বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব – ২৭+২৭

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২৭
জাওয়াদ জামী

শিউলি আক্তার ডুকরে কাঁদছে। সে ভাবতেই পারেনি তার স্বামীর সাথে এমন কিছু হবে। কায়েসের সাথে যেতে পারেনি বলে তার আফসোসের অন্ত নেই।
শিহাব মায়ের থেকে একটু দূরে বসে আছে। ওর চোখেও পানি। মনে একটাই চিন্তা হানা দিচ্ছে, আব্বু সুস্থ হবে তো?

সারাটা রাস্তা কুহু কাঁদতে কাঁদতে যায়। কায়েস ঘুমাচ্ছে। তাহমিদ সকালে কোন একটা ঔষধ দিয়েছিল, যার প্রভাবে ব্যথা কম অনুভব করছে এবং সেই সাথে ঘুমাচ্ছে।

মধ্য দুপুরে ওরা মেডিকেলে পৌঁছায়। তাহমিদ পূর্বেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল, তাই কায়েসকে ভর্তি করতে কোন ঝামেলা হয়না। ওরা মেডিকেলে পৌঁছানোর খানিক পরেই তাহমিনা আক্তার হাজির হন সেখানে৷
কায়েসকে ভর্তির পর ডক্টর আসলেন। যিনি তাহমিদের শিক্ষক। তিনি সকল পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে জানালেন, বুকের তিনটা হাড় ভেঙে গেছে। গত কয়েকদিন থেকে চিকিৎসার অভাবে সেখানে ইনফেকশন দেখা দিয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে অপারেশন করা প্রয়োজন। তাহমিদ বড়মার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় অপারেশনের। ডাক্টরকে ওদের সিদ্ধান্ত জানালে, তিনি জানান আগামীকাল দুপরেই অপারেশন করবেন।

কুহু বারান্দায় বসে কাঁদছে। ওর পাশে তাহমিনা আক্তার বসে আছে। ফুপু কথা বলছে ডক্টরের সাথে। এমন সময় তাহমিদ সেখানে আসে। কুহুর সামনে এক গ্লাস পানি বাড়িয়ে দেয়। কুহু তাহমিদের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি দেয়। ওর তো পিপাসা লাগেনি! তবে তাহমিদ কেন ওকে পানি দিচ্ছে!
” জলদি খেয়ে নাও। এখানে স্যালাইন গুলিয়ে এনেছি। সারাটা রাস্তা যে হারে কেঁদেছ, আমি ভয়ই পেয়েছিলাম। শরীর থেকে প্রচুর পানি বেরিয়ে গেছে, না জানি রাস্তায়ই কিছু একটা ঘটে যায়। ভাগ্য ভালো তেমন কিছুই হয়নি। এখন স্যালাইন না খেলে দেখা যাবে, ডিহাইড্রেশন হয়ে বাপ-মেয়ে একসাথে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছ। তারাতারি খেয়ে নাও। তোমার এখন সুস্থ থাকা জরুরি। তাছাড়া যে ত্যা’ড়া মেয়ে তুমি, বাপের সেবা করতে দিলেও, নিজের বিষয়ে আমাকে নাক গলাতে দিবেনা, তা ভালোই জানি। ” তাহমিদের কথা শুনে কুহু বিরাট ঝটকা খায়। এই মানুষটা বলে কি! এর মাথার তার ছেঁ’ড়া নাকি!
” আহ, তাহমিদ কি শুরু করেছিস এসব! এখন মেয়েটার পেছনে না লাগলেই কি নয়? দেখছিস ও এমনিতেই বাবার চিন্তায় অস্থির। তার ওপর তুই ওকে খোঁ’চা’চ্ছি’স? ”
” তুমি আর ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলনা মা। এই মেয়ে এমনিতেই যে ত্যা’ড়া, এরপর তোমার সাপোর্ট পেলে ইন্টারন্যাশনাল ত্যা’ড়া কমিটির সভাপতি হিসেবে নিয়োগ পাবে। এখন এই স্যালাইনটুকু ওকে খেতে বল৷ আর বেশি চিন্তা করতে নিষেধ কর। ওর বাপের কিছুই হবেনা। এ যাত্রায় তার লাইফের লাইসেন্স রিনিউ হলো। তবে আরে একটা দিন দেরি হলেই টপকে যেত। ”
কুহু যতই তাহমিদের কথা শুনছে ততই ওর মাথা ঘুরাচ্ছে। কি অবলীলায় কঠিন কথাগুলো বলছে, এই অ’স’ভ্য ছেলে।
” আন্টি, তোমার ছেলেকেই তার আনা স্যালাইন খাওয়াও। বকবক তো কম করলোনা। এখন এই স্যালাইন তারই প্রয়োজন। ” কুহু রে’গে একসা।
তাহমিদ ওর রা’গ দেখে হাসছে। এই মেয়ে রা’গ’তেও জানে!
” তাহমিদ, তুই যাবি? তুই কি বলতো? আমি তোকে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি! ”
” অবাক পরেও হতে পারবে। এখন ওকে এটা খেতে বল। আর সে যদি কথা না শোনে, তবে আমি ওকে জোর করে খাওয়াব বলে দিলাম। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, অনেক লোকজন হাঁটাহাঁটি করছে। এত মানুষজনের সামনে যদি, ওকে সত্যিই জোর করে! এই ভেবেই কুহু তাহমিদের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়েই ঢকঢক করে পান করে গ্লাসের সবটুকু স্যালাইন পানি। এরপর খালি গ্লাস এগিয়ে দেয় তাহমিদের দিকে।
তাহমিদ গ্লাস নিয়ে মুচকি হেসে প্রস্থান করে। কারন ও জানত, ও যদি এভাবে কথা না বলত তবে কুহু কিছুতেই খেতোনা। গতকাল থেকেই মেয়েটা কেঁদেকেটে বুক ভাসাচ্ছে। ওকে দেখেই বোঝা যায়, অনেক দূর্বল হয়ে গেছে।

