#গল্পঃবিকেল বেলার রোদ
#পর্বঃ১০
#লেখাঃনুসরাত মাহিন
ঝড়ের কবলে পড়ে বেঁচে আসা বিধ্বস্ত পাখিটা যে রকম অবস্থায় হয় শাকিল মাস্টারের ওই একি রকম অবস্থা হয়েছে। মামা আর আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বেচারার বেহাল অবস্থা।
— শাকিল সাহেব আপনি বলেছেন আপনি বিবাহিত না এটাই আপনার প্রথম বিয়ের কথা চলছে। যদি তাই হয় নিসাকে নিয়ে তো আপনি গ্রাম থেকে পালিয়েছিলেন তাহলে কী নিসা কে আপনি বিয়ে করেননি শুধুই ভোগ করেছেন।
— তানভীর সাহেব কী সব বাজে কথা বলছেন আমি নিসাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছি মানে। আমি কেন নিসাকে নিয়ে পালিয়ে যাব।
— মিথ্যা কেন বলছেন নয় বছর আগে আপনি নিসাকে নিয়ে পালিয়ে যাননি..??
— না আমি নিসাকে নিয়ে পালিয়ে যাইনি।
— নিসাকে নিয়ে পালিয়ে না গেলে নিসা কোথায়..??
— নিসা কোথায় আমি সেটা আমি কি করে জানবো।
— আপনি জানেন না। নয় বছর আগে অচিনপুর গ্রাম থেকে নিসাকে নিয়ে পালিয়ে আসার আগে নাদিয়ার সাথে দেখা করার জন্য নাদিয়েদের বাসায় যাননি। ওই রাতে নাদিয়ার কাছে কেন গিয়েছিলেন..??
— আমি নিসাকে নিয়ে নাদিয়ারে বাসায় গিয়েছিলাম নাদিয়াকে দেখার জন্য ওর সাথে কথা বলার জন্য।
— নাদিয়ার সাথে দেখা করার জন্য গিয়েছেন মানে বুঝালাম না।
— নাদিয়ার বাবা সাত দিন ধরে নাদিয়াকে বাসায় আটকে রেখেছিল। আমি নাদিয়ার সাথে কোন ভাবে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। নাদিয়ার সাথে দেখা করার একটাই মাধ্যম ছিল নিসা। নাদিয়াকে সাত দিন না দেখে আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তাই নিসাকে নিয়ে নাদিয়াদের বাসায় গিয়েছিলাম দেখা করার জন্য কারন নাদিয়ার সাথে আমার রিলেশনের কথা শুধু নিসাই জানতো।
নাদিয়ার সাথে আমার এক বছরের রিলেশন..
রুপগঞ্জ সরকারি ডিগ্রী কলেজে সবে মাত্র নতুন জয়েন্টে করেছি। প্রথম দিন ইন্টার ফাস্ট ইয়ারের অর্থনীতি ক্লাস নিতে গিয়ে আমার চোখ আটকে যায় শ্যাম বর্নের একজন স্টুডেন্টকে দেখে। দেখতে আহামুরি সুন্দর ছিল না কিন্তু চেহারার মধ্যে ছিল মাধুর্যতায় ভরা। বড় বড় দুইটা কালো মায়াবী চোখ, খুব বেশি লম্বা ছিল না। শ্যাম বর্নের মানুষ দেখতে এত সুন্দর হয় আমার জানা ছিল না।
Love at fast side প্রথম দেখায় কেউ যদি কারো মনে দাগ কেটে থাকে তাকে বলে লাভ এট ফাস্ট সাইড। প্রথম দেখাই ভালো লায়া প্রথম দেখাতেই ওই শ্যাম বর্নের মেয়েটা আমার মনে দাক কেটে ছিল।
