখনি মেয়েটার আশপাশে থাকি তখনি খুব বেশি রিফ্রেশ লাগে। কি হতে পারে আমার আর সিরাতের মাঝের কানেকশন!!”

– ” আমি বলে দিচ্ছি! কানেকশন একটাই আর সেটা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত তুই একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছিস। মেয়েটা আর কেউ নয় বরং সিরাত যাকে নিয়েই তোর এত চিন্তা ভাবনা!”
পেছন থেকে ধ্রুবের কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে হালকা চমকে পেছন ফিরে তাকায় ফাইয়াজ।

– ” কি সব হাবিজাবি বলছিস? আমি সিরাতের প্রেমে পড়েছি? কিন্তু কি করে?”
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে ফাইয়াজ।

– ” আমি ঠিকই বলছি। যাক শেষ মেষ বিখ্যাত রকস্টার ফাইয়াজ আহমেদ মুগ্ধ একজনের প্রেমে পড়লো। এটাতো কালকের স্পেশাল‌ নিউজ হওয়া উচিত।
কিন্তু আফসোস একটাই, যে প্রেমে পড়েছে সে নিজেই জানে না সে যে কাউকে ভালোবেসে ফেলেছে!”
খানিকটা মজা করে ধ্রুব কথাটা বলতেই আড়চোখে ধ্রুবের দিকে তাকায় ফাইয়াজ। সাথে সাথে চুপ হয়ে যায় ধ্রুব।
– ” তুই এত শিওর হলি কি করে যে আমি সিরাতের প্রেমে পড়েছি? আর তোরই বা প্রেম বিষয়ে এত কনফিডেন্স কি করে? প্রেম ট্রেম করিস নাকি?”
সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই আমতা আমতা করে ধ্রুব।
– ” আরে আমি প্রেম করতে যাব কেন? আমি কি তোর মতো নিরামিষ নাকি? সাধেই কি উপন্যাসের বই পড়ি? উপন্যাসের বই পড়লে প্রেম প্রেম ফিলিং আসে। তাই বললাম!”

– ” আচ্ছা বাদ দে! খুব সম্ভবত আগামী দু তিন দিনের মধ্যে রিয়াকে নিয়ে আবারো ঢাকায় ব্যাক করতে হবে।
রিয়ার কথা বলতেই একটা কথা মনে পড়লো ফারিহার সাথে কালকে কথা হয় নি।”
বলেই পকেট থেকে ফোন বের করতেই ফাইয়াজ খেয়াল করে ফোন অফ হয়ে গিয়েছে।

– ” ধ্যাত ফোনে চার্জ নেই। সুইচড অফ হয়ে রয়েছে। চল তাহলে নিচে যাওয়া যাক। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।”
ফাইয়াজের কথামতো ধ্রুব আর ফাইয়াজ দুজনেই ছাদ থেকে নিচে নেমে আসে।

পুরো বিকেল জুড়ে কান্না করতে করতে মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয় সিরাতের। তাই সেটা প্রশমিত করার জন্য খাটের সাথে হেলান দিয়ে চুপচুপ বসে আছে সে। কিন্তু চোখে ঘুমের রেশ মাত্র নেই।‌
– ” আমার সাথেই সবসময় এমন হয় কেন? মিস্টার ফাইয়াজ ই বা কেন আমার মতো একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখতে যাবেন? আচ্ছা উনার কানে কি ঘটনাটা কোনো ভাবে পৌঁছেছে?
আর যদি রিপোর্টাররা এই নিউজ ছড়িয়ে দেয় তাহলে তো এই নিউজটা, না না!! এ হতে পারে না।”
বিড়বিড় করে এক লাফে শোয়া থেকে উঠে বসে সে। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামতেই পাশে থাকা পানির গ্লাস পড়ে গিয়ে মেঝেতে টুকরো টুকরো কাঁচে পরিণত হয়।
এদিকে কিছু পড়ার আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই পাশের ঘর থেকে ছুটে আসে চন্দ্রিকা। রুমে এসে মেঝের দিকে চোখ যেতেই আতকে উঠে সে।
– ” স,সি,সি্,সিরাত!”
আতংকিত হয়ে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে চন্দ্রিকা।………..

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here