সন্ধ্যা থেকেই ওদেরকে মেডিকেল থেকে বাসায় যেতে তাড়া দিচ্ছে তাহমিদ। আফরোজা নাজনীন ভাইকে রেখে কিছুতেই যেতে চাচ্ছেননা। আর কুহুও বারবার বলছে, বাবার কাছেই থাকবে
এদিকে সেই সকাল থেকে ওরা না খাওয়া। তাহমিনা আক্তার দুপুরে আসার সময় খাবার আনতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার শ্বাশুড়ির কথায় আনেননি। তিনি বলেছিলেন, ওরা আসছে এরপর কোথায় কোথায় দৌড়াতে হবে। খাবার খাওয়ার সময় পাবেনা। হয়েছেও তাই। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে তারা ঝামেলামুক্ত হন। তাই এখন তাহমিদ ওদের বাসায় পাঠাতে চাচ্ছে। কিন্তু কেউই রাজি নয়।
” বড়মা, তোমরা চলে যাও। আমি আজ রাতে মেডিকেলে থাকব। এমনকি আমাদের ক্লাসের অনেকেই আজ এখানে থাকবে৷ আমরা মামার খেয়াল রাখতে পারব। তুমি বরং বাসায় গিয়ে রেষ্ট নাও। অনেক ধকল গেছে তোমার ওপর। কাল সকালে আবার আসবে। আমি আর একটা কথাও শুনতে চাইনা। তোমরা এখনই যাবে। ”
” বাপ, ওর যদি কিছু প্রয়োজন হয়, কিংবা ক্ষুধা লাগে। তখন ওকে কে দেখবে? আমি বরং থাকি। কুহু আর তাহমিনা বাসায় যাক। ”
” না ফুপু, আমিও তোমার সাথে থাকব। বাবাকে এভাবে রেখে আমি যাবনা। ”
” এই মেয়ে, তুমি শুনতে পাওনি আমি কি বলেছি? তোমরা কেউই এখানে থাকতে পারবেনা। আমি এখানে থাকব, বুঝেছ? তাছাড়া কাল তোমার ক্লাস নেই? কোচিং নেই? তুমি ক্লাস করে এখানে আসবে এবং কোচিংয়ের আগেই ফিরে যাবে। আমার কথার ওপর যদি আর কিছু বলেছ, তবে ঠাঁ’টি’য়ে একটা দিব। বড়মা তোমরা বাসায় যাও। আর একটা কথা বলবেনা। ”
তাহমিদ রেগে গেছে বুঝতে পেরে আফরোজা নাজনীন আর কিছুই বলেননা। ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, নার্সদের কাছে তাকে দেখতে বলে বেরিয়ে আসেন কেবিন থেকে।
” মা, ওকে দেখে রেখ। বাসায় নিয়ে যেয়ে খাইয়ে দিও। ও সকাল থেকেই না খেয়ে আছে। ”
” আমি জানি বাসায় যাওয়ার পর কি করতে হবে। কত দ্বায়িত্ববান হয়ে গেছে আমার ছেলে! যে ছেলে কখনো মা খেয়েছে কিনা তা জিজ্ঞেস করেনি! আর আজ সেই ছেলেই আরেকজনের কথা ভাবছে! ” মুচকি হেসে বললেন তাহমিনা।
” প্লিজ মা, তুমি অন্তত এভাবে বলোনা। আমরা ছাড়া ওর কে আছে। ওর ভালোমন্দ আমাদেরই দেখতে হবে। ”
” হয়েছে, হয়েছে। একটু আগেই যে ধমকটা দিলি, এরপর ওকে পাওয়ার আশা বাদ দে। এমন ভাবে কথা বলিস, যেন মুখে নিমপাতার রস লেগে আছে। একটু ভালো করে কথা বলতে পারিসনা? এমনিতেই মেয়েটা চিন্তায় পা’গ’ল হয়ে আছে। এরমধ্যে তুই শুধু ওকে ধ’ম’কা’স। আচ্ছা শোন, বাসায় যাবিনা? তুই কি খাবিনা? সকাল থেকেই এভাবে আছিস, ফ্রেশ হতে হবেনা? তুইও বাসায় চল। গোসল সেরে, খেয়েদেয়ে আবার আসবি। ”
” স্যারকে না বলে আমি যেতে পারবনা, মা। আচ্ছা তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি বড়মাকে ডাকছি। স্যারের সাথে কথা বলে দেখছি উনি কি বলেন। ”
তাহমিদ ফোন করে বড়মার কাছে। তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন তাহমিনার। তাহমিদে ওর বড়মাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে। এরপর সোজা যায় স্যারের কাছে। তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মা, বড়মা আর কুহুকে নিয়ে বাসায় আসে।
বাসায় এসে যে যার রুমে যায়। কুহু আসে সিক্তান রুমে। সিক্তার কাছ থেকে একটা থ্রি-পিস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে।
গোসল সেরে ওরা নিচে আসে। তাহমিনা আক্তার খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তাহমিদ, কুহু আর আফরোজা নাজনীন একসাথে খেতে বসে। খাওয়া শেষে তাহমিদ বেরিয়ে যায় মেডিকেলের উদ্দেশ্যে।

