বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব -০৩

#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ৩
#লেখিকাঃদিশা মনি

রূপা আলোর দিকে দৃষ্টি সরিয়ে বলে,
‘আমি কিন্তু তোমার অনেক বড় উপকার করেছি। তোমার উচিৎ আমাকে ধন্যবাদ জানানো।’

আলো রূপার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায়। এই মুহুর্তে রূপাকে তার পৃথিবীর সবথেকে খা’রা’প মেয়ে মনে হচ্ছে। আলো রসিকতার সাথে বলে,
‘তোমার মতো মেয়েরা আর যাই হোক কারো উপকারের কারণ হতে পারে না। তোমরা শুধু অন্যের সংসার ভাঙতে পারো।’

‘হ্যা ঠিক বলেছ আমি খারাপ মেয়ে। আমি জানি আমি খারাপ। কিন্তু তোমার স্বামীর থেকে কম খারাপ। তুমি জানো তোমার স্বামী একজন ধ’র্ষ’ক?’

রূপার কথাটা শুনে আলোর মাথা বনবন করে ঘুরতে থাকে। সে এটা জানে যে আতিক ভালো লোক নয়। কিন্তু এত বড় একটা অন্যায়ের সাথে যে আতিক যুক্ত থাকতে পারে সেটা তার ভাবনারও বাইরে ছিল।

রূপা বলতে থাকে,
‘কি অবাক হচ্ছো তাইনা? আমার কথাটা নিশ্চয়ই বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে তোমার শাশুড়ীকে জিজ্ঞাসা করো।’

আলো আমিনা বেগমের দিকে তাকায়। আমিনা বেগম চোখ নামিয়ে নেন। তার চোখে মুখে অনুশোচনার ছাপ স্পষ্ট। আলোর মনে সন্দেহ দানা বাধে। তাহলে কি রূপা যা বলছে তা সত্য?

‘চুপ আছেন কেন মিসেস আমিনা বেগম উত্তর দিন। আপনার ছেলের এত বড় একটা সত্য কিভাবে লুকালেন নিজের ছেলের বউয়ের থেকে? মেয়েটাকে এতদিন এভাবে ঠকাতে পারলেন?’

রূপার কথাটা শুনে আমিনা বেগম আলোর দিকে তাকান।

‘বিশ্বাস কর আলো আমি তোকে ঠকাতে চাইনি। এটা অনেক বছর আগের একটা ঘটনা। সেইসময় আতিক একটা ভুল করে ফেলেছিল। প্রমাণের অভাবে আর টাকা পয়সার জোর খাটিয়ে সব বিষয় ধামাচাপা দেওয়া হয়। আমি ভেবেছিলাম আতিক এতদিনে বদলে গেছে কিন্তু….’

আলোর হতবাকে সীমা ছাড়িয়ে যায়। এই একবছরে আতিকের থেকে খারাপ ব্যবহার সহ্য করেছিল সে শুধু নিজের শাশুড়ীর ভালোবাসার জন্য। আর আজ আলো জানতে পারল তিনিও কি-না তাকে ঠ’কি’য়েছেন। আলোর গোটা পৃথিবীটা অন্ধ’কা’রে নিম’জ্জি’ত হয়। এখন আলোর মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে কেউই ভরসার যোগ্য নয়। নাহলে যেই আমিনা বেগমকে আলো অন্ধের মতো বিশ্বাস করতো সেই কিনা আলোকে একটা ধ’র্ষ’কের সাথে বিয়ে দিয়েছে।

