#বিচ্ছেদ -১২
সাতদিন পরে আশিকের ফ্লাইট।
রায়নাকে ছেড়ে যেতে হবে ভাবলেই
আশিকের খুব কষ্ট হচ্ছে।
ফেরার সময়টা যতই এগিয়ে আসছে আশিকের মন অস্হির হয়ে উঠছে।
রায়নার কাগজ-পত্র গুলো আজ রিয়া দিতে আসবে।
রিয়া কফি গ্লোরীতে আসবে।
ওর কাছে হয়।
সবকিছু ঠিকঠাক বুঝে নিতে চেয়েছিল আশিক,তাই রিয়াকে অনুরোধ করেছিল আসতে।
প্রথমে রিয়া একটু ইতস্তঃত করছিল পরে অবশ্য বিষয়টার গুরুত্ব বুঝে রাজি হয়েছে আসতে।
রিয়ার আপত্বি নেই রায়নার আমেরিকায় নাগরিকত্বের ব্যাপারে।
বিষয়টা এমন নয় যে আজ আবেদন করলে কালই হয়ে যাচ্ছে। এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই আশিক আমেরিকা ফিরেই ল’ইয়ার র সাথে কথা বলবে।
রায়না তার নিজের সন্তান এটা প্রমান করতে হবে। যেটা একসময় খুব স্বাভাবিক ভাবে হতে পারতো, সেটা আজ প্রমাণ করতে হবে !
জীবনে আরো কত দুঃখ পাওনা হয়ে আছে আশিক জানে না।
নিজের ভুলের মাশুল দিতে হবে হয়তো এভাবেই। আশিক কষ্টকে ভয় পায়না।
কষ্ট তো তার প্রাপ্য।
তার সন্তান কত কষ্ট করেছে জন্মের পর থেকেই।
তার ভুলের জন্যেই তো কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা।
আর কষ্ট দিতে পারে না আশিক তার মেয়েকে। এবার মেয়েকে সুখ ফিরিয়ে দেবার পালা। মেয়ের সুখের জন্য সবকিছু করবে আশিক।
সেদিন যমুনা থেকে রায়নাকে তার পছন্দ মত পোষাক কিনে দিতে পেরে ওর অসম্ভব ভাল লাগছিল।
সারাজীবন এত মানুষের বাচ্চাদের কত উপহার দিয়েছে। আর তার নিজের বাচ্চা একটা দামী ড্রেস পরতে পারেনা ?
সেদিন রায়নার চোখে খুশীর ঝিলিক দেখছিল আশিক। সব বাচ্চারাই মনে হয় তার বাবার হাত ধরে শপিং করতে ভালবাসে।
আমেরিকায় তার অনেক বন্ধুকেই দেখেছে ছুটির দিনে তাদের বাচ্চাদের নিয়ে শপিং মলগুলোতে সময় কাটাতে। আশিক তখন বুঝতো না।
বাবা-সন্তানের সম্পর্কের এই মধুর অনুভবটার সাথেই তো আশিক পরিচিত ছিল না।
নীলার ছেলে দু’বছর আমেরিকায় তার বাড়ীতে থেকেছে বটে। কিন্তু তার সাথে আশিকের কোন সখ্যতায় গড়ে ওঠেনি।
বরং একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হয়েছে।
ছেলেটি আশিককে দেখলেই অস্বাভাবিক আচরণ করতো। কপাল কুঁচকে রাখতো।
আশিকের দিকে তাকাতো না। হাতের আইপ্যাডের দিকে মনোযোগী হয়ে পড়তো।
সারাদিন তার হাতে আইপ্যাডটা থাকবেই।
আশিক নীলাকে কয়েকবার বলেওছিল,সারাক্ষণ আইপ্যাডে গেইম খেললে ওর ক্ষতি হবে। নীলার এটা খেয়াল করা উচিৎ।
এটা বলার পর থেকে আশিককে আরো অপছন্দ করতো নীলার ছেলে অয়ন।
নীলা মনে করতো, যেভাবে ওর ছেলে ভাল থাকতে চায় সেভাবেই তাকে থাকতে দেয়া উচিৎ। আশিক অহেতুক চিন্তা করে ওর ছেলেকে ডিস্টার্ব করছে। আইপাডে সময় কাটালে নীলার ছেলের আর কোনদিকে হুস থাকতো না। বিরক্তও করতো না।
আশিকের ধারনা,নীলা নিজের কাজ গুলো নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে করার জন্য ছোট থেকেই অয়নকে আইপ্যাডে অভ্যস্ত করে তুলেছে।
রায়নার থেকে ২/৩ বছরের বড় হবে অয়ন।
কখনো আশিকের সাথে অয়নের কোন অন্তরঙ্গ মূহুর্ত্য তৈরী হয়নি।
একবার নীলা তখনও বাসায় ফেরেনি।
অয়ন স্কুল থেকে আগে আগেই ফিরেছিল।
তার ক্ষুধা লেগেছিল। আশিক ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা দুধ আর স্যান্ডুইচ বের করে করে ওকে খেতে দিয়েছিল।
অয়ন খাবারটা প্রথমে খেতে চায়নি পরে আশিক অনেকবার বলার পরে খেয়েছিল।
একটাও কথা বলেনি।
যদিও সে খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারেiiনা।
অয়ন স্পেশাল চাইল্ড।
কিন্ত পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারে সে খুব সচেতন। সেটা সে বুঝিয়ে দিতে পারে খুব স্ট্রংলি। আশিক তার পছন্দের নয়।
আশিকও কোনদিন অয়নকে নিজের সন্তান বানানোর চেষ্টা করেনি।
তবে অয়নের চিকিৎসার জন্য নীলাকে সাহায্য করাটা মানবিক কাজ মনে করে আশিক। এটা নীলার ছেলে বলে নয়,এটা একজন স্পেশাল চাইল্ডকে আরো একটু ভাল রাখার জন্য তার তরফ থেকে একটা চেষ্টা মাত্র।
আশিক এটাই মনে করে।
আশিক কফি গ্লোরীতে ঢুকে কোনার একটা টেবিলে বসলো। ওয়েটার এগিয়ে আসতেই
হাত ইশারায় পরে আসতে বললো।
রিয়া ঠিক পাঁচটায় ঢুকলো।
ওর পাঁচটায়ই আসার কথা ছিল।
রিয়া হালকা নীল রঙের একটা শাড়ী পরেছে। সুন্দর লাগছে।
সেই আগের মতই খুব গুছিয়ে ছিমছাম করে হালকা সেজেছে।
আশিক রিয়াকে দেখে একটু হাসলো।
রিয়াকে কি একটু নার্ভাস মনে হচ্ছে ?