শরীর ক্লান্ত থাকায় কুহু শোওয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পরে। আফরোজা নাজনীনেরও একই অবস্থা। আজ তিনি কুহুকে নিজের সাথে রেখেছেন। সানাউল রাশেদিন দেশের বাইরে গেছেন কিছুদিনের জন্য।

সকালে খাবার খেয়েই আফরোজা নাজনীন মেডিকেলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তার সাথে কুহুও আছে।
কুহুকে মেডিকেলে দেখা মাত্রই তাহমিদের মাথা গ’র’ম হয়ে যায়। এই মেয়েকে সে ক্লাস শেষে আসতে বলেছিল, আর সে কিনা সকালেই এসে হাজির। ওর ইচ্ছে করছে কুহুকে আচ্ছামত ধো’লা’ই করতে। কিন্তু বড়মা থাকায় কিছু বলতে পারছেনা।
কায়েসের বুকের ব্যথা আগের থেকে কম। কিন্তু তিনি ভালোমত কথা বলতে পারছেননা। আফরোজা নাজনীন ভাইয়ের পাশে বসে আছেন।
ডক্টর এসে চেক-আপ করছেন। একটা নার্স কুহু আর আফরোজা নাজনীনকে বাইরে যেতে বললে তারা বাইরে এসে দাঁড়ায়। এমন সময় শিউলির নম্বর থেকে ফোন আসে আফরোজা নাজনীনের ফোনে। তিনি ফোন রিসিভ করে একটু ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ান ।

