বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব -০৮

#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ৮
#লেখিকাঃদিশা মনি

আলো হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মালেকা বেগমের দিকে। কি বলছেন তিনি? যা করেছেন আলোর ভালোর জন্যই করেছেন। আলো প্রশ্ন করে,
‘সাজিদ ভাইয়ার থেকে আমাকে আলাদা করে কিভাবে আমার ভালো করলেন তুমি?’

‘সাজিদের ব্যাপারে সবটা জানলে তুই বুঝতে পারবি। তুই তো জানিস অনেক মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক ছিল স্কুল কলেজেই।’

‘এটা তো আমি জানতাম। সাজিদ ভাই এত সুন্দর যে অনেক মেয়ের তার জন্য পাগল ছিল। আমিও তো সাজিদ ভাইকে ভালোবাসতাম। আমার কিশোরী বয়সের প্রথম প্রেম ছিল সাজিদ ভাই। তাকে দেখার জন্য দিনরাত ছটফট করতাম। আল্লাহর কাছে কত করে চাইতাম সাজিদ ভাইকে। একসময় সাজিদ ভাই আমার মনের আশা পূর্ণ করলেন। তিনি জানালেন তিনি আমায় ভালোবাসেন এবং বিয়ে করতে চান। সেই দিনটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল কিন্তু রাতারাতি সব স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। পরেরদিনই তোমার বান্ধবী তার ছেলের জন্য আমাকে দেখতে আসে। প্রথম দেখাতেই আমাকে পছন্দ করে নেয় এবং নিজের হাতের বালা খুলে আমাকে দিয়ে বলে, এটা নাকি তাদের বাড়ির বউদের হাতে থাকে। সেদিন আমি হতবিহ্বল হয়ে যাই৷ মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগে এক সপ্তাহের মধ্যে আমার বিয়ে হয়ে যায় আতিকের সাথে।’

‘আমি সবটাই জানি আলো। কিন্তু তুই কি জানিস সাজিদের আসল উদ্দ্যেশ্য? তাহলে শোন কোন পরিস্থিতিতে এবং কি কারণে আমরা এত তাড়াতাড়ি করে তোর বিয়ে দিয়েছিলাম। তুই সাজিদের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানিস। একটা ব্যাপার হয়তো জানিস না মায়ার সাথেও সাজিদের প্রেমের সম্পর্ক ছিল৷ ওদের সম্পর্ক এতটা গভীর ছিল যে একদিন আমি জানতে পারি মায়া মা হতে চলেছে। কথাটা শুনে তুই এখন যত অবাক হচ্ছিস তার থেকেও বেশি অবাক হয়েছিলাম আমি। মায়ার এই অবস্থার কথা জেনে আমি সাজিদের কাছে যাই তার কাছে গিয়ে মায়াকে বিয়ে করার অনুরোধ করি। সাজিদ সেদিন স্পষ্ট জানিয়েছিল সে বিয়ে করবে না। আমি হিতাহিত জ্ঞানশুণ্য হয়ে যাই। মায়া পরে সাজিদের কথায় এভোশন করায়। সাজিদ মায়ার দিকে আর চোখ তুলেও তাকায় নি। মায়ার দিকে সেই সময় তাকাতে পারিনি আমি। মেয়েটা একেবারে ভেঙে পরে। মায়ার পর সাজিদ তোকে নিজের টার্গেট করে। আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সাজিদ আরো অনেক মেয়ের সাথেই প্রেম করে তাদের ছে*ড়ে দিয়েছে। আমি চাইনি মায়া বা অন্য কোন মেয়ের মতো তোরও একই পরিণতি হোক। আমি সাজিদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপও নিতে পারছিলাম মায়ার ভয়ে। কারণ সাজিদ আমাকে মায়ার আপত্তিকর ছবি দেখিয়ে ভয় দেখায়। অন্যদিকে জসীমের ভয়ে তোর আব্বুও তোর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমরা দুজনই তখন অনেকটা তাড়াহুড়োয় পরে যাই তোর বিয়ে দেওয়ার জন্য। এমন সময় আমিনা আমাকে নিজের ছেলের কথা জানায়। তখন আমার কাছে এটাই সেরা সুযোগ মনে হয়। তাই আমি দ্রুত তোর সাথে আতিকের বিয়ের ব্যবস্থা করি। ‘

মালেকা বেগমের কথাগুলো শুনে মায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। সাজিদকে ছোটবেলা থেকে ভালোবেসে গেছে সে। তার ভালোবাসায় তো কোন খুঁত ছিলনা। তাহলে কি সে ভুল মানুষকে ভালোবসল?

