#গল্প সপ্তাহ#
বিচ্ছেদ – ১
রিয়া যখন নিজের ভিতরে নতুন কারো অস্তিত্ব টের পাচ্ছিল,তখনই আশিকের সাথে ওর বিচ্ছেদের মত বড় ঘটনাটার সূত্রপাত হয়েছিল।
রিয়া বাপের বাড়ীতে ছিল। মায়ের শরীরটা খারাপ থাকায় সে ঢাকায় এসেছিল মাকে দেখতে।
আশিকও এসেছিল সাথে।
রিয়ার মাকে দেখে ফিরে গিয়েছিল নিজের কর্মস্হলে। আশিকের পোস্টিং তখন ছিল কুমিল্লায়।
চার দিনের ছুটি নিয়ে শাশুড়ীকে দেখতে এসেছিল।
ফিরে যাওয়ার আগের দিন রাতে রিয়ার বিষর্ন্ন মুখে ব্যাগ গোছানো দেখে বলেছিল,তুমি থাকো আরো কয়েকটা দিন মায়ের সাথে।
রিয়া খুব খুশী হয়েছিল।
এক রাতে ফোনে কথা বলতে বলতেই খুব ঝগড়া হলো রিয়ার সাথে আশিকের।
আশিক প্রচন্ড সৎ এবং ভাল ছেলে।কিন্তু খুব বদ-মেজাজি । সে নিজের মতামত এবং বিশ্বাসকেই সঠিক মনে করে। তার মতের সাথে মিললে ভাল,না মিললে ঝামেলা হয়।
রিয়াও খুব জেদী।
রিয়ার খুব রাগ হয়েছিল সেরাতে।
অভিমানে বুক ভেঙে যাচ্ছিল।
পরদিন সকালেই রিপোর্ট হাতে পেয়ে অদ্ভুত এক আনন্দে বুকের ভিতরটা কাঁপছিল রিয়ার।
কখন জানাবে আশিককে !
কিন্তু অভিমানে বুকটা ভার হয়ে আছে।
ঝগড়া বা রাগ হলেই আশিক এত বাজে ব্যবহার করে, এত খারাপ কথা বলে যে রিয়ার খুব রাগ হয়।
অবশ্য রিয়াও খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
সেও খারাপ ব্যবহার করে ফেলে আশিকের সাথে।
রিয়ার বাবা ফোন করে জানিয়েছিল আশিককে।
আশিক আসলো না। ফোনও করলোনা।
রিয়া খুব অবাক হয়ে ভেবেছিল,কেন আশিক আসলো না এমন একটা খবর শুনেও ?
তবে কি রিয়া ফোন করেনি বলে আসলো না ?
আশিকের না আাসা, ফোন না করা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি রিয়া। তীব্র অভিমান এক সময় রাগে পরিণত হয়েছিল। রিয়াও জেদী হয়ে উঠেছিল।
তাই আশিকের অসুস্থতার খবর পেয়েও কোন
ফোন করেনি রিয়া।
রিয়ার বাবা-মা অনেক বলেছিল, ফোন করে কথা বলে ফিরে যেতে।
রিয়ার এক কথা,আশিক তো আমাকে নিতে আসেনি। কেন ফিরে যাবো ?
যেদিন রায়না জন্মেছিল,
রিয়া খুব কেঁদেছিল সেদিন।
গভীর রাতে যখন কেউ জেগে ছিলনা, তখন।
রায়নার জন্ম নিয়ে কত সপ্ন দেখেছিল ওরা দু’জন।
অথচ,মেয়েটা জন্ম লগ্ন থেকেই শুধু মায়ের পরম
মমতা পেল…বাবার বুকের উষ্ণতা পেল না !
ভেবেছিল রাজকন্যার মত করে বড় করবে
মেয়েকে।
রাজা-রানী আর রাজকন্যা !
রাজ্য নেই.. রাজা নেই..
তবুও রায়না তার রাজকন্যা।
রায়নার জন্মের পর ওদের ডিভোর্সটা গেল।
রিয়া বুঝেছিল জীবনে বড় একটা শূন্যতার সৃষ্টি হলো, যা হয়তো এই জীবনে আর কোনদিন পূরণ হবেনা।
রায়নার জন্মের পরও আশিক আসলো না।
রাগে-দুঃখে-অপমানে রিয়া কোন কথায় বলেনি,
যখন সবাই আশিকের না আসা নিয়ে কথা বলেছিল।
ক্লিনিক থেকে বাবা-মায়ের সাথেই ফিরে এসেছিল বাড়ীতে। মনের কোথাও ক্ষীণ আশা ছিল, আশিক হয়তো নিতে আসবে।
রিয়া ফিরে যাবে আবার নিজের সংসারে।
দূর্ভাগ্য; তেমন কিছু হয়নি।
রায়নার এক বছর পূর্ণ হলে রিয়া একটা চাকুরীর চেষ্টা করে এবং পেয়েও যায়।
রিয়ার অনার্সের পর পরই ওর বিয়ে হয়ে যায়।
বিয়ের পরে মাস্টার্সে ভর্তিও হয়েছিল। কিন্তু,আশিক এবং সংসারে বেশী মন দিতে গিয়ে মাস্টার্সের ক্লাস করা হতনা। তাছাড়া আশিকের পোস্টিংও ঢাকার বাইরে হওয়ায় ক্লাস করার সুযোগও ছিলনা।
এ নিয়ে মায়ের মনে অনেক দুঃখ।
তবে, রিয়া আর এসব নিয়ে ভাবেনা।
মোটামুটি একটা ভাল চাকুরী পেতে খুব বেগ পেতে হয়নি রিয়াকে।তাছাড়া, সে যথেষ্ট স্মার্ট। কাজেই, ঘরে বসে থেকে বাবার উপর অযথা চাপ বাড়াতে চায়নি রিয়া।
রায়না তার নানুমনির কাছে খুব ভাল থাকে।
তবে রিয়া অফিস থেকে ফিরলে মা-মেয়ের এক মায়াময় জগতে ওরা ডুবে যায়..
