#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#সপ্তদশ_পর্ব
কাঁচ জাতীয় কোনো বস্তুর ভাঙচুরের শব্দ কর্ণপাত হতেই উপরের দিকে দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করে রিয়ান। দোতলায় কর্নারের দিকে থাকা সিরাতের রুমটার সামনে গিয়েও কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে গেল সে। পরক্ষণেই আবারো দরজাতে মৃদু ধাক্কা দিতেই দরজা আপনাআপনি খুলে যায়। রুমের ভেতরে প্রবেশ করতেই টেবিলের কাছে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাঁচের টুকরো গুলো চোখ এড়ায় না রিয়ানের।
মাথা তুলে তাকাতেই রুমের কর্নারে আলমারির কাছটায় ভয়ে গুটিসুটি মেরে থাকা সিরাতের উপর চোখ পড়ে তার।
– ” কি ব্যাপার তুই ওখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আর রুমে এসব কাঁচ ভাঙলো কি করে?”
শীতল গলায় জিজ্ঞেস করে রিয়ান।
– ” আ,আ্,আমি আসলে, আমি আসলে,,”
– ” কি হয়েছে এভাবে তোতলাচ্ছিস কেন? আমি কিছু জিগ্যেস করেছি তোকে সিরাত।”
– ” আসলে আমার হাত লেগে ফুলদানিটা নিচে পড়ে গিয়েছিল। আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি, রিয়ান ভাইয়া!”
সিরাতের কথায় সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে সিরাতকে ভালো করে পরখ করে নিল রিয়ান। অতঃপর গুটি গুটি পায়ে কাঁচের টুকরো গুলো ডিঙিয়ে সিরাতের খানিকটা সামনে গিয়ে দাঁড়াল রিয়ান।
– ” ইউ নো সিরাত পাখি, তুই বড্ড বেশি বোকা। আমার কাছ থেকে কথা লুকানোর অযথা চেষ্টা করছিস। টেবিলের কাছে কি করছিলি তুই?”
– ” ক,ক্,কই? আমি সত্যি বলছি আমি কিছু করছিলাম না। আমি তো বললাম ভুল হয়ে গিয়েছে আমার!”
– ” আচ্ছা ঠিক আছে। এবার না হয় বিশ্বাস করলাম কেননা তুই জেনেশুনে নিজের বোনকে তো মৃত্যুর পথে ঠেলে দিবি না তাইনা? আর হবু বরকে এভাবে ভাই ভাই ডাকতে নেই। নেক্সট টাইম এর পরিণতি কিন্তু অত্যন্ত ভয়ংকর হতে পারে সিরাত পাখি!”
রিয়ানের বলা কথাবার্তা শুনে ভয়ে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে সিরাতের। একটা মানুষ কতটা ভয়ংকর হলে এমন কথাবার্তা বলতে পারে। রিয়ান রুম থেকে বের হতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সিরাত।
তার মিনিট পাঁচেক বাদেই আলমারির দরজার খোলার আওয়াজ পেয়ে পেছন ঘুরে তাকায় সে।
আলমারির অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে আসে ফাইয়াজ। এতক্ষণ আলমারির ভেতর নড়াচড়া না করে চুপচাপ বসে থাকার ফলস্বরূপ কপাল সহ বুক, পিঠ বেশ খানিকটা ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছে।
– ” আপনি ঠিক আছেন? কি দরকার ছিল এখানে আলমারির ভেতরে গিয়ে লুকানোর? ”
– ” আহা আমার কথা বাদ দাও। আমি ঠিক আছি। তোমার কোথাও কাঁচের টুকরো লাগে নি তো?”
– ” না আমি ঠিক আছি!”