তার নিজেরও একটু একটু নার্ভাস লাগছে।
দীর্ঘ বারো বছর পর আবার রিয়ার সাথে এভাবে একান্তে দেখা হচ্ছে।
এটা কোন রোমান্টিক ডেটিং নয়।
তাদের মধ্য কোন সম্পর্ক না থাকলেও রায়নার কারনে তাদের মধ্য একটা সম্পর্ক রয়েই গেছে। তারা দু’জন রায়নার বাবা-মা।
এটা কোনদিন বদলাবে না।
এই সম্পর্কের কারণেই আবার দেখা হওয়া।
রিয়া নার্ভাস ভঙ্গিতে সালাম দিয়ে বসলো।
সে আশিকের মুখের দিকে তাকায়নি এখনো।
প্রথম যেদিন রিয়া তার সাথে দেখা করতে বাইরে এসেছিল,সেদিনও খুব নার্ভাস ছিল। লাজুক ভঙ্গিতে কথা বলেছিল।
আশিক রিয়ার নার্ভাসনেস আর মিষ্টি লাজুকতা খুব এনজয় করেছিল।
ওদের বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে ওরা দেখা করেছিল। সেই বিকেলটা কত সুন্দর ছিল।
ওরা অল্প অল্প কথা বলছিল।
দু’জনেই দু’জনের ভাল লাগাগুলো শেয়ার করেছিল। সেদিনই তো আশিক জেনছিল রিয়া আইসক্রিম খেতে ভালবাসে তবে সে খুব হেলথ সচেতন সেটাও জানিয়েছিল।
রিয়াও সেদিন থেকেই জেনেছিল আশিকের ব্লাক কফি খুব পছন্দ।
ওয়েটার এসে দাড়িয়েছে অর্ডার নেয়ার জন্য।
আশিক রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,আইসক্রিম ?
রিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে না করলো।
আস্তে করে বললো,কফি।
আশিক একটু অবাক হলো। সেদিন যমুনাতেও রিয়া শুধু কফি নিয়েছিল।
রিয়া কি এখন আর আইসক্রিম খায়না ?
আগে এত কফির ভক্ত ছিল নাতো !
তবে কি আশিকের সামনে আইসক্রিম
খাবেনা বলেই কফি নিচ্ছে ?
একটু মন খারাপ হলো আশিকের।
তার জন্য রিয়াকে জীবন থেকে আর কি কি বাদ দিতে হয়েছে ?
সেটা জানার কোন উপায় নেই।
কফি চলে এসেছে।
ওরা নিঃশব্দে কফি পান করলো।
ওদের নিজের তো কোন কথা নেই
আজ আর !
ওয়েটার কফির মগ গুলো নিয়ে গেল।
রিয়া একটা ফাইল আশিকের সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো, এখানে রিয়ার সব কাগজ পত্র আছে। আপনি দেখে নিন।
আশিক বেশ অবাক হলো রিয়ার মুখে আপনি শুনে। কখনো তো শোনেনি।
রায়নায় কাগজ-পত্রগুলো ঠিকমত চেক করলো। একটা ছোট্ট জটিলতা ধরা পড়লো।আশিকের নামের বানানে ছোট্ট একটা ভুল।
রায়হান বানানে i এবং y এর জটিলতা।
আশিক বললো, এই ভুলটা দ্রুত ঠিক করতে হবে। কারণ কাগজপত্র গুলো আমি সাথে নিয়ে যেতে চাই।
রিয়ার মন খারাপ হলো।
এই ভুলটা রায়নার জন্মের সময় হয়েছে। তখন ক্লিনিকের ফর্মে কে আশিকের নাম লিখেছিল আজ আর মনে নেই রিয়ার।
বানানের ভুলটা তখনই হয়েছে।
রায়নার জন্মের আগে থেকেই তো আশিকের সাথে তার যোগাযোগ বন্ধ।
আশিকের নাম রিয়ার কোনদিন আর প্রয়োজন হয়নি। তাই এই ভুলটা ওর চোখে ধরা পড়েনি।
আশিক বললো,এটা ঠিক করে ফেলতে হবে।
সমস্যা নেই। আমি করে ফেলবো।
রিয়া কিছু বললো না। জানে আশিক করে ফেলবে কাজটা হয়তো সহজেই।
রিয়া ভাবলো এবার উঠি,কাজতো শেষ।
রিয়া উঠতে গিয়েও থমকে গেল আশিকের কথায়,তুমি কেমন আছো রিয়া ?
রিয়ার মনে হলো বহুদূর থেকে ভেসে এলো আশিকের কন্ঠ। আশিক তাকে জিজ্ঞাসা করছে সে কেমন আছে ?
কেন জিজ্ঞাসা করছে হট্যৎ ?
রিয়া, আশিকের দিকে তাকালো।
এই প্রথম সে আশিকের দিকে সরাসরি তাকালো।
আশিক তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
আশিককে কি একটু রোগা লাগছে !
ওর চোখে পরাজিত মানুষের ছায়া।
একাকীত্ব একজন মানুষকে কত অসহায় করে তোলে!
রিয়া কঠিন হতে চেয়েও হতে পারলোনা।
ছোট্ট করে জবাব দিল,ভাল আছি।
রিয়া অপেক্ষা করছে।
আশিককে দেখে মনে হচ্ছে সে আরো কিছু
বলবে।
যে মানুষটা এক সময় ‘তারই’ ছিল.. সবচেয়ে কাছের ছিল, আজ সেই মানুষটা কত দূরের হয়ে উল্টো দিকের চেয়ারে বসে আছে।
কত ফর্মাল সম্পর্ক আজ তার সাথে !
