বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব -১০

#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ১০
#লেখিকাঃদিশা মনি

আলো অনেকক্ষণ থেকে একা নিজের রুমে বসে আছে। ভয়ে তার অবস্থা খুবই শোচনীয়। জোনাকি সেই কখন মুদি দোকান থেকে চাল আনতে বাজারে গেছে এখনো ফেরেনি। আলোর ভয় একটা ব্যাপার নিয়ে। মুদি দোকানের পাশেই তো জসিমেরা আড্ডা দেয়। গতকালের ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য না আবার তারা জোনাকির কোন ক্ষতি করে দেয়।

ঘড়ির কাটায় সময় যতো এগোচ্ছিল আলোর ভয় ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। একসময় আলোর ভয়টাই সত্য হয়। ফোনে ম্যাসেজের টুংটাং শব্দ আসতেই আলো আতকে ওঠে।

কাপা কাপা হাতে ফোন হাতে নিয়ে ম্যাসেজটি চোখে পড়তেই আলো দিশেহারা হয়ে যায়।

ম্যাসেজে স্পষ্ট করে লেখা,
‘নিজের বোনকে বাচাতে চাইলে তাড়াতাড়ি আমার আস্তানায় চলে আয়। যদি তুই না আসিস তাহলে তোর বোনকে আর কোনদিন ফেরত পাবি না। চালাকি করে কাউকে আবার সাথে আনিস না। নাহলে তোদের সবাইকে খ’ত’ম করে দেব।’

ম্যাসেজটা সিন করে আলো আর স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে না। দ্রুতপায়ে রুম থেকে বের হয়ে ছুটতে থাকে জসিমের আস্তানায়।

জসিম অট্টহাসিতে মগ্ন। তার সামনে হাত পা বাধা অবস্থায় পড়ে আছে জোনাকি। জোনাকি বলছিল,
‘শ’য়তান ছেড়ে দে আমায়। আমার বোনটার এতবড় ক্ষ’তি কেন করতে চাইছিস? মেয়েটা এমনিতেই অনেক সমস্যার মধ্যে আছে। এখন তোর জন্য মেয়েটার বেচে থাকা অসম্ভব হয়ে গেছে।’

জসিম হাসি থামিয়ে বলে,
‘আমি তো চেয়েছিলাম আলোকে সুখী করতে। কিন্তু তোর বাপ আর বোনের যা তেজ সেটা আমার সহ্য হচ্ছিল না। সোজা কথায় যখন কাজ হলোনা তখন তো আমায় বাকা পথে হাটতেই হতো। তুই কোন চিন্তা করিস না তোর বোনকে এতকিছুর পরেও আমি নিজের বউ বানাতে রাজি আছি। তার আগে শুধু ওর তেজটা একটু কমাবো। রাস্তায় সবার সামনে জসিমের গালে থা’প্পর মা’রার ফল তো ওকে ভোগ করতেই হবে।’

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে আলো। আপু,আপু বলে চিৎকার করছিল সে। আলোকে দেখেই জসিম বলে,
‘আমার কাছে শেষপর্যন্ত ধরা দিতেই হলো তোকে। এবার তোর সব তেজ আমি শেষ করব।’

জসিম আলোর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আলো পালানোর চেষ্টা করে কিন্তু তার আগেই জসিম শক্ত করে ধরে ফেলে আলোকে।

১৯.
সজীব হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার সময় আলোকে ছুটে ছুটে কোথাও যেতে দেখে তার পেছনে আসে। এসে দেখে আলো জসিমের আস্তানার দিকে যাচ্ছে। সজীব তখনই বুঝতে পারে আলো নিশ্চয়ই বড় কোন সমস্যায় পড়েছে। তাই আর কালক্ষেপণ না করে নিজের কয়েকজন বন্ধুকে ডেকে নিয়ে আসে সজীব। সবাইকে নিয়ে একসাথে জসিমের আস্তানায় আসলে দেখতে পায় জসিম আলোর উপর জো’র জ’ব’র’দ’স্তি করছে।

সজীব এবং তার বন্ধুরা মিলে জসিমের থেকে আলোকে বাচিয়ে নেয়। জসিমরা সংখ্যায় বেশি হলেও সজীব তার বন্ধুরা সবাই লাঠি, ব্যাট হাতে নিয়ে এসেছে। জসিমদের হাতে কিছু ছিলনা তাই জসিমরা তাদের সাথে পে’রে ওঠেনা।

