#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা
পর্বঃ ষষ্ঠ
মধ্য রজনী।রাস্তা ঘাটে মানুষজন নেই বললেই চলে।আজিজুর রহমান আর তার দুই মেয়ে এবং স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে বনানীর একটা বড় বিল্ডিং এর সামনে।রাহাত আর তার বাব-মাকে খুলনা পাঠিয়ে দিয়েছেন আজিজুর রহমান।আর তারা গাড়ি করে এখানে চলে এসেছে। পাঁচ মিনিট যাবত তারা বাড়িটার সামনে দাঁড়ানো।ষোলো তালা বিল্ডিং। বেশ সুন্দর দেখতে।বিল্ডিং এর ভিতরে গেইট তালা মারা যার কারণে তারা ঢুকতে পারছে না।আজিজুর রহমান বলছেনও না কার বাড়িতে এসেছে।
দুই মিনিট পর গেইট খোলার শব্দে ফিরে তাকায় সবাই।টি-শার্ট আর হুডি পড়া এক ছেলে বের হয়ে এসেছে।দেখতে অনেক লম্বা,শরীরের রঙ প্রচুর ফর্সা অতিরিক্ত ঠান্ডায় হয়তো আরও ফর্সা দেখাচ্ছে।বুঝাই যাচ্ছে ঘুম থেকে উঠে এসেছে।
ছেলেটা বের হয়েই আজিজুর রহমানকে দেখতে পেয়ে বেশ চওড়া একটা হাসি দিলো।সামনে এসে সালাম দিলো আজিজুর রহমান আর তার স্ত্রীকে।
নীলার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।এ ছেলে কে? এ বাড়িতেই বাবা কেনো এসেছে সে বুঝতে পারছে না।
নীলার ভাবনার মাঝেই আজিজুর রহমান দুই মেয়েকে ডেকে বললেন
-‘নিরু আর নীলা ও হলো বর্ণ আহমেদ।আমার অনেক আগের স্টুডেন্ট খুব পছন্দের ছাত্র বর্ণ।নিরু অবশ্য চিনিস।আমাদের বাসায় দু একবার গিয়ে ছিল।নীলা তখন বাসায় ছিলো না ও ঢাকা ছিলো।’
নিরুপমা হাসি মুখ করে বর্ণের দিকে তাকিয়ে বলল
-‘আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।’
বর্ণও হালকা হেসে সালামের উত্তর দিলো।কিন্তু নীলা কোনো হেলদোল দেখালো না।বর্ণ নীলার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো।
থমকে গেলো বর্ণ।আধাঁরে আধাঁরিয়া সৌন্দর্যে আটকে গেলো সে।মন থেকে ডেকে উঠল “আধাঁরময়ী”।
নীলা বিরক্ত হচ্ছে খুব।বাবা এই রাতে এই ছেলেটার সাথে পরিচয় করানোর জন্যই কি তাদের এখানে নিয়ে এসেছে? পরক্ষণেই তার মাথায় ভাবনা উদয় হলো।বাবা তো বললো এই ছেলেটা বাবার পছন্দের স্টুডেন্ট,তবে কি বাবা তাকে এই ছেলেটার বাসায় রেখে যাবে?তার কিছু ভাবতে ভালো লাগছে না।এত ভাবনা করার থেকে ভালো বাবাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করা।যেই ভাবনা সেই কাজ।নীলা শান্ত স্বরে তার বাবাকে বলল
-‘বাবা,আমরা এখানে কেনো এসেছি? অনেক তো রাত হলো।কোথাও থাকার ব্যবস্থা করা উচিত।’
আজিজুর রহমান মেয়ের অধৈর্য হওয়ার কারণটা বুজেছে।আসলে তার মেয়ে অপরিচিত মানুষের সান্নিধ্য পছন্দ করে না।পছন্দ না করারও কারণ আছে।বরাবরই নীলা নিজের আত্মসম্মান টাকে প্রাধান্য দেয় কিন্তু যখনই কোনো অপরিচিত মানুষের সাথে দেখা হয় তখন ঐ মানুষ নীলার গায়ের রঙ নিয়ে কথা বলে।এতে নীলা লজ্জা পায়, হীনমন্যতায় ভুগে।তাই সবসময় অপরিচিত মানুষ দেখলে নীলার পালাই পালাই একটা ভাব থাকে।জেনো সে মানুষটার সামনে থেকে যেতে পারলেই বাঁচে।মেয়ের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আজিজুর রহমান।আর হেসে বলে