রিয়া কেমন আছে.. তাকে প্রশ্ন করে জেনে নিতে হচ্ছে !
কেন এমন হয় ছোট্ট এই জীবনে ?
আশিক নরম গলায় বললো, রিয়া তুমি রায়নাকে অসম্ভব সুন্দর শিক্ষা দিয়ে বড় করেছো,আমি ওকে দেখে সত্যিই অভিভূত।
তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আমি।
রিয়া অবাক হয়ে বললো,কেন আপনি কৃতজ্ঞ কেন ?
আশিক একটা ধাক্কা খেলো মনে মনে।
রিয়ার মুখে আবারও আপনি শুনে কেমন যেন লাগলো ওর।
মুখে বললো, তুমি আমাদের মেয়েকে এত কষ্ট করে, এত সুন্দর ভাবে মানুষ করছো।
আমি তো কিছুই করিনি এতদিন। সবই তুমি করেছো।
রিয়ার মনে হলো কঠিন কিছু কথা শুনিয়ে দেয়। কিন্ত সেরকম কিছুই করলো না সে।
শুধু বললো,আমি তো মা, তাই কারো কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদের আশা নিয়ে আমি এসব করিনি।
রায়না আমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মত।আমার ওকে ছাড়া শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তাই যা করেছি নিজের জন্যেই করেছি। আপনি কেন কৃতজ্ঞ হতে যাবেন ?
আশিক আস্তে করে বললো,তুমি রায়নার মনে তার বাবা সম্পর্কে এত ভাল ধারনা দিয়ে এসেছো শুরু থেকেই, যেখানে সত্যিই তার বাবা এত ভাল নয়। এজন্য কৃতজ্ঞতা তোমার প্রতি।
রিয়া শুধু বললো,রায়নার জন্য এটাই ভাল হবে মনে হয়েছে, তাই করেছি।
রিয়া বাড়ী ফিরেছিল ছ’টায়।
আগামীকাল স্কুলে একটা প্রোগ্রাম আছে।
যেখানে বাবা-মা দু’জনের উপস্হিত থাকার কথা। রায়নার জন্য সবসময় রিয়া একাই থেকেছে। এনিয়ে রায়না কখনো তেমন কিছু বলেনি। মেয়েটা মনে মনে কি ভাবে সবসময় প্রকাশ করেনা। একবার খুব মন খারাপ করেছিল। সবার বাবা আসে, কেবল তার বাবা আসেনা। যদি একবার তার বাবাও আসতো !
কালকের প্রোগ্রামে রায়না চায়, তার বাবাও আসুক। রিয়া না বলতে পারেনি। অবশ্য না বলার কোন কারণও নেই, কারণ আশিক রায়নার বাবা এই সত্যটাকে অস্বীকার করতে চায়না রিয়া।
রায়না জানিয়েছে তার বাবাকে স্কুলের প্রোগ্রামে আসার কথা।
কাল আশিক আসবে।
স্কুলের প্রোগ্রাম খুব সুন্দর ভাবে শেষ হয়েছিল। আশিক এসেছিল। রায়নার চোখে আজ অন্যরকম আনন্দ খেলা করছিল।
এটা একটা বিশেষ প্যারেন্টস মিটিং ছিল।
সব ক্লাস একসাথে করে মিটিং করলে ভাল হয়না, তাই ক্লাস অনুযায়ী মিটিং হয় রিয়াদের স্কুলে। যেমন আজ ইংলিশ ও বাংলা মিডিয়ামের ক্লাস ফোরের সব সেকশনের প্যারেন্টস মিটিং ছিল।
আজ আশিক কথা বলেছিল। প্যারেন্টসদের মধ্য থেকে মতামত চাওয়া হয়েছিল আলোচনার সময়।
রায়নার সেকি আনন্দ।
সে স্কুল গেট থেকে বাবার হাত ধরে অডিটোরিয়াম পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল।
প্যারেন্টস মিটিং অডিটোরিয়ামে হয়েছিল। বন্ধুরা জানতে চাইছিল,রায়না উনি তোমার বাবা ?
গর্ব ভরে রায়না তাদের বলছিল,হ্যাঁ.. আমার বাবা।
রিয়ার ভাল লাগছিল রায়নার আনন্দ দেখে। আবার কষ্টও লাগছিল। কারণ, আশিক সবসময় এভাবে রায়নার পাশে থাকেতে পারবেনা।
সে তো ফিরে যাবে আমেরিকায়।
তখন কষ্ট পাবে মেয়েটা।
আশিক আজ রায়নার স্কুলে প্যারেন্টস মিটিং এ গিয়েছিল। এরকম অভিজ্ঞতা তার প্রথম।
প্রিন্সিপ্যাল,ভিপি সহ ক্লাস ফোরের বিভিন্ন টিচারদের সাথে প্যারেন্টস মিটিং ছিল।
পড়ালেখার মান আরো কিভাবে ভাল করা যায় সে বিষয়ে অভিভাবকদের মতামত চাওয়া হয়েছিল এবং অভিভাবকদের কোন অভিযোগ থাকলে সেটাও বলতে বলা হয়েছিল। রিয়া ছিল তার সাথে।খুবই প্রাণবন্ত আলোচনা চলছিল।
আশিক রায়নার কাছে জেনে নিয়েছিল পড়ালেখার কি কি ব্যাপারে তার অসুবিধা হচ্ছে,সে অনুযায়ী কিছু বক্তব্য সে তুলে ধরেছিল।
আশিকের বক্তব্য কে সমর্থন করে জোরে হাত তালি দিয়েছিল অভিভাবক ও টিচারা।
মিটিং শেষে অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে দেখে রায়না অপেক্ষা করছে এক ঝাঁক ছোট-বড় মেয়েদের নিয়ে। ওরা রায়নার বন্ধু, জুনিয়র,সিনিয়র। যাদের সাথে রায়নার খুব বন্ধুত্ব। আজ সে তার বাবার সাথে তার বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দেবে বলে অপেক্ষা করছিলো।
আশিককে দেখেই রায়না দৌড়ে এসে আশিকের হাত ধরে টেনে বন্ধুদের মাঝে নিয়ে গিয়ছিল।
সবার সাথে পরিচিত হয়েছিল আশিক।
ওর খুব ভাল লাগছিল।
মেয়েগুলি ওকে চকলেটের জন্য ধন্যবাদ দিল। আশিক তো অবাক।
সে তো তাদের চকলেই খাওয়ায়নি তাহলে ধন্যবাদ কেন ?