” তুমি একা দাঁড়িয়ে আছ কেন? বড়মা কোথায়? ” তাহমিদ জিজ্ঞেস করল কুহুকে।
” ফুপু ফোনে কথা বলছে। ”
” তোমাকে সকালে এখানে আসতে নিষেধ করেছিলাম। ক্লাস করে আসতে পারতে। ”
” বাবাকে এ অবস্থায় রেখে ক্লাসে মন বসবেনা। ”
” পরীক্ষার আর বেশি দেরি নেই। তুমি এখানে থাকলেও কিন্তু কোন লাভ নেই। আর ক্ষতিটাও তোমারই হচ্ছে। আমি মামার খেয়াল রাখতে পারব। আর নার্সদেরও বলে দিয়েছি। তারা তাদের সাধ্যমত মামার খেয়াল রাখবে। তুমি ক্লাস আর কোচিং মিস দিওনা। এখান থেকে সোজা হোস্টেলে যাবে। তোমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাসায় যাবে। সেখান থেকেই ক্লাস কর। আমি বড়মাকে বলে দিব। ” তাহমিদের কথার মাঝে অধিকারবোধ দেখে অবাক হয় কুহু।
এই মানুষটার মন বোঝা দায়। এই রা’গ তো এই স্বাভাবিক।
” আমি হোস্টেল থেকেই যাতায়াত করতে পারব। ” কুহুর বলতে দেরি, কিন্তু তাহমিদের রা’গ’তে দেরি হয়না।
” আবার ত্যা’ড়া’মি করছে দেখ! এই মেয়ে, তোমার কি ত্যা’ড়া লগ্নে জন্ম? নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছ, আমি যা বলব তার বিপরীতে যাবে তুমি? হোস্টেল থেকে যখনতখন বের হতে দিবে তোমাকে! নাকি সাহস খুব বেশি বেড়েছে? শুধু তুমি বলে আমি তোমার সব ত্যা’ড়া’মি সহ্য করছি। অন্য কেউ হলে, তার গাল লাল করে দিতাম। ”
” আপনি এভাবে রিয়্যাক্ট করছেন কেন! অন্য কারও সাথে তো এমনভাবে রা’গে’ন’না। শুধু আমার সাথেই রা’গ করেন কেন? ”
” আল্লাহ, আমাকে উল্টো প্রশ্ন করছে! মুখে মুখে কথাও বলছে আবার! এখন দেখছি আগেই ভালো ছিল এই মেয়ে। ”
” আমি আগে কিংবা এখন সবসময়ই ভালো ছিলাম, আছি, থাকব। ” সাহস করে বলে ফেলে কুহু।
” মাফ কর আমাকে। তোমার যা ইচ্ছে তাই কর। ” দুই হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলে তাহমিদ। আর দুপদাপ পা ফেলে কোথাও চলে যায়।
কুহু নিজের আচরণে নিজেই অবাক হয়ে গেছে। ও কিভাবে তাহমিদের মুখের ওপর কথা বলল! এত সাহস হয়েছে ওর!

বিঃদ্রঃ গত কয়েকদিন থেকে হাসবেন্ড ভিষণ অসুস্থ। তাকে সময় দিতে যেয়ে, লিখার সময় পাচ্ছিনা। এবং পার্টগুলোও ছোট হচ্ছে। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমি সকলের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী।

চলবে…#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২৮
জাওয়াদ জামী

কায়েসের অপারেশন চলছে। বাইরে কুহু, আফরোজা আর তাহমিনা অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। তাহমিদ ওটির ভেতরে আছে।
আফরোজা নাজনীন একমনে আল্লাহকে ডাকছেন।
কুহু স্থির হতে পারছেনা। চিন্তায় ওর হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। অনবরত দোয়া ইউনুস পাঠ করছে। তাহমিনা আক্তার কুহুর কাছাকাছি থাকছেন।
” কুহু মা, এত টেনশন করিসনা। দেখবি তোর বাবা ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবে। তুই একটি বস তো। এভাবে অস্থির হলে, তোর একটা কিছু হয়ে যাবে। তুই এই চেয়ারটায় বস। ”
” আন্টি আমার কিছুই ভালো লাগছেনা। কেমন যেন পা’গ’ল পা’গ’ল লাগছে। ”
” এভাবে বলিসনা, মা। তু… ” তাহমিনা আক্তার কথা শেষ করতে পারলেননা। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে সেখানে আসেন শাহনাজ সুলতানা। আনান পরিক্ষা শেষ করে বাসায় যাওয়া মাত্রই তিনি মেডিকেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন।
ফুপুকে দেখেই কুহুর ঠোঁট ভেঙে কান্না শুরু করে। তিনিও পরম মমতায় কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। কারো মুখে কোন কথা নেই। সবারই চোখ অপারেশন থিয়েটারের দরজার দিকে।

