বিচ্ছেদ পর্ব -১৩

#বিচ্ছেদ – ১৩

রায়নার জ্বর প্রচন্ড বেড়েছে।
ওকে হসপিটালে নিতে হয়েছে।
রায়না এখন আই,সি,ইউ তে।
স্কুল থেকে ছুটির আগেই ভিপি ম্যাডামকে বলে চলে আসতে হয়েছিল রিয়াকে।
ইভা ফোন করে কান্না জড়িত গলায় বলেছিল,ভাবী এক্ষুনি বাসায় আসো। রায়নার শরীর বেশী খারাপ হয়ে পড়েছে।
ওকে হসপিটালাইজড করতে হবে।
রিয়া জলদি বাসায় ফিরেছিল ম্যাডামকে বলে।
আশিক খবর পেয়েই চলে এসেছিল।
রায়না জ্বরের ঘোরে ভুল বকছিল।
গা পুড়ে যাচ্ছিল জ্বরে।
আশিক মেয়েকে স্কয়ারে নিতে চেয়েছিল।
রিয়া না করেছিল।
রিয়া বলেছিল, এখন এতো দূরে নিতে গেলে যদি রায়নার অবস্হা আরো খারাপ হয়ে যায় ?
হাইটেক হসপিটাল একদম কাছেই রয়েছে।
এবং এটা বেশ ভাল হসপিটাল।
আশিক কোন কথা না বলে গাড়ী হাইটেকের দিকে ঘুরিয়েছিল।
হাইটেকে আনার সাথে সাথেই রায়নার দ্রুত চিকিৎসা শুরু হয়েছে।
কাফরুলের এই হাসপাতালে বেশীর ভাগ ডাক্তার আর্মির। আর্মির অবসরপ্রাপ্ত এবং চাকুরীরত চিকিৎসকরা সম্মিলিত ভাবে এই হাসপাতালটি গড়ে তুলেছেন।
সামরিক হাসপাতালের মত করেই চালানোর চেষ্টা করা হয়।
খুবই পরিস্কার-পরিছন্ন।
চিকিৎসার জন্য যাবতীয় আধুনিক সুব্যবস্হা ও সুযোগ সুবিধা রয়েছে।
রিয়া প্রয়োজন পড়লে এখানেই আসে।
পেশেন্টকে তারা যথেষ্ট কেয়ার করে।

আই সি ইউ র বাইরে ওয়েটিং রুমে বসে আছে রিয়া। ওরা রায়নাকে নিয়ে দুপুরেই চলে এসেছিল। খবর পেয়ে রাশিক,মামুন এবং রিয়ার বাবা-মা চলে এসেছিলেন।
সবাই রায়নার হট্যৎ এমন গুরুতর অসুস্হ হয়ে পড়ায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে।
রিয়ার মা কাঁদছিলেন।
রায়নাকে তিনি জন্মের পর হাতে করে মানুষ করেছেন। রায়নার জন্য তার অন্য এক মায়া।
আশিক মেয়ের চিকিৎসকার ব্যাপারে খুঁটি নাটি বিষয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলছে।
তাকে খুব অস্হির দেখাচ্ছে।
রায়নার বিভিন্ন রকম চেক আপ করা হবে।
ওর জ্বরটা অস্বাভাবিক রকম বেশী।
১০৫ ডিগ্রি জ্বর মোটেও স্বাভাবিক নয়।
এখন রায়না ঘুমাচ্ছে।
তার শরীরে গ্লুগোজ সেলাইন চলছে।