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আলো বলে,
‘তাহলে এখন তুমি কেন মায়ার সাথে সাজিদের বিয়েটা হতে দিচ্ছ।’

মালেকা বেগম হা হুতাশ করে বলেন,
‘কি করব বল? মায়া যে আমার কোন কথা শুনবে না। সে আমায় বলেছে সাজিদকে না পেলে আত্ম***হ****ত্যা করবে। সাজিদ কোন এক অজানা কারণে মায়াকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে।’

‘মায়া এতকিছুর পরেও সাজিদকে ক্ষমা করে দিল?’

‘জানিনা আমার মেয়েটা এমন কেন। যারা সত্য করে ওর ভালো চায় তাদেরকে ভুল বোঝে আর যারা মুখে মিষ্টি কথা বলে কিন্তু ওর ক্ষতি চায় তাদেরকেই নিজের আপন ভাবে।’

‘এমন হতে দিলে চলবে না। আমি মায়াকে বোঝাবো ও যেন এই বিয়েটা না করে। আর তোমাকে ধন্যবাদ আম্মু তুমি আমার জীবনটা রক্ষা করার জন্য এতকিছু করেছ।’

‘রক্ষা করতে পারলাম আর কই। সেই তো আতিকের সাথে বিয়ে দিয়ে তোর জীবন ন’ষ্টই করে দিলাম।’

‘আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। সাজিদ ভাইয়ের সাথে থাকলে তিনি আরো বড় ক্ষ’তি করে দিতে পারতেন। তুমি কোন চিন্তা করোনা। আমি মায়ার জীবনটা ন’ষ্ট হতে দেবনা।’

১৫.
সাজিদ বেশ ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে ভাবছে এবার আলোর সাথে মালেকা বেগমের ঝালেমা হবে। মালেকা বেগমকে নিজের শত্রু মনে করে সাজিদ। এখন নিজের সবথেকে প্রিয় মানুষটা যদি মালেকা বেগমকে অপমান করে তখন মালেকা বেগমের অবস্থা কেমন হবে সেটাই ভাবছে সাজিদ।

সাজিদের কাছে নারী মানেই একটা নে’শা। নারীদের ভো’গ্যপ’ন্যের মতো ভাবে সাজিদ। জীবনে যেই নারীর দিকে নজর দিয়েছে তাকেই নিজের করে পেয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু আলো। এরজন্য মালেকা বেগমকেই দায়ী মনে করে সাজিদ। সেই কারণেই মালেকা বেগমের উপর এত ক্ষোভ তার।

মালেকা বেগমের উপর শোধ তোলার জন্যই মায়াকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল সাজিদ। এখন যখন দেখছে আলো ডিভোর্সি হয়ে ফিরে এসেছে তখন নতুন করে সুযোগ পেয়ে গেছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আলোকে নিজের করে পে’তে চায় সাজিদ। সেই কারণেই তো কাল আলোর অবস্থার কথা জানার পর গোটা মহল্লায় সেসব কথা রটিয়েছে সাজিদ।

সাজিদের উদ্দ্যেশ্য ছিল আলো যাতে মানুষের কটু কথা শুনে দূর্বল হয় আর সেই সুযোগে আলোর দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে যাতে সাজিদ তার অপূর্ণ বাসনা পূর্ণ করতে পারে।