দীর্ঘ তিন ঘন্টা পর অপারেশন শেষ হয়। ডক্টর কায়েকসে নিবিড় পর্যবেক্ষনে রেখেছেন। চব্বিশ ঘণ্টা পর তাকে কেবিনে শিফট করা হবে। কায়েসের জন্য নির্ধারিত কেবিনে সবাই উৎকন্ঠা নিয়ে বসে আছে। নাজমা পারভিনও একটু আগেই এসেছেন। তিনি একজন মহিলাকে নিযুক্ত করেছেন, তার শ্বশুরকে দেখার জন্য। তিন দিনের জন্য শ্বশুরের দ্বায়িত্ব তার কাছে দিয়েই তবে তিনি ঢাকায় এসেছেন। তিন বোন মিলে এই কাঁদছেন, তো এই হা হুতাশ করছেন। আবার মাঝে মাঝে কুহুকে শান্তনা দিচ্ছেন, আদর করছেন। দুপুর গড়িয়ে শেষ বিকেলের প্রহর এসেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ কিচ্ছুটি মুখে তোলেননি। তাহমিনা আক্তার বাসা থেকে খাবার এনেছেন, কিন্তু কেউই সেই খাবারে হাত দেয়নি। তিনি অনেকে সেঁধেও কাউকে খাওয়াতে পারেননি। অগত্যা নিরুপায় হয়ে বসে বসে তিন বোনের কান্না দেখছেন।
রাতে তারা তিন বোন মেডিকেলে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগেই তাহমিনা বাসায় ফিরে গেছেন। অসুস্থ শ্বাশুড়িকে রেখে তিনি আর মেডিকেলে থাকার সাহস করেননি। আবার বাসায় গিয়েই রাতের খাবার করতে হবে। এখানে পাঠাতে হবে। তিনি বাসায় গিয়ে রান্না করেই ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়েছেন। তাহমিদ সেই গাড়িতেই বাসায় ফিরবে। তাই আফরোজা নাজনীন কুহুকে বললেন, তাহমিদের সাথে বাসায় যেতে। তারা তিনবোন এদিকটা সামলে নিবেন। কুহুও আর দ্বিরুক্তি না করে তাহমিদের সাথে বেরিয়ে আসে।
মেডিকেল থেকে বাসার দূরত্ব এক ঘন্টা। কুহু গাড়িতে উঠে বসতেই, তাহমিদ ওকে সিট বেল্ট বাঁধতে বলে। কিন্তু কুহুর আজ তাহমিদের কাছে শোনার মুড নেই। তাই শুনেও না শোনার ভান করে বসে থাকে। এদিকে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। তাহমিদ দেখল কুহু সিট বেল্ট বাঁধেনি, তাই বাধ্য হয়েই ও সিট বেল্ট বাঁধতে গেলেই কুহু অসম্মতি জানায়।
” ধন্যবাদ, আমি এভাবেই যেতে পারব। ”
” সাধে তো আর তোমাকে ত্যা’ড়া বলিনা। এই মেয়ে যার কপালে জুটবে, তার জীবনটা তেজপাতা করে ছাড়বে। সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি।
হয় নিজে বেল্ট বাঁধবে, নয়ত আমি বেঁধে দিব। কথা ক্লিয়ার? আমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুণব, এর মধ্যে বেল্ট না বাঁধলে আমার জন্যই সুবিধা। ” তাহমিদ গুণতে শুরু করার আগেই কুহু ঝটপট বেল্ট বেঁধে নেয়। ও মোটেও চায়না তাহমিদ সিট বেল্ট বেঁধে দিক।