– ” আচ্ছা ঠিক আছে, আমাকে এখন যেতে হবে। নিজের খেয়াল রেখো! আর চিন্তা করো না আমি থাকতে নিশাতের কিছু হবে না! আই প্রমিজ।”
বলে হাঁটা শুরু করতে গিয়েও থেমে যায় ফাইয়াজ। কয়েক পলক সিরাতের দিকে তাকিয়ে ব্যালকনির দিকে চলে যায়। মিনিট পাঁচেক পর ফাইয়াজের অনুপস্থিতি টের পেয়ে ধীর পায়ে ব্যালকনির দিকটায় চলে যায় সে। আজ না চাইতেও মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তির ঢেউ বয়ে যাচ্ছে।
মাঝ থেকে কেটে গিয়েছে আরো দুটো দিন। এই দুটো দিনের মাঝে ফাইয়াজ কোনো না কোনো ভাবেই এসে সিরাতের সাথে দেখা করে গিয়েছে। তাছাড়া এ কয়েকদিনের মাঝে প্রথমবারের মতো নিশাতের সাথে ফোনে কথা বলতে পেরে মন খারাপ উধাও হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে।
দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরে রিয়ান। চোখ টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। কোট, টাই সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। ঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথে টেবিলের উপর থাকা ফুলদানি, কাঁচের গ্লাস মেঝেতে ছুঁড়ে মারে। সাথে পাশে থাকা টি টেবিলে সজোরে লাথি মারতেই সেটা ছিটকে খানিকটা সামনে গিয়ে পড়ে। রুমের মধ্যে চুপচাপ বসে ছিল সিরাত। হঠাৎ নিচ থেকে ভাঙচুরের তীব্র শব্দ কানে পৌঁছাতেই হালকা চমকে উঠে সে।
বিছানা ছেড়ে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। ভাঙচুরের এক পর্যায়ে সিঁড়ির কাছে সিরাতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভেতরের থাকা রাগের পরিমাণ নিমিষেই আরো কয়েক গুণ বেড়ে যায় রিয়ানের। যার ফলস্বরূপ দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় সিরাতের দিকে।
এদিকে হঠাৎ করে সবকিছু চুপচাপ হয়ে যাওয়ায় হালকা খটকা লাগলো সিরাতের মনে।
– ” কি ব্যাপার, এখনি তো এত শোরগোল হচ্ছিল, হঠাৎ করে সব শান্ত হয়ে গেল কি করে?”
সিরাতের ভাবনায় ছেদ পড়ে চুলের মুঠোতে কারো হিংস্র স্পর্শ পেয়ে। চুলের মুঠিতে টান পড়তেই কপালের শিরা উপশিরাগুলো ব্যাথায় অবস্থা বেগতিক। যার ফলস্বরূপ মুখ দিয়ে আপনাআপনি চিৎকার বেরিয়ে আসে,
– ” আহ্! রিয়ান ভাইয়া লাগছে আমার, ছাড়ুন আমাকে!
কি করেছি আমি?”
– ” আমি তোকে বারবার বারণ করেছিলাম না সিরাত পাখি যে আমাকে রাগাস না। এর পরিণাম ভালো হবে না। কিন্তু তুই তারপরও এত বড় স্পর্ধা করেছিস! কি মনে করেছিলি আমার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবি আর আমার কানে কিছুই পৌঁছাবে না!
আর এটার শাস্তি স্বরূপ তোকে আজীবনের জন্য আমার খাঁচাতেই বন্দী হয়ে থাকতে হবে!
আগামী পাঁচ ঘন্টার মাঝেই তোর আর আমার বিয়ে হবে!
আর পালানোর কোনো রাস্তাও থাকবে না। কেননা তুই আমার, শুধুমাত্র আমার খাঁচায় বন্দী হয়ে যাবি!”
বিয়ের কথা শুনতেই ধক করে উঠল সিরাতের মন। মস্তিষ্কে শুধু রিয়ানের বলা কথাগুলো ঘুরপাক খেয়ে চলেছে।
বলার পর সিরাতকে ছেড়ে দিয়ে বাইরের দিকে হাঁটা দিল রিয়ান।
ঝিমঝিমে মাথা নিয়ে সিড়িতেই ধপাস করে বসে পড়লো সিরাত। চোখ মুখ শুষ্ক হয়ে এসেছে ইতিমধ্যে। আর হৃদয়ে কাউকে হারিয়ে ফেলার ভয় ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
– ” না না, এ হতে দেয়া যাবে না! আমি রিয়ান ভাইয়াকে বিয়ে করতে পারব না। রকস্টার সাহেব আপনি কোথায়? প্লিজ আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান! আমি এখানে থাকতে চাই না!”
