বিকেলে ভোরের ফুল পর্ব ১৬

#বিকেলে_ভোরের_ফুল

#পর্ব_১৬

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

স্পর্শ যেদিন ফুলের বাবাকে ফোনে হুমকি দিয়েছিল সেদিনই তিনি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন যে তার মেয়েকে যে কিডন্যাপ করেছে সে রাজির আসরাফের কাছের কেউ হবে।তাই প্রতিশোধ নিতে ফুলকে কিডন্যাপ করেছে।তাই তিনি স্পর্শের বাবার সব খবর বের করে এনেছে। কিন্তু স্পর্শের কোন খোঁজ পায়নি তাই তার সন্দেহ আরো গাঢ় হয়। চারদিকে পুলিশ আর নিজের লোক ছড়িয়ে দেয় ফুলকে খোঁজার জন্য।

ফুলের জ্ঞান সবে মাত্র ফিরল। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো। ফুল নিজেকে গাড়ির মধ্যে পেল।আশাপাশে ভালো করে তাকালো ফুল। চলন্ত গাড়ির মধ্যে আছে,ওর পাশে দুজন মহিলা পুলিশ বসা। ফুল উঠেই অস্থির হয়ে গেল। বারবার স্পর্শের নাম নিতে লাগল। মহিলা দুজন ফুলকে শান্ত করার চেষ্টা করতেছে কিন্তু ফুল শান্ত হতে চাচ্ছে না। ফুল বলছে,

–“স্পর্শ কোথায়??কোন গাড়িতে আছে??গাড়িটা একটু থামাবেন প্লিজ।”

–“তুমি ভয় পেয় না।স্পর্শ আর তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। ওকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। ইউ আর সেভ নাউ।”

–“আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করুন। আমি একবার স্পর্শের কাছে যেতে চাই।”

মহিলা দুজন বুঝতেছে না যে ফুল কেন স্পর্শ স্পর্শ করছে??ফুলকে শান্ত করার জন্য একজন বললেন,

–“দেখ ফুল এখন গাড়ি থামানো যাবে না।গাড়ি সোজা সিলেট পুলিশ স্টেশনে গিয়ে থামবে। তারপর না হয় তুমি স্পর্শের সাথে দেখা করো।”

–“কিন্তু,,,,,”

–“কোন কিন্তু নয় চুপচাপ বসো।”

–“আর আমার কাছে যে ফোন আর ওয়ালেট ছিল সেগুলো কোথায়?? আমার কাছেই তো ছিলো। আমি যখন জ্ঞান হারালাম তখন ওগুলো কোথায় পড়ে গেল??”

–“আমার কাছে আছে এই নাও।”

মহিলা স্পর্শের ওয়ালেট আর ফোনটা ফুলের হাতে দিলো। ফুল সেগুলো আঁকড়ে ধরে কান্না করে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

–“আপনি ঠিকই বলেছেন,সময় খুব তাড়াতাড়ি চলে যায় সময় কে আটকানো যায় না।তাইতো আমরা আবার সময়ের ব্যবধানে আলাদা হয়ে গেলাম। আপনার সাথে কাটানো সময়গুলো যদি আটকে রাখতে পারতাম তাহলে খুব ভালো হতো। আমাকে তখন কেন আপনার আসল পরিচয় দিলেন না??”

ফুলের কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেল। মহিলা দুজন ফুলের কথার আগাগোড়া না বুঝেই ফুলকে শান্তনা দিচ্ছে। ফুল কান্না থামিয়ে চোখ মুছে বলল,

–“আচ্ছা পুলিশ জানলো কিভাবে যে আমি ওই দ্বীপে আছি??”

–“তুমি হয়তো জানো না যে টাকার পাওয়ার ঠিক কতখানি। তোমার বাবা সারা সিলেট তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তোমাকে যখন পায়নি তখন তিনি এটা বুঝে গেছেন যে তুমি সিলেট নেই।তাই তিনি সারাদেশের সব থানায় ইনফর্ম করে দেন। এমনকি আকাশপথেও তোমাকে খোঁজা হয়েছে। পুলিশেরা হেলিকপ্টার দিয়ে যখন সমুদ্রের উপর দিয়ে স্ক্রোল করছিল তখন তারা তোমাকে দেখতে পায়।আর তারপর তোমাকে আনতে আমরা যাই।”

ফুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে তাকালো।ওর লাইফ থেকে এভাবেই ওর প্রিয় মানুষগুলো চলে যাচ্ছে। সর্বশেষ ছিলো স্পর্শ, এতদিন পর তাকে পেয়েও হারিয়ে ফেলল। ফুল নিরবে কেঁদে যাচ্ছে।

