বিবর্ণ বসন্ত পর্ব ৫

#বিবর্ণ_বসন্ত
নুসরাত জাহান লিজা
পঞ্চম পর্ব

দশ.
পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম সূর্যকে ফ্রেমিং করছিল আবিদ। পুরো আকাশে লালচে মেঘের ভেলা, মনে হচ্ছিল আকাশে যেন আগুন লেগেছে। ধূপছায়া গোধূলি লগ্নের মনোরম সৌন্দর্যকে ধারণ করায় মগ্ন আবিদ থমকালো কারো ডাকে, “এই যে ফটোগ্রাফার ভাইয়া, শুনছেন? ”
আবিদ ঘুরে অতসীকে দেখতে পেল, কণে দেখা আলোতে আরও বেশি স্নিগ্ধ লাগছিল ওকে।
“বাব্বাহ, এত মনোযোগ দিয়ে ছবি তোলেন আপনি! সেই কখন থেকে ডাকছি, সাড়াই পাচ্ছিলাম না, ভাবলাম আপনি কানে কম শোনেন কিনা!” বিস্ময়ের সাথে কিছুটা যেন অভিমান মেশানো গলায়। আশ্চর্য! কীসব ভাবছে সে, একদিন একমুহূর্তের দেখায় কেউ অভিমানের অধিকার কেন দেখাতে যাবে! নিজের মনেই হেসে ফেলে ও।
“আসলে এতটা সুন্দর আকাশটা, যে তার বিশালতায় আর সৌন্দর্যে ডুবে গিয়েছিলাম! সেদিন তো মোটামুটি থ্রেট করে গেলেন, আজ হঠাৎ নিজে থেকে দেখা দিলেন যে?”
আবিদ এই দু’দিন ওকে খুঁজেছে, ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা অনুভব করেছে দেখা না পেয়ে। আজ মন বলছিল দেখা হবে, হয়েই গেল তবে।
“তাছাড়া আর উপায় কী বলুন? আপনি তো পাড়ার প্রায় সব বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করেছেন আমার কথা। পরে দেখা যাবে আমার বাড়িতেই চলে এসেছেন, বলা তো যায় না!”
আবারও অপ্রতিভ বোধ করলো আবিদ, যেখানে কথার পিