বাসর পর্ব ৪

#বাসর
৪র্থ_পর্ব__


দুপুর দুটো বাজে।আকাশে কড়া রোদ।লাশ জলদি দাফন করতে হবে। জানাজা হয়ে গেছে।খাটিয়া করে কবরের পাশে লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বাড়িতে কান্নার রোল পড়েছে।এতো মানুষ কাঁদছে যে এখান থেকে নীলা কিংবা সালমা বেগমের গলা আলাদা করা যাচ্ছে না। লাশ যখন খাটিয়া করে নিয়ে যাচ্ছে তখন নীলা চিৎকার করে ডেকে উঠলো,’একটু রাখুন। প্লিজ একটু রাখুন।’
বাড়ির সবাই হঠাৎ কান্না ভুলে গিয়ে নীলার দিকে তাকিয়ে আছে।খাটিয়া বাহকেরা থমকে দাঁড়িয়ে গেছে বাড়ির আঙিনায়। তারা কেউ বুঝতে পারছে না নতুন এবং বিধবা বৌটি হঠাৎ থামতে বললো কেন তাদের?
নীলা দৌড়ে আসছে।তার পেছনে উড়ছে লম্বা কালো চুল। আর পেছনে ধুলোয় গড়াচ্ছে সাদা আঁচলখানি।

নীলা খাটিয়ার উপর ঝুঁকে গিয়ে কাফনের কাপড়টা নাঈমের মুখ থেকে খানিক সরিয়ে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইল। তারপর যখন তার চোখ ভিজে উঠছিলো জলে তখন সেই জল বাঁ হাতের পিঠ দিয়ে মুছে ভেজা গলায় বললো,’আপনি যে আমায় ছেড়ে এভাবে একা একা চলে যাচ্ছেন আমার কী হবে বলুন তো? আপনি এমন স্বার্থপর কেন? আমি কীভাবে একা বেঁচে থাকবো এই পৃথিবীতে। আপনাকে যে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। আপনি কী জানেন না নারীরা খুব মায়াবতী হয়। বিয়ের পর নারীরা শুধু তার স্বামীকেই ভালোবাসে?
আপনি কী জানেন না একজন নারীর কাছে তার স্বর্গ তার স্বামী? ‘ তারপর সে নাঈমের মুখে, কপালে আর নাকে খানিক ছুঁয়ে দিলো তার হাত।তার ভেজা হাতের স্পর্শ কী নাঈম পাচ্ছে? মানুষ মৃত্যুর পরেও কী তার প্রিয়জনদের স্পর্শ পায়? যদি পেতো তবে তার মা যে এখন তার মরে যাওয়ার স্হানটিতে পড়ে গড়াগড়ি করে রোদন করছে তা টের পেতো।টের পেতো নীলার ভালোবাসা। সেলিমের ভ্রাতৃত্বের দৃঢ়তা।

ওরা জানতো নীলা সহজে লাশের কাছ থেকে সড়বে না।তাই তারা নীলার বাবাকে ডাকলো। ফয়জুর রহমান তার শক্ত হাতে নীলাকে ঝাপটে ধরে রাখলেন।আর এই সুযোগে তারা লাশ নিয়ে চলে গেল কবরের কাছে। নীলা কাঁদছে।রোদন করে কাঁদছে।আর বলছে, আপনি তো বলে গেলেন না আমি এখন কী করবো? আপনি না বলেছিলেন আপনাকে রোজ দিন জায়নামাজের কাছে হাত টেনে টেনে নিয়ে যেতে। এখন তো আপনিই চলে গেলেন। আপনি কী ভীষণ মিথ্যাবাদী! আপনি কী ভীষণ মিথ্যাবাদী!’
নীলার বাবা ফয়জুর রহমান মেয়েকে কত করে যে সান্ত্বনা দিচ্ছেন কিন্তু এতে কোন কাজ হচ্ছে না। নীলা কাঁদছে।যেন কাঁদতে কাঁদতে সেও আজ মরে যাবে।

