#বাসর
#১০ম_এবং_শেষ_পর্ব
‘
‘
তখন ভোর সকাল।গাছের পাতা ভেদ করে ফুলের মতো ফুটে উঠছে লাল টুকটুকু দিবাকর। এই সময় জানলায় দাঁড়িয়ে এক জোড়া দোয়েলের প্রণয় দৃশ্য দেখছিলো নীলা।আর তার মা জানলার কাছেই মাচার দিকে বেড়ে উঠা সবুজ পুঁইশাক তুলে রাখছিলেন তার আঁচলের পেটে।
সালমা বেগম তখন আমতা আমতা করে নীলাকে বললেন,’বউমা, তুমি আমারে পছন্দ করো না মা?’
নীলা খানিক চমকালো।তার চোখ মুহূর্তের জন্য পলক ফেললো। তারপর খানিক সময় চুপ করে থেকে সে বললো,’আম্মা।’
সালমা বেগম মাথা উপরে তুললেন।
নীলা আবার বললো,’আম্মা, আপনাকে আমি অনেক অনেক পছন্দ করি!’
‘আমি যা বলি তা শুনবা তুমি মা? আমি তোমার কাছে কিছু চাইলে তুমি তা দিবা?’
নীলা কথা বললো না।সে চুপ করে রইলো।
সালমা বেগম ফের বললেন।
‘আমার একটা কথা রাখবা মা। এই কথাটা রাখলে সারা জনম তোমার দাসী হইয়া থাকবাম মা!’
সালমা বেগম নীলার একটা হাত টেনে ধরে কেঁদে উঠলেন। নীলার খুব মায়া হচ্ছে এই মানুষটার জন্য। খুব খুব মায়া! কারণ নিজের কোন পছন্দের মানুষ কাঁদলে ভীষণ খারাপ লাগে। তখন পছন্দের মানুষটির জন্য নিজেরও কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হয়।
কিন্তু নীলা কাঁদলো না এবং কথাও বললো না।সে তাকালো সামনে।বাইরে মাচার উপর বসে থাকা দুটো দোয়েল একটির ঠোঁটের উপর ওপরটি ঠোঁট রাখলো। নীলার চোখ কেমন ভিজে উঠছে জলে।
সালমা বেগম কাঁদছেন। তিনি আজ নিজেকে অনেক বড় অসহায় মনে করছেন। নীলাকে যে তিনি এতো ভালোবাসেন তা আগে অতটা টের পাননি তিনি। কিন্তু এখন তাকে হারানোর ভয়ে বুঝতে পারছেন নীলাকে তিনি অনেক বেশি পছন্দ করেন। তাকে ছাড়া তিনি কিছুতেই থাকতে পারবেন না।
সালমা বেগম আবার বললেন,’বউমা, তোমারে আমি নিয়া যাইবো মা। সাথে কইরা নিয়া যাইবো’
জাহানারা বেগম বাইরে থেকে সবকিছু লক্ষ্য করছেন। শুনছেন। মনে মনে তিনি ভীষণ রাগ পাচ্ছেন। কিন্তু সেই রাগ তিনি প্রকাশ করলেন না।
সালমা বেগম অবশ্য এইসব খেয়াল করছেন না। তিনি নীলার পাশে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকলেন,’বেয়াইন।’
জাহানারা তাকালেন। সালমা বেগম এবার বললেন,’সেলিমের লাইগা বউমারে আমি নিয়া যাইবো।’
জাহানারা বেগম কিছু বলার আগেই নীলা ওখান থেকে দৌড়ে চলে গেল ঘরের ভেতর। জাহানারা বেগম খানিক সময় চুপ থাকলেন। তারপর বললেন,’আপনার বেয়াইর সাথে আলাপ করেন। এইসবে আমি নাই।’
সালমা বেগমের কেমন আশা আশা লাগছে। কেন জানি তার মনে হচ্ছে ফয়জুর রহমান অমত করবেন না এতে।
‘
একলা একা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বালিশে মুখ লুকিয়ে নীলা কাঁদছে।তার কেন জানি হঠাৎ নিজেকে অসহায় অসহায় লাগছে।তার শাশুড়ির প্রতি খুব রাগ হচ্ছে। আবার নাঈমের কথাও মনে পড়ছে খুব। কিন্তু সমস্যা হলো নাঈমের মুখের অবয়ব তার স্মরণ নেই।সে তীব্র চেষ্টা করে যাচ্ছে তার মুখের অবয়ব চোখের সামনে আনার জন্য। কিন্তু আসছে না। নীলা মনে মনে ডাকলো,’নাঈম,নাঈম। এই নাঈম।’
নাঈম তার ডাকে মোটেও সাড়া দিলো না। নীলা এখন ভাবছে সেলিমকে নিয়ে। নীলা জানে তার বাবা সেলিমের ব্যাপারে অমত করবেন না। কিন্তু সে ভাবছে সেলিমকে নিয়ে সে কী করে সংসার করবে? নাঈমকে ছাড়া তো সে আর কাউকে ভালোবাসে না!
