বাসর পর্ব ৩

#বাসর
#৩য়_পর্ব

সেলিম খানিক ক্ষীপ্রই ছিল তখন। হঠাৎ এভাবে নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষটার মৃত্যু তাকে উন্মাদ করে তুললো। এবং তার ভেতর খুব করে সন্দেহ ঢুকে গেছে যে নাঈমের মৃত‍্যুটা কোন স্বাভাবিক মৃত্যু নয়।তার ভাবি নীলা খুব কৌশল করে তার ভাইটিকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এই সন্দেহ থেকেই তার জেদ বেড়ে গেছে।সে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে যেতে ভাবলো, তাকে প্রতিশোধ নিতে হবে।যে করেই হোক তাকে তার ভাইয়ের মৃত‍্যুর প্রতিশোধ নিতে হবে।
খুনের বদল খুন করতে হবে।
তাই নীলা তাদের কাছে ঘেঁষতেই মেঝেতে পড়ে থাকা গ্লাসের ভাঙ্গা একটা টুকরো ছুঁড়ে মারলো সে নীলার উপর। নীলা সরে গিয়েও নিজেকে বাঁচাতে পারলো না। সেলিম ফের ঢিল ছুঁড়লো।
সেই ঢিল গিয়ে তার কপালটার ঠিক ডানে এসে লাগলো।আরেকটু হলে চোখেই পড়তো। নীলা নিজেকে হঠাৎ বিশ্বাস করতে পারলো না।এটা কীভাবে করে ফেলতে পারলো সেলিম?
তবে কী তার দুর্দশা শুরু হয়ে গেছে? নীলা তার কপালে হাত দিয়ে দেখলো অনেকখানি জখম হয়ে গেছে। ওখান থেকে স্রোতের মতো রক্ত নামছে গলগল করে। সেই রক্তে ভিজে যাচ্ছে তার গালের এক পাশ,গলা আর বিয়ের রঙিন শাড়িখানিও।সে এখন হতভম্ব, স্থবির এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।এক পাও নড়ছে না।যেন সে এখানেই শেকড় গেঁথে ফেলেছে আজন্ম কাল দাঁড়িয়ে থাকার জন্য।

সালমা বেগম মৃত ছেলের মাথা তার কোল থেকে নামিয়ে যত্ন করে জায়নামাজের উপর রেখে দৌড়ে এলেন নীলার কাছে। এসে নীলাকে আঁকড়ে ধরে বললেন,’পাগল হইয়া গেছে ভাইয়ের লাইগা ভাই।ও এইসব কিছু বোঝ থাইকা করতাছে না মা। সেলিম পাগল হইয়া গেছে!’
নীলা কোন কথা বললো না তার শাশুড়ির কথার পরে।সে যেভাবে ছিল সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে এখনও।
‘ তুমি আসো আমার সাথে আসো। ‘
নীলাকে ধরে ধরে তার শাশুড়ি ঘরের বাইরে উঠোনের দিকে নিয়ে গেলেন। উঠোনের পরে মস্ত পুকুর। পুকুরের পাড়ে নানান গাছ- গাছড়া। সবুজ দূর্বা। সেই দূর্বার শীর্ষে জমে আছে বিন্দু বিন্দু শিশির।সালমা বেগম ওখান থেকে শিশির মাখা কিছু দূর্বা ঘাস ছিঁড়ে হাতের তালুয় নিয়ে থেঁতলে তা এনে লাগিয়ে দিলেন নীলার কপালে। নীলা ব‍্যাথায় তার জিভে দাঁত কামড়ে ধরলো।সালমা বেগম আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন,’চিন্তা কইরো না মা সব ঠিক হইয়া যাইবো। আল্লাহ পাক সব ঠিক কইরা দিবো। আর সেলিম তো তোমার ভাইয়ের মতোই।এর আচরণে তুমি কিছু মনে কইরো না মা।ভাইয়ের এইরকম মৃত্যু সে মাইনা নিতে পারতাছে না। দাফন কাফন হউক।দেখবা সব ঠিক হইয়া যাইবো।’
না সেলিমের আচরণে নীলা মোটেও কিছু মনে করেনি। বরং এটাই তো স্বাভাবিক। হঠাৎ একজন মানুষ বাসর ঘরে মরে পড়ে থাকবে আর তার আত্মীয় স্বজন তা সহজভাবে মেনে নিবে এটা তো নিয়ম না। বরং নিয়ম হলো বাসর ঘরে যে নতুন বউটি আছে তাকে দোষারোপ করা।খতিয়ে দেখা তার কার সাথে প্রেমের সম্পর্ক আছে। এই প্রেমের জন্যই তো খুন। কিন্তু নীলার কাছে তার শাশুড়িকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তিনি যে আচরণ করছেন তাও স্বাভাবিক নয়। কারণ, পৃথিবীতে কোন মা-ই তার সন্তানের মৃত‍্যুতে এমন ভাবে সৌম্য শান্ত হয়ে থাকতে পারে না। কিন্তু তার শাশুড়ি তা পারছেন। কীভাবে পারছেন এতটা পাষান হতে তিনি? কিছুতেই নীলার তা বোঝে আসছে না!