রায়না তখন বলেছিল,সে বাবার আনা চকলের বন্ধুদের দিয়েছিল।
আশিক হাসলো।
বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলোর সাথে কিছুটা সময় খুব আনন্দে কাটলো।
রায়না তার স্কুলের এটা-ওটা তার বাবাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালো।
রায়নার আনন্দ আশিককে স্পর্শ করে যাচ্ছিল বার বার।
আশিক ভাবছিল,ছেলে-মেয়েরা কি এমনই হয় ? তাদের সব কিছু তারা বাবা-মাকে শেয়ার করতে চায় ?
আশিক রায়নাকে ওদের বাসার সামনে পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল।
রায়না বিদায় নেয়ার আগে বাবাকে জড়িয়ে ধরে গাঢ় স্বরে বলেছিল, Love you, baba.
আশিক ফোন করেছিল।
রায়নার জ্বর এসেছে জানতে পেরে খবর নিতে ফোন করেছিল।
ইভার কাছে খবর পেয়েছিল।
অনেক উদ্বিগ্ন মনে হলো আশিককে।
রাশিককে গাড়ী দিয়ে পাঠাবে কিনা ? রায়নাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে কিনা ? মেডিসিন দেয়া হয়েছে কিনা ? এরকম অনেক প্রশ্ন আর অস্হিরতা ঝরে পড়লো আশিকের কন্ঠে।
রায়নার সাথেও কথা বললো।
রিয়া বুঝতে পারছিল, আশিকের খুব রায়নার কাছে আসতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু যেহেতু সেটা সম্ভব নয়, হয়তো তাই আরো বেশী অস্হির বোধ করছে।
গতকাল বিকেলে আশিক রিয়াকে ‘ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা’ জানিয়েছে।
আশিক কি ভেবেছিল রিয়া পারবে না ?
রায়নাকে সুশিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে ?
সঠিক ভাবে মানুষ করতে ?
কিন্তু বাস্তবে রিয়া সেটা করে দেখাচ্ছে ।
তাই এত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ?
রায়না তার বাবাকে এত ভালবাসে এতেও সে কৃতজ্ঞ রিয়ার কাছে,বলছিল আশিক।
কৃতজ্ঞ থাকায় উচিৎ বলে মনে করে রিয়া। সাধারণত সবাই যা করে রিয়া তা করেনি। কারণ রিয়ার মনে হয়েছে সন্তানের চোখে বাবা-মা দুজনই সমান।
তাদের দু’জনের সমস্যার কারণে তারা আলাদা হয়েছে,তার ফলে রায়নার চোখে একজন খারাপ হয়ে যাবে কেন..?
রায়নাকে রিয়া ততটুকুই বলে যতটুকু রায়নার এই বয়সে জানা উচিৎ।
রিয়া রায়নাকে তার বাবার ভাল দিকগুলোই বলতো।
খারাপ দিক গুলো শোনার বয়স হয়নি বলেই মনে করেছে রিয়া।
তাই আশিকের দ্বিতীয় জীবনের কথা জানেনা রায়না।
রায়না জানে বাবা-মায়ের মিল হয়নি বলে আলাদা হয়ে গেছে।
তাই তার বাবা তাদের সাথে থাকেনা।
তবে যখন আশিক ওদের গ্রহন না করে আমেরিকা ফিরে গিয়েছিল,সে তো বুঝতো না বাবা কেন চলে গেল তাকে রেখে। তাই তখন ছোট্ট রায়না অভিমান করে বলতো,বাবা বালো না..আমাকে নিয়ে গেলনা !
আশিক যাওয়ার পর ফোন করলেও রায়না কথা বলতে চাইতো না।
অবশ্য স্কুলের চাকুরী নিয়ে এখানে চলে আসার পর আর কোন ফোন করতে পারেনি আশিক। কারণ রিয়া যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল সবার সাথে।
রিয়া মনে করে, রায়না বড় হয়ে সব জেনে শুনে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেবে।
এখানে ওর ইচ্ছে বা মনোভাব মেয়ের উপর চাপিয়ে দিতে চায়নি রিয়া।
রায়না স্কুলে যেতে পারলো না।
সকালে খাবার মুখে দিয়েই বমি করে ফেলেছে। রিয়ারর মনটা খারাপ হয়ে গেল।
রায়নাকে এভাবে রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না।
রহিমা খালার কাছে রেখে সৌয়া সাতটার দিকে রিয়া স্কুলে চলে গেল এক রাশ অস্হিরতা নিয়ে।
স্কুল থেকে ফিরে এসে রায়নাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।
জ্বরটা সকালে আবার এসেছে।
ইভা বলেছে এগারোটার দিকে এসে রায়নার সাথে থাকবে।
এতক্ষণ মেয়েটাকে একা থাকতে হবে।
আশিক রায়নাকে ফোন করলো।
মেয়েটা জ্বর আর বমি করে কাহিল হয়ে পড়েছে। রিয়া স্কুলে যাওয়ার পর আবারও বমি করেছে। মেয়েটার কত কষ্ট হচ্ছে।
ক্লান্ত গলায় কথা বললো, বাবা তুমি কি একটু আসবে আমার কাছে ?
আশিকের মন খারাপ হয়ে গেল।
কিভাবে যাবে সে রায়নার কাছে ?
তার ছোট্ট মেয়ে অসুস্থ হয়ে তাকে কাছে ডাকছে.. অথচ সে যেতে পারছেনা।
জীবনে এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে ???
আশিক অসহায় বোধ করলো।
ছটফট করছে ভিতরটা।
নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে আজ।
সাতদিন পরেই ফিরতে হবে তাকে।
এর মধ্য রায়না কেন অসুস্হ হয়ে পড়লো ?