জসিম আর তার চ্যালাদের মে’রে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আলো তখনো ঘোরের মধ্যে ছিল। আজকের ঘটনা যেন তাকে আরো অসহায় করে দেয়। জোনাকি নিজের বাহুতে শক্ত করে ধরে রাখে আলোকে৷

সজীব আলোর কাছে এসে বলে,
‘তুই ঠিক আছিস তো? এভাবে বাঘের গুহায় ঢুকতে গেলি কেন? আমি যদি তোকে না দেখতাম তাহলে কতবড় ক্ষতি হয়ে যেত ভেবে দেখেছিস একবার।’

‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সজীব ভাই। আলোর এখানে কোন দো’ষ নেই। ঐ জসিম আমাকে তুলে নিয়ে এসে আলোকে হু’ম’কি দিয়েছিল। আমাকে বাচানোর জন্যই আলো নিজের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে ছুটে এসেছিল। ‘

‘ঠিক আছে তুই আলোকে নিয়ে বাড়ি যা। ওকে দেখে স্বাভাবিক মনে হচ্ছেনা। মে বি এখনো ট্রমা কা’টিয়ে উঠতে পারছে না। ওর রেস্ট দরকার।’

জোনাকি আলোকে নিয়ে বাড়িতে আসে। গোটা মহল্লায় আলোর ঘটনাটা ছড়িয়ে পরে। কেউ কেউ আলোর পক্ষে কথা বলছিল তো কেউ আবার বিপক্ষে। কারো কথা ছিল এরকম,
‘ঐ মেয়ের চরি’ত্রই তো ভালো না। স্বামী তো আর এমনি এমনি ডিভোর্স দেয়নি। নিশ্চয়ই চরিত্রের দো’ষ ছিল। এখন বাপের বাড়িতে এসে ন’ষ্টা’মি করতে গিয়ে ধরা পরে সব দো’ষ জসিমের উপর চাপিয়ে দিয়েছে।’

মালেকা বেগম আলোর বিছানার পাশে বসেছিল। ভয়ে আর শোকে মেয়েটা একেবারে স্তব্ধ হয়ে আছে। মালেকা বেগম নিজের চোখের জললে আটকাতে পারেন না।

‘তোর সাথেই কেন বারবার এমন হয় আমি জানি না আলো। আল্লাহ যে তোর ভাগ্যে কি লিখে রেখেছে আমার জানা নেই। আমি শুধু আল্লাহর কাছে এটুকুই চাইবো যেন তিনি তোর জীবনে একটুখানি শান্তি দেয়।’

এতক্ষণে আলো মুখ খোলে। মালেকা বেগমের কথার বিপরীতে বলেন,
‘আমি জানি আমার জীবনে সুখ এত সহজে ধরা দেবেনা। আদৌ কখনো ধরা দেবে কিনা সেটাও জানি না। আমার জীবনে বোধহয় এখনো লম্বা একটা বিবর্ণ আলোকবর্ষ পারি দেওয়া বাকি আছে।’

২০.
Time and tide wait for none

সময়ের স্রোত আরো কিছুদিন এগিয়েছে। আজ সাজিদ মায়ার গায়ে হলুদ। কোনভাবেই বিয়েটা আটকানো যায়নি। যার দায় অবশ্য পুরোটা মায়ার উপর বর্তায়।

নিজের জেদের কারণে মায়াও হয়তো নিজের সামনের জীবনটা একটা বিবর্ণ আলোকবর্ষ পারি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে৷ যেটাকে নিজের সুখ ভেবে রঙিন স্বপ্ন দেখছে সেই বিয়েটাই হয়তো মায়ার জীবনকে সম্পূর্ণ বে-রঙিন বানিয়ে দেবে।

মালেকা বেগম তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলেন। আলো তার পাশেই ছিল। মালেকা বেগম আলোকে বলেন,
‘আমার মেয়েটা এত অবুঝ কেন বুঝিনা। শতচেষ্টার পরেও ওর জেদের কাছে আমাদের হার মা’নতে হলো। যতই হোক মায়া তো আমারই মেয়ে। সন্তান অবাধ্য হলেও মা-বাবা সবসময় তাদের চিন্তা করে। মায়ার জীবনটা ন’ষ্ট হয়ে গেলে যে আমরাই সবথেকে বেশি কষ্ট পাবো।’