বলতে বলতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে সিরাত।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো প্রায়। কিন্তু ফাইয়াজের কোনো হদিস মিলছেনা। অপেক্ষারত অবস্থায় বধূ বেশে চেয়ারের উপর একমনে বসে আছে সিরাত। এই বুঝি ফাইয়াজ আসবে, কিন্তু তার ভাবনাকে বদলে দিয়ে ফাইয়াজের কোনো উপস্থিতি টের পায়নি সে।
বেশ খানিকক্ষণ আগেই কয়েকজন মেয়ে এসে হুট করেই তাকে শাড়ি, চুড়ি পড়িয়ে সাজানো শুরু করে। কিছু সময়ের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলেও পরক্ষণেই রিয়ানের বলা কথা মনে পড়ে। লাল টুকটুকে শাড়ি, বধূ বেশে অপরূপ সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে সিরাতের মাঝে। কিন্তু আফসোস বধূ রূপে সাজতে হচ্ছে এমন একটা মানুষকে বিয়ে করার জন্য যাকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারবে না সে। ভেবেই ভেতর থেকে এক অজানা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সিরাতের।
বসে বসে নিয়তির নির্মম পরিহাসের কথা ভেবে যাচ্ছিল সিরাত। পেছন থেকে সেলেনা চৌধুরীর ডাক পড়তেই হালকা নড়েচড়ে বসে সে।
– ” কিরে নবাবজাদী আর কতকাল এভাবে মূর্তির মতো আসন দিয়ে বসে থাকবি! নিচে তোর জন্য কাজী অপেক্ষা করছে!
না জানি আমার ছেলেটাকে কোন কালোজাদু করে নিজের মায়ায় ফেলেছিস! কিন্তু আমার সামনে তোর কোনো নাটক চলবে না। একবার শুধু বিয়েটা হতে দে তারপর আমি নিজে তোকে রিয়ানের হাতে ধাক্কা দিয়ে এ বাড়ি থেকে বের করে দিব!
অপয়া কোথাকার!”
বলতে বলতে মুখ বাঁকিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন সেলেনা চৌধুরী। ছেলের এমন হুট করে বিয়ের ডিসিশন নেয়ার প্রতি তিনি প্রবলভাবে বিরক্ত।
মিনিট বিশেক পরেও যখন সিরাতের আসার কোনো নাম গন্ধ নেই তখন একপ্রকার বিরক্তি নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় রিয়ান। সামনের দিকে পা বাড়াবে ঠিক সেই মুহূর্তে চোখ পড়ে উপর থেকে নেমে আসা সিরাতের উপর। আর সাথে সাথেই চোখ আটকে যায় সিরাতের দিকে।
এদিকে সিরাত এক পা এক পা করে সিঁড়ি দিয়ে পা ফেলছে আর মনে মনে আপন কল্পনার জগতে হারিয়ে যাচ্ছে সেখানে শুধু মাত্র ফাইয়াজের হাসি আর কন্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি এসে কানে বিঁধছে। ফাইয়াজের কন্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়ে আপনাআপনি তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দু তিন জন মেয়ে এগিয়ে গিয়ে সিরাতকে নিয়ে রিয়ানের পাশে বসাতে যাবে তখনই থমকে দাঁড়ায় সিরাত।
পেছন থেকে তাড়া দিলেও একই ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে রিয়ান।
– ” আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারব না রিয়ান ভাইয়া!”
শীতল গলায় উপস্থিত কয়েকজন মানুষের সামনে বলে উঠে সিরাত।
– ” এখন আমার রাগ উঠাস না সিরাত। ভালোয় ভালোয় বলছি বিয়ের জন্য বসে পড়! নাহলে কিন্তু ভালো হবে না তোর জন্য।”
– ” হ্যাঁ আমি ঠিকই বলছি! আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারব না!
আমি আপনাকে ভালোবাসি না! সেখানে আপনাকে বিয়ে করার কোনো প্রশ্নই আসে না!”
– ” সিরাত!! বেশি বেড়ে গিয়েছিস তাই না? আমি এতক্ষন ধরে সোজাসুজি ভাবে বলছিলাম ভালো লাগে নি তাই না?
তোর আমাকেই বিয়ে করতে হবে আর সেটাও এই মুহূর্তে!
কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করুন!”
– ” না আমি করব না আপনাকে বিয়ে! আপনার মতো একটা জঘন্য মানুষকে আমি কখনোই বিয়ে করব না যে কিনা একটা মানুষকে আটকে রেখে তার বোনের ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে!”
– ” ঠিক বলছিস তো? করবি না আমাকে বিয়ে? তাহলে শোন একটা কথা!
হ্যাঁ আমি একটা খারাপ মানুষ! আর তোর এই খারাপ মানুষকেই বিয়ে করতে হবে! কেননা শুধু মাত্র তোকে পাওয়ার জন্য, এই সমস্ত প্রোপার্টি হাসিল করার জন্যে যেখানে আমি তোর মা বাবাকেই ছাড় দেই নি সেখানে তোর বোন নিশাত কিছুই না!”
– ” মানেহ্! কি বলছেন এসব? মা বাবার সাথে কি করেছিলেন আপনি?
আতংকিত কন্ঠে বলে উঠে সিরাত!
– ” ইয়েস সিরাত পাখি! তোর বাবা মা কোনো এক্সিডেন্টে মারা যায় নি; আর না তোর চোখের দৃষ্টিশক্তি! এটা সম্পূর্ণ একটা প্ল্যানের উপর নির্ভর করে তোর বাবা মাকে মার্ডার করা হয়েছে!”
রিয়ানের মুখে এমন ভয়ঙ্কর কথা শুনে পুরো শরীর বোধশক্তি হীন হয়ে আসে সিরাতের। মনে হচ্ছে এর চেয়ে বোধহয় আর কোনো কষ্টই এ পৃথিবীতে নেই।
– ” আর সেটাও আমিই করিয়েছি! এখন এতকিছু জানার পরেও তুই আমাকেই বিয়ে করবি!”
– ” ছিহ্ রিয়ান ভাইয়া, আপনার লজ্জা করল না নিজের বাবা মায়ের মতো দুজনকে মেরে ফেলতে? কি ক্ষতি করেছিল আমার মা বাবা আপনার? কেন আমাকে আর আমার বোনকে এতিম বানিয়ে দিলেন?
এতকিছু জেনেও আমি আপনাকে বিয়ে করব এটা আপনি ভাবলেন কি করে! আপনার মত এমন নিকৃষ্ট মস্তিষ্কের মানুষকে আমার সাথে বিয়ে কখনোই সম্ভব না!”
– ” হাহাহা! তাই নাকি সিরাত পাখি? সেটা নাহয় একটু পরেই দেখতে পারবে; কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করুন!”
বলেই সিরাতের হাত খপ করে ধরে ফেলে রিয়ান। এদিকে সিরাত নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে কিন্তু একটা পুরুষালী হাতের শক্তির বিরুদ্ধে ঠিক পেরে ওঠে না সে।
– ” ছাড়ুন আমাকে! কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? আমি করবো না আপনাকে বিয়ে!”
সিরাতের কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে সোফায় গিয়ে বসে পড়ে রিয়ান।
কাজী সাহেব রিয়ানকে কবুল বলতে বললে রিয়ান গটগট করে কবুল বলে দেয়।
– ” বলুন মা কবুল!”
কাজী সাহেব বলে উঠেন।
– ” না আমি বলব না! আমি করব না এই লোকটাকে বিয়ে!”
– ” সিরাত সোজাসুজি বলে দে কবুল!”
– ” আরে এক মিনিট রিয়ান সাহেব! এত তাড়াহুড়ার কি আছে? আমার উপস্থিতি ছাড়াই আমার রানীকে বিয়ে করে নিবেন আর আমি আসবো না এটা হয় নাকি!
পেছন কারো গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠ ভেসে আসে!……………
#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#অষ্টাদশ_পর্ব
হঠাৎ পেছন থেকে ফাইয়াজের কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই চকিতে ফিরে তাকায় সিরাত। চোখে মুখে একরাশ বিস্ময়ের আভা স্পষ্ট।
– ” ফাইয়াজ আপনি এসেছেন?”
– ” ইয়েস মেরি জান! তুমি এই ফাইয়াজ আহমেদ মুগ্ধ ব্যাতীত অন্য কারো হবে এটা কখনোই সম্ভব না!”