সেলিম আবার পাগলামি শুরু করেছে। নাঈমের লাশ কবরে নামাতে দিচ্ছে না। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে,’আমি ভাইয়াকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমি ভাইয়াকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমি ভাইয়াকে কবর দিতে দিবো না।’
সবাই বোঝ দিচ্ছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না।তার মা এলে কাজ হবে, মাকে মানবে এই ভেবে তার মাকে ডাকা হলো।
সালমা বেগম এসেছেন।তার ভেতর পুরে ছারখার হয়ে যাচ্ছে তবুও তিনি এমন ভান করলেন যেন তিনি শক্ত পোক্ত আছেন। তিনি ছেলেকে আদেশ করলেন,’বাবা, এইদিকে আয়।আয় আমার কাছে আয়।’
সেলিম তার মার ডাকে সাড়া দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মার কাছে চলে এলো।সালমা বেগম ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললেন,’আমার এক ছেড়া চইলা গেছে,তুইও যদি এমন করস তখন আমার কী ভালা লাগে বাপ?’
সেলিম কাঁদতে কাঁদতে বললো,’আমি পারি না। ভাইয়াকে ভুলতে পারি না আমি আম্মা।’
সালমা বেগম ছেলের সাথে নানান কথা বলতে লাগলেন তখন। নানান বোঝ দিলেন ছেলেকে। আর এই সুযোগে তারা কবর দিয়ে ফেললো নাঈমের। সাথে সাথে সেই কবরে বাঁশ দিয়ে বেড়া দেয়া হলো। কালকের জীবন্ত হাসিখুশি মানুষটা এখন কবরের ভেতর।আহা কী জীবন! ক্ষুদ্র জীবন!

জাহানারা বলছেন নীলাকে সাথে করে বাড়ি নিয়ে যাবেন। স্বামী হীন মেয়ের তো এখানে থেকে কোন লাভ নেই। তাছাড়া এমন না যে তার মেয়ের বিয়ের বছর খানিক পরে তার স্বামী মারা গেছে।এমনকি দিন দশেকও নয়। বাসরের আগেই মৃত্যু। তিনি তার মেয়েকে বিধবা হতে দিবেন না। কিছুতেই না। মেয়েকে তিনি বললেন এইসব সাদামাটা কাপড় ছেড়ে তার রঙিন কাপড় পড়তে।তার মেয়ে বিধবা নয় এটাই তিনি প্রমাণ করতে চাইছেন। কিন্তু নীলা তা মানছে না।সে তার মায়ের কথার প্রতিবাদ করেছে।বলেছে,’বিয়ের পর কোন মেয়ের স্বামী মারা গেলে সে বিধবাই হয় মা।’
জাহানারা মেয়ের কথায় চমকে গিয়েছেন। তিনি বললেন,’বিয়ের পর, কিন্তু তোদের বিয়ের কার্যাবলীইতো এখনও শেষ হয়নি?’
‘আম্মা, কবুল বললেই বিয়ে হয়ে যায়। আমি কবুল বলেছিলাম এবং মন থেকেও তাকে মেনে নিয়েছিলাম। আমার স্বামী মারা গেছে। আমাকে চার মাস এখানে থাকতে হবে।এর আগে কোন ভাবেই বাড়িতে যাবো না আমি।’
ফয়জুর সাহেব বললেন,’এটাই বরং ভালো।’
অবশ্য সালমা বেগম এই বিষয়ে কিছু বললেন না। তিনি শুধু নীলাকে বললেন,’মাগো, তোমার যা ইচ্ছা তাই করো। তুমি যদি মনে করো বাড়ি চলে যাইবা যাও। এইখানে থাকার ইচ্ছা হইলে থাকো। তোমার মনের অবস্থা খারাপ তা আমি জানি। আমার কোন অধিকার নাই তোমার উপর জোর খাটাইবার।’
নীলার কেন জানি এই মহিলাকে খুব আপন মনে হচ্ছে। হঠাৎ কেন জানি মনে হচ্ছে এই মহিলাকে ছেড়ে সে কিছুতেই কোথাও যেতে পারবে না। চলে গেলে তিনি অনেক কষ্ট পাবেন। অনেক অনেক কষ্ট পাবেন। তারচেয়ে কষ্ট করে হলেও সে এখানে চারমাস থাকবে। শাশুড়ির পাশে থাকবে। তাছাড়া এই বাড়িতে তার স্বামীর ছায়া আছে। এই ছায়া ছেড়ে সে কী করে চলে যাবে?
‘নীলা বললো,’আব্বা,আমি এখানে থাকবো।’
ফয়জুর সাহেব বললেন,’আচ্ছা। এইখানেই থাকো তুমি মা। আমি কয়দিন পর পর তোমারে আইসা দেইখা যাবো। তোমার মার ইচ্ছা হইলে সেও আসবো।’
নীলা বললো,’আচ্ছা।’
তার বাবা মা চলে যাওয়ার সময় নীলার কী যে কষ্ট হলো!সারা সন্ধ্যা সে বিছানায় পড়ে থেকে বালিশে মুখ ডুবিয়ে কেঁদেছে আর ভেবেছে, মাত্র একদিন আগেও তার জীবনটা কী সুন্দর ছিল!
বাসর ঘরে ফুল সহ‍্যিত বিছানায় বসে বসে কত স্বপ্ন সে মনে মনে এঁকেছিল!সে কী তখন জানতো তার একটি স্বপ্নও আর পূরণ হবে না!
নীলার ফুঁপিয়ে কান্না আসছে।আজ তার বাবা মার সাথে খালিদ আসেনি। খালিদের কথা সে জিজ্ঞেসও করেনি তাদের কাছে। কিন্তু এখন খুব মনে পড়ছে ছোট ভাইটির কথা। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। খুব খুব কষ্ট!
হঠাৎ সে তার পিঠে কোমল একটা হাতের স্পর্শ পেলো। সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে সে দেখলো তার শাশুড়ি এসে বসেছেন পাশে।তার হাতে প্লেট ভর্তি গরম খিচুড়ি। সেই খিচুড়ি থেকে সাদা ধোঁয়া উঠছে কুন্ডুলি পাকিয়ে।
সালমা বেগমকে কাছে পেয়ে তার কান্না আরো বেড়ে গেলো।সালমা বেগম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,’কাইন্দো না মা।কানলে তো আর মানুষ ফিরবো না। বরং কষ্ট হইবো তার রুহুর।মা, সারাদিন তুমি কিছু মুখে দেও নাই। এখন খিচুড়িটা খাও মা।’
নীলা তার ভেজা গলায় বললো,’কীভাবে খাবো আমি আম্মা? আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না।’
নীলার মুখ ভেঙে আবার কান্না আসছে।
সালমা বেগম বললেন,’না খাইলে কেমনে হইবো মা। শরীর তো ভাইঙ্গা পড়বো।খাও মা। লক্ষ্মী মা আমার।’
সালমা বেগম তার মুখের কাছে এনে নলা ধরেছেন। নীলা জানে তার শাশুড়িও সারাদিন কিছু মুখে তুলেনি।সে তার শাশুড়িকে বললো,’আপনি যদি খান তবে আমিও খাবো আম্মা।’
সালমা বেগম বললেন,’আমিও খাইয়াম মা।এই দেহো খাইতাছি।’
বলেই সালমা বেগম নিজের মুখে এক নলা ভাত নিলেন। তারপর নীলার মুখেও দিলেন।কী কষ্ট হলো যে সেই ভাত খেতে নীলার!

