বিচ্ছেদ পর্ব -০২

#গল্প সপ্তাহ#
বিচ্ছেদ – ২

সকাল থেকেই আশিক খুব অস্হির হয়ে ছিল।
কারণ আজ তার মেয়ের সাথে দেখা হবে।
তার মেয়ে ! তার ছোট্ট মেয়ে !!
যাকে জন্মের পর থেকে সে আজও দেখেনি।
এটা তার দূর্ভাগ্য !
তবে অবশ্যই আজও মেয়েকে না দেখা তার জীবনের সবচেয়ে বড় একটা বেদনাময় দিক।
মেয়েটার জন্মের খবর শোনার আগেই রিয়ার সাথে
এমন ঝামেলা হলো যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাদের।
আশিক ভিতরে ভিতরে রাগ – অভিমান পুষে রাখে।
এটা তার স্বভাব।
সে বাবা হবে খবরটা তার শশুর দিয়েছিলেন।
রিয়ার উপর এটাও তার একটা রাগ।
এরকম একটা খবর তাকে রিয়া নিজে কেন দিল না ?
তবে সে রিয়ার বাবার কাছে খবর পাঠিয়েছিল যে, সে রিয়াকে নিজের কাছে নিয়ে এসে সকল মেডিক্যাল পরীক্ষা-নিরিক্ষা করাতে চায়।
রিয়া আসতে রাজি হয়নি।
সেদিন আশিক খুব অপমানবোধ করেছিল।
আশিকের মা বার বার বুঝিয়েছিল,এখন এসব নিয়ে অশান্তি করার সময় নয়। রিয়াকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা উচিৎ।
কিন্তু আশিক খুব একরোখা।
তার বক্তব্য ছিল,আমি যখন বলেছি তখন তো আসেনি। তাই নিজেকেই ফিরতে হবে।

কিছুদিন বাদেই রোড এক্সিডেন্ট করে আশিকের স্পাইনাল কর্ড ফেটে যায়।
আশিক পুরোপুরি বিছানায় পড়ে যায়।
পুরো পাঁচ মাস সময় লাগে তার সুস্হ হতে।
রিয়াকে খবর দেয়া হয়েছিল।
রিয়া আসেনি।
রিয়ার এই সময় ফিরে না আসাটা আশিক কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি।
দূরত্ব বাড়তে থাকে রিয়ার সাথে।
তারপর যখন মেয়ের জন্মের খবর পেল,তখন রিয়ার উপর তীব্র অভিমান আর রাগে সে মেয়েকেও দেখতে গেলনা।
সে সময়টা খুব খারাপ কেটেছে আশিকের।
বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয়-স্বজন এত কটাক্ষ করে কথা বলতো যে হতাশায় ডুবে যেতে লাগলো আশিক।
কেউ কেউ বলতো, আরে.. বাচ্চা টাচ্চা কিছু হয়নি মনে হয়। বাচ্চা হলে কি তোমার কাছে ফিরে না এসে থাকতে পারতো !
কেউ বলতো, আশিক তোমার এক্সিডেন্টের পরও তোমার বউ তোমাকে দেখতে এলো না ?
কেমন বউ ??
আশিক পাগল হয়ে যাচ্ছিল মানুষের এত কথা, এত প্রশ্নে। সবার সহানুভূতি অসহৃ লাগছিল।
খুব ভালবাসতো রিয়াকে।
একদিন মাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদেছিল।
বলেছিল,আম্মু আমি তো ওকেই ভালবেসেছিলাম।
তাহলে এমন হল কেন ?
ও কেন ফিরে আসলো না ?
মা বলেছিলেন,রিয়া ফিরে আসেনি,তুমিও ওকে আনতে যাওনি। তোমরা যার যার জেদ নিয়ে বসে আছো। জেদের পরিণাম কখনো ভাল হয়না।

ভাল হয়নি। কিছুই ভাল হয়নি।
ভালবাসা কি ঘৃনায় পরিণত হয়েছিল ?
তাই আশিক যখন ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছিল,তখনও রিয়া একটিবারের জন্যও
ফোন করেনি।
বলেনি,আমি ডিভোর্স চাইনা।
আশিকও ফোন করে ওর মতামত চাইনি।
ডিভোর্সের পরে একটা স্কলারশিপ নিয়ে দু’বছরের জন্য আশিক দেশের বাইরে চলে গিয়েছিল।

আমেরিকায় থাকতেই ইভা তাকে জানিয়েছিল মেয়ের কথা।
একদম তোমার মত হয়েছে,ভাইয়া।
বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিল ইভা।
আগোরায় রিয়ার হাত ধরে টুক টুক করে
হেঁটে যেতে দেখেছিল ইভা।
দূর থেকে দেখে বাসায় এসে মাকে জড়িয়ে খুব কেঁদেছিল। মাও খুব কেঁদেছিলেন।
তারপর আশিককে জানিয়েছিল।
আশিকের তখন দেশে ফেরার সময় হয়ে গিয়েছিল।
দেশে ফেরার আগেই মেয়ের জন্মদিনে প্রিয় বন্ধু রিয়াজকে দিয়ে কেক,ফুল,খেলনা,বেলুন
পাঠিয়েছিল।
রিয়া নাকি স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে তার এসব কিছু পাঠানো।
দেশে ফিরেই মেয়েকে দেখার জন্য ছটফট করছে।
এতদিন যে দেখেনি সেজন্য কষ্ট হচ্ছে।
আজ তার সন্তানকে সে দেখবে।