‘
সালমা বেগম অবশেষে সবকিছু খুলে বললেন ফয়জুর রহমানের কাছে। ফয়জুর রহমান শুনে বললেন,’মেয়ে তো আর জীবন ভর একলা থাকতে পারবে না। বিয়ে শাদি তো তারে দিতেই হবে। কিন্তু সেলিমের ব্যাপারে অমত করে নাকি আল্লাহ জানে!’
সালমা বেগম তখন বললেন,’আমি যেমনেই হউক রাজি করাইবো ওরে।যেমনেই হউক রাজি করাইবো বেয়াই।’
ফয়জুর রহমান বললেন,’দেখেন।তারে বইলা দেখেন। মেয়ে রাজি হইলে তো আমার কোন সমস্যা নাই। আমার দুঃখি মেয়েটার যদি সুখ হয় তাইলে আমার মনও একটু শান্ত হয়।’
‘
সালমা বেগম নীলার দু হাত টেনে ধরে বললেন,’মা মাগো, তোমার কাছে এই একটাই আর্জি আমার।তোমারে আমি হারাইতাম চাই না গো মা। তুমি রাজি হইয়া যাও মা।’
সালমা বেগমের চোখে টলমল করছে জল। তিনি শক্ত করে ধরে আছেন নীলার দুটো হাত। তিনি এমন ভাবে ধরেছেন যেন নীলাই একমাত্র তাকে রক্ষা করতে পারে। নীলা যেন এই বিপদের দিনে তার ত্রাণকর্তা।যেন নীলার হাত দুটো অথৈ সাগরে ভাসতে থাকা কোন খড়কুটো।আর তিনি জলে ডুবে যেতে থাকা কোন নাবিক। ডুবে যেতে যেতে বাঁচার জন্য তিনি আঁকড়ে ধরেছেন সেই খড়কুটো। তিনি বাঁচতে চান। বাঁচতে তাকে হবেই যেভাবেই হোক!
নীলা ভাবলো। অনেক্ষণ ভাবলো। কিন্তু তার মন সায় দিচ্ছে না। অবশেষে তার কাছে এলেন ফয়জুর রহমান। তিনি এসে নীলার পাশে বসে ডাকলেন,’মারে?’