সারাদিন ও সারারাত জার্নি করে সিলেট পৌঁছালো সবাই। ফুলের গাড়ি এসে পুলিশ স্টেশনে থামা মাত্রই ফুল ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। সেখানে আরও কতগুলো গাড়ি থামানো। ফুল দৌড়ে দৌড়ে এক গাড়ি থেকে আরেক গাড়ির ভিতর উঁকি দিয়ে দেখতেছে।ওর চোখদুটো শুধু স্পর্শকে খুজতেছে।এর মধ্যেই মিডিয়ার লোকজন এসে ফুলকে ঘিরে ধরে প্রশ্ন করতে লাগলো। কিন্তু ফুলের কানে কোন কথাই যাচ্ছে না। মহিলা পুলিশ আর আরও কয়েকজন পুলিশ এসে ফুলকে সেভলি ভেতরে নিয়ে গেল। ভেতরেই ফুলের বাবা বসে আছে।ফুলকে দেখেই তিনি রেগে গিয়ে বললেন,

–“ফুলকে এখানে কেন এনেছেন??আমি বলেছিলাম না ওকে বাড়িতে দিয়ে আসতে।”

একজন মহিলা বলল,

–“আসলে ফুলই এখানে আসতে চাইছিল। আমরা অনেক বললাম কিন্তু ও শুনলো না।”

–“ও বাচ্চা মেয়ে,তাই বলে তো আপনারা বাচ্চা নন।যান ওকে বাড়িতে দিয়ে আসুন।”

ফুল এসে ওর বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

–“বাবা আমি স্পর্শের সাথে দেখা করতে চাই।”

ফুলের কথায় উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেল। আজমল চৌধুরী তো আরও রেগে গেলেন।

–“কি বলছো তুমি??”

–“আমি ঠিকই বলছি বাবা।প্লিজ আমাকে একবার স্পর্শের সাথে দেখা করতে দাও।”

ফুলের বাবা হুংকার দিয়ে বললেন,

–“আপনারা এখনই ফুলকে নিয়ে যান না হয় আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”

সবাই ভয়ে কেঁপে উঠল। মহিলা দুজন টানতে টানতে ফুলকে নিয়ে গাড়িতে বসায়। ফুল ছটফট করতেছে বারবার স্পর্শের কথা বলছে কিন্তু ওর কথা কেউ শুনছে না।

গাড়ি এসে থামল চৌধুরী মঞ্জিলে। ফুল গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। বাড়ির উঠোন ভর্তি মহিলারা গিজগিজ করতেছে। ফুলকে দেখে জাইফ সাইফ দৌড়ে আসতে চাইলো। কিন্তু ফুলের দাদি ওদের আটকে দিলেন।রিনা বেগম ও ওখানে দাঁড়িয়ে আছে।ফুলের দাদি বলে উঠলেন,

–“ফুল এইহানে আয়।”

ফুল গিয়ে ওর দাদির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
ফুলের দাদি ইশারায় ছোট একটা চৌকি দেখিয়ে বলল,

–“এই চৌকিতে উইঠা খাড়া।”

ফুল তাকিয়ে দেখল মাটিতে একটা চৌকি পাতা আর তার পাশে পাঁচ থেকে ছয় কলসি দুধ। ফুল বিস্মিত চোখে জিজ্ঞাসা করল,

–“কেন?? আর এসব কি??”

–“এইসব দিয়া তোরে পাক পবিত্র করা হবে।”

–“পবিত্র মানে।”

–“মানে আবার কি!!অন্য পোলার লগে এতদিন থাকলে কি হেই মাইয়া সতী থাহে।ওই পোলা তোরে কি করছে না করছে হেইডা আমি ভালো কইরাই বুঝতে পারছি।এহন কথা বাড়াইস না। এইহানে খাড়া, আমি কবিরাজের কাছে গেছিলাম কবিরাজ কইছে তোরে এই দুধ দিয়া গোসল করাইতে।”

দাদির কথা শুনে ফুল এবার খুব রেগে গেল। অনেক শুনেছে ওর দাদির কথা আর শুনবে না। ফুল রেগে বলল,

–“আমি পবিত্রই আছি। তুমি এই দুধ দিয়ে গোসল কর কেননা তোমার মনটা অপবিত্র। ভালো করে গোসল করো।”

–“কি কইলি তুই?? আমার মুখের উপরে কথা কওয়ার সাহস হইলো কেমনে তোর?? কয়দিন বাইরে থাইকা পাখনা গজাইছে নাকি?? তাড়াতাড়ি গোসল কর। তারপর নফল নামাজ পড়বি দেখবি তুই পবিত্র হইয়া যাবি।”

–“নিকুচি করেছে তোমার গোসল।”