রাত তিনটার মত বাজে।
সবাই চলে গেছে।
কেউই যেতে চাইছিল না।
রিয়া বলেছে যেতে। কারণ,সবাই মিলে রাত জেগে কষ্ট করে তো লাভ নেই।
আশিক যাবেনা রিয়া জানতো।
তাই সে আশিককে কিছুই বলেনি।
রাশিকও কিছুতেই যাবেনা। অথচ, ওর সকালে অফিস আছে। তাই রিয়া অনেক বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে।
রিয়ার কেমন এক অনুভূতি হচ্ছে।
বুকের ভেতরটা খালি খালি লাগছে।
তার বুক কাঁপছে..
কেন এত কাঁপছে তার বুক ?
রায়নার কিছু হবে না তো ?
রায়না ছাড়া তার তো কেউ নেই..কিচ্ছু নেই !
রায়না তার অক্সিজেন।
রিয়ার মনে হলো তার নিঃস্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
রিয়ার কি একটু শীত লাগছে ?
ওয়েটিং রুমের এসিটা কি বেশী ঠান্ডা করে ফেলেছে রুমটা ?
নাকি রিয়ারই ঠান্ডা লাগছে ?
রিয়া ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে সোফার এক কোনায় বসে আছে।
‘কফি’ শব্দ টা কানে আসতেই রিয়া মুখ
তুলে তাকালো।
আশিক দাড়িয়ে আছে, কফি হাতে।

আশিক কফিটা বাড়িয়ে দিল রিয়ার দিকে।
রিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝালো লাগবেনা।
আশিক সোফার আরেক প্রান্তে বসলো।
বললো, এটা এখন তোমার খুব দরকার।
তোমাকে সুস্হ এবং শক্ত থাকতে হবে।
প্লিজ…
রিয়া হাত বাড়িয়ে কফিটা নিল।
ধরেই থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর,
ছোট ছোট চুমুকে কফি খেতে শুরু করলো।
রিয়াকে খুব অসহায় লাগছে।
রিয়া কি কাঁদছিল এতক্ষণ ?
অসম্ভব শূন্য লাগছে বুকটা আজ আশিকের,
রিয়ার জন্য কষ্ট হচ্ছে।
জীবনে এরকম সব পরিস্হিতি গুলো গত বারো বছর ধরে রিয়া নিশ্চয় একাই সামলে এসেছে। অথচ, কথা ছিল ওরা দু’জন একসাথে সব সামলাবে।
আজ যেমন সামলাচ্ছে। আজকের ঘটনাটা নিতান্তই একটা সংযোগ মাত্র !
আশিক না থাকলে রিয়া নিজেই সব করতো।
এমনকি আজও রিয়া তার কোন সাহায্য চায়নি। আবার আশিককে কোন কাজে বাঁধাও দেয়নি।
আশিক রায়নার সাথে কথা বলে ফোন রাখার দু’ঘন্টা বাদেই ইভার ফোন এসেছিল।
আশিক রায়নাকে বলতে পারেনি তখন, মা আমি এক্ষণি আসছি..
সে চুপ করেছিল। আশিকের চুপ থাকাটা রায়নার কষ্ট নিশ্চয় আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল তখন !
ইভার ফোন পেয়ে উড়ে চলে গিয়েছিল আশিক। রায়না এলোমেলো কথা বলছিল জ্বরের ঘোরে। বমি করেছে আরো কয়েকবার।
ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল রায়নার মুখ।
আশিকের বুকের ভেতর থেকে কান্না ঠেলে উঠে আসছিল তখন, রায়নাকে ওভাবে দেখেছিল।
রহিমা খালা রায়নাকে কোলে করে নীচে নামিয়ে আনতেই আশিক ছোঁ মেরে রায়নাকে কোলে তুলে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠেছিল।
তার ফুটফুটে মেয়েটা একরাতের মধ্যেই কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে।
আশিক সহৃ করতে পারছিলনা।
আশিক এখানে কিছুই তেমন চেনেনা।
গত কিছুদিন যাবৎ ক্যান্টনমেন্টে আসা-যাওয়া করতে করতে কিছুটা চেনা হয়েছে এলাকাটা। কিন্তু এ এলাকার হাসপাতাল, ক্লিনিক সম্পর্কে কিছুই জানেনা। এজন্য শুরুতেই ওর স্কয়ার হাসপাতালের কথা মনে হয়েছিল। তবে রিয়া ওকে হাইটেক হাসপাতালের কথা বলাতে দ্রুত এখানে নিয়ে আসতে পেরেছে।
রায়নার ডাক্তার বলেছে রক্ত পরীক্ষা করে রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত কিছু বলতে পারছেনা।
রায়নার এত জ্বর কেন নামছে না,সেটাই বোঝার চেষ্টা করছেন তারা।
রায়নার গায়েও প্রচন্ড ব্যাথা।
রিয়ার দিকে তাকিয়ে মায়া হলো আশিকের।
বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে রিয়াকে।
চোখে প্রচন্ড আতঙ্ক !
হারাবার ভয়ে অস্হির দু’চোখ।
আশিকের খুব ইচ্ছে হলো রিয়ার পাশে বসে ওর হাতটা ধরে সাহস দিতে।
কিন্তু সম্ভব নয় সেটা। তাই শুধু মুখে বললো,,ভয় পেওনা রিয়া। রায়না ঠিক হয়ে যাবে। একদম ঠিক হয়ে যাবে।
রিয়া বেদনার্ত চোখে ওর দিকে তাকালো।রিয়ার দু’চোখ বেয়ে তখন জল পড়ছে।