আমি আস্তে আস্তে মেয়েটার খোঁজ নিতে লাগলাম মেয়েটা নাম নাদিয়া।
কলেজের সবাই নাদিয়া আর ওর সাথে মেয়েটাকে দেখলেই মানিকজোড় বল বলে ডাকতো বুঝলাম সাথের মেয়েটা নাদিয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে নাদিয়াকে দেখতাম মাঝে মাঝে নাদিয়ার পিছু নিতাম ওকে ফলো করতাম। নাদিয়া বিষয়টা না বুঝলেও নিসা বুঝতে পেরেছিল।
আমি লক্ষ করে দেখলাম কলেজের সামনে প্রায়ি নাদিয়া আর নিসাকে কিছু ছেলেরা বিরক্ত করতো, পিছন থেকে বাজে কথা বলতো যাকে বলে ইভটিজিং
আমি বিষয়টা প্রিন্সিপাল স্যারকে জানাই। প্রিন্সিপাল স্যার ছেলেগুলোর শাস্তির ব্যবস্থা করে। এরপর কিছুদিন করির, জুলহাসদের কলেজের সামনে দেখা যাইনি।
কবির রুপগঞ্জ কলেজের এমেতে পড়লেও জুলহাস জগন্নাথ ইউনিভার্সিটিতে পড়তো। ছুটিতে গ্রামে এলেই মেয়েদেরজে উতক্ত করা ছিল ওদের কাজ।
আমি সন্ধ্যার পরে প্রতিদিন রুপালি ব্যাংকে পাশের চায়ের দোকানে চা খেতে যেতাম। বাবু ভাইয়ের চায়ের দোকানে বসেই নিসার বাবার সাথে আমার পরিচয় হয় উনিও চা খেতে আসতো।
নিসার বাবা আমাকে অনুরোধ করে নিসাকে পড়ানোর জন্য আমি রাজি হয়ে যাই।
নিসাকে পড়ানো শুরু করি। নিসার কাছে নাদিয়ার কথা জিজ্ঞাস করতাম। নিসা কিছু বলতো না শুধু হাসত। একদিন নিসা হুট করে আমাকে জিজ্ঞেস করে বসে আমি নাদিয়াকে পছন্দ করি কিনা। আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা সম্মতি জানাই। নিসাকে অনুরোধ করি নাদিয়াকে বলার জন্য আমি নাদিয়াকে ভালোবাসি।
নিসাই নাদিয়ার সাথে আমার রিলেশনটা করিয়ে দেয়।
আমরা কলেজে বা রাস্তা বসে কখনো কথা বলতাম না। কেউ বুঝতেই পারিনি নাদিয়ার সাথে আমার প্রেম ছিলো। যা টুকটাক কথা হতো নিসাদের বাসায় বসে নাদিয়া মাঝে মাঝে নিসাদের বাসায় আমার কাছে অর্থনীতি পড়তে আসতো।
বেশির ভাগ সময়ে আমাদের কথা হত চিঠির মাধ্যমে। আমাদের চিঠি আদান প্রদানের কাজ করতো নিসা।
আমি প্রতিদিন নিসার কাছে নাদিয়ার জন্য একটা করে চিঠি লিখে দিতাম…
তোকে কিছু কথা বলার বাকি থাক
যেনো সেই কথাগুলো বলার জন্য
আরেকটা দিন তোর কাছে যেতে পারি!
তোকে জানার কিছুটা বাকি থাক
যেনো সেটুকু জানার জন্য
আরেকটাবার তোর কাছে যেতে পারি!
তোকে দেখে মুগ্ধ হওয়ার কিছুটা বাকি
থাক
যেনো আরেকটা বার মুগ্ধ হওয়ার জন্য
তোর আরেকটু কাছে আসতে পারি!
তোর গানের সুরে হারিয়ে যাওয়ার কিছুটা বাকি থাক
যেনো আরেকটা বার হারানোর জন্য
তোর আরো কাছে আসতে পারি!