‘তুমি তো নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছিলে আম্মু মায়াকে বোঝানোর। শুধু তুমি কেন আমরাও তো কম চেষ্টা করিনি। এখন মায়া যদি নিজের ভালোটা বুঝতে না পারে সেখানে আমরা আর কি করব। আল্লাহর কাছে শুধু এটুকুই চাইব তিনি যেন মায়াকে সঠিক বুঝদান করেন।’

মায়া নিজের বান্ধবীদের সাথে সেলফি তুলতে ব্যস্ত ছিল। আজ তার আনন্দের কোন সীমা নেই। সাজিদকে নিজের স্বামী হিসেবে পেতে যাচ্ছে ভেবেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে মায়া।

মায়ার এক বান্ধবী তাকে ঠেস মে’রে বলে,
‘সাজিদ ভাই তাহলে শেষ অব্দি তোরই হলো। তাকে একটু সামলে রাখিস। অনেকের তো আবার নজর আছে সাজিদ ভাইয়ের উপর।’

‘আমার হবু বর এত হ্যান্ডসাম যে একজনের শ’কুনের দৃষ্টি রয়েছে তার উপর। কোন টেনশন নেই ঐ পে’ত্নীটা সাজিদ ভাইকে আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না।’

আলোর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে মায়া। আলোর খুব কষ্ট হয় মায়ার এরকম কথা শুনে। সেখানে দাড়িয়ে থাকা আর সম্ভব ছিলনা আলোর পক্ষে। তাই একছুটে সেখান থেকে চলে আসে।

রুমে এসে জোনাকিকে দেখতে পায় আলো। জোনাকি আলোকে একটি হলুদ শাড়ি দিয়ে বলে,
‘এই শাড়িটা পরে নে আলো৷ আমি নিজে পছন্দ করে তোর জন্য কিনে এনেছি। শাড়িটাতে তোকে খুব সুন্দর মানাবে।’

আলো জোনাকির দিকে তাকায়। জোনাকি দেখতে সেরকম সুন্দর নয় ঠিকই কিন্তু তার চোখেমুখে মায়াবী ভাব দেখা যায়। মেয়েটা আসলেও খুব মায়াবী।

শাড়িটা হাতে নিয়ে আলো বলে,
‘শুধু আমার জন্যই শাড়ি কিনলে আপু। নিজের জন্য কিছু কিনলে না?’

জোনাকি আলোর কথা ঠাট্টায় উড়িয়ে দিয়ে বলে,
‘আমাকে কি আর সাজলে ভালো লাগে। আমার যা রূপ তাতে সাজলেও কি আর না সাজলেও কি। জানিস তোর দুলাভাই যে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে তার মূল কারণ এটা নয় যে আমি তাকে সন্তানের মুখ দেখাতে পারিনি। আমি যদি সুন্দরী হতাম তাহলে তিনি সব ভুলে আমায় ঠিকই নিজের করে রাখতেন। আমি স্বামীকে রূপের মায়ার বেধে রাখতে পারিনি।’

জোনাকির কথাগুলো শুনে আলোর খুব খারাপ লাগে। ১৮ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল জোনাকির। তারপর ৪ বছর স্বামীর ঘরে অনেক অত্যা’চা’র সহ্য করে পরেছিল। শেষে বাচ্চা না হওয়ার দোহাই দিয়ে জোনাকিকে বের করে দেওয়া হয়৷ জোনাকি নিজের ২৩ বছরের জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। এদিকে আলোর অবস্থাও ভিন্ন নয়। ২০ বছরের জীবনে আলো নিজেও অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছে।

আলো আর বেশি না ভেবে হলুদ শাড়িটা পরে বাইরে চলে আসে।শাড়িটায় সত্যি খুব ভালো মানিয়েছে আলোকে।

আলো বাড়ির বাইরে এসে যা দেখল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা।

সাজিদকে মায়ার এক বান্ধবীর সাথে চুম্বনরত অবস্থায় দেখে ফেলে আলো।
চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here