-‘এই তো মা থাকার ব্যবস্থাই তো করতে এসেছি।’
নীলা চমকে উঠলো তার মানে সে যেটা ভেবেছে সেটাই সত্যি ।শেষমেশ বাবা তাকে অপরিচিত মানুষের বাসায় রাখবে।না না সে থাকবে না আর কারো বাসায়। দরকার হয় পড়াশোনা করবে না বাড়ি চলে যাবে তাও ভালো।
পরক্ষণেই আবার নীলার মনে পড়ে বাড়ি গিয়েও তো শান্তি নেই।পাষাণ মানুষটার মুখোমুখি হতে হবে।নীলা ভাবে কী করা যায়। ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয় সে কিন্তু উপায় মেলে না।অথৈ সাগরে পড়ে যায় নীলা।অতিরিক্ত চিন্তায় কথা হ-য-ব-র পাঁকিয়ে যায়। মুখ ফসকে বলে ফেলে
-‘না না বাবা আমি আর কারো বাসায় থাকবো না তুমি বরং আমাকে হোস্টেলে দিয়ে দেও।’
কথা থামিয়ে নীলা নিজের আঁচল দিয়ে কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে।বর্ণ আড়চোখে তাকায় নীলার দিকে।মেয়েটার আচারন কেমণ অদ্ভুত। সন্দেহে ভ্রু কুঁচকে আসে বর্ণের।মেয়েটার কি কোনো সমস্যা আছে?
আজিজুর রহমান মেয়ের কাছে আসে।পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে সুন্দর করে মুছিয়ে দেয় মেয়ের মুখ।তারপর শীতল কণ্ঠে বলে
-‘মা আমি তোমাকে আর কারো বাসায় রাখছি না।তুমি তোমার নিজের বাসায় থাকবে।এই যে এই বিল্ডিং এর আট তলায় তোমার জন্য তোমার আব্বু একটা ফ্লাট কিনেছে।ভেবেছিলাম তোমার জন্মদিনে তোমাকে এটা গিফ্ট করবো কিন্তু কপালের লেখা কি আর জানতাম।’
অবাকে হা হয়ে যায় নীলা আর নিরুপমা। নীলার মা অবাক হয় না কারণ সে আগেই জানতো।নিরুপমা তো বেশ খুশি। তারপরও দুষ্টমির সুরে বলল
-‘বাহ্ বাহ্ সব ভালোবাসা ছোট মেয়ের জন্য। আর বড় মেয়েটা কী বানের জলে ভেসে এসেছে নাকি?’
নীলা বুঝে না বোনের দুষ্টুমি। তার রাগ হয়।আপু তার ভালো একদমই সহ্য করতে পারে না।সেই রাগ থেকে মুখটা নিকষ কালো আধাঁর করে গম্ভীর কন্ঠেই বলে
-‘বলেছিলাম না আপু তুমি কিছু না পেলেও জীবনে সব পেয়ে গেছো কারণ একটাই সেটা তুমি জানো।আর আমার সত্যিই এসব ফ্লাটের দরকার নেই।তুমিই নিয়ে যাও সব।’
বোনের কথায় অভিমান হয় নিরুপমার।তবে সে কিছু বলে না বোনকে।তার বোন তো একসময় আপু বলতে পাগল ছিলো।এখন এমন করছে হয়তো বোনের মন বেশিই খারাপ।
বর্ণ অবাকের উপর অবাক হচ্ছে নীলার আচরণ দেখে।উপস্থিত সবাই নিরুপমার মজা বুঝতে পেরেছে আর এই মেয়ে কি না কত গুলো খারাপ কথা শোনালো নিজের বোনকে।আজব মেয়ে। প্রথম দেখাতেই নীলার আচরণ বর্ণের মনে খারাপ প্রভাব ফেলে।
আজিজুর রহমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই বলল
-‘বর্ণ চলো আমাদের নিয়ে।এত রাতে তোমাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত মাই সান।’
বর্ণ মাথা নিচু করে তড়িঘড়ি করে উত্তর দেয়
-‘না না স্যার এসব বলে লজ্জা দিবেন না।আসেন আপনারা তো আমাদের পাশের ফ্লাটেই উঠেছেন তাই না?’