ফাইয়াজকে দেখামাত্র ঝট করে উঠে পড়ে রিয়ান। চোখে মুখে রাগ, ক্ষোভ মিশ্রিত ভঙ্গিমা ফুটে উঠেছে।
– ” তুই এখানে!!
তোকে তো আমার লোকদের দিয়ে,,”
– ” ইয়েস মিস্টার রিয়ান চৌধুরী, আপনি ঠিকই বলেছেন! আপনি আপনার লোকদের দিয়ে আমাকে কিডন্যাপ করিয়েছিলেন; বাট ইউ নো এই ফাইয়াজ আহমেদ মুগ্ধর সাথে গেম খেলা এতটাও ইজি না!
আমি ইচ্ছে করেই তোর বোনা জালে পা দিয়েছিলাম! আর এতক্ষন ভাবছিলি সবকিছু তোর প্ল্যান মোতাবেক ই হচ্ছে; উহু মিস্টার রিয়ান চৌধুরী!
এটা তোর ভুল ধারণা, যা হয়েছে সব আমার ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী ই হয়েছে।”
মৃদু হেসে বলে উঠে ফাইয়াজ। আর ফাইয়াজের কথাবার্তা শুনে রিয়ান যেন হতভম্ব!
– ” হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দিজ, ইউ বাস্টার্ড!
তুই কি মনে করেছিস এগুলো করলেই আমি ভয় পেয়ে যাবো! লাইক সিরিয়াসলি? এই রিয়ান চৌধুরী ভয় পাবে তাও তোকে? তোর চোখের সামনেই আমি সিরাতকে বিয়ে করব আর তুই কিছুই করতে পারবি না! কেননা সিরাত আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য; আফটার অল সিরাতের প্রিয় বোন নিশাতের জীবন আমার হাতে বন্দী!”
নিশাতের কথা শুনে আঁতকে উঠে সিরাত। চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট। মা বাবাকে হারানোর পর বোনকে হারানোর কথা মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই পুরো শরীর হিম হয়ে আসে আতংকে।
এদিকে ফাইয়াজের মাঝে যেন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে পূর্বের ন্যায় মৃদু হেসে চলেছে যে হাসিতে লুকানো আছে গুচ্ছ কয়েক রহস্য। যেটা দেখে খানিকটা ভ্রু কুঁচকে ফেলে রিয়ান।
– ” উহু এবারও ভুল! নিশাতের জীবন তোর কাছে বন্দী না রিয়ান! এটা সম্পূর্ণ তোর ভুল ধারণা! নিশাত তোর কাছে না বরং আমার কাছে আছে তাও কড়া সেফটি সহ!”
ধীর পায়ে এগিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলে উঠে ফাইয়াজ।
নিজের সমস্ত কার্যকলাপ এভাবে ভেস্তে যাবে তা কখনো কল্পনাও করে নি রিয়ান। ফাইয়াজের প্রতি তার রাগ এখন উর্ধ্বে চলে গিয়েছে।
– ” নো এটা হতে পারে না! ফাইয়াজ কাজটা একদম ই ঠিক করিস নি তুই! আমার সাজানো গোছানো প্ল্যান এভাবে নষ্ট হতে পারে না!”
বলেই আশপাশ তাকিয়ে হুট করে সিরাতকে নিজের কবজায় বন্দী করে নেয় রিয়ান। শেরওয়ানির পেছনের দিক থেকে একটা পিস্তল বের করে সিরাতের মাথায় তাক করে সে। এতে করে কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে যায় সিরাত।
– ” এবার কি করবি? আমার সব প্ল্যান নষ্ট হয়ে গেলেও তোর প্রাণভোমরা আমার হাতে! যখন ইচ্ছে তখন গানের ট্রিগারে চাপ দিলেই তোর প্রাণভোমরা টুকুস করে উড়ে চলে যাবে। তখন কি হবে ফাইয়াজ?”