ফজরের আজান হয়েছে।একটা দুটো পাখি ডাকতে শুরু করেছে।। সালমা বেগম পুকুরে গিয়ে অজু করলেন। তারপর ঘরে ফিরে জায়নামাজ বিছিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করলেন। নামাজের পর তিনি দু হাত তুললেন খোদার দরবারে।দোয়ায় তিনি বললেন,’হে মাবূদ, তুমি এতো বড় পাষাণ কেন গো মাবূদ?মাবূদ, আমার ছেলের সব থাইকা আনন্দের দিনে তারে তুমি কাইড়া নিলা আমার বুক থাইকা!ক‍্যান নিলা?ক‍্যান?’
সালমা বেগম কাঁদছেন। পাগলের মতো কাঁদছেন।তার কান্নায় বাড়িটা কেমন থমথম করে উঠলো। এবার তার সাথে কান্নার গলা মিশালো সেলিম।সে তার মায়ের কাছে এসে মার গলায় জড়িয়ে ধরে বললো,’ভাইয়া নাই আর আম্মা। আমার কলিজার টুকরা ভাই আর নাই।’
সালমা বেগম ছেলের মাথার হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,’নিয়তি।নিয়তিরে বাপ। এই পৃথিবীতে নিয়তির খেলা অইলো সবচেয়ে বড় খেলা। নিয়তির চাইতে বড় কোন সত‍্য নাই বাপ।’
সেলিম ফুঁপিয়ে উঠলো আবার।সে বললো,’আম্মা,আমি নিয়তির উপর ছাড়বো না বিষয়টা। আমার মন বলছে ভাবীর হাত আছে ভাইয়ার মৃত‍্যুতে।’
‘মানুষের মৃত‍্যুতে মানুষের কোন হাত থাকে না রে বাপ।হাত থাকে আল্লাহর। তিনি ইচ্ছা করলেই মানুষ মরে। ইচ্ছা করলেই বাঁচে।’
সেলিম তার মার প্রতি ক্ষীপ্ত হয়ে উঠলো।সে তার মাকে ছেড়ে দিয়ে সরে গিয়ে বললো,’আম্মা, তুমি ওই ডাইনিটার পক্ষ নিচ্ছো!’
সালমা বেগম তার ছেলের দিকে সৌম্য শান্ত চোখে তাকিয়ে বললেন,’আমি সত‍্যের পক্ষ নিছি। মরা মানুষ নিয়া মিথ্যা নাটক সাজানো আমি পছন্দ করি না।’
‘নাটক! নিজের সন্তানের আকস্মিক মৃত‍্যুকে তুমি সহজ করে দেখছো?’
‘কঠিন কইরা দেখলে কী হইবো বাপ। কঠিন কইরা দেখলে কী তোর ভাই ফিইরা আসবো?’
সেলিমের এখন যা রাগ পাচ্ছে!সে তবুও শান্ত ভঙ্গিতে বললো,’মৃত‍্যুর পর কেউ ফিরে আসে না। কিন্তু তার মৃত্যুর জন্য যে দায়ী তার শাস্তি হলে সে সুখ অনুভব করে।তার আত্মা শান্তি পায়।’
সালমা বেগম বললেন,’চুউপ করতো বাপ। আত্মীয় স্বজনরে খবর দে।পাড়া প্রতিবেশীরারে জানা।তারা যত জলদি আইবো ততো জলদি দাফন কাফন হইবো। ভাইয়ের দাপন কাপনের ব‍্যবস্হা কর।তার আত্মা কষ্ট পাইতাছে। আত্মীয় স্বজনরে খবর দে।জলদি কর সবকিছু।’
সেলিম মায়ের কথামতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।পাড়া প্রতিবেশী আর আত্মীয় স্বজনদের কাছে খবর পৌঁছাতে হবে।জলদি করতে হবে সবকিছু। মায়ের আদেশ। মায়ের আদেশের পরে আর কোন কথা নেই সন্তানের।