আজিজুর রহমান মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানায়।ব্যাগ হাতে নিতে গেলে বর্ণ তাকে ব্যাগ নিতে দেয় না।তার সামনে তারই স্যার ব্যাগ বহন করবে সেটা হতে পারে না।
আজিজুর রহমান বর্ণের ভদ্রতা দেখে খুশি হয়।নীলা ও নিরুর হাত শক্ত করে ধরে বাড়ির ভিতরে ঢুকে। পিছে আসে তার স্ত্রী আর বর্ণ।
__________
নীলারা নতুন বাসায় এসেছে আজ চারদিন হতে চলল।নীলার বাবা-মা,আপুও এখানে আছে।ফ্লাট টা সুন্দর মতন গুছিয়ে দিয়ে তারা চলে যাবে।
এই চারদিনে বর্ণের পরিবারের সাথে ভাব হয় নীলার পরিবারের। বর্ণের পরিবারে আছে তার মা-বাবা,দাদী,ডিভোর্সী ফুপি,ফুফাতো ভাই আর তার নিজের বোন।
সবাই বেশ মিশুক।নীলাদের বাসার গুছানোর কাজে তারাও বেশ সাহায্য করেছে।নীলার পরিবারের সবাই ও তাদের সাথে বেশি মিশে গেছে একমাত্র নীলা বাদে।নীলা সবসময়ই নিজের রুমে বসে থাকে।আসলে নতুন পরিবেশে তার মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে।ভালো হোক খারাপ হোক কত গুলো দিন ঐ বাড়ির মানুষদের সাথে কাটিয়েছে।একটা মায়া তো পড়ে গেছে।নীলা মায়া কাটানোর শোক ভুলতে পারে না।আসলে শুধু নীলা না পুরো নারী জাতটাই এমন।এতটাই নরম জাতের হয় তারা, যে কোথাও দুদিন কাটালে সে জায়গা, সেই জায়গার মানুষের প্রতি মায়া জমে যায়।মায়া জিনিসটাই তো খারাপ।একবার কোনো মানুষের প্রতি মায়া পড়ে গেলে তা কাটাতে কাটাতে পুরো জীবনও কম সময় হয়ে যায়।
নীরার সাথে বর্ণের বোনের একটু ভাব হয়েছে।আসলে মেয়েটা চঞ্চল। তাই না চাইতেও মিশে গেছে।আর নীলার ভার্সিটিতেই পড়ে মেয়েটা।তার এক ক্লাশ জুনিয়র। ওর নাম রঙ। বেশ ইউনিক আর সুন্দর নাম। নীলা না চাইতেও মেয়েটার সাথে কথা বলে কারণ সে এই রঙের মাঝে মৌ আপুকে দেখতে পায়। অবশ্য মৌ আপুর সাথে কোনো দিকে মিল নেই তবুও সে মিল খুজেঁ পায়।আসলে মানুষ এমনই।তারা একজন মানুষের অনুপস্থিতি আরেকজনের দ্বারা মিটাতে চায়।সেইজন্যই কখনো একজন মানুষের সাথে মিল না থাকা স্বত্তেও তারা আরেকজন মানুষকে মিলিয়ে খুশি থাকার চেষ্টা করে।রঙ মেয়েটার মাঝেও নীলা এই কাজ করছে।মেয়েটাকে দেখলে নীলার মৌ আপুর কথা মনে পড়ে।ঐ বাড়িতে মৌ আপু কম কথা বলতো কিন্তু নীলার সাথে বেশ মিশতো।আদর করতো খুব।
