বিকেল বেলার রোদ পর্ব ৪

#গল্পঃবিকেল বেলার রোদ
#পর্বঃ০৪
#লেখাঃনুসরাত মাহিন

রাত ১১.১০ বাজে চারিদিকে অন্ধকার কোন জনমানব নেই সারা রাস্তা ফাকা শুধু তিন চারটা কুকুর এসে আমার সামনে বসে আছে । সারাদিন পেটে তেমন কিছুই পরেনি। ঢাকায় আসার সময়ে আমার পাশে সিটের আপুটার কেক থেকে চার পিচ কেক খেয়েছিলাম আর কিছুই খাইনি। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেরিয়েছি এখন খুব ক্লান্ত লাগছে। আসে পাশে থাকা সব হোটেল মোটেল বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। রাস্তার পাশে থাকা একটা চায়ের দোকান খোলা ছিল ওখান থেকে এক প্যাকেটে পাউরুটি আর এক হালি কলা কিনেছি । চায়ের দোকানের সামনে রাখা টুলের উপরে বসে আমিও খাচ্ছি কুকুর গুলোকেও রুটি ছিড়ে দিচ্ছি।

কোথায় যাব কী করব কিছুই জানি না। ঢাকায় যেসব আত্নীয়স্বজন আছে তাদের বাসায় যাওয়া যাবে না। আমি ঢাকার কিছুই চিনি না কী করব এখন..??

— ভাইজান আমি তো এখন দোকান বন্ধ করে দেব আপনি কী এখানে বসে থাকবেন নাকি চলে যাবেন..?

— আমি যদি রাতটা এখানে থাকি আপনার কোন সমস্যা হবে..??

— না আমার আবার কিসের সমস্যা তয় এখানে বেশি রাত পর্যন্ত থাকলে আপনার সমস্যা হতে পারে জায়গাডা বেশি ভাল না।

— জায়গা ভাল না মানে,, কী সমস্যা হবে..??

— নির্জন এলাকা রাতের বেলা এখানে প্রায়ী ছিনতাই হয়।

— আপনি তো অনেক রাত পর্যন্ত এখানে থাকেন আপনার সমস্যা হয় না।

— আমার বাসা পাশেই সমস্যা হবে কিভাবে। বারোটা বাজার আগেই তো দোকান বন্ধ করে বাসায় চলে যাই। ভাইজান আপনি থাকেন তাইলে আমি যাই।

— ভাই এখানে আসেপাশে কোথাও থাকার জন্য মেস পাওয়া যাবে।

— এই এলাকায় নাই তবে পাশের এলাকায় অনেক মেস আছে বিশ্ববিদ্যালয় এরিয়া তো এই জন্য।

— ধন্যবাদ ভাই।

মানুষের থেকে জীব জানোয়ার ও ভাল উপকারের মূল্য দিতে জানে। কয় পিস পাউরুটি খাওয়ার বিনিময়ে ওরা আমাকে পাহারা দিচ্ছে।

কোথাও থাকার জায়গা না পেলে দিনের বেলা কাজ করব রাতের বেলা এখানে এসে থাকব ওই ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে পড়ালেখা করে বিদ্যাসাগর হব। বিপদে পড়লে মানুষের মাথা কত আজব চিন্তাভাবনা আসে মনে হয় মাথাটা পুরোটাই গেছে।

সারাদিনের ক্লান্তির কারনে দুচোখে তন্দ্রা লেগে এসেছিল হঠাৎ করে কার চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। কিছু দূর দূরে একজন রিক্সা আলাকে তিন জন লোক মিলে মারছে। আমি দৌড় দেবার সাথে সাথে কুকুর গুলো আমার সাথে দৌড়ে সামনে আগাল।

আমি পৌঁছাবার আগেই ছিনতাইকারি পালিয়ে গেছে। বয়স্ক লোকটাকে এত জোড়ে ধাক্কা মেরে ফেলেছে লোকটার সামনের দুইটা দাঁত পড়ে গেছে। রক্তে জামা ভিজে যাচ্ছে।

আমি হেল্প হেল্প কেউ কী আছেন বলে চিৎকার করতে লাগলাম। আমার চিল্লা চিল্লি শুনে একটা মানুষ ও বের হয়ে এল না । চাচার কাছে জিজ্ঞেস করলাম আশেপাশে কোন ক্লিনিক আছে কিনা উনি বল্ল মেইন রোডের ওখানে একটা বড় ফার্মেসী আছে চব্বিশ ঘন্টা খোলা থাকে সেখানে নিয়ে আসলাম।

ইট পাথরের শহরে মানুষগুল থাকতে থাকতে ওরাও ইট পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেছে। কেউ কার খোঁজ রাখে না। যে যার নিজের মতো থাকে।

— চাচা আপনার গায়ে অনেক জ্বর। বৃদ্ধ বয়সে এই অসুস্থ শরীর নিয়ে রিক্সা চালাতে বের হয়েছেন কেনো..?