সালমা বেগমের সব কথা শুনছিল ও ঘর থেকে নীলা।সে দৌড়ে এসে তার শাশুড়ির কোলের উপর জলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,’আম্মা, আম্মা, আমার ভাগ্য এতো মন্দ কেন গো আম্মা!’
সালমা বেগম নীলাকে সান্ত্বনা দিতে চেয়ে নিজেই গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলেন। এই যে চেষ্টা করলেন কান্না থামাতে। ভাবলেন তিনি কাঁদলে তো নীলা, সেলিম আরো ভেঙে পড়বে। কিন্তু তিনি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। মুহুর্তে দুটি মেয়ে মানুষের কান্নায় বাড়িটি কান্না বাড়ি হয়ে উঠলো। ততক্ষণে খবর পেয়ে বাড়িতে মানুষের জটলা শুরু হয়েছে।পাড়া প্রতিবেশী আর আত্মীয় স্বজনেরা আসতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে ‌। খবর পেয়েছেন নীলার বাবাও। কিন্তু তিনি এই কথা নীলার মাকে জানাননি। তিনি বলেছেন নীলার শাশুড়ির হঠাৎ বড় অসুখ করেছে। বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ।তার নাকি ইচ্ছে বেয়াই বেয়াইন এর সাথে দেখা করার,কথা বলার । এই কথা বলেই তিনি নীলার মা জাহানারাকে নিয়ে নীলার শশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন।সত‍্যিটা জানলে সহজে মানতে পারবে না বলেই তিনি মিথ্যে বলেছেন তার স্ত্রীর কাছে।

সেলিম খুব পাগলামি করছে। একবার বঁটি নিয়ে নীলার কাছে দৌড়ে গিয়ে তাকে খুন করে ফেলতে চেয়েছে। কিন্তু বাড়ি ভর্তি মানুষের জন্য সে পারেনি। তাকে ধরে ফেলে তার কাছ থেকে বঁটি কেড়ে নেয়া হয়েছে।সে এখন বাড়ির পেছনে শিউলি গাছটার নিচে বসে আছে। ওখানেই একদল মানুষ নাঈমের জন্য কবর খুড়ছে। সে কবর খুড়ার কাজের তদারকি করছে। একবার সে এখানেও পাগলামি করেছে।কবর খুঁড়তে থাকা মানুষদের মধ‍্য থেকে একজনকে সে জিজ্ঞেস করেছে,’কবর এতো ছোট কেন?’
যাকে জিজ্ঞেস করেছে তার বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে।মধ‍্যবয়স্ক লোকটি বিজ্ঞের মতো বললো,’মাপঝোপ কইরাই লইছি। কোন সমস্যা নাই।’
‘সমস‍্যা আছে। আপনার মাপ ঠিক হয়নি। আপনি আমাদের দুই ভাইয়ের মাপ নিয়ে কবর খুড়েন। এই কবর আমাদের দুই ভাইয়ের কবর।জোড় কবর।’
সেলিমের কথা শুনে এই লোকটা এমন ভয় পেল!সে সঙ্গে সঙ্গে কবর থেকে উঠে বাড়ির দিকে দ্রুত পা ফেলে চলে গেল।পেছন থেকে ডেকেও আর কেউ তাকে পেছন ফেরাতে পারলো না।সে ভয় পেয়েছে। ভীষণ ভয়!