____
বিকেল পাঁচটা। নীলা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। তার মন খারাপ ভীষণ। কাল সবাই চলে যাবে।এত বড় বাসাটাই সে একা হয়ে যাবে।কীভাবে থাকবে ভেবেই কান্না পায় তার খুব।ঐ বাসায় তো অনেক মানুষ ছিলো।নিজেকে একা অনুভব হতো না।পরক্ষণেই ভাবে, কিন্তু অপমান তো বেশ হতো।এখানে তো আর কেউ থাকবে না অপমান করার।
নীলার মনে পড়ে শুভ্রমের কথা।আংটি পড়ানোর সময় শুভ্রম বেশ কয়েকবার তাকিয়ে ছিলো তার দিকে।তাকালেও বা লাভ কী?মানুষটা তো তার না।আর এই মানুষটা তাকে ভালোবাসে নি কখনো।হয়তো এতদিন চোখের সামনে দেখে ভালো লাগায় পড়েছিলো।তাই তো তার রূপ নিয়ে বলতে দ্বিধা বোধ করে নি।
নীলা হাসে নির্মম হাসি।ভাগ্য কি খেলা টা না খেলছে।নীলার ভাবনায় বিঘ্ন ঘটে কারো ডাকে।পিছে ফিরে দেখে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।নীলা ঠিক চিনতে পারে না ছেলেটাকে।
অন্য দিকে বর্ণ নীলাকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। মেয়েটাকে সে এই নিয়ে চারবার দেখেছে।তবুও কি মেয়েটা তাকে চিনতে পারে নি? বর্ণ এগিয়ে যায়।নীলাকে প্রশ্ন করে
-‘চিনতে পারেন নি আমাকে মিস?’
নীলা কতক্ষণ ড্যাবড্যাব করে তাকায়। তারপর ধীর কন্ঠে বলে
-‘না চিনতে পারি নি।’
বর্ণ অবাক হয়।সে ভাবে এই মেয়েটার মাথায় নিশ্চিত সমস্যা আছে। নাহয় এতবার দেখার পরেও চিনতে পারে নি।আবার বর্ণ পরক্ষণে নিজেই ভাবে সত্যিই কি মেয়েটা তাকে দেখেছে? মেয়েটার সামনে যতবার সে গিয়েছে ততবারই মেয়েটা মাথা নিচু করে কোনো এক অজানা সংকোচে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।
বর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।তবে কী তার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত। গভীর ভাবনায় পরে যায় সে।
#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা
পর্বঃ সপ্তম।
বর্ণ আর নীলা দুজনেই ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। বর্ণ পরিচয় দেওয়ার পর নীলা তাকে চিনতে পেরেছে।তারপর থেকেই দুজন চুপচাপ।নীলা এমনেতেই এক বোকামির জন্য লজ্জিত হয়েছে।সেদিন রাত্রে ছেলেটা তাদের এগিয়ে গিয়ে নিয়ে আসলো আর সে ছেলেটাকেই ভুলে গেলো।আবার যদি এখন এখান থেকে চলে যায় তাহলে তো আরো খারাপ দেখাবে।তাই সে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
বর্ণ কথা কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না।মেয়েটা কেমন গম্ভীর। কী বললে কী মনে করে সেই ভেবেই ভয় লাগছে তার।
নিরবতা ঠেলে বর্ণই বলে উঠলো
-‘আচ্ছা আপনি এমন চুপচাপ থাকেন কেনো?’