৫.
‘তুমি জানো আলো তোমার স্বামী আতিক কি করেছিল? আমার চাচাতো বোন রেহানা, খুব সহজ সরল একটি মেয়ে ছিল। গ্রাম থেকে পড়াশোনার উদ্দ্যেশ্যে আমাদের কাছে শহরে আসে। রেহানা খুব মিশুকে ছিল সবার সাথে ভালোভাবে মিশত। গ্রাম্য মেয়ে হওয়ায় ওর মনে তেমন প্যা’চ ছিলনা। সবাইকে বিশ্বাস করতো। আমি প্রথম প্রথম ওকে পছন্দ করতাম না কিন্তু ওর মিশুকে স্বভাবের জন্য ওর সাথে না মিশেও পারি না। আতিক আমার বন্ধু হওয়ার সুবাদে প্রায়ই আমাদের বাড়িতে যেত। আমাদের ফ্যামিলি ভীষণ মডার্ন ছিল তাই এই নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যাথা ছিলনা। আমিও ছিলাম তেমনই হুটহাট ছেলে বন্ধুদের বাড়িতে নিয়ে আসতাম। হ্যা এটা ঠিক আমি অনেক ছেলের সাথেই রিলেশনে ছিলাম কিন্তু রেহানা তো এমন ছিলনা। আমি আতিককে খুব ভালো করেই চিনতাম। তাই রেহানার দিকে যখন ও তাকাতো তখন ওর তাকানো দেখেই আমি বুঝে যেতাম ও কোন ফ’ন্দি আটছে। আমি তখন অনেক স্বার্থপর ছিলাম তাই নিজের ছাড়া আর কারো কথা ভাবিনি। একদিন যখন আমরা কেউ বাড়িতে ছিলাম না তখন আতিক আমাদের বাড়িতে আসল। রেহানা বাড়িতে একা ছিল। ওকে একা বাড়িতে দেখে আতিক একটা সুযোগ পেয়ে যায় নিজের চা’হিদা মেটানোর। সেইদিন আতিক রেহানাকে ধ*র্ষ*ণ করে।’

রূপার কথাগুলো শুনে আলো কাপতে থাকে। আতিকের উপর ঘৃ’ণা আর রাগে সে ফে’টে পড়ে। রূপার চোখে জল। রূপা বলে,
‘জানো আমিও না খুব একটা ভালো মেতে তেমনটা নয়। রেহানা সেদিন আমাকেই সর্বপ্রথম তার সাথে হওয়া অবিচারের কথা বলে। আমার মতো একটা মেয়ে যে বিয়ের আগে নিজের স’তী’ত্ব খুইয়ে বসেছিলাম তাই আমার কাছে এসব খুব সাধারণ মনে হয়েছিল। আমি রেহানাকে বলেছিলাম চুপ থাকতে। রেহানা সেদিন আমার কথায় খুব কষ্ট পেয়েছিল। আমার দিকে কিরকম ঘৃ’ণার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। এরপর রেহানা আমাদের বাড়ি ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। গ্রামে গিয়ে ওর বাবা-মাকে সব জানায়। রেহানার বাবা একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি তার মেয়ের প্রতি হওয়া অন্যায় মুখ বুজে মেনে নিতে চাননি। তিনি আমার বাবার সাথে এই ব্যাপারে যোগাযোগ করেন কিন্তু আমার বাবাও কোন ঝা’মে’লায় জড়াতে চাননি। তাই তিনি বলেন তাকে কোনরকম সাহায্য করতে না করে দিয়েছিলেন। রেহানার বাবা তখন নিজ উদ্যোগে পুলিশের কাছে মামলা করে আতিকের নামে। কিন্তু আতিকের ক্ষমতার কাছে তারা হার মেনে যায়। আতিকের তো কিছুই হয়না বরং সবাই রেহানার নামেই ছি ছি করতে থাকে। রেহানা এসব সহ্য করতে না পেরে সু’ই’সা’ই’ড….’

রূপা থেকে যায়। আলো ব্যঙ্গ করে বলে,
‘তুমি একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের পাশে দাড়াতে পারলে না? এখন আর কেদে কি হবে। রেহানার পরিস্থিতির জন্য কিন্তু কোন না কোনভাবে তুমিও দায়ি। তুমি আর তোমার বাবা একটু সাহায্য করলেই হয়তো রেহানা আজ এরকম সিদ্ধান্ত নিত না।’

‘আমি জানি সেটা। আমিও দো’ষী। রেহানার মৃ’ত্যুর পর আমি অনু’শো’চনায় দ’গ্ধ হতে থাকি। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আতিককে একদিন না একদিন তার পা’পের শাস্তি দেবোই। কিন্তু সেইসময় আমার হাতে কিছু ছিলনা।’

৬.
আলো রূপাকে জিজ্ঞেস করে,
‘আতিককে শা’স্তি দেওয়ার জন্য তোমায় ওকে বিয়ে করতে হলো কেন?’