আচমকা কেউ সাজিদকে ডাকে। সাজিদ পেছনে ঘুরে সজীবকে দেখতে পায়। সজীব বলে,
‘তোর ব্যাপারে আমি কখনোই নাক গলাতে চাইনি ভাইয়া। তবে আজ না বলে থাকতে পারছি না। আলোর ব্যাপারে সব কথা তুই মহল্লায় রটিয়েছিস তাইনা? মেয়েটার সাথে এমন কেন করছিস তুই? কিসের এত শত্রুতা ‘

‘আমি যা খুশি করব তোর কি? তুই নিজের চরকায় তেল দে। চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে বসে আছিস। আমার উপার্জনের টাকায় খাচ্ছিস আবার আমাকেই কথা শোনাচ্ছিস।’

সজীবের খুব গায়ে লাগে সাজিদের কথাটা। সজীব হালকা হেসে বলে,
‘তুই ভুলে যাসনা আমি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। আপাতত আগের কার্যালয় থেকে রিজাইন করেছি শুধু৷ আর কিছুদিনের মধ্যেই বিদেশে চলে যাব। তোর ঘাড়ে বসে খাচ্ছি না আমি। প্রয়োজনে এই কয়দিনে তোর কত টাকা খেলাম তার হিসাব দিয়ে দিবি আমি বেতন পেয়ে সব টাকা শোধ করে দেব।’

‘বেশি বড় কথা শিখে গেছিস। মোনালিসার কথা ভুলে গেছিস?’

১৬.
মোনালিসা নামটা শুনে সজীবের মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। আলোর বিয়ের পর মোনালিসাকেই নিয়েই নতুন করে স্বপ্ন দেখেছিল সজীব। মোনালিসা সজীবের খালাতো বোন। বড্ড হাসিখুশি চঞ্চল মেয়েটা।

সাজিদের বদ নজর মোনালিসার উপরেও পরে। সজীব মোনালিসাকে নিজের মনের কথা জানানোর পরে মোনালিসা খুব খুশি হয়ে জানায় সেও সজীবকে ভালোবাসে।

খুব ভালোই চলছিল সবকিছু। হঠাৎ করে সবকিছু বদলে যায়। সাজিদ একদিন প্রপোজ করে বসে মোনালিসাকে। সাজিদ দেখতে সজীবের থেকে অনেক বেশি সুন্দর। সাজিদ যেখানে লম্বা,ফর্সা,সুঠাম দেহী সেখানে সজীব সেরকম লম্বা না, গায়ের রং ও শ্যামলা। তাই মোনালিসা সজীবকে ভুলে সাজিদের সাথে রিলেশনশিপ শুরু করে।

মোনালিসা সজীবকে ভুলে গেলেও সজীব ভুলতে পারে না। মোনালিসার ধোকাবাজির পরও সে মোনালিসার অপেক্ষায় ছিল।

একদিন মোনালিসা সজীবের কাছে এসে কাদতে কাদতে বলে,
‘সাজিদ আমায় ঠকিয়েছে। ও আমার সাথে ফিজিক্যাল হয়ে এখন বলছে আমার সাথে ব্রেকআপ করবে। প্লিজ তুমি সাজিদকে বোঝাও। ওকে না পেলে আমি বাচবো না।’

সজীব সেদিন নিজের কথা ভুলে নিজের প্রিয়তমার জন্য সাজিদের কাছে গিয়েছিল। সাজিদ সেদিন সজীবকে মোনালিসার কিছু আপত্তিকর ছবি দেখিয়ে বলে,
‘চুপ করে থাকবি আর মোনালিসাকেও বলবি চুপ থাকতে। নাহলে এই সব ছবি ভাইরাল করে দেব।’

সজীব আর কিছু বলার সাহস পায়নি।

এসব কথা ভেবে সজীব সাজিদকে বলে,
‘মানুষ যে কেন সরাসরি মন না দেখে রূপ দেখে বুঝিনা। যদি মানুষের রূপ না দেখে মন দেখা যেতো তাহলে হয়তো কেউ তোর মতো ছেলেদের প্রেমে পড়ে নিজের জীবন ন*ষ্ট করত না। মানুষ রূপের কাঙালী হয়ে মনের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। তাই বারবার ঠকে যেতে হয়।’
চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here