হঠাৎ এমন প্রশ্নে নীলা বিভ্রান্তিতে পড়লো।নীলার বিভ্রান্তি বুঝতে সমস্যা হলো না বর্ণের।সে সাথে সাথেই বলল
-‘আরে ধূর আমি উল্টাপাল্টা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি।কিছু মনে করবেন না।আসলে আপনাকে সবসময় গম্ভীর থাকতে দেখি তো তাই কৌতূহল বশত বলে ফেলেছি।রাগ করবেন না প্লিজ।’
নীলা সামনের ছেলেটার আচরণে মুগ্ধ হয়।কি সুন্দর একটা প্রশ্ন করলো এটা আবার নীলার খারাপ লাগবে ভেবে কত অনুনয়ও করলো।নীলা অবাক হয়।এ পর্যন্ত কেনো মানুষ নীলাকে কিছু বলার সময় ভাবে নি।আর এই ব্যাক্তি সামান্য কথা বলেও কতকিছু বলেছে জেনো রাগ না করে।
নীলা মুচকি হাসি দিয়ে বলল
-‘আরে না না রাগ করবো কেনো?আপনি তো খারাপ কিছু বলেন নি।’
বর্ণ নীলার হাসি দেখে মুগ্ধ। এত সুন্দর করে মেয়েটা হাসতে জেনেও হাসে না?কি সুন্দর গোলগাল মুখ।হাসলে বাম গালে একসাথে দুইটা টোল পড়ে।চুল গুলো মাশাল্লাহ কোমড় অব্দি।এ এক আধাঁরিয়া সৌন্দর্য।বর্ণকে চুপ থাকতে দেখে নীলা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো
-‘কি হলো কি দেখছেন?’
বর্ণের জেনো হুঁশ ফিরে আসলো।সে মাথা নিচু করে মুচকি হাসি দিয়ে ডান হাতটা দিয়ে মাথার চুল গুলো পিছে ঠেলে বলল
-‘না কিছু না।’
নীলা কিছু একটা ভেবে আবারও চুপ হয়ে গেলো। বর্ণ নীলার চুপ হওয়াটাও বুঝতে পারলো। সে হেসে বলল
-‘আচ্ছা মিস. আমার মনে হয় আপনি কোনো কারণে মিশতে চান না সবার সাথে।কারণটা কি বলবেন?’
নীলা চুপ করে থাকে। কি ই বা বলবে।তার বলার কিছু নেই।নীলার ভাবনার মাঝেই বর্ণ বলল
-‘কারণ টা কি আমি বোধহয় আন্দাজ করতে পেরেছি।শুনেন আমি একটা কথা বলি।আপনি যে সবার থেকে নিজেকে এমন গুটিয়ে নেন,অচেনা মানুষের সামনে থাকতে সংকোচবোধ করেন, কেউ আপনাকে কিছু বলে না দেয় সে ভয়ে থাকেন এগুলো করে কখনোই আপনি আপনার আত্মসম্মান রক্ষা করতে পারবেন না।বরং এগুলো করা মানে আপনি আপনার দুর্বলতা সবার সামনে প্রকাশ করছেন।সবাইকে বুজাচ্ছেন আপনি পালিয়ে বাঁচতে চান কিন্তু আপনার ব্যাক্তিত্ব তো এটা না নীলাম্বরী সরি নীলা।’
একমনে চুপ করে সবটা কথা শুনলো নীলা।বর্ণ নীলাকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলল
-‘এভাবে থাকলে হবে না নীলা।আপনাকে সবার সামনে যেতে হবে।সবার সাথে মুক্ত মনে মিশতে হবে।সবার মাঝে যখন একজন আপনাকে নিয়ে বাজে একটা কথা বলবে তখন আপনি একটা দৃঢ় হাসি দিয়ে সেই কথার তীব্র প্রতিবাদ জানাতে হবে।তবেই না সবাই আপনার ব্যাক্তিত্বের প্রখরতা বুঝবে মেডাম।’
নীলা বেশ মুগ্ধ হচ্ছে তার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটার কথায়।শরীর কাটা দিয়ে উঠছে।ছেলেটার কথার ধরন একজনের সাথে মিলে যায়।