বলেই বাঁকা হাসি হাসল রিয়ান।
– ” তোর সাহস থাকলে তুই শুধু একটা আঁচ দিয়ে দেখা সিরাতের গায়ে! বাকি ট্রেইলার আমি নিজে তোকে দেখিয়ে দিব।”
বেশ শান্ত গলায় বলে উঠে ফাইয়াজ। বলতে বলতে গুটি গুটি পায়ে রিয়ানের দিকে এগোতে থাকে সে।
– ” ফাইয়াজ যেখানে আছিস ওখানেই থেমে যা! আর এক পা ও এগোলে কিন্তু ট্রিগার চালাতে আমার এক সেকেন্ড ও দেরি হবে না!”
তবুও ফাইয়াজের মাঝে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
– ” আই সে স্টপ! আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই গুলি চালিয়ে দিব ফাইয়াজ!”
– ” আমি তো বললাম ই তোর সাহস থাকলে তুই ট্রিগার আঙুল চেপে দেখা! আই সইয়ার তোকে আমি জ্যান্ত কবর দিয়ে দেব!”
এদিকে ফাইয়াজ আর রিয়ানের কথাবার্তা শুনে ভয়ে চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে সিরাত। এই বুঝি মস্তিষ্ক ছেদ করে গুলি তীব্র বেগে বের হয়ে যাবে।
ফাইয়াজের প্রতিটা পদক্ষেপ যথেষ্ট সন্দেহ জনক মনে হচ্ছে রিয়ানের কাছে। কিছু একটা ভেবে বাঁকা হেসে ট্রিগারে চাপ দিতে যাবে এমতাবস্থায় পেছন থেকে গান শটের আওয়াজ কানে আসে সবার। রিয়ানের হাত থেকে পিস্তল টাও নিচে পড়ে গিয়ে ইতোমধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কেননা পেছন থেকে আসা গুলিটা রিয়ানেরই ডান হাতের উল্টো পিঠ ছুঁয়ে গিয়েছে।
ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে সিরাতকে ছেড়ে দেয় রিয়ান।
– “ইউ আর আন্ডার এরেস্ট মিস্টার রিয়ান চৌধুরী! কন্সটেবল আবির, ইনাকে নিয়ে আসুন!”
সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসারের কথায় কন্সটেবল এগিয়ে যায় রিয়ানের দিকে। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে সবটা নিরবে দেখলেও পুলিশ এগিয়ে আসতেই সেলেনা চৌধুরী ও তেতে এগিয়ে আসেন।
– ” এই আপনারা কারা? আমার ছেলেকে এরেস্ট করবেন কোন সাহসে? আপনারা জানেন এক অর্ডারেই আপনাদের সবার চাকরি আমি খেয়ে ফেলতে পারি!”
– ” হাসালেন মিসেস সেলেনা চৌধুরী! আপনার এসব কথার কোনো মূল্যই আমাদের কাছে নেই।”
– ” মানেহ্ কি? আপনি আমার ছেলেকে এরেস্ট করবেন কোন ভিত্তিতে? কিছু করেছে আমার ছেলে?”
– ” সেটা রিমান্ডে নিলেই আপনাআপনি সব সত্য বের হয়ে যাবে। আর তাছাড়া আমাদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ ও আছে।
মিস সিরাতের বাবা মাকে খুন করার অপরাধেই মিস্টার রিয়ান চৌধুরীকে এরেস্ট করা হচ্ছে।”
– ” এগুলো সব মিথ্যা! আপনারা রিয়ানকে এভাবে নিয়ে যেতে পারেন না!”
সেলেনা চৌধুরীর কথায় ভ্রূক্ষেপ নেই বললেই চলে। কন্সটেবল গিয়ে রিয়ানের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিতেই সেলেনা চৌধুরী দৌড়ে এগিয়ে গেলেন।
– ” চিন্তা করিস না বাবা রিয়ান। আমি এক্ষুনি মিস্টার বসুকে ফোন করছি! উনাকে নিয়ে গিয়ে আমি তোর জামিন করিয়ে আনব।”
ফাইয়াজের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠেন সেলেনা চৌধুরী।
– ” আপনি যে ঠিক এ জায়গায় উপস্থিত থাকবেন তা আপনাকে কে বলল?
আমি কি একবারও বলেছি যে শুধু রিয়ান ই জেলের হাওয়া খাবে; আপনাকে কি করে ছেড়ে দেই বলুন তো!”