সকালে আশিক ও রিয়া আই,সি,ইউ তে গিয়ে রায়নাকে দেখলো।
তার ঘুম ভেঙ্গেছে।
বাবা-মাকে দেখে হাসার চেষ্টা করলো।
আশিক রায়নার মাথায় হাত রাখলো।
রায়না দূর্বল গলায় বললো, বাবা.. আমি জানতাম, তুমি আসবে।
রিয়া শুধু মেয়ের কপালে হাত দিয়ে অস্হির হয়ে উঠলো। এখনো অনেক টেম্পারেচার রায়নার শরীরে।
ডাক্তার বললেন, আজ দুপুরের মধ্যেই ব্লাডের রিপোর্ট পাওয়া যাবে। তখন নিশ্চিত হওয়া যাবে রায়নার ব্যাপারে।
ডাক্তার চিকুন গুনিয়া আসঙ্কা করছেন।
সন্তানের অসুস্হতা আশিক-রিয়াকে অস্হির এবং অসহায় করে তুলেছে।
এই মূহুর্ত্যে রায়নার সুস্হ হয়ে ওঠা ছাড়া ওরা আর কোন কিছুই ভাবছেনা।
নিজেদের সম্পর্কের ব্যক্তিগত দূরত্ব নিয়েও ভাবছে না। ওরা ভাবছে শুধু ওদের সন্তানের সুস্হতার কথা।

রিয়া আরো একটু সহজ হয়েছে আশিকের সাথে। সকালে আশিক রিয়াকে একটু জোর করেই একটা স্যান্ডউইচ আর কফি খাইয়েছে।
রিয়া খেতে চায়নি।
আশিক একটু জোর করেই বলেছে এই সময়ে রিয়ার এভাবে না খেয়ে থাকাটা একেবারেই ঠিক নয়। তাই রিয়ার খাওয়া উচিৎ।
রায়নার জন্যেই সুস্হ থাকা দরকার।
রিয়া মেনে নিয়েছিল আশিকের কথা।
তবে আশিক খেয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করা হয়নি।
রায়নার জ্বর উঠা-নামা করছে।
এটা নিয়েই রিয়ার খুব অস্বস্তি হচ্ছে।
অবশ্য তার কারণও আছে।
কয়েক মাস আগে রিয়ার এক খালাত বোনের ৮/৯ বছরের বাচ্চা মাত্র সাত দিনের জ্বরে মারা গেল। ওটা শুধু জ্বর ছিল না,জ্বরের সাথে মারাত্মক ভাইরাস ওর শরীরে ঢুকে গিয়েছিল। বাচ্চাটার বাবা-মা শুরুতে বুঝতে পারেনি। সাধারণ জ্বর মনে করে চিকিৎসা শুরু করতেই দেরী করে ফেলেছিল। তারপর স্কয়ার হাসপাতালে অনেক চেষ্টার পরও বাঁচানো গেলনা। ভাইরাসটি বাচ্চাটার রক্তে আক্রান্ত হয়েছিল।
প্রতি ঘন্টায় ওর রক্ত দূষিত হয়ে যাচ্ছিল। এবং একটা সময় আর মেডিসিন কাজ করছিল না। বেবীটার রক্ত পরিশুদ্ধ করা যাচ্ছিলনা।
কি কষ্ট ! কি কষ্ট !
এত ছোট একটা বাচ্চা এভাবে চলে গেল !
ওর মা বাঁচবে কিভাবে ?
এবং ওর বাবা স্তব্ধ হয়ে গেল ।
এমন যে হবে সপ্নেও তো ভাবেনি।
রিয়া ওর খালাত বোনের কথা ভাবলেই ভিতরে ভিতরে খুব ভেঙ্গে পড়ে।
রায়নার জ্বর আসার পর থেকে ঘুরে ফিরে এসব কথায় মনে পড়ছে।
না এরকম খারাপ কিছুই হবেনা নিশ্চয় ।
রিয়া নিজেকে বোঝায়।
আশিক রিপোর্ট আনতে গেছে।
রিয়া নিজেই যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আশিক বললো,তুমি এখানেই থাকো। যেকোন সময় রায়নার তোমাকে প্রয়োজন হতে পারে।
আশিক ঠিকই বলেছে। রিয়ার এখানেই থাকা উচিৎ। রায়নার কাছাকাছি।
আসলে সব সময় সব কাজ একাই করতে হয় রিয়াকে। তাই কাজ ভাগাভাগি করে নিলে এত স্বস্তি হয় জানতো না রিয়া।
জানা হয়নি কোনদিন।
আশিক গতকাল থেকে সবকিছুই করছে।
একজন বাবার যা যা করার কথা, তার সবই সে করছে। রিয়া বাঁধা দেয়নি।
আশিক রিপোর্ট নিয়ে এখনো ফেরেনি।
সে ফিরলেই জানতে পারবে সবকিছু।