নীলার ভাবনার মাঝে নীলার শরীরে একটা চাদর জড়িয়ে দেয় কেউ।নীলা ভাবে তার পুরোনো পরিচিত মানুষটাই হয়তো চাদর জড়িয়েছে।নীলা তাকিয়ে দেখে আজ তার ভাবনা ভুল।তার শরীরে বর্ণ আলগোছে চাদর টা জড়িয়ে দিয়েছে।নীলার মনে পড়ে কথার ধরণ টা কার মতন।তার বাবাও তো এত সুন্দর করে তাকে বুঝাতো।এভাবে শীত কালে তার বাবাই তো তাকে এভাবে চাদর জড়িয়ে দিয়েছে।নীলার বুকটা ছ্যাত করে উঠে।আর কাউকে সে বিশ্বাস করবে না।সবাই খারাপ সবাই।নীলা ছুটে ছাদ থেকে নেমে যায়।
বর্ণ কিছু বুঝে উঠার আগেই নীলার এমন আচরণে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। সে কয়েকবার নীলাকে পিছু ডাকে।নীলা শুনে না সেই ডাক।বর্ণ ভাবে তার চাদর জড়িয়ে দেওয়াতে আধাঁরিয়া রমনী রাগ করেছে।বর্ণ ‘ও শীট’ বলে ছাদের রেলিং এ ঘুষি লাগায়। ঘুষি দিয়ে সে আশ্চর্য হয়ে যায় কারণ এত জোড়ে ঘুষি দেওয়ার পরও সে ব্যাথা পায় নি।সে তাকিয়ে দেখে কারো একটা শক্ত পোক্ত হাতের উপর ঘুষিটা পড়েছে।
হাতের অধিকারী মানুষটাকে দেখে বর্ণ আরও অবাক হয়ে যায়। কারণ সে আর কেউ না বর্ণের স্যার আজিজুর রহমান। বর্ণ তাড়াতাড়ি করে বলে উঠে
-‘স্যার আমি দুঃখিত। আপনার হাতে লেগে যাবে আমি ভাবি নি সরি স্যার।আপনি আমাকে শাস্তি দেন আমি সত্যিই বুঝি নি।’
আজিজুর রহমান বরাবরই বর্ণের আচরণ দেখে বিমোহিত। এখানে ছেলেটার কোনো দোষ নেই।সেই এসে হাতটা রেখেছে জেনো ছেলেটা ব্যাথা না পায়। আজিজুর রহমান মুচকি হাসি দিয়ে বর্ণের বাহুতে হালকা চড় দিয়ে বললেন
-‘তুমি তো ইচ্ছে করে দেও নি।আমি নিজেই হাতটা রেখেছি তাহলে শাস্তি কিসের?’
বর্ণ অবাক হয় স্যারের ব্যবহারে।এই জন্যই এ মানুষটাকে তার এত প্রিয়। বর্ণ মাথা নত করে বলে
-‘তবুও স্যার আমার খেয়াল রাখা উচিত ছিলো।দুঃখিত স্যার।’
আজিজুর রহমান দীর্ঘশ্বাস নেয়।তারপর রেলিং এ ভর করে নিচের দিকে তাকিয়ে বলে
-‘তোমরা আজকাল কার ছেলে মেয়েরা বড্ড অধৈর্য কোনো কিছু না জেনেই অধৈর্য হয়ে পরো।আমি তোমাকে ভরসা করি।আমি জানি তুমি অনেক বুদ্ধিমান তাই ধৈর্য হারা হওয়াটা তোমায় মানায় না।’
বর্ণ বুঝতে পারে না তার স্যার হঠাৎ এই কথা বলছে কেনো? প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে সে তাকায় আজিজুর রহমানের দিকে।আজিজুর রহমান বর্ণের দৃষ্টির অর্থ বুঝে। মুচকি হেসে বলে
-‘আমার মেয়ে তোমার উপর রাগ করে এখান থেকে যায় নি।গিয়েছে অন্য কারণে।’
বর্ণ চমকায়।তবে স্যার সবটা দেখেছে? স্যার কি তাহলে তাকে ভুল বুঝবে?