ফুল সব কলসি উপুড় করে ফেলে দিলো। তারপর এক দৌড়ে রুমে চলে আসলো। রুমে এসেই দরজা বন্ধ করে দিলো। তাড়াতাড়ি করে বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিল। ফুল স্পর্শের সাথে দেখা করতে যাবে লুকিয়ে।ওর বোঝা হয়ে গেছে যে ওর বাড়ির কেউ স্বইচ্ছায় ওকে স্পর্শের সাথে দেখা করতে দেবে না। ফুলের দাদি তো রেগেমেগে আগুন।যে ফুল কখনো ওনার মুখের উপর কোন কথা বলেনি সেই ফুল আজকে সবার সামনে ওনাকে অপমান করলো।এর একটা বিহিত তিনি করবেনই।

🍁🍁🍁

স্পন্দন তড়িঘড়ি করে অফিস থেকে ফিরে আসলো।এসেই দেখল ওর মা রুমে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন।মামা মামী বাবা আর দিয়া (স্পন্দনের স্ত্রী)ওর মায়ের সেবা করতেছে।একটু আগেই দিয়া স্পন্দনকে ফোন করে বলল যে স্পর্শকে নাকি পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে এবং বাকি সবকিছু বলল। এসব শুনে ওর মা জ্ঞান হারিয়েছে।স্পন্দন তাই অফিসের কাজ ফেলে দ্রুত বাড়িতে চলে এসেছে।

স্পন্দন আর ওর বাবা মামা সোফায় বসে আছে।সবার মুখে চিন্তার ছাপ। দিয়া আর মামি ওর মায়ের কাছে আছে।মামা বলে উঠলেন,

–“এখন কি হবে?? আজমল চৌধুরীর থেকে আমরা কিভাবে স্পর্শকে বাচাব??”

স্পর্শের বাবা বলল,
–“আমি জানি না। আমার মাথায় কিচ্ছু আসছে না। আমি স্পর্শকে বারবার বলেছিলাম সিলেট থেকে ফিরে আসতে। আমি জানতাম ও সিলেট আছে কিন্তু কেন সেটা ও আমাকে বলেনি।আজমল খুব ভয়ংকর লোক।ওর থেকে ছাড়া পাওয়া খুব কঠিন।”

স্পন্দন বলে উঠলো,

–“কিন্তু বাবা আইন বলতে তো কিছু আছে নাকি?? আমরা কোর্টে লড়ব।”

মামা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

–“তাতে কি আদৌ কিছু হবে?? সবটাই তো প্রমান হয়ে গেছে।”

–“কিন্তু মামা ওর সাজা তো কমানো সম্ভব।”

স্পর্শের বাবা ডুকরে কেঁদে উঠলো বলল,

–“আমার ছেলেটাকে আমার মতোই জেল খাটতে হবে।এই দৃশ্য বাবা হয়ে কিভাবে দেখব আমি??”

স্পন্দন বাবাকে শান্তনা দিয়ে বলল,

–“বাবা তুমি ভেঙ্গে পড়লে কি করে হবে বলোতো??মা তো আরো ভেঙে পড়বে। প্লিজ তুমি শান্ত হও।”

মামা স্পর্শের বাবার কাঁধে হাত রেখে বলল,

–“স্পন্দন ঠিকই বলছে। আমাদের সবাইকে এখন শক্ত হতে হবে।

ফুল খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।স্পর্শের ওয়ালেট আর ফোনটা নেড়েচেড়ে দেখতাছে। ফুল ভাবছে স্পর্শ এখন কি করছে??কোন অবস্থায় আছে??সেটা জানার খুব দরকার ফুলের।ফুল এবার উঠে দাঁড়ালো।
গায়ের জামাটা পাল্টে নিয়ে রেডি হয়ে নিল।সন্ধ্যার পরই ও বেরিয়ে পড়বে।ব্যাগ গুছিয়ে রেখে ফুল ড্রয়িং রুমে আসলো।পুরো রুম ফাঁকা। ফুল ধীর পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ফ্রিজ খুলে দেখল কিছু আছে কি না??পেয়েও গেলো কাস্টার্ড। কাস্টার্ডের বাটি নিয়ে ফুর টেবিলে বসে খেতে লাগল।এই বাড়িতে ফুলকে খাওয়ার জন্য কখনোই কেউ ডাকে না। ফুলের যখন খেতে ইচ্ছে করবে তখন ওকে এসেই খেতে হবে।

ফুল খেয়ে নিজের রুমে চলে গেল। সূর্যাস্তের পর ফুল বের হওয়ার জন্য তৈরি হয়। বেলকনি দিয়ে একটা কাপড় বেঁধে নিচে নামবে। কিন্তু এটা তো সিনেমা নয় যে খুব তাড়াতাড়ি নেমে যাবে। অর্ধেক নেমেই ফুলের হাত জ্বলতে লাগলো। কাপড় পিচ্ছিল থাকায় এরকমটা হয়। ফুল আর পারল না হাত ছেড়ে দিতেই দুম করে নিচে পড়ে গেল।

চলবে,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here