কিছুদূর আসতেই তাহমিদ ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে। ড্রাইভার গাড়ি থামালে তাহমিদ নেমে কোথাও যায়। অনেকক্ষণ পর
পর দু হাতে কয়েকটা পলিব্যাগ আর শপিংব্যাগ ঝুলিয়ে আসে। দেখে বোঝাই যাচ্ছিল, ব্যাগগুলোতে কিছু আছে। একটা ব্যাগ ড্রাইভারকে দিয়ে, পেছনে কুহুর পাশে এসে বসে।
গাড়ি চলতে শুরু করলে, তাহমিদ একটা ব্যাগ থেকে কয়েকটা চকলেট আর চিপস বের করে কুহুকে দেয়। আরেকটা শপিংব্যাগ ধরিয়ে দেয় কুহুর কাছে।
” কি আছে এতে? আর আমাকে দিচ্ছেন কেন? ”
” বাসায় যেয়ে দেখ, কি আছে। কিন্তু দয়া করে সিক্তাকে দেখিওনা। ওর জন্যও একটা ব্যাগ আছে । ”
” কিন্তু আমি এটা নিতে পারবনা। আপনি বরং এগুলো সিক্তাকেই দিন। ”
” এমনিতেই তো আর ত্যা’ড়া বলিনা! তুমি কি বাচ্চা? কিছুই বোঝনা? অবশ্য যে বুঝেও না বোঝার ভান করে, তাকে কিছুতেই বোঝানো যায়না। বাই দ্য ওয়ে, তোমার নিতে ইচ্ছে না করলে ফেলে দিও। কিন্তু এখনতো চিপস, চকলেট খাও। এগুলো অনন্ত ফেলোনা। ”
কুহু ঠোঁট টিপে হাসে। ও ইদানীং লক্ষ্য করেছে এই মানুষটাকে রাগাতে বেশ লাগে। সে রেগে গেলে কপালের মাঝখানের নীলচে দুইটা শিরা ফুলে উঠে। যা দেখতে কুহুর কাছে আকর্ষনীয় লাগে।
কুহু আনমনে চিপসের প্যাকেট খুলে চিপস মুখে পুরতে থাকে।
” এই মেয়ে দেখছি, মিনিমাম ফর্মালিটিও জানেনা! পাশে কেউ বসে থাকলে তাকেও যে অফার করতে হয়, এটাও কি শিখিয়ে দিতে হয়! ” কুহুর ফর্মালিটির আশায় না থেকে তাহমিদ প্যাকেট থেকে কয়েকটা চিপস নিয়ে খেতে শুরু করে।
” আমার সাথে আপনার কি শ’ত্রু’তা, আমি ভেবে পাইনা! আমার জন্য এসব আনতে পারলে, নিজের জন্য নিতে দোষ কোথায়! এভাবে অন্যের থেকে কিছু নেয়া মোটেও ঠিক নয়। ” কুহু পানসে মুখে জবাব দেয়।
” প্রথমত, তোমার সাথে আমার কোন শ’ত্রু’তা নেই। শ’ত্রু’তা তোমার চালচলন, আচার আচরণের সাথে। দ্বিতীয়ত, আমি মোটেও অন্যের কাছ থেকে কিছুই নিচ্ছিনা। নিচ্ছি নিজের মানুষের কাছে থেকে। যে আমার একান্ত আপনজন। তার ওপর আমার ষোলআনা অধিকার আছে। অবশ্য এসব তোমাকে বলে লাভ নেই। তোমার গো’ব’র ভর্তি মাথায় এসব ঢুকবেনা। ”
” আমার ঠ্যাকা পরেনি, আপনার এসব ফালতু কথা বোঝার। আপনার কথা আপনিই বুঝে, গিলে খান। ”
” শোন মেয়ে, বেশি কথা বলোনা। আজকাল একটু বেশিই কথার তুবড়ি ছুটছে তোমার মুখে৷ আমি কিছু বলছিনা মানে এই নয়, যে ভবিষ্যতেও কিছু বলবনা। এটা বেশ বুঝতে পারছি, ভবিষ্যতে কঠিন শা’স্তি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ”
” আপনি আমাকে শা’স্তি দিবেন! আপনি শা’স্তি দেয়ার কে! আমার মুখ আর আমিই কিছু বলতে পারবনা! কত খা’রা’প মানুষ চিন্তা করা যায়! ”
” না, তুমি কিছুই বলতে পারবেনা। আর আমি কে, এটা কিছুদিন পরই বুঝতে পারবে। তবে আই সয়্যার, তোমাকে শা’স্তি দিতে আমার মোটেও খা’রা’প লাগবেনা। আমি আবার খা’রা’প মানুষ কিনা। তাই প্রতিদিনই চাইব তুমি অ’প’রা’ধ কর, আর আমি শা’স্তি দিব। ” তাহমিদের কথা শুনে কুহুর একটা শিরশিরে অনুভূতি বুকের মাঝে উথালপাতাল করছে। এই ছেলে এমনভাবে কথা বলে কেন! একটুও লজ্জাশরমের বালাই নেই।
দুজনের খুনসুটির মাঝেই গাড়ি এসে দাঁড়ায় ‘কুঞ্জছায়া’র গেইটে। তাহমিদ গাড়ি থেকে নেমে, দরজা খুলে দেয়। কুহু বের হয়ে আসলে ওর হাতে শপিংব্যাগ ধরিয়ে দেয়।
কুহু হাঁটতে শুরু করলে, তাহমিদ জোড় কদমে ওর পাশে আসে।
” রাত দশটার পর একবার ছাদে এসো। আমি অপেক্ষা করব। তবে তার আগে দেখবা ব্যাগে কি আছে। ”
” পারবনা। ” কুহুর সোজা উত্তর।
” অলরাইট, আমি কাউকে জানাতে চাচ্ছিলামনা। কিন্তু তুমিই সবাইকে জানানোর জন্য উৎসাহিত করলে। এরপর আমি তোমাকে ধরে বেঁধে ছাদে নিয়ে গেলে, পরে আমাকে দোষ দিতে পারবেনা। ”
কয়েকধাপে তাহমিদ পৌঁছে গেছে মেইন গেইটে। কলিংবেলে চাপ অপেক্ষা করছে গেইট খোলার।