রূপা বলে,
‘কারণ আমার মনে হয়েছিল আতিকের ঘরে ঢুকলে ওর বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া সহজ হবে আর ঠিক সেটাই হলো। আতিকের সিক্রেট লকার থেকে আমি ওর বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ পাই। রেহানা ছাড়াও আরো অনেক মেয়ের সাথে অন্যায় করেছিল আতিক। আতিক খুব বোকা ছিল জানো নিজের অপ’রা’ধের প্রমাণগুলো সে নিজের কাছে রেখে দিত। এগুলো দেখে ও খুশি হতো। মেয়েদের প্রতি অন্যা’য় করে সে নিজেকে আ’সল পুরুষ ভাবত। আমি কাল রাতে সুযোগ বুঝে আতিকের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সময় ওর নাকে এমন একটা পারফিউম দেই যাতে করে ও অজ্ঞান হয়ে যায়। তারপর আতিকের বিরু’দ্ধে কিছু প্রমাণ পাই কিন্তু সেগুলো যথেষ্ট ছিলনা। এরপর পরেরদিন আমি ইচ্ছে করেই ঝা’মেলা তৈরি করি যাতে আতিক রেগে যায়। কারণ আমি জানতাম আতিক রেগে গেলে ও বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে আর সেই সুযোগে আমি অনেকটা সময় পাবো আরো প্রমাণ জোগাড় করার। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি জানতাম না তুমি প্রেগন্যান্ট ছিলে আর আমাকে বাচানোর জন্য নিজের এত বড় ক্ষতিটা করে ফেলবে। সেদিন তুমি যাওয়ার পর আমি আতিকের রুমে গিয়ে ওর সিক্রেট লকারটা খুঁজে পাই। তারপর সেখান থেকে তার বিরু’দ্ধে অনেক শক্তপোক্ত প্রমাণ পাই। যেই পুলিশ অফিসার আতিককে গ্রে’ফ’তার করেছে সে আর কেউ নয় রেহানার আপন বড় ভাই। রেহানার প্রতি অবিচার হতে দেখে সে শপথ করেছিল একদিন পুলিশ হয়ে নিজের বোনের প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিচার করবেই। তার সাথে মিলেই আমি সব পরিকল্পনা করি। আমি সব প্রমাণ এরপর তার হাতে তুলে দেই। তারপর সে এসে আতিককে গ্রেফতার করে। যদিও আতিককে সাময়িকভাবে না’রী নি’র্যা’ত’নের মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে কিন্তু এখন তার সব অপরাধ দেশবাসীর কাছে আনা হবে। আমিও অনেক অন্যায় করেছি আমাকেও জে’লে যেতে হবে। তোমার সাথে আমি ক্ষ’মা চাইব না সেই মুখ আমার নেই। তোমার এরকম পরিস্থিতির জন্য আমিই হয়তো দায়ি কিন্তু একবার ভেবো দেখো আতিকের মতো একটা ছেলের সাথে সংসার করার থেকে এইরকম পরিস্থিতিতে থাকা ভালো নয় কি?’

‘ঠিক বলেছ তুমি রূপা। আমি যদি আগে জানতাম আতিক এত খা’রা’প একজন মানুষ তাহলে কবেই সব ছেড়ে চলে যেতাম। আর আম্মা আপনি। আপনাকে আমি খুব বিশ্বাস করেছিলাম কিন্তু আপনি….আমি আতিকের কাছ থেকে ডিভোর্স চাইব। তারপর সব ছেড়ে চলে যাব। জানি আমাকে সামনের জীবনে এক বিবর্ণ আলোকবর্ষ পারি দিতে হবে। তবুও আমি খুব খুশি যে আতিক তার পা’পের শাস্তি পেয়েছে। আমি এখন প্রস্তুত এক বিবর্ণ আলোকবর্ষ পারি দেওয়ার জন্য। দেখা যাক জীবন আমায় কোথায় নিয়ে যায়।’
চলবে ইনশাআল্লাহ
>>গল্পটা আপনাদের কেমন লাগছে কমেন্ট করে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here