আশিক রায়নার রিপোর্ট নিতে পাঁচ তলায় এসেছে। রিপোর্টটা নিয়ে এখনই ডাক্তারকে দেখাবে। তাহলে নিশ্চিত হবে রায়নার খারাপ কিছু হয়নি। মনে মনে আশিক বললো, জানপাখি তুমি তাড়াতাড়ি সুস্হ হয়ে উঠো।
তোমাকে এভাবে রেখে দেশ ছাড়বো কেমন করে আমি ?
রিপোর্ট হাতে পেয়ে গেল আশিক।
দোতলায় নেমে এলো।
রিয়াকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলো।
ওরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে।
ভাল করে রিপোর্ট দেখলেন ডাক্তার।
তারপর বললেন,ভয়ের কিছু নেই।
এটা ভাইরাল ফিভার। টেম্পারেচারটা এজন্যেই এত বেশী। ভাইরাল ফিভারেও এরকম টেম্পারেচার হতে পারে।যেকোন সময় জ্বর ছেড়ে যাবে। আর মেডিসিনের কাজ শুরু করতেও তো একটু সময় লাগে। ডোন্ট ওরি !
আশিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।
রিয়া চোখ বন্ধ করে আছে।
ওর সারা মুখে স্বস্তির ছায়া।
অদ্ভুত এক প্রশান্তি নেমে এসেছে ওর মুখে।
সন্ধ্যার পর থেকে রায়নার জ্বর কমতে শুরু করলো। রাত বারোটার পর স্বাভাবিক তাপমাত্রা ফিরে এলো শরীরে।
রায়না তার মাকে খুঁজলো। তার ক্ষুধা পেয়েছে। রিয়া তার জন্য গরম স্যুপ নিয়ে গেল। ইভা সন্ধ্যার পরে এসে রায়নার জন্য চিকেন স্যুপ দিয়ে গেছে।
রায়নাকে বালিশে হেলান দিয়ে বসিয়ে রিয়া যত্ন করে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে।
আশিক রায়নার হাত ধরে পাশে বসে আছে।
দূর্বল ক্লান্ত রায়নাকে খুব সুখী মনে হচ্ছে।
জীবনে প্রথম বাবা-মাকে এভাবে একসাথে কাছে পেয়েছে সে।
আশিক জানতে চাইলো,খুব কষ্ট হচ্ছে মা তোমার ?
মাথা নেড়ে বললো, এতক্ষণ হচ্ছিলো। এখন আর কষ্ট হচ্ছেনা বাবা। তুমি আর মা থাকলে কষ্ট হয়না তো !