মেয়েটা সুস্হ হয়ে উঠবে তো তাড়াতাড়ী ?
মেয়েকে ফিরে পেয়ে ভেবেছিল সব পেয়ে গেছে। কিন্ত এই ‘সব ফিরে’ পাওয়ার মধ্য যে এত না পাওয়া.. এত অসহয়ত্ব লুকিয়ে আছে, আশিক জানতো না !
রায়না দূর্বল গলায় বললো,বাবা.. কথা বলছো না কেন ? তুমি কি আসতে পারবে বাবা ?
খুব কষ্ট হচ্ছে আশিকের।
অসুস্হ মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে কিভাবে না বলবে আশিক …????
(চলবে…)
সাতদিন পরে আশিকের ফ্লাইট।
রায়নাকে ছেড়ে যেতে হবে ভাবলেই
আশিকের খুব কষ্ট হচ্ছে।
ফেরার সময়টা যতই এগিয়ে আসছে আশিকের মন অস্হির হয়ে উঠছে।
রায়নার কাগজ-পত্র গুলো আজ রিয়া দিতে আসবে।রিয়া কফি গ্লোরীতে আসবে। ওর কাছে হয়।সবকিছু ঠিকঠাক বুঝে নিতে চেয়েছিল আশিক,তাই রিয়াকে অনুরোধ করেছিল আসতে।প্রথমে রিয়া একটু ইতস্তঃত করছিল পরে অবশ্য বিষয়টার গুরুত্ব বুঝে রাজি হয়েছে আসতে।
রিয়ার আপত্বি নেই রায়নার আমেরিকায় নাগরিকত্বের ব্যাপারে।
বিষয়টা এমন নয় যে আজ আবেদন করলে কালই হয়ে যাচ্ছে। এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই আশিক আমেরিকা ফিরেই ল’ইয়ার র সাথে কথা বলবে।
রায়না তার নিজের সন্তান এটা প্রমান করতে হবে। যেটা একসময় খুব স্বাভাবিক ভাবে হতে পারতো, সেটা আজ প্রমাণ করতে হবে !
জীবনে আরো কত দুঃখ পাওনা হয়ে আছে আশিক জানে না।
নিজের ভুলের মাশুল দিতে হবে হয়তো এভাবেই। আশিক কষ্টকে ভয় পায়না। কষ্ট তো তার প্রাপ্য। তার সন্তান কত কষ্ট করেছে জন্মের পর থেকেই।
তার ভুলের জন্যেই তো কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা।
আর কষ্ট দিতে পারে না আশিক তার মেয়েকে। এবার মেয়েকে সুখ ফিরিয়ে দেবার
পালা। মেয়ের সুখের জন্য সবকিছু করবে আশিক।
সেদিন যমুনা থেকে রায়নাকে তার পছন্দ মত পোষাক কিনে দিতে পেরে ওর অসম্ভব ভাল লাগছিলল।
সারাজীবন এত মানুষের বাচ্চাদের কত উপহার দিয়েছে। আর তার নিজের বাচ্চা একটা দামী ড্রেস পরতে পারেনা ?
সেদিন রায়নার চোখে খুশীর ঝিলিক দেখছিল আশিক। সব বাচ্চারাই মনে হয় তার বাবার হাত ধরে শপিং করতে ভালবাসে।
আমেরিকায় তার অনেক বন্ধুকেই দেখেছে ছুটির দিনে তাদের বাচ্চাদের নিয়ে শপিং মলগুলোতে সময় কাটাতে। আশিক তখন বুঝতো না।
বাবা-সন্তানের সম্পর্কের এই মধুর অনুভবটার সাথেই তো আশিক পরিচিত ছিল না।
নীলার ছেলে দু’বছর আমেরিকায় তার বাড়ীতে থেকেছে বটে। কিন্তু তার সাথে আশিকের কোন সখ্যতায় গড়ে ওঠেনি।
বরং একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হয়েছে।
ছেলেটি আশিককে দেখলেই অস্বাভাবিক আচরণ করতো। কপাল কুঁচকে রাখতো।
আশিকের দিকে তাকাতো না। হাতের আইপ্যাডের দিকে মনোযোগী হয়ে পড়তো।
সারাদিন তার হাতে আইপ্যাডটা থাকবেই।
আশিক নীলাকে কয়েকবার বলেওছিল,সারাক্ষণ আইপ্যাডে গেইম খেললে ওর ক্ষতি হবে। নীলার এটা খেয়াল করা উচিৎ।
এটা বলার পর থেকে আশিককে আরো অপছন্দ করতো নীলার ছেলে অয়ন।
নীলা মনে করতো, যেভাবে ওর ছেলে ভাল থাকতে চায় সেভাবেই তাকে থাকতে দেয়া উচিৎ। আশিক অহেতুক চিন্তা করে ওর ছেলেকে ডিস্টার্ব করছে। আইপাডে সময় কাটালে নীলার ছেলের আর কোনদিকে হুস থাকতো না। বিরক্তও করতো না।
আশিকের ধারনা,নীলা নিজের কাজ গুলো নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে করার জন্য ছোট থেকেই অয়নকে আইপ্যাডে ব্যস্ত রাখে।
রায়নার থেকে ২/৩ বছরের বড় হবে অয়ন।
কখনো আশিকের সাথে অয়নের কোন অন্তরঙ্গ মূহুর্ত্য তৈরী হয়নি।
একবার নীলা তখনও বাসায় ফেরেনি।
অয়ন স্কুল থেকে আগে আগেই ফিরেছিল।
তার ক্ষুধা লেগেছিল। আশিক ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা দুধ আর স্যান্ডুইচ বের করে করে ওকে খেতে দিয়েছিল।
অয়ন খাবারটা প্রথমে খেতে চায়নি পরে আশিক অনেকবার বলার পরে খেয়েছিল।
একটাও কথা বলেনি।
যদিও সে খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারেiiনা।
অয়ন স্পেশাল চাইল্ড।
কিন্ত পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারে সে খুব সচেতন। সেটা সে বুঝিয়ে দিতে পারে খুব স্ট্রংলি। আশিক তার পছন্দের নয়।
আশিকও কোনদিন অয়নকে নিজের সন্তান বানানোর চেষ্টা করেনি।
তবে অয়নের চিকিৎসার জন্য নীলাকে সাহায্য করাটা মানবিক কাজ মনে করে আশিক। এটা নীলার ছেলে বলে নয়,এটা একজন স্পেশাল চাইল্ডকে আরো একটু ভাল রাখার জন্য তার তরফ থেকে একটা চেষ্টা মাত্র।
আশিক এটাই মনে করে।
আশিক কফি গ্লোরীতে ঢুকে কোনার একটা টেবিলে বসলো। ওয়েটার এগিয়ে আসতেই
হাত ইশারায় পরে আসতে বললো।
রিয়া ঠিক পাঁচটায় ঢুকলো।
ওর পাঁচটায়ই আসার কথা ছিল।
রিয়া হালকা নীল রঙের একটা শাড়ী পরেছে।
সেই আগের মতই খুব গুছিয়ে ছিমছাম করে হালকা সেজেছে।
আশিক রিয়াকে দেখে একটু হাসলো।
রিয়াকে কি একটু নার্ভাস মনে হচ্ছে ?