রাতে নীলা তার শাশুড়ির সাথে ঘুমোতে গেল। ঘুমাবার আগে তার শাশুড়ি নাঈমের বিষয়ে কত কী গল্প করলেন! নীলা সেসব মনোযোগ দিয়ে শুনলো এবং অন্ধকারে চাপা স্বরে কাঁদলো। আগের রাতে ঘুম না হওয়ায় এবং সারাদিন কান্নাকাটি করায় সালমা বেগমের শরীর ছিল ক্লান্ত।তাই তিনি হঠাৎ ঘুমিয়ে গেলেন।তার ঘুম যখন ভাঙলো তখন রাত তিনটে। তিনি ঘুম থেকে উঠেই বিছানায় শূন্যতা অনুভব করলেন। তিনি তার ডান হাতটা বিছানায় রাখলেন কিন্তু নীলার স্পর্শ পেলেন না। খুব ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে টর্চ জ্বালালেন। আর তখনই তার ভয়টা আরো বেড়ে গেলো কারণ ঘরের দরজাটা ছিল খোলা। তিনি চিৎকার করে ডাকলেন,’সেলিম। সেলিম?’
সেলিম তার ঘর থেকে জলদি বের হয়ে এলো।সেও ঘুমিয়ে গিয়েছিল।সালমা বেগমের ডাকে হঠাৎ জেগে উঠেছে।সে ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বললো,’কী হয়েছে আম্মা?’
সালমা বেগম কাঁপা গলায় বললেন,’বউমা ঘরে নাই।’
‘ঘরে নাই মানে?’
সালমা বেগম বললেন,’আমি ঘুমাইয়া গেছিলাম।ঘুম থাইকা উইঠা দেখি বিছানায় আমার পাশে সে নাই। তারপর লাইট জ্বালাইয়া দেখি দরজা খোলা।’
সেলিম এখন কী করবে বুঝতে পারছে না।তার মনে হচ্ছে নীলাকে এখানে রাখা ঠিক হয়নি। না রাখাই ভালো ছিল। তার ভয় হচ্ছে। ভীষণ ভয়!আর মনে হচ্ছে নীলা মেয়েটি সাধারণ কোন মেয়ে নয়।সে অনেক ধূর্ত। তার চরিত্রে রহস্য আছে। গভীর রহস্য!
সেলিম ভাবছে। তার ভাবনাকে এলোমেলো করে দিয়ে হঠাৎ সালমা বেগম বললেন,’আমার পেছন পেছন আয় বাপ।’
সেলিম কিছুই বুঝতে পারছে না তার মার কান্ড কারখানা। তবে তার মায়ের আদেশ তার যে করেই হোক পালন করতে হবে।সে হাঁটছে ।তার মায়ের পিছু পিছু হাঁটছে। কিন্তু বুঝতে পারছে না তার মা এই এতো রাতে কোথায় যাবে?
#চলবে__
#অনন্য_শফিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here