ফাইয়াজের কথায় ভড়কে উঠেন তিনি।
– ” এসব কি ধরনের আজগুবি কথা? আমি কেন জেলে যেতে যাব? আমি কি কিছু করেছি নাকি!”
– ” কি করেছেন আর কি করেন নি সেটা পুলিশ স্টেশনেই দেখা যাবে। লেডি কন্সটেবল এরেস্ট হার!”
দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। রিয়ানের চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। টকটকে লাল চোখে প্রতিশোধের ছায়া স্পষ্ট।
– ” আমি তোকে দেখে নিব ফাইয়াজ! আর সিরাত পাখি; তুই আমার না তো আর কারো হতে পারবি না এটা মাথায় রাখিস। খুব শীঘ্রই আবারো দেখা হবে!”
বলেই ক্রোধ নিয়ে গটগট করে বাইরে বেরিয়ে যায় রিয়ান, সেলেনা চৌধুরী সহ পুলিশের বাকি কর্মকর্তা।
এতক্ষণ ধরে এত ঝড় ঝাপটার ভেতর থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছে সিরাত যার ফলস্বরূপ ক্লান্ত শরীর নিয়ে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ে সে।
– ” সিরাত, আর ইউ ফাইন? কি হয়েছে?”
ফাইয়াজ ও তড়িঘড়ি করে সিরাতের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে প্রলাপ বকতে থাকে। এদিকে ফাইয়াজের কথায় রেসপন্স না করে চুপচাপ বসে আছে সিরাত।
– ” সিরাত!! হোয়াট হ্যাপেন্ড? নিশাত পুরো সেফ আছে আমার কাছে! প্লিজ কোনো চিন্তা করো না!”
ফাইয়াজের কথা বলার একপর্যায়ে ধীর গতিতে এগিয়ে ফাইয়াজকে জড়িয়ে ধরে সিরাত। চোখের কোণ দিয়ে অশ্রুর ধারাপাত বয়ে চলেছে শুভ্র রঙের মুক্তোর মত। এদিকে হুট করে জড়িয়ে ধরায় থম মেরে যায় ফাইয়াজ। মুখ দিয়ে কোনো প্রকার শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে না। তবে তার অজান্তেই মুখের কোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
—————
আহমেদ বাড়ির লোকজনদের মাঝে থমথমে অবস্থা। জাফর সাহেব গম্ভীর দৃষ্টিতে মেঝেতে তাকিয়ে আছেন। পাশেই তার স্ত্রী এবং মেয়ে ফারিহাও ভয়ে চুপসে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলে ওঠার জন্য সাহসে কুলাচ্ছে না। কেননা আহমেদ ম্যানশনের চৌকাঠের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ফাইয়াজ। তার পাশেই সিরাত ও ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
– ” বাবা আমি তোমাকে সব এক্সপ্লেইন করছি; আগে তুমি আমার কথাটা তো শোনো!”
আর কিছু বলার পূর্বেই জাফর সাহেব হাত উঁচু করে ফাইয়াজকে থামিয়ে দিলেন।
– ” আমি কোনো প্রকার কথা শুনতে চাই না; আর না কোনো এক্সপ্লেইন! আমি তোমার এমন কার্যকলাপ দেখে হতবাক। বড়দের পরামর্শ ছাড়াই তুমি ডিসিশন নিতে শিখে গিয়েছ দেখছি, তাই বলে এটা মনে করো না এ বাড়িতে আমার কথার কোনো খেলাপ হবে!
আমি যা ডিসিশন নিয়েছি সেটাই তোমাকে মানতে হবে।”
গম্ভীর গলায় বলেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন জাফর সাহেব। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে উপস্থিত হলরুমে থাকা সকলে।
এদিকে সিরাতকে দেখতে পেয়ে ফারিহা উৎফুল্ল হয়ে এগিয়ে যায় তার দিকে।
– ” আরে তুমি বাহিরে দাঁড়িয়ে আছো কেন আপু? ভেতরে এসো!”
বলেই সিরাতের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় ফারিহা। দোতলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটাই এতক্ষণ পর্যবেক্ষণ করছিল রিয়া। সিরাত ভেতরে প্রবেশ করতেই রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমে চলে যায় সে।………..
#চলবে 🍂