পরদিন বেলা বারোটায় রায়নাকে ডিসচার্জ করে দিল। যদিও রায়না খুবই দূর্বল।
তবুও যেহেতু রাত বরোটার পরে আর জ্বর ফিরে আসেনি, তাই ডাক্তার ওকে ছেড়ে দিতে আপত্তি করেননি।
আশিক ওদের গাড়ীতে করে বাসায় পৌছে দিল। মেয়েকে আদর করে বিদায় নেবার সময় রায়না তার হাত ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আস্তে করে বললো, আরো একটু থাকো না, বাবা !
রিয়া মেয়েকে বোঝালো তার বাবার বিশ্রামের প্রয়োজন। গত তিন দিন সে একটুও বিশ্রাম নিতে পারেনি।কাজেই রায়নার মন খারাপ না করে বাবাকে যেতে দেওয়া উচিৎ।
আশিক মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিয়ে আবার তোমার কাছে চলে আসবো।
রায়না আর আপত্তি করেনি।
রায়নাকে চেঞ্জ করিয়ে দিয়ে রিয়া শাওয়ার
নিল। রায়নাকে পাতলা মুরগির ঝোল দিয়ে নরম ভাত খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিল।
রায়নাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে থাকলো
গভীর মমতায় অনেকক্ষণ।
এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো মা-মেয়ে একে অপরের নির্ভরতা হয়ে।

আশিক বাসায় ফিরে শাওয়ার নিয়ে লাঞ্চ করে এক মগ কফি নিয়ে লিভিং রুমে এসে বসলো। বাসায় কেউ নেই এখন মাজেদা খালা ছাড়া। রাশিকের অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। মাজেদা খালা ওর মায়ের আমলের কাজের লোক। বিয়ে হয়েছিল কিন্ত সংসার হয়নি। ওদের সাথেই রয়ে গেছে। বোকা সোজা সরল টাইপের মানুষ মাজেদা খালা। মায়ের সাথে সাথে ওদের তিন ভাই বোনকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে সে।
বয়স হয়েছে খালার তবুও অনেক মমতা দিয়ে এখনো ওদের দেখা শোনা করে। আরো একজন বুয়া এসে অন্যান্য কিছু কাজ করে দিয়ে যায়। রান্নাটা খালা নিজে করে।
মায়ের কাছ থেকে সবকিছু শিখেছিল, তাই রান্নাটা খুব ভাল করে।
ওদের জন্য অসম্ভব মমতা তার।
ওদের উপর দাবীও অনেক বেশী।
রায়নার অসুস্হতার কথা শোনার পর থেকে
একা একাই বক বক করছে।
মাজেদা খালার সব কথা এখন আল্লাহ্ র সাথেই হয়। এত এত অভিযোগ সারাদিনে সে আল্লাহ্ র কাছে করে। সব অভিযোগের উত্তরও চাই তার।
আশিকের এই অবস্হা.. রাশিক এখনো বিয়ে করেনি। এসব নিয়েও তার হাজারটা অভিযোগ। আশিক কেন এসব ঠিক করে না?
সে বড় ভাই, এসব দায়িত্ব তো তারই।
আশিক কোন উত্তর দেয়না। রাশিক হাসে আর বলে, সময় মত সব হবে।