— কী করব বাবা সবি কপাল ঘরে কোন খাবার নেই, বউডা অসুস্থ টাকার অভাবে চিকিৎসাও করাতে পারি না, ওষুধ কিনতে পারি না ঠিক মত দুইবেলা ভাত ও দিতে পারি না। বয়স হইছে রিক্সাও চালাতে পারি না আজকে সারাদিন রিকশা চালিয়ে যা ইনকাম করছিলাম তা দিয়ে চাল, ডাল,আলু কিনছি আর বাকি কিছু টাকা রাখছিলাম বউয়ের জন্য ওষুধ কেনার জন্য কিন্তু টাকাগুলা অরা নিয়া গেল।

— চাচা আপনি কাঁদছেন…? কাঁদবেন না একটা ব্যাবস্থা হবেই। আপনার বাসা কোথায়..??

— সামনের বস্তিতে থেকি।

— আপনার শরীরের যা অবস্থা একা তো যেতে পারবেন না চলেন আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। আপনার হাটু অনেক ফুলে গেছে হাড়ে কোন সমস্যা হইছে মনে হয় ভাল ডাক্তার দেখাতে হবে।

— কিছু দেখান লাগবে না বাবা পরে গিয়ে সামান্য ফুলে গেছে ঠিক হয়ে যাবে।

—চাচা আপনার কোন ছেলে মেয়ে নেই..?

— থাইকা ও নেই। পোলারে জমি জমা, বউয়ের গহনা বিক্রি করে লেখাপড়া করাইছি বড় পাশ দিছে ক্যাডোর হইছে। এখন আর আমারে চেনে না কোন খবর নেয় না। আমাগো শ্বশুরবাড়ি লোকেদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে তার মান সম্মান থাকবে না। পোলায় বিয়া করছে শুনে দেখতে গেছিলাম। আমার ছেলে শ্বশুর বাড়ির লোকেদের সাথে আমারে পরিচয় করাইয়া দিছে আমি নাকি তাগো বাড়ির কাজের লোক। সে নাকি এতিম বাবা মা অনেক আগে মারা গেছে। লজ্জায়, ঘৃনায়, অপমানে আর কোন দিন ছেলের মুখ দেখিনায়। একটা মেয়ে আছে ডিগ্রী পাশ করিয়ে ভাল ঘর দেখে বিয়া দিছি। ভিটা মাটি যা ছিল মেয়েরে বিয়া দিয়ে গিয়া সব শেষ হইছে। গরিব দেখে মেয়ে জামাই আমাদের সাথে কোন পরিচয় রাখেনায়। মেয়ে জামাই মাইয়ারে বইলা দিছে আমাগো সাথে যোগাযোগ রাখলে তালাক দিয়ে দেবে। আমার মাইয়াডা লুকাইয়া মাঝে মাঝে দেখা করে অল্পকিছু যা পারে টাকা পয়সা দিয়া যায়। আমি নিতে চাইনা তারপরেও জোড় করে দিয়ে যায়। এখন আমার কিছুই নাই তাই বাধ্য হইয়া রিক্সা চালাই।

— চাচার কথা শুনে চোখ পানি চলে এসেছে। সন্তানরা হচ্ছে বাবা-মায়ের বৃদ্ধ বয়সের লাঠি। যে বাবা মা সারাজীবন কষ্ট করে সন্তানদের বড় করে অথচ নিজেরা ভালো থাকার জন্য সেই বাবা মাকে কীভাবে পর করে দেয়। ওরা সন্তান না ওরা শয়তান।

আব্বা আম্মার কথা খুব মনে পড়ছে। আব্বার মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলা আমার উচিৎ হয়নি। সব বাবা মা সন্তানের মঙ্গল চায়। আব্বা তুমি আমাকে মাফ করে দিও।

চাচার বাড়িতে এসে দেখি ছোট্ট একটা ভাঙাচুরা এক রুমের ঘর সামনে খোলা বারান্দ এক পাশে চকি পাতান অন্য পাশে রান্নাঘর। ঘরের ভিতরে তেমন মাল জীনিস নেই একটা খাট, আলনা, টেবিল চেয়ার। ঘরটা খুব পরিপাটি ভাবে গোছান।

চাচার স্ত্রী খুব অসুস্থ কোন বোধ শক্তি নেই। ব্যাথার যন্ত্রণার চাচা ছটফট করছে গায়ে জ্বরও বেঁড়েছে অনেক। ওনাদের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে ককয়েকদিন ধরে না খেয়ে আছে। খালি পেটে ওষুধ ও খাওয়াতে পারব না। চাচাকে বিছানায় শুয়িয়ে দিলাম।
কোন দোকান খোলা নেই খাবার কিনে আনবো।

মায়ের একা রান্না করতে কষ্ট হত দেখে আমি মাকে রান্নায় সাহায্য করতাম। মোটামুটি রান্না করতে পারি সেই অভিজ্ঞা থেকে চুলা ধরিয়ে রান্না শুরু করে দিলাম। চাউলে ডাউলে খিচুড়ি। খিচুড়ি রান্না করে চাচা চাচিকে খায়িয়ে ওষুধ খাওয়ালাম।

এত রাতে কোথায় যাব বারান্দায় রাখা চকিতে ব্যাগেটাকে বালিস বানিয়ে শুয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম ভেঙে দেখি আমার মাথার নিচে বালিস, গায়ে চাদর দেওয়া। চাচা চাচি তো এখন ও ঘুম তাহলে কে দিল..??

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here