নীলা তাকালো।তার চোখ ফোলা ফোলা। দীর্ঘ সময় ধরে কাঁদার জন্য এমন হয়েছে।
ফয়জুর রহমান বড় অনুনয়ের গলায় এবার বললেন,’মারে,জগতে যদি কয়েকজন ভালো মানুষ থাকে তার মধ্যে তোর শাশুড়িও একজন। এই মানুষটার মনে কোন প্যাঁচ গোছ নাইরে মা।বড় সরল মহিলা তিনি।তোর কপাল মা এমন একজন শাশুড়ি পাইছস। তিনি যদি তোরে তার ঘরে রেখে দিতে চান তাইলে মা অমত করিস না।’
নীলা সবকিছু শুনেও চুপ হয়ে আছে।কী বলবে বুঝতে পারছে না। তার মনে বার বার একই কথা বাজছে সুরের মতো করে। নাঈমকে কী করে ভুলে যাবো আমি। নাঈমকে কী করে ভুলে যাবো আমি।
ফয়জুর রহমান আবার বলা শুরু করলেন। তিনি বললেন ,’নিয়তি হলো মা পরম সত্যের নাম। এই সত্য মেনে নিতে হবে মা। সেলিমের সাথে না হইলেও অন্য কারোর সাথে তোর বিয়ে হবেই। জীবন তো আর এভাবে কাটবে না।আমরাও বেঁচে থাকবো না চিরদিন। একটু কষ্ট লাগলেও মেনে নে মা।দয়া করে মেনে নে।’
নীলা হাউমাউ করে তখন কেঁদে উঠলো। বাবাকে সে না বলতে পারবে না।বাবাকেও যে প্রচন্ড ভালোবাসে সে!
‘
অবশেষে নীলা রাজি হলো। যদিও তার মন সায় দিচ্ছে না। কিন্তু বাবা আর শাশুড়ির মন রাখতে তাকে রাজি হতে হলো। এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না যে তার! মানুষ তো বরাবরই এমন। বাস্তবতার কাছে তাকে হারতে হয় বারবার।পরম সত্য নিয়তিকে তার মাথা ঠুকে প্রণাম করতে হয়!
———————————————————————
‘
আজ নীলার বাসর।না প্রথম বাসর নয় এটা তার দ্বিতীয় বাসর। কিংবা প্রথম দ্বিতীয় বলে কোন বিশেষণ নেই এটা তার শুধুই বাসর।সে অবশ্য প্রথম বাসরের মতো অত সেজেগুজে বসে আছে না এখন। মুখে কোন রং মাখেনি।কানে হাতে দামী ফুল চুড়ি নেই তার। সাধারণ একটা শাড়ি পরে বসে আছে সে। অপেক্ষা করতে তার আজ খুব ভালো লাগছে।তার মনে হচ্ছে এই অপেক্ষাতেই জীবন কেটে যাক। সেলিম আর না আসুক এখানে।সে একাই বেশ থাকবে।
কিন্তু সেলিম এসে গেছে। দরজায় ঠোকা দিয়েছে পরপর তিনবার। নীলা দরজা খুলে দিলে
সে ভেতরে এসে লজ্জিত মুখে নিচ দিকে তাকিয়ে বললো,’একটা বালিশ আর কাঁথাটা দেন। আমি মেঝেতে শুয়ে পড়ি।’
নীলা খানিক সময় চুপ থাকলো। তারপর অতি কষ্টে মুখটা উপরের দিকে তুললো। সেলিমের দিকে তাকিয়ে সে হকচকিয়ে গেছে।এ কি সেলিম?
তার সন্দেহ হচ্ছে। কারণ তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তার চেহারার অবয়ব নাঈমের। একেবারে হুবহু নাঈমের।
সেলিম কাঁপছে।ভয়ে এবং লজ্জায়।তার মুখে প্রবল আড়ষ্টতা।দেখতে লাগছে বোকাদের মতো।
সেলিম আবার বললো,’বালিশ আর কাঁথাটা দিন। আমি নিচে শুবো।’
নীলা এবার হেসে ফেললো। হেসে বললো,’আপনার জায়গা তো নিচে নয়!’
সেলিমও এবার হেসে ফেললো। নীলা সেই দিকে তাকালো।এ তো সেলিম নয়।নাঈম। নাঈমের মুখের আদল,হাসি।নাঈম হাসছে।সাদা মুক্তোর মতো দাঁত কেলিয়ে হাসছে।
‘
‘
#(সমাপ্ত)
‘
‘
#অনন্য_শফিক