কফি শেষ করে আশিক নিজের রুমে আসলো। গত তিনদিনের মেইল চেক করা হয়নি। মেইল চেক করতে বসলো।
নীলার নামটা দেখে চমকে উঠলো আশিক !
গত প্রায় এক বছর নীলার সাথে ওর কোন যোগাযোগ নেই।
সম্পর্কটা তো শেষ হয়ে গেছে।
এখন শুধু কাগজে-কলমে শেষ হতেই বাকী।
সেটারও খুব বেশী দেরী নেই !
তাহলে নীলা কেন মেইল করলো তাকে ?
আশিক ল্যাপটপ বন্ধ করলো।
নীলার মেইলটা পড়তে ইচ্ছে করছে না এখন।
ওর মন পড়ে আছে রায়নার কাছে।
মেয়েটা আসার সময় ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
আশিকের কষ্ট হচ্ছে রায়নার জন্য।
মেয়ের কাছে যেতে হবে কিন্ত রিয়ার বাসায় যাবে কিভাবে ?
সে তো এখন পর্যন্ত রিয়ার বাসায় যায়নি।
রিয়াও যেতে বলেনি।
রিয়ার বাসার নিচ থেকেই চলে আসে।
মেয়েটার সাথে বাকী কয়েকটা দিন একটু বেশী করে সময় কাটাবে ভেবেছিল।
কিন্তু এখন রায়নার শরীর এত দূর্বল যে ওকে বেশী নড়া চড়া করানো ঠিক হবে না।
আর মাত্র তিনদিন পরেই ফিরে যেতে হবে আশিক কে। আরো কিছুদিন মেয়েটার সাথে থাকতে পারলে ভাল হত।
রায়না এমন অসুস্হ হয়ে পড়বে কে ভেবেছিল ?
আশিক সন্ধ্যার সময় বের হলো রিয়ার বাসার উদ্দেশ্যে। রিয়া একটা ছোট্ট মেসেজ করেছে তার মোবাইলে, “রায়না তার বাবার জন্য অপেক্ষা করছে।”
তার মানে রিয়ার আপত্বি নেই রায়নাকে দেখতে ওর বাসায় গেলে।
আসলে আশিক একেবারেই রিয়াকে বিব্রত করতে চায়নি। নিজেও বিব্রত হতে চায়নি।
তাই রিয়ার বাসায় যাওয়ার কথা মাথায় আনেনি। কিন্তু বর্তমান পরিস্হিতিই এমন দাড়িয়েছে যে এছাড়া কোন উপায় নেই।
রায়নার জন্য কেক আর ফ্রুটস কিনলো আশিক। কেক হয়তো এখন খেতে পারবে না তবুও দেখলে নিশ্চয় খুশী হবে !

রায়না বাবাকে পেয়ে প্রচন্ড খুশী হয়ে উঠেছিল। কেক দেখে আশিককে জড়িয়ে ধরে বলেছে,বাবা আমি খুব হ্যাপি।
নিজ হাতে একটু ফ্রুটস খাইয়ে দিয়েছে।
আশিক ঘন্টা দুয়েক রায়নার সাথে কাটিয়ে বাড়ী ফিরেছিল।
রিয়া একবার শুধু সামনে এসেছিল।
ভদ্রতা করে দেখা করেই চলে গিয়েছিল ভিতরে।
স্কুলের অনেক খাতা দেখা জমে আছে, সেগুলো দেখছে বলে ভিতরে চলে গেল।
আর আসেনি সামনে।
তবে আশিকের জন্য ব্লাক কফি বানিয়ে রহিমা খালার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
কফিতে চুমুক দিয়েই আশিক বুঝতে পেরেছিল এটা রিয়ার হাতের কফি !
কিইবা করার ছিল রিয়ার ?
রহিমা খালা নিশ্চয় স্ট্রং ব্লাক কফি বানাতে পারতো না ?
তাই রিয়া বাধ্য হয়েই হয়তো আশিকের জন্য কফি বানিয়েছে।
বারো বছর পর.. তোমার হাতের কফি !
থ্যান্কস রিয়া.. কফির জন্য।
আশিক মনে মনে বলল।
রিয়া এত বদলে গেছে ভাবেনি আশিক।
সবচেয়ে যেটা চোখে পড়ার মত পরিবর্তন সেটা হলো, ইগো র লেশমাত্র নেই রিয়ার ভেতর।
রিয়া অনেক সহনশীল হয়েছে।
তবে আত্মসম্মান বোধ পুরোমাত্রায় আছে।
আশিক নিজেও কি যথেষ্ট বদলায়নি ?

আশিক ল্যাপটপ ওপেন করে নীলার মেইল
পড়তে শুরু করলো….
ধীরে ধীরে আশিকের চোয়াল শক্ত হয়ে
উঠলো।
পুরো মেইল শেষ করত পারলো না আশিক।
ঘৃনায় ওর সমস্ত শরীর রি রি করে উঠলো…

(চলবে..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here