তার নিজেরও একটু একটু নার্ভাস লাগছে।
দীর্ঘ বারো বছর পর আবার রিয়ার সাথে এভাবে একান্তে দেখা হচ্ছে।
এটা কোন রোমান্টিক ডেটিং নয়।
তাদের মধ্য কোন সম্পর্ক না থাকলেও রায়নার কারনে তাদের মধ্য একটা সম্পর্ক রয়েই গেছে। তারা দু’জন রায়নার বাবা-মা।
এটা কোনদিন বদলাবে না।
এই সম্পর্কের কারণেই আবার দেখা হওয়া।
রিয়া নার্ভাস ভঙ্গিতে সালাম দিয়ে বসলো।
সে আশিকের মুখের দিকে তাকায়নি এখনো।
প্রথম যেদিন রিয়া তার সাথে দেখা করতে বাইরে এসেছিল,সেদিনও খুব নার্ভাস ছিল। লাজুক ভঙ্গিতে কথা বলেছিল।
আশিক রিয়ার নার্ভাসনেস আর মিষ্টি লাজুকতা খুব এনজয় করেছিল।
ওদের বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে ওরা দেখা করেছিল। সেই বিকেলটা কত সুন্দর ছিল।
ওরা অল্প অল্প কথা বলছিল।
দু’জনেই দু’জনের ভাল লাগাগুলো শেয়ার করেছিল। সেদিনই তো আশিক জেনছিল রিয়া আইসক্রিম খেতে ভালবাসে তবে সে খুব হেলথ সচেতন সেটাও জানিয়েছিল।
রিয়াও সেদিন থেকেই জেনেছিল আশিকের ব্লাক কফি খুব পছন্দ।
ওয়েটার এসে দাড়িয়েছে অর্ডার নেয়ার জন্য।
আশিক রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,আইসক্রিম ?
রিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে না করলো।
আস্তে করে বললো,কফি।
আশিক একটু অবাক হলো। সেদিন যমুনাতেও রিয়া শুধু কফি নিয়েছিল।
রিয়া কি এখন আর আইসক্রিম খায়না ?
আগে এত কফির ভক্ত ছিল নাতো !
তবে কি আশিকের সামনে আইসক্রিম
খাবেনা বলেই কফি নিচ্ছে ?
একটু মন খারাপ হলো আশিকের।
তার জন্য রিয়াকে জীবন থেকে আর কি কি বাদ দিতে হয়েছে ?
সেটা জানার কোন উপায় নেই।
কফি চলে এসেছে।
ওরা নিঃশব্দে কফি পান করলো।
ওদের নিজের তো কোন কথা নেই
আজ আর !
ওয়েটার কফির মগ গুলো নিয়ে গেল।
রিয়া একটা ফাইল আশিকের সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো, এখানে রিয়ার সব কাগজ পত্র আছে। আপনি দেখে নিন।
আশিক বেশ অবাক হলো রিয়ার মুখে আপনি শুনে। কখনো তো শোনেনি।
রায়নায় কাগজ-পত্রগুলো ঠিকমত চেক করলো। একটা ছোট্ট জটিলতা ধরা পড়লো।আশিকের নামের বানানে ছোট্ট একটা ভুল।
রায়হান বানানে i এবং y এর জটিলতা।
আশিক বললো, এই ভুলটা দ্রুত ঠিক করতে হবে। কারণ কাগজপত্র গুলো আমি সাথে নিয়ে যেতে চাই।
রিয়ার মন খারাপ হলো।
এই ভুলটা রায়নার জন্মের সময় হয়েছে। তখন ক্লিনিকের ফর্মে কে আশিকের নাম লিখেছিল আজ আর মনে নেই রিয়ার।
বানানের ভুলটা তখনই হয়েছে।
রায়নার জন্মের আগে থেকেই তো আশিকের সাথে তার যোগাযোগ বন্ধ।
আশিকের নাম রিয়ার কোনদিন আর প্রয়োজন হয়নি। তাই এই ভুলটা ওর চোখে ধরা পড়েনি।
আশিক বললো,এটা ঠিক করে ফেলতে হবে।
সমস্যা নেই। আমি করে ফেলবো।
রিয়া কিছু বললো না। জানে আশিক করে ফেলবে কাজটা হয়তো সহজেই।
রিয়া ভাবলো এবার উঠি,কাজতো শেষ।
রিয়া উঠতে গিয়েও থমকে গেল আশিকের কথায়,তুমি কেমন আছো রিয়া ?
রিয়ার মনে হলো বহুদদূর থেকে ভেসে এলো আশিকের কথা। আশিক তাকে জিজ্ঞাসা করছে সে কেমন আছে ?
কেন জিজ্ঞাসা করছে হট্যৎ ?
রিয়া, আশিকের দিকে তাকালো।
এই প্রথম সে আশিকের দিকে সরাসরি তাকালো।
আশিক তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
আশিককে কি একটু রোগা লাগছে !