তাহমিনা আক্তার ওদের জন্য টেবিলে খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন। আয়েশা সালেহা আগেই খেয়ে শুয়ে পরেছেন। তার শরীরটা কয়েকদিন থেকে ভালো যাচ্ছেনা। কুহু মেডিকেল থেকে এসে গোসল সেরে একটু বসেছে। শরীরটা বেশ ক্লান্ত।
তাহমিদ গোসল সেরে নিচে এসে দেখল কেউ আসেনি খেতে। তাই ও নিচ থেকেই সিক্তার নাম ধরে ডাকতে শুরু করে। ভাইয়ের ডাক শুনে সিক্তা আর কুহু নিচে আসে।
ওদের তিনজনের খাওয়া হলে তাহমিনা আক্তার খেয়ে নেন। এরপর যে যার রুমে আসে। তবে কুহু দিদুনের কাছে যায়। ও দিদুনের কাছেই ঘুমাবে। সিক্তা চাচ্ছিল কুহু তার সাথে ঘুমাক। কিন্তু কুহু বলেছে দিদুন অসুস্থ তাই তার কাছেই থাকবে। বাধ্য হয়ে সিক্তা রাজি হয়।

রাত দশটা বেজে ত্রিশ। তাহমিদ ছাদে কুহুর জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু কুহুর আসার কোন নামই নেই। অথচ একবারের জন্যও তাহমিদ ধৈর্য্য হারায়না। সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়।