নীলার বাবা-মা এসে গেছেন। নীলার মা কীভাবে যেন বাড়ির দেউঠি পর্যন্ত আসতেই বুঝে গেছেন আসলে কী ঘটেছে এই বাড়িতে। তিনি দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন। তারপর সর্বহারা কোন মা পাখির মতো আর্তনাদের গলায় ডাকলেন,’নীলা।নীলা মা রে?’
নীলা তখন বসে আছে বড় ঘরের খাটের উপর।না বউ সেজে নয় বিধবার পোশাকে।সাদা শাড়ি। গায়ের সকল অলংকার খুলে ফেলতে হয়েছে তার। তার দু গালে জলের দাগ বসে আছে। তবুও তাকে কী সুন্দর লাগছে!
নীলার চারপাশেই মেয়েদের ভীড়। কৌতুহলী মহিলারা জানতে চাইছে, কীভাবে কী হলো।
এক মহিলা তার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,’মেলামেশার পরে মারা গেছে না আগেই?’
নীলা কোন উত্তর দেয়নি। এই সময় আবার দরজার পাশে দুটি মহিলা তাকে নিয়ে কথা বলছে। একজন বলছে,’আমার মন বলে কী বু, এইখানে একটা বিরাট রহস্য আছে।’
‘কী রহস্য আছে?’
অপর মহিলাটি চোখ কপালে তুললো।
তারপর যে মহিলাটি কথা বলতে শুরু করেছিলো সেই ফিসফিস করে বললো,’বউডারে সুবিধার মনে হইতাছেনা। খারাপ মাইয়া। চরিত্রের সমস্যা আছে। দেহো না এহনও মাইয়ার চেহারা কেমন উজলা। যেনো খুশিতে আত্মহারা।
দেইখো দুইদিন পর সব কিলিয়ার হইয়া যাইবো পানির মতো।’
নীলা শুনেছে। স্পষ্ট শুনেছে।
ঠিক এই সময় বাহির থেকে তার মা ডেকে উঠেছে। নীলা গলা শুনেই বুঝে ফেলেছে তার মা এসেছে।সে সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে দরজা পেরিয়ে বাইরে চলে গেছে। বাইরে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করে দ্বিতীয়বার জ্ঞান হারিয়েছে। কিন্তু উপস্থিত অধিকাংশ মেয়ে মানুষই তার জ্ঞান হারানোর চেয়ে তার চরিত্র নিয়ে আলোচনা করতেই বেশি মজা পাচ্ছে।কেউ কেউ বলছে,’দেখো,দেখো, নতুন বউ কী করে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল?
ছিঃ ছিঃ ছিঃ!
অসতী। চরিত্রহীন।’
———————————————————————

দুপুর দুটো।আকাশে কড়া রোদ।লাশ জলদি দাফন করতে হবে। জানাজা হয়ে গেছে।খাটিয়া করে কবরের পাশে লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বাড়িতে কান্নার রোল পড়েছে।এতো মানুষ কাঁদছে যে এখান থেকে নীলা কিংবা সালমা বেগমের গলা আলাদা করা যাচ্ছে না। লাশ যখন খাটিয়া করে নিয়ে যাচ্ছে তখন নীলা চিৎকার করে ডেকে উঠলো,’একটু রাখুন। প্লিজ একটু রাখুন।’
বাড়ির সবাই হঠাৎ কান্না ভুলে গিয়ে নীলার দিকে তাকিয়ে আছে।খাটিয়া বাহকেরা থমকে দাঁড়িয়ে গেছে বাড়ির আঙিনায়। তারা কেউ বুঝতে পারছে না নতুন এবং বিধবা বৌটি হঠাৎ তাদের থামতে বললো কেন?

#চলবে____
#অনন্য_শফিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here