আজিজুর রহমান বর্ণকে চুপ থাকতে দেখে বলে
-‘আমি কখনোই তোমাকে ভুল বুঝি নি বর্ণ।যদি ভুল বোঝারই হতো তাহলে একবছর আগে থেকেই ভুল বুঝতাম।যখন দেখে ছিলাম তুমি আমার বাসায় গিয়ে আমারই ছোট মেয়ের রুম থেকে সবার অবর্তমানে আমার ছোট মেয়ের ছবি মুগ্ধ চোখে দেখে পকেটে ভরে নিয়েছিলে।’
বর্ণ আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সাথে লজ্জাও পায় কারণ তার স্যার সবটাই এত দিন জানতো।
বর্ণকে লজ্জা পেতে দেখে আজিজুর রহমান বলল
-‘লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই মাই সান।আমি জানি তুমি একবছর আগেই আমার ছোট মেয়েকে ছবি দেখেই পছন্দ করেছো।তারপর আরও দুবার আমার বাসায় গিয়ে আমার ছোট মেয়ের ছবি লুকিয়ে নিয়ে এসেছো।আমি সবটাই জানি।কিন্তু আমি বাঁধা দেই নি।হ্যাঁ নীলা আমার মেয়ে তেমন তুমিও তো আমারই সন্তান।আর আমি জানি তুমি অনেক যোগ্য। কিন্তু সেটা যে নীলার কাছে তোমাকে প্রমাণ করতে হবে সান।’
বর্ণ মুচকি হেসে মাথা নাড়ায়। সামনের মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়।
আজিজুর রহমান বর্ণের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
-‘আমি তোমাকে ভুল চিনি নাই তা একটু আগে আবার প্রমাণ হলো। আমার মেয়ের শীতে গরম কাপড় মনে করে পড়ার অভ্যাস নেই।বরাবরই আমাকে পড়িয়ে দিতে হয়।আজ দেখলাম আমার কাজটা অন্য কেউ নিজের হাতে তুলে নিয়েছে।নিশ্চিত হলাম মানুষ চিনতে আমার সত্যিই ভুল হয় নি।’
বর্ণ প্রাণভরে শ্বাস নেই।যাক একবছর পর তার মনের খবর কেউ জানলো এতেই শান্তি।তখনই বর্ণ ফিল করলো তার শরীরে কেউ চাদর জড়িয়ে দিচ্ছে।সেটা আর কেউ না আজিজুর রহমান।
আজিজুর রহমান বর্ণের গায়ে চাদর জড়াতে জড়াতে বলল
-‘তুমি তো তোমার চাদরটা আমার মেয়েকে দিয়ে দিলে।তাই আমার মেয়ের জন্য যেটা এনেছি সেটা তুমি নেও।আমার মেয়ের খেয়াল তুমি তখনই রাখতে পারবে যখন তুমি নিজে সুস্থ থাকবে।তাই না?’
বর্ণ উপর নিচ মাথা নাড়ায়। তারপর বলে
-‘স্যার তাহলে নীলাম্বরী রাগ কেনো করলো সেটা বললেন না।’
আজিজুর রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে।আকাশ পানে চেয়ে বলে
-‘শামুক দেখেছো কখনো? তার উপরের খোলশ শক্ত ভিতরেরটা নরম।আমার মেয়েও ঠিক এমনই।সে আগে এমন ছিলো না তবে কোনো এক কারণে হয়ে গেছে।আমার যতটুকু মনে হয় তোমার কাজ তাকে মুগ্ধ করেছে কিন্তু সে চায় না কারো উপর মুগ্ধ হতে বা বিশ্বাস করতে।তাই সে পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে গেলো।’
বর্ণ এবার বুঝতে পারে নীলার আচরণের কারণ।হঠাৎ করেই আজিজুর রহমান বর্ণের দুহাত আকড়ে ধরে বলে
-‘বলো তো আমার মেয়েটা আমার কাছে কী?’
বর্ণ মুচকি হেসে বলে
-‘আপনার প্রাণ।’
আজিজুর রহমান ছলছল নয়নে তাকিয়ে বর্ণকে বলল
-‘তাহলে মনে রেখো এক নিরুপায় বাবা তার প্রাণ তোমার ভরসায় রেখে যাচ্ছে।ভরসা রেখো সে হতভাগা বাবার।’
আজিজুর রহমান এক সেকেন্ড ও দাঁড়াল না চলে গেলো।বর্ণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আজিজুর রহমানের দিকে।বরাবরই দেখে আসছে এই মানুষটার ব্যাক্তিত্বে পাহাড়ের মতন প্রখর তালগাছের মতন উচুঁ।আজ সে মানুষটারও চোখ ছলছল করছে!
#চলবে,,
#চলবে,