ওর চোখে পরাজিত মানুষের ছায়া।
একাকীত্ব একজন মানুষকে অসহায় করে তোলে। রিয়া কঠিন হতে চেয়েও হতে পারলোনা।
ভাল আছি,ছোট্ট করে জবাব দিল।
রিয়া অপেক্ষা করছে।
আশিককে দেখে মনে হচ্ছে সে আরো কিছু
বলবে। যে মানুষটা এক সময় ‘তারই’ ছিল.. সবচেয়ে কাছের ছিল, আজ সেই মানুষটা কত দূরের হয়ে উল্টো দিকের চেয়ারে বসে আছে।
কত ফর্মাল সম্পর্ক আজ তার সাথে !
রিয়া কেমন আছে.. তাকে প্রশ্ন করে জেনে নিতে হচ্ছে !
কেন এমন হয় ছোট্ট এই জীবনে ?
আশিক নরম গলায় বললো, রিয়া তুমি রায়নাকে অসম্ভব সুন্দর শিক্ষা দিয়ে বড় করেছো,আমি ওকে দেখে সত্যিই অভিভূত।
তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আমি।
রিয়া অবাক হয়ে বললো,কেন আপনি কৃতজ্ঞ কেন ?
আশিক একটা ধাক্কা খেলো মনে মনে।
রিয়ার মুখে আপনি শুনে কেমন যেন লাগলো ওর। মুখে বললো, তুমি আমাদের মেয়েকে এত কষ্ট করে, এত সুন্দর ভাবে মানুষ করছো।
আমি তো কিছুই করিনি এতদিন। সবই তুমি করেছো।
রিয়ার মনে হলো কঠিন কিছু কথা শুনিয়ে দেয়। কিন্ত সেরকম কিছুই করলো না সে।
শুধু বললো,আমি তো মা, তাই কারো কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদের আশা নিয়ে আমি এসব করিনি। রায়না আমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মত।আমার ওকে ছাড়া শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তাই যা করেছি নিজের জন্যেই করেছি। আপনি কেন কৃতজ্ঞ হতে যাবেন ?
আশিক আস্তে করে বললো,তুমি রায়নার মনে তার বাবা সম্পর্কে এত ভাল ধারনা দিয়ে এসেছো শুরু থেকেই, যেখানে সত্যিই তার বাবা এত ভাল নয়। এজন্য কৃতজ্ঞতা তোমার প্রতি।
রিয়া শুধু বললো,রায়নার জন্য এটাই ভাল হবে মনে হয়েছে, তাই করেছি।
রিয়া বাড়ী ফিরেছিল ছ’টায়।
আগামীকাল স্কুলে একটা প্রোগ্রাম আছে।
যেখানে বাবা-মা দু’জনের উপস্হিত থাকার কথা। রায়নার জন্য সবসময় রিয়া একাই থেকেছে। এনিয়ে রায়না কখনো তেমন কিছু বলেনি। মেয়েটা মনে মনে কি ভাবে সবসময় প্রকাশ করেনা। একবার খুব মন খারাপ করেছিল। সবার বাবা আসে, কেবল তার বাবা আসেনা। যদি একবার তার বাবাও আসতো !
কালকের প্রোগ্রামে রায়না চায়, তার বাবাও আসুক। রিয়া না বলতে পারেনি। অবশ্য না বলার কোন কারণও নেই, কারণ আশিক রায়নার বাবা এই সত্যটাকে অস্বীকার করতে চায়না রিয়া।
রায়না জানিয়েছে তার বাবাকে স্কুলের প্রোগ্রামে আসার কথা।
কাল আশিক আসবে।
স্কুলের প্রোগ্রাম খুব সুন্দর ভাবে শেষ হয়েছিল। আশিক এসেছিল। রায়নার চোখে আজ অন্যরকম আনন্দ খেলা করছিল।
এটা একটা বিশেষ প্যারেন্টস মিটিং ছিল।
সব ক্লাস একসাথে করে মিটিং করলে ভাল হয়না, তাই ক্লাস অনুযায়ী মিটিং হয় রিয়াদের স্কুলে। যেমন আজ ইংলিশ ও বাংলা মিডিয়ামের ক্লাস ফোরের সব সেকশনের প্যারেন্টস মিটিং ছিল।
আজ আশিক কথা বলেছিল। প্যারেন্টসদের মধ্য থেকে মতামত চাওয়া হয়েছিল আলোচনার সময়।
রায়নার সেকি আনন্দ।
সে স্কুল গেট থেকে বাবার হাত ধরে অডিটোরিয়াম পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। বন্ধুরা জানতে চাইছিল,রায়না উনি তোমার বাবা ?
গর্ব ভরে রায়না তাদের বলছিল,হ্যাঁ.. আমার বাবা।
রিয়ার ভাল লাগছিল রায়নার আনন্দ দেখে। আবার কষ্টও লাগছিল। কারণ, আশিক সবসময় এভাবে রায়নার পাশে থাকেতে পারবেনা।
সে তো ফিরে যাবে আমেরিকায়।
তখন কষ্ট পাবে মেয়েটা।
আশিক আজ রায়নার স্কুলে প্যারেন্টস মিটিং এ গিয়েছিল। এরকম অভিজ্ঞতা তার প্রথম।
প্রিন্সিপ্যাল,ভিপি সহ ক্লাস ফোরের বিভিন্ন টিচারদের সাথে প্যারেন্টস মিটিং ছিল।
পড়ালেখার মান আরো কিভাবে ভাল করা যায় সে বিষয়ে অভিভাবকদের মতামত চাওয়া হয়েছিল এবং অভিভাবকদের কোন অভিযোগ থাকলে সেটাও বলতে বলা হয়েছিল। রিয়া ছিল তার সাথে।খুবই প্রাণবন্ত আলোচনা চলছিল।
আশিক রায়নার কাছে জেনে নিয়েছিল পড়ালেখার কি কি ব্যাপারে তার অসুবিধা হচ্ছে,সে অনুযায়ী কিছু বক্তব্য সে তুলে ধরেছিল।
আশিকের বক্তব্য কে সমর্থন করে জোরে হাত তালি দিয়েছিল অভিভাবক ও টিচারা।
মিটিং শেষে অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে দেখে রায়না অপেক্ষা করছে এক ঝাঁক ছোট-বড় মেয়েদের নিয়ে। ওরা রায়নার বন্ধু, জুনিয়র,সিনিয়র। যাদের সাথে রায়নার খুব বন্ধুত্ব। আজ সে তার বাবার সাথে তার বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দেবে বলে অপেক্ষা
করছিলো।
আশিককে দেখেই রায়না দৌড়ে চলে এসে আশিকের হাত ধরে টেনে বন্ধুদের মাঝে নিয়ে গিয়ছিল।
সবার সাথে পরিচিত হয়েছিল আশিক।
ওর খুব ভাল লাগছিল।
মেয়েগুলি ওকে চকলেটের জন্য ধন্যবাদ দিল। আশিক তো অবাক।
সে তো তাদের চকলেই খাওয়ায়নি তাহলে ধন্যবাদ কেন ?