আমেরিকা থেকে ফিরেছে মাত্র।
এখনো হেড অফিসের ফর্মালিটিজ শেষ হয়নি।
সাতদিন পরেই তাকে কুমিল্লা ফিরে যেতে হবে।
ডোর বেল বাজতেই ইভা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
আশিক ড্রয়িং রুমে চোখ বন্ধ করে সোফায় বসে আছে। অপেক্ষা করছে জীবনের নতুন অনুভবের সূচনার জন্য !

সকালে অফিসে গিয়েও অস্হির বোধ করছিল রিয়া। আজ বিকেলে আশিকের সাথে দেখা হবে।
রায়নাকে নিয়ে যেতে হবে।
রায়নাকে বলেছে তার বাবা আমেরিকা থেকে ফিরে এসেছে। আজ বাবার সাথে তার দেখা হবে।
হাত তালি দিয়ে খুশী প্রকাশ করেছে রায়না।
আশিকদের বাসা ধানমন্ডিতে।
আশিকের বাবা সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন।
অবসর গ্রহনের কয়েক বছর পর ক্যানসারে আক্রান্ত হন। ওদের বিয়ের দু’বছর আগেই মারা যান।
ওদের খুব ছিমছাম পরিবার।
আশিকরা তিন ভাই বোন।
রাশিক বুয়েটে পড়ছে আর ইভা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে।
ইভা-রাশিক পিঠা পিঠি ভাই বোন। রাশিক সবার ছোট। তবে অনেক বুদ্ধিমান এবং শান্ত স্বভাবের।
আর ইভা খুবই লক্ষ্মী একটি মেয়ে।
আজ কতদিন পর ওবাড়ীতে যাবে !
ঐ মানুষ গুলোর সাথে দেখা হবে।
ওরা এখন রিয়ার কেউ না হলেও রায়নার অনেক কিছু। ওরা রায়নার শেকড় !
তাই ওকে যেতে হবে যতই অস্বস্তি হোক।

বিকেলে রায়নাকে নিয়ে ঠিক সময়ে পৌঁছে গেল আশিকদের বাড়ীতে।
সেই বাড়ী !
বিয়ের পর প্রথম এবাড়ীতেই এসেছিল রিয়া।
মূলত; এটায় রিয়ার শশুর বাড়ী।
তার শশুর ধানমন্ডির এই ফ্লাটটা করেছিলেন অবসর গ্রহনের পর। তার বাবার মতই।

আশিকদের ফ্লাটটা বেশ বড়।
এবং চমৎকার ভাবে সাজানো।
রিয়ার শাশুড়ী খুবই গোছানো স্বভাবের।
শুনেছে তার শশুর খুব সৌখিন ছিলেন।
লিফট থেকে বের হয়েই কেমন নার্ভাস লাগছিল
রিয়ার। একদিন এটা তারও বাড়ী ছিল।
আজ আর ওর কিছু নয়।
ডোর বেলে হাত রেখে রায়নার দিকে তাকিয়ে
হাসারর চেষ্টা করলো।
ইভা দরজা খুলে দিয়ে গভীর মমতায় রিয়ার হাত
ধরে ভিতরে নিয়ে গেল।
রিয়া ওখানেই দাড়িয়ে পড়লো।
ইভা রায়নাকে আদর করে নিয়ে গেল।
রিয়া আশিক কে দেখতে পাচ্ছে এখান থেকেই।
একই রকম আছে।
চার বছর পর দেখছে ওকে।
চোখ বন্ধ করে দুই হাত মাথার পিছনে দিয়ে বসে আছে সোফায়।
রায়না এগিয়ে যাচ্ছে..

বাবা.. ডাক শুনে চোখ খুলতেই চোখের সামনে এক দেবশিশুকে দেখলো আশিক।
পলক হীন চোখে তাকিয়ে আছে আশিক তার রাজকন্যার দিকে!
দেবশিশু চঞ্চল চোখে দেখছিল আশিককে।
আশিকের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে..
দেবশিশু মিলিয়ে যাওয়ার আগেই তাকে বুকের ভিতরে টেনে নিল আশিক।
তার বুকের সবটুকু উষ্ণতা দিয়ে আঁকড়ে ধরলো তার রাজকন্যাকে !!

জল ভরা চোখে দৃশ্যটি দেখলো রিয়া দূর থেকে।
এই জীবনে এত কষ্ট কেন ?
কষ্টগুলোকে ছাপিয়ে উঁকি দিতে চায় কি ভালবাসা ?

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here