কুহু শপিংব্যাগ নিজের কাছেই রেখেছে। খেয়ে এসে শুয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওর ঘুম আসছেনা। আবছা আলোয় ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখল সাড়ে দশটা বাজে।
” তাহমিদ ভাইয়া, কি আমার জন্য ছাদে অপেক্ষা করছে! এতরাতে ছাদে যাওয়া কি ঠিক হবে? ” নিজেই নিজেকে সুধায়। কিন্তু উত্তর না পেয়ে উঠে বসে। খানিক পর শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। কোনায় থাকা চেয়ারের দিকে এগিয়ে যায়। চেয়ারটা আলোর দিকে টেনে নিয়ে বসে পরে। শপিংব্যাগের মুখ ফাঁকা করে দেখার চেষ্টা করে৷ এরপর হাত গলিয়ে দেয় ব্যাগের ভেতর। হাতে উঠে আসে আরেকটা ছোট ব্যাগ। সেটা খুলে দেখল কালো কাঁচের চুরি, আবার ভেতরে হাতে দিলে পায় একটা কালো হিজাব, দুইটা থ্রিপিস, এরপর একে একে আলতা, কালো টিপ, আর বেলি ফুলের মালা পায়। আর সবশেষে পায় একটা চিরকুট। সেখানে লিখা আছে,
” আমার শ্যামাঙ্গীনিকে যেকোন সাজেই মায়াবতী লাগে। আমার বহুদিনের সাধ শ্যামাঙ্গীনিকে একবার খোঁপায় বেলিফুলের মালা, কপালে কালো টিপ, হাতে কাঁচের চুরি আর আলতা রাঙ্গা পায়ে দেখি। তার পরনে থাকবে কালো জামদানী শাড়ি। কিন্তু আজ তাড়াহুড়োয় শাড়ি কিনতে পারিনি। এজন্য আমি অতিব দুঃখ প্রকাশ করছি।
আমার শ্যামাঙ্গীনি কি আজকে আমার সাধ পূরন করবে? তবে কথা দিচ্ছি, একদিন আমার আলমারি ভর্তি কালো জামদানী থাকবে। যেগুলোর মালকিন থাকবে একমাত্র আমার শ্যামাঙ্গীনি। ”
চিরকুটটা পড়ে কুহুর হাত-পা কাঁপছে। এসব কি লিখেছে মানুষটা! এতই যদি ভালোবাসা তবে সেদিন কেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল? তবে নানান ঘাত-প্রতিঘাতের পর এবার ও একটু প্রশান্তি চায়। চায় একজন যত্নবান পুরুষ। যে পুরুষের ছায়ায় সে নিরাপদে থাকবে। যে পুরুষের মাঝে নিজেকে হারাবে। যার ভালোবাসায় পূর্ণ হবে। সেই ছায়া সে তাহমিদের মাঝে দেখেছে। দেখেছে একজন পুুরুষ কতটা দ্বায়িত্ববান হতে পারে। অন্যের বিপদে কিভাবে ঝাঁপিয়ে পরতে পারে। সকলকে আপন করে নেয়ার ক্ষমতা যার মধ্যে বিরাজমান। কিন্তু আজ রাতে কি করবে কুহু? নানান চিন্তায় দোদুল্যমান কুহুর মন। মন এবং মস্তিষ্কের স্নায়ুযুদ্ধ চলে অনেকসময়। শেষে জয়ী হয় মন। কিন্তু কুহু এখনই ধরা দিতে নারাজ।

তাহমিদ ধৈর্য্য নিয়ে ছাদের রেলিং ধরে অপেক্ষা করছে। রাত এগারোটা ছুঁইছুঁই। কুহু এখনো আসেনি। এই অপেক্ষা মন্দ লাগছেনা। বরং এই অপেক্ষা ওর কাছে মধুর মনে হচ্ছে।
হঠাৎ করেই তাহমিদ ওর চারপাশে একটা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছে। পেছনে না তাকিয়েই বুঝতে পারে গন্ধের উৎপত্তি। ওর ঠোঁটের কোন প্রসারিত হয়।
মন বলে উঠে, ” সে এসেছে। তোর শ্যামাঙ্গীনি এসেছে। এবার ওকে বলে দে মনের ভেতর যা কিছু আছে। ”
” অনেকসময় ধরে অপেক্ষা করছি। বড্ড য’ন্ত্র’ণা দাও তুমি। অপেক্ষার প্রহর যে কত কঠিন, তা যদি তুমি জানতে। ” পেছনে না ফিরেই বলে তাহমিদ।
কুহু তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রয়। পেছনে না তাকিয়েই কিভাবে বুঝল আমি এসেছি!

(অনেকেই জানতে চেয়েছেন জাওয়াদ জামী কার নাম।
আমার একমাত্র ছেলে জাওয়াদ জামী তাসিন। তার নামে আইডি থাকলে সে ভিষণ খুশি হয়। তাই তার খুশির জন্যই এই নাম দিয়েছি।)

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here