রায়না তখন বলেছিল,সে বাবার আনা চকলের বন্ধুদের দিয়েছিল।
আশিক হাসলো।
বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলোর সাথে কিছুটা সময় খুব আনন্দে কাটলো।
রায়না তার স্কুলের এটা-ওটা তার বাবাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালো।
রায়নার আনন্দ আশিককে স্পর্শ করে যাচ্ছিল বার বার।
আশিক ভাবছিল,ছেলে-মেয়েরা কি এমনই হয় ? তাদের সব কিছু তারা বাবা-মাকে শেয়ার করতে চায় ?
আশিক রায়নাকে ওদের বাসার সামনে পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল।
রায়না বিদায় নেয়ার আগে বাবাকে জড়িয়ে ধরে গাঢ় স্বরে বলেছিল, Love you, baba.
আশিক ফোন করেছিল।
রায়নার জ্বর এসেছে জানতে পেরে খবর নিতে ফোন করেছিল।
ইভার কাছে খবর পেয়েছিল।
অনেক উদ্বিগ্ন মনে হলো আশিককে।
রাশিককে গাড়ী নিয়ে পাঠাবে কিনা ? রায়নাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে কিনা ? মেডিসিন দেয়া হয়েছে কিনা ? এরকম অনেক প্রশ্ন আর অস্হিরতা ঝরে পড়লো আশিকের কন্ঠে।
রায়নার সাথেও কথা বললো।
রিয়া বুঝতে পারছিল, আশিকের খুব রায়নার কাছে আসতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু যেহেতু সেটা সম্ভব নয়, হয়তো তাই আরো বেশী অস্হির বোধ করছে।
গতকাল বিকেলে আশিক রিয়াকে ‘ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা’ জানিয়েছে।
আশিক কি ভেবেছিল রিয়া পারবে না ?
রায়নাকে সুশিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে ?
সঠিক ভাবে মানুষ করতে ?
কিন্তু বাস্তবে রিয়া সেটা করে দেখাচ্ছে ।
তাই এত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ?
রায়না তার বাবাকে এত ভালবাসে এতেও সে কৃতজ্ঞ রিয়ার কাছে,বলছিল আশিক।
কৃতজ্ঞ থাকায় উচিৎ বলে মনে করে রিয়া। সাধারণত সবাই যা করে রিয়া তা করেনি। কারণ রিয়ার মনে হয়েছে সন্তানের চোখে বাবা-মা দুজনই সমান।
তাদের দু’জনের সমস্যার কারণে তারা আলাদা হয়েছে,তার ফলে রায়নার চোখে একজন খারাপ হয়ে যাবে কেন..?
রায়নাকে রিয়া ততটুকুই বলে যতটুকু রায়নার এই বয়সে জানা উচিৎ।
রিয়া রায়নাকে তার বাবার ভাল দিকগুলোয় বলতো।
খারাপ দিক গুলো শোনার বয়স হয়নি বলেই মনে করেছে রিয়া।
তাই আশিকের দ্বিতীয় জীবনের কথা জানেনা রায়না।
সে জানে বাবা-মায়ের মিল হয়নি বলে আলাদা হয়ে গেছে।
তাই তার বাবা তাদের সাথে থাকেনা।
তবে যখন আশিক ওদের গ্রহন না করে আমেরিকা ফিরে গিয়েছিল,সে তো বুঝতো না বাবা কেন চলে গেল তাকে রেখে। তাই তখন ছোট্ট রায়না অভিমান করে বলতো,বাবা বালো না..আমাকে নিয়ে গেলনা !
আশিক যাওয়ার পর ফোন করলেও রায়না কথা বলতে চাইতো না।
অবশ্য স্কুলের চাকুরী নিয়ে এখানে চলে আসার পর আর কোন ফোন করতে পারেনি আশিক। কারণ রিয়া যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল সবার সাথে।
রিয়া মনে করেছে, রায়না বড় হয়ে সব জেনে শুনে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেবে।
এখানে নিজের ইচ্ছেটা মেয়ের উপর চাপিয়ে দিতে চায়নি রিয়া।
রায়না স্কুলে যেতে পারলো না।
সকালে খাবার মুখে দিয়েই বমি করে ফেলেছে। রায়নার মনটা খারাপ হয়ে গেল।
রায়নাকে এভাবে রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না।
রহিমা খালার কাছে রেখে সৌয়া সাতটার দিকে রিয়া স্কুলে চলে গেল এক রাশ অস্হিরতা নিয়ে।
স্কুল থেকে ফিরে এসে রায়নাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।
জ্বরটা সকালে আবার এসেছে।
ইভা বলেছে এগারোটার দিকে এসে রায়নার সাথে থাকবে।
এতক্ষণ মেয়েটাকে একা থাকতে হবে।
আশিক রায়নাকে ফোন করলো।
মেয়েটা জ্বর আর বমি করে কাহিল হয়ে পড়েছে। রিয়া স্কুলে যাওয়ার পরও আবার বমি করেছে। মেয়েটার কত কষ্ট হচ্ছে।
ক্লান্ত গলায় কথা বললো, বাবা তুমি কি একটু আসবে আমার কাছে ?
আশিকের মন খারাপ হয়েগেল।
কিভা