বিকেল বেলার রোদ পর্ব ৫

#গল্পঃবিকেল বেলার রোদ
#পর্বঃ০৫
#লেখাঃনুসরাত মাহিন

ভেবেছিলাম সকালবেলা চাচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাব কিন্তু যাওয়া হল না চাচার শরীরের অবস্থা অনেক খারাপ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। কেন জানি অসহায় মানুষ দুইটাকে ফেলে রেখে যেতে পারলাম না। সবি আল্লাহর ইচ্ছা আল্লাহই ওনাদের প্রতি মায়া সৃষ্টি করে দিয়েছেন।

সকালে রাস্তার পাশের হোটেল থেকে রুটি, ডিম,ভাজি কিনে এনেছি। হোটেলের মালিকের কাছ থেকে এখানকার একজন ভালো ডাক্তারের ঠিকানা এনেছি। বিকালে চাচা চাচিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।

আমাকে দেখে এই বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটিয়া মহিলার মিটি মিটি হাসাহাসি করছে। চিন্তা করেছিলাম দুপুরে চুলায় রান্না করবো কিন্তু লজ্জা লাগছিল মাহিলাদের মাঝে গিয়ে রান্না করতে। দুপুরের খাবার ও হোটেল থেকে কিনে আনতে হবে।

বিকাল বেলা ডাক্তার তাপস কুমার ভদ্রোর চেম্বারে বসে আছি। লোকটার নামের শেষে ভদ্রো লেখা থাকলেও তারমধ্যে আমি কোন ভদ্রোতার ছাপ দেখিনি। যে সব রোগি তার দেওয়া প্যাথলজিতে টেষ্ট পরীক্ষা করাইনি সেই রিপোর্টগুলো দেখা দূরে থাক ছুরে ফেলে দিচ্ছে।

আমাদের ডাক পড়ল ডাক্তারকে অনুরোধ করলাম গরিব মানুষ দুজনের ভিজিট কম রাখার জন্য। এক টাকাও কম রাখেনি দুজনের ছয়শো ছয়শো বারশো টাকা ভিজিট রেখেছে সাথে এক কুড়ি পরীক্ষা দিতেছে। কি কি করা লাগবে তার পিএসের কাছ থেকে জেনে নিতে বলেছে।

ডাক্তারের হাতের লেখা দেখে আমি শিহরিত, বিস্মিত আমার হার্ট এট্যাক করার মতো অবস্থা। এই রকম ইন্টারন্যাশনাল হাতের লেখা আমি প্রথম দেখলাম। বেশির ভাব ডাক্তাদের হাতের লেখা খারপ থাকে কি লেখে বোঝা যায় না। ইনিজে কী লিখছে কোন বোঝার মত অবস্থা নেই।

গেলাম ডাক্তারের পিএসের কাছে। পিএসকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার যে ওষুধের নাম লিখে দিয়েছে কিছুই বুঝছি না। উনি বল্লেন, আমি ও স্যারের লেখা বুঝি না আপনার ও বোঝা লাগবে না। এ লেখা একমাত্র বোঝে জনতা ফার্মেসি ভাইয়েরা। পিএস সাহেব একখানা কার্ড ধরিয়ে দিলেন। কার্ডে ফার্মেসির ঠিকানা লেখা আছে ওখান থেকে মেডিসিন কিনবেন আর ন্যাশনাল প্যাথলজি থেকে টেষ্টগুলো করিয়ে আনবেন। মনের মধ্যে বেশ কয়েকটা প্রশ্ন জন্মনিল। খুব সাহস করে পিএস সাহেব কে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম।

— আপু আপনাকে দুই একটা প্রশ্ন করতে পারি..??

— কী প্রশ্ন..??

— না তেমন কিছু না একটু কথা বলতাম। আসলে হয়েছে কী আপু আপনাকে আমার খুব ভাল লেগেছে। ভালো লাগবেই না কেন আপনি যা সুন্দর আমি তো ভেবেছি আপনি কোন মডেল তারকা। আপনি যে ডাক্তার সাহেবের পিএস আমি বুঝতেই পারিনি। আপু আপনি এত সুন্দর কেন বলেন তো..??