রায়নাকে দেখলেই আশিককে মনে পড়ে।
রায়না তার বাবার মত হয়েছে।
আশিক সুদর্শন এবং সুপুরুষ।
মেয়ের চোখ,নাক,ঠোঁট,হাসি একেবারে তার
বাবার মত।
বুকের ভেতরটা টন্ টন্ করে ওঠে রিয়ার।
কেন একটিবার তুমি আসলে না আশিক ?
মেয়েকে দেখতেও না ???
তুমি আসলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হত।
রায়নার যখন তিন বছর বয়স তখন একদিন হট্যৎ
বড় একটা কেক আর কিছু খেলনা,বেলুন, ফুল নিয়ে
হাজির আশিকের এক বন্ধু।
রিয়া খুবই অবাক !
আশিকের বন্ধু জানালো আশিক তার মেয়ের জন্মদিনে উপহার আর কেক পাঠিয়েছে।
রিয়া কঠিন কিছু কথা বলতে যাচ্ছিল..
তার আগেই রায়না দৌড়ে এলো।
কেক, খেলনা,বেলুন দেখে মূহুর্ত্যেই তার চোখ- মুখ উজ্জল হয়ে উঠলো।
চিৎকার করে উঠলো,বিলুন ! আমার জন্য ?
সাথে সাথে আশিকের বন্ধু বলে উঠলো,হ্যাঁ.. এই সবকিছু তোমার জন্য ! জানো কে পাঠিয়েছে ?
তোমার বাবা পাঠিয়েছে।
রায়না অবাক হয়ে তাকালো রিয়ার দিকে।
মা.. এতা আমাল বাবা পাতিয়েছে ?
রিয়া কোন কঠিন কথা বলতে পারেনি সেদিন।
কারণ,মেয়েকে সব সময় বলে এসেছে তার বাবা
আমেরিকায় থাকে। তাই রায়নার কাছে আসতে পারেনা। কিন্তু, একদিন ঠিক চলে আসবে।
জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে মেয়েকে বলেছিল, হ্যাঁ তোমার বাবা পাঠিয়েছে তোমার জন্য।
আঙ্কলকে থ্যাঙ্কস বলো, মা।
রায়না লক্ষ্মী মেয়ের মত থ্যাঙ্কস বলেছিল।
বাবাকে বলো তাতালি তলে (চলে) আততে।
রায়না বলেছিল আশিকের বন্ধুকে।
আশিকের বন্ধু রায়নার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলেছিল,অবশ্যই বলবো মামনি।
সেরাতে আশিকের পাঠানো কেক কেটেই রায়না জন্মদিন পালন করেছিল।
আহামরি কিছু নয়। বিল্ডিং এর সব বাচ্চাদের নিয়ে ঘরোয়া আয়োজন।
রিয়ার বাবা সারাজীবন সম্মানের সাথে চাকুরী করেছেন। অবসর গ্রহনের পর এক কালীন যা টাকা
পেয়েছিলেন তা দিয়ে মোহাম্মাদপুর হাউজিং-এ ১৬ শ’ স্কয়ার ফিটের একটা ফ্লাট কিনেছিলেন।
এখন পেনশন আর ছেলের পাঠানো কিছু টাকা দিয়েই তাদের চলে যায়।
তাই রিয়া বুঝতো বাবার উপর চাপ পড়ে যায়। যদিও বাবা সেটা মানতে চাননা। এজন্য রিয়ার চাকুরী করাটা খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
রিয়া এমনিতেও চাকুরী করতোই তবে হয়তো রায়না আর একটু বড় হলে শুরু করতো।
রিয়া চেষ্টা করে গুছিয়ে, হিসেব করে চলতে।
বাবাকে প্রেসার দিতে চায়না।
বাবা তার নাতির জন্য তার সাধ্যমত করেন।
নানা-নানুর আদর, যত্ন, আর ভালবাসায় তার
রায়না একটু একটু করে বেড়ে উঠছিল।
একদিন হট্যৎ আশিকের ছোট বোন ফোন করে
ল্যান্ড ফোনে। জানায় আশিক তার মেয়েকে দেখতে চায়। রিয়া যদি আপত্বি না করে।
এত সুন্দর করে ভাবী ডেকেছিল ইভা।
রিয়া গভীর দুঃখী গলায় বলেছিল, আমাকে ভাবী ডাকো কেন ? আমি কি এখনো তোমার ভাবী ?
ইভার উত্তর ছিল, জানিনা কেন এখনো ভাবী ডাকি।
আমি হয়তো সারাজীবন ভাবীই ডাকবো।
আশিকের পরিবারের সাথে রিয়ার কোন সমস্যা ছিলনা। আশিকের পরিবার চায়নি ওদের বিচ্ছেদ হোক। বিশেষ করে আশিকের মা একেবারেই চাননি।
ইভা সেদিন ফোনে এসব বলছিল।
তারপরও ওদের দু’জনের ইগোর কারনেই ডিভোর্সটা শেষ পর্যন্ত হয়েছিল।
রিয়া ভেবেছিল আশিকের পরিবারও চায়না রিয়াকে।
রিয়া ভুল ভেবেছিল।
অনেক ভেবে চিন্তে রিয়া সিদ্ধান্ত নিল মেয়েকে তার বাবার সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাবে।
( চলবে )