একদিন নাদিয়া, নিসা বিকালে ঘুরতে বেরিয়ে ছিল। কবির, জুলহাস, রাজু মিলে নাদিয়া, নিসার পথ আটকিয়েছে।
ও বন্ধু লাল গোলাপি, ও বন্ধু লাল গোলাপি
কোই রোইলারে এসো এসো বুকে রাখবো ধরে।
জুলহাস নিসার এক হাত ধরে টানাটানি করছে। আমি ওদের ওখানে পৌছানোর আগেই নিসা পায়ের থেকে জুতা খুলে জুলহাসের গালে বারি মেরে বসে। জুলহাস নিসার গায়ে হাত তোলার আগেই জুলাসের হাতটা ধরে ফেলি। আমি কোন কিছু বুঝে উঠার নাদিয়া করিরের গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়।
ঐ দিন আমি ছিলাম দেখে জুলহাসরা নাদিয়া, নিসাকে কিছুই বলেনি ঠিকেই কিন্তু ওদের চেহারার মধ্যে ছিল হিংস্রতার ছাপ। আমি বকাঝকা দিয়ে কবিরদের তারিয়ে দিয়েছিলাম।
আমার কেন জানি মনে হয়েছিল কবির আমার অথবা নাদিয়া, নিসার কোন ক্ষরি করতে পারে। ওদের দুজনকে বাসায় পৌছিয়ে দিয়ে থানায় যাই জুলাহাস কবিরের নামে জিডি করতে।
থানায় যাওয়ার পরে দেখি ওসি চেয়ারে বসে টেবিলের ওপরে পা উঠিয়ে মুখটা এদিক সেদিক করে পান চাবাচ্ছে।
— কি চাই আপনাকে তো চিনতে পারলাম না।
— ওসি সাহেব আমি এলাকায় নতুন এসেছি তাই হয়তো আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি কলেজে নতুন শিক্ষক কিছু দিন হয়েছে জয়েন্ট করেছি।
— ও আচ্ছা মাস্টার সাহেব খুব ভালো হইছে আপনার সাথে পরিচয় হয়ে। এই মাস্টার সাহেবের জন্য চা নিয়ে আয়। হঠাৎ করে কী মনে করে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসছেন।
— আমি মুলোতো আপনার সাথে একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করতে এসেছি। আলাপ ছাড়ও আমি একটা জিডি করতে চাই।
— খুব ভালো, খুব ভালো তো কী বিষয়ে আলাপ করতে চান। বলেন কী সাহায্য করতে পারি.।
— ওসি সাহেব আপনি জানেন কিনা জানি না এখানকার কিছু বখাটে ছেলেপেলে কলেজের মেয়েদের প্রতিনিয়ত ইভটিজিং করে যাচ্ছে। ওই ছেলেদের জ্বালায় আমার অনেক স্টুডেন্ট ঠিক মতো কলেজে আসতে পারছে না। আপনার সাহায্য খুবি প্রয়োজন ছেলেগুলোর বিরুদ্ধে যদি আইনগত ব্যবস্থা নিতেন তাহলে আমার ছাত্রীরা সেভ থাকতে পারতো।
— ছেলে গুলোর নাম কী..??
— কবির, জুলহাস, রাজু
— মাস্টার সাহেব কিছু মনে করবে না ফুল ফুটলে ভোমর তো ফুলের মধু খেতে আসবেই। শুধু ছেলে গুলোর দোষ দিয়ে কী লাভ বলেন। ওই ছেমরি গুলার দোষ আছে। মাইয়া মানুষ ঘরে থাকবে তানা পড়ার নাম করে রাস্তায় আইসা লাফালাফি করে বেরায়।
মাইয়ে মানুষের এত পড়ালেখা করার দরকার কী। স্টার জলসা দেইখা ওড়না ছাড়া বুক দেখিয়ে পাছা দেখিয়ে চলা ফেরা করবে ছেলেরা তো পিছু নেবেই। ছাওয়াল গুলা খারাপ না আমি খুব ভালো করেই ওদের চিনি। বয়সের দোষ উর্তি বয়স মাইয়ে মানুষ দেখলে মনের মধ্যে প্রেম প্রেম ভাব আসে তাই দুই চার লাইন গান গাইতেই পারে ওটা কোন ব্যাপার না।
— আপনি একজন আইনের লোক হয়ে বেআইনি কথা আপনার মুখে মানায় না। আপনি বখাটে ছেলেদের সাপোর্ট করছেন।
— বুজছেন মাস্টার মাস্টারি করতে করতে আপনাদে
স্বভাব হয়ে গেছে মাস্টারি ফলানো। সব স্থানে মাস্টারি করা ঠিক না। আমাকে আসছেন আইন শিখাতে। আরে এই চুল বাসাতে পাকেনায়।
আপনি বসেন চা খান চলে জান এই বিষয়ে আর কোন কথা বলতে চাই না। কবিরে হচ্ছে এলাকার প্রভাবশালী ওর অনেক ক্ষমতা। নিজের ক্ষতি না চাইলে কবিরের পিছনে লাইগেন না ক্ষতি হতে পারে। আপনার ভালোর জন্য কথা গুলা বল্লাম। কোন জিডি ফিডি নেওয়া হবে না। আপনি এখন আসতে পারেন
মনেরো বাগানে ফুটিল ফুলরে রোশিক ভোমর আইলো না…
ফুলের মধু খাইলো না…
— অপমানিত হয়ে থানা থেকে বের হয়ে আসলাম বুঝলাম ওসি কবির, জুলহাসদের দালাল। পানখোর ওসির প্রতি খুব ঘৃনা হচ্ছিল।
চলবে….