— কী যে বলেন না ভাইয়া। তবে সবাই বলে আমার চেহারা অনেক সুন্দর। আমি নাকি দেখতে কারিনা কাপুরের মতো।

— মনে মনে বললাম কারিনা কাপুর নাকি জরিনা কাপুর। বাংলাদেশের খল নাইকা রিনা খানের মতো দেহায়। রিনা খানের ছোড বোইন কিনা খান। যাক পাম পট্টিতে কাজ হইছে।

আপু আপনি খারিনা কাপুর ও স্যরি কারিনা কাপুরের থেকেও সুন্দর।

— ধন্যবাদ। কী জেন জানতে চেয়েছিলেন..?

— আপু ডাক্তার সাহেব অনেক কয়টা টেষ্ট দিয়েছে কিন্তু টেষ্ট গুলো রিপোর্ট করিয়ে আনার আগেই ও মেডিসিন লিখে দিয়েছে।। রিপোর্ট না দেখে বুঝল কীভাবে, কী সমস্যা হইছে..?

— রোগি দেখতে দেখতে স্যারের অভিজ্ঞাতা হয়ে গেছে টেষ্টের রিপোর্ট লাগে না।

— তাহলে যে পরীক্ষা করতে দিয়েছে এগুলা কেন দিয়েছে..??

— টাকা, টাকা, টাকা সবি টাকার খেলা, আপনার কানটা আমার মুখের কাছে নিয়ে আসেন একটু গোপনে বলি।

— কান মুখের কাছে নেওয়ার কথা শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ভেবেছিলাম কানের উপরে কাঁমড় দিয়ে বসে কিনা। যাখন বল্ল গোপন কথা মনে একটু সাহস পেলাম। জি আপু বলেন

— আমাদের স্যার হলো টাকার কুমির টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না। স্যার যেখানে পরীক্ষা করতে দিয়েছে ন্যাশনাল প্যাথলজি ওখান থেকে কপিশন পায় রোগি প্রতি ৪০% কমিশন দেয়।

— আর ফার্মেসি

— ফার্মেসি থেকেও স্যারকে কমিশন দেয়। আপনার রোগি দু’জন রক্ত শূন্যতায় ভুগছে। অভাবের কারনে মনে হয় শরীরে পুষ্টিকর খাবার পরেনি। মেডিসিনের পাশাপাশি ফলমূল, পুষ্টিকর খাবার খাওয়ান ঠিক হয়ে যাবে। টেষ্ট ফেষ্ট না করিয়ে ওই টাকা দিয়ে খাবার কিনে খাওয়ান। ওনাদের দুজনকে দেখে খুব মায়া হল তাই বললাম।

হুম এবার বুঝলাম ঐ সাদা পোষাকটা ওদের লেবাস। ডাক্তারদের ধর্ম রোগিদের সেবা করা কিন্তু এইসব ডাক্তারদের ধর্ম রক্ত চুষে খাওয়া। গরিব মানুষের গলায় পারা দিয়ে টাকা নেয়।

এদেরকে ডাক্তার না বলে কসাই নামে ডাকা উচিৎ।

মাঝে মাঝে কিছু কিছু ডাক্তার, পুলিশদের কে ডেকে জিজ্ঞাস করতে ইচ্ছা করে আপনাদের ইউনিফর্মেরর
মধ্যে কী জানোয়ার লুকিয়ে থাকে। ইউনিফর্মরর গয়ে পরলেই মানুষ থেকে জানোয়ারে রুপান্তোরিত হয়ে যায়।

ডাক্তার দেখিয়ে মেডিসিন কিনে, কিছু ফলমূূল, রাতের খাবারের জন্য বড় এক প্যাকেট পাউরুটি কলা কিবে বাসায় চলে আসলাম।

— আসসালামু আলাইকুম

— ওয়ালাইকুম সালাম

—বাবাজি ভালো আছেন..?

— আলহামদুলিল্লাহ্‌ আমি ভালো আছি। আপনি ভাল আছেন..?

— জে আমিও ভালো আছি।

— আপনি কে,, কাদের চাচার রিলেটিভ..?

— আমি লোকমান, পাশের ঘরে আমরা থাকি কাদের ভাইয়েত প্রতিবেশী। আমি বাড়িতে ছিলাম না অফিসে মাল আনতে ঢাকার বাহিরে গেছিলাম। আজ বাসায় এসে আমার স্ত্রীর কাছে শুনলাম কাদের ভাইকে আপনে ছিনতাইকারিদের হাত থেকে বাঁচাইছেন।
ভাই ভাবিরে ডাক্তার ও দেখাইছে। আপনি কে বাবা..?

— আমি জুনাদেয় দুইদিন হলো গ্রাম থেকে শহরে আসছি কাজের সন্ধানে।

— মানুষ দুইটা খুব অসহায় সারাজীবন শুধু কষ্টো করে গেল। আমার সামার্থ থাকলে বুড়া বুড়ির দ্বায়িত্ব আমি নিতাম। টাকাত কাছে অসহায় সাধ আছে সাধ্য নাই। নিজের অভাবের সংসার যা ইনকাম করি তা দিয়ে ঠিক মতো সংসার চলে না। ওভারটাইম কাজ করে ছেলে মেয়ে দুই’টা লেখা পড়ার খরচ যোগাই। ছেলে টা প্রতিবন্ধী আমার একমাত্র আশা আমার মাইয়াডা। আমার মাইয়াডা লেখাপড়ায় খুব ভালো। তার ইচ্ছা ডাক্তার হবে। শত কষ্ট হলেও মেয়েটার পড়ালেখা চালাই যাব। আমি যতটুক পারি কাদের ভাইরে সাহায্য করার চেষ্ঠা করি। বাবা কিছু মনে কইরেন না কথায় কথায় অনেক কিছু বলে ফেল্লাম।

— না, না আমি কিছু মনে করিনি। চাচা একটা কথা জিজ্ঞাস করি..??

— কী কথা বাবা..?

— আপনার মেয়ের ইচ্ছা সে ডাক্তার হবে। আপনার ইচ্ছা কী..? আপনার মেয়েকে কি বানাতে চান।

— আমার মেয়ের স্বপ্ন ই আমার স্বপ্ন। আমার মেয়ের স্বপ্ন সে ডাক্তার হবে আরি ঘুমাইলে স্বপ্ন দেখি আমার মাইয়া ডাক্তারি পোষাক পরে হাসতেছে। আমার মাইয়ার হাসিমাখা মুখটা আমার কাছে পৃথিবীর সেরা সুখ। আমার সন্তানের সুখ ই আমার সুখ। বাপ হইছি কী সন্তানের কাধের উপরে দ্বায়িত্বের বোঝা চাপাই দেবার জন্য না বাবাজি। বাবা মানে সন্তানের সব দ্বায়িত্বের বোঝা নিজের কাধে বহন করা ,সন্তানের ইচ্ছা পুরন করা।

আমার ছেলেটা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী চোখে দেখেনা। ছেলেটার জন্য খুব কষ্ট হয় পৃথিবীতে জন্ম নিয়েও আলো দেখল না। অন্য বাচ্চারা যখন খেলা করে আমার ছেলে ঘরের সামনে বসে থাকে। ওর চোখ ভাল থাকলে পোলাডা ও লাফালাফি ঝাপাঝাপি করত। প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি করে দিছি পড়াশুনা করে কিছু একটা করে খাইতে পারে। শুনেছি প্রতিবন্ধী কোটা আছে ওই কোটায় সরকারি চাকরি করা যায়।

বাবা আপনাদের জন্য আমার বউ রান্না করছে। রাতের খাবার তো এখন ও খাওনি আমি গিয়া খাবার গুলা নিয়া আসি।

— লোকটার কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। জ্ঞানী হবার জন্য শিক্ষা লাগে না অল্প শিক্ষিত মানুষ ও জ্ঞানী হতে পারে। লোকমান নামের অর্থ জ্ঞানী মানুষটা আসলেই জ্ঞানী তার নামটা সার্থক।

সাতদিন হলো ঢাকায় এসেছি কাদের চাচাদের দেখাশুনা করার পাশাপাশি একটা কাজের খোঁজ করেছি কিন্তু কোথাও একটা কাজ পাইনি। ওনারা দুজন এখন অনেকটা সুস্থ হয়েছে এখান থেকে চলে যাব।

বাড়ি থেকে চলে আসার সময় মা যে খামটা দিয়েছিল তার মধ্যে সাত হাজার টাকা ছিল। ডাক্তার খরচ, মেডিসিন কেনা, খাবার কিনে চার হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে এখন আছে তিন হাজার টাকা। তিন হাজার টাকা দিয়ে কিছু একটা করা যায় কিনা।

— চাচা অনেক দিন তো হয়েছে আপনার এখানে আছি। এখন তো আপনারা সুস্থ আমি চলে যেতে চাচ্ছি।

— বাবা কোথায় যাবা তুমি..? ঢাকায় তো তোমার কেউ নাই। কোন কাজ ও যোগার করতে পারনি কোই থাকবা, কী করবা..? বাবা তুমি কিছু মনে না করলে কাজ যতদিন না খুজে পাও আমার এখানে থাকতে পার। তুমি আমার ছেলের মতো তাই কথাগুলা বল্লান। কিছু মনে কোইরনা বাবা।

— চাচা আমি কিছু মনে করিনি। চাচা আমি এক সর্তে আপনার এখানে থাকতে পারি। আপনি আজকের পর রিকশা চালাতে পারবেন না এখন থেকে আমি চালাব।
ছেলে বেঁচে থাকতে বাবা কীভাবে রিকশা চালায়। আপনি যেমন আপনার ছেলের মতো আপনিও তেমনি আমার বাবার মতো।

আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছি। এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। কোথায় থাকব, কোথায় খাব, পড়াশুনা খরচিবা কীভাবে চালাব তাই বাধ্য হয়ে রিকশা চালানোর পেশাটাকে বেছে নিলাম। বাস্তবতা বড়োই কোঠিন কষ্ট না পেয়ে নিয়তিকে মেনে নিয়েছি। আমাকে যেভাবে হোক প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে। আল্লাহ তালা ছাড়া কেউ জানে না আমাদের আগে পিছে কী হবে। আমার কারনে দুইটা মানুষ ভালো থাকবে আল্লাহ এটাই চেয়েছিল।

***

ঢাকায় এসেছি দুইমাস হয়ে গেল এরি মধ্যে এডমিশন পরীক্ষাটা হয়ে গেছে। পরীক্ষা খুব ভাল হয়েছে আগামিকাল রেজাল্ট দেবে। ঢাকায় আসার পরে যেদিন দিপা আন্টি বাসায় নিয়ে গেল দিপা আন্টির রুমে ঢোকার পরে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম সারা ঘরে মামার ছবিতে ভরা। এই দুইমাস গবেষণা করে যা বুঝলাম আন্টি মামাকে ভালোবাসে কিন্তু মামাকে ভালোবাসার কথা বলতে পারিনি।

সকাল বেলা ঘুম ভেঙে দেখি মামা এসেছে। আমার খুব নার্ভাস লাগছে। দিপা আন্টি আর মামা মিলে সান্তনা দিচ্ছে ভয় পাওয়ার কিছু নাই।

বল্লেই হলো ভয় পাওয়ার কিছু নাই আমার জীবন মরনের প্রশ্ন।

ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আমার চান্স হয়নি রেজাল্ট দেখে খুব কষ্ট পেয়েছি। বিবিএতে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছি। কী আর করা মন খারাপ করে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেলাম। ভাল পড়াশুনা করে যেকোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিসিএস ক্যাডার হওয়া যায়। মনকে সান্তনা দিয়ে লেখাপড়াটা ভালো ভাবে শুরু করলাম।

— আন্টি

— কিছু বলবি

— হুম

— কী..??

— তুমি তো বলেছিলে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর যে কোন একটা কীচিং এ ক্লাস নেবার ব্যাবস্থা করে দেবে। ব্যাবস্থা করে দাও না যে কোন একটা কোচিং এ।

— আমার এখানে থাকতে কী তোর কোন কষ্ট হচ্ছে..?

— আরে না কীসের কষ্ট। কোচিং এ ক্লাস নিলে চর্চা হয়ে যাবে যখন বিসিএস দেব প্রিপারেশটা ভাল থাকবে।

আন্টি একটা কোচিং এ ক্লাস নেবার ব্যবস্থা করে দিল।

ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আকাশের মেঘ করে আছে এখনি বৃষ্টি নেমে যাবে। ভার্সিটিতে ক্লাস শেষ করে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি রিকশা পাচ্ছি না। হাটা শুরু করলাম কিছু দূর যাবার পর দেখি একটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে..।

— এই রিকশা যাবে..??

— কোথায় যাবেন..??

— ব্যাংক কলনি

— জি উঠেন।

লোকটাকে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে কোথায় দেখেছি মনে করার চেষ্ঠা করছি। আরে এটা তো সেই ভাইয়াটা ঢাকায় আসার সময় আমার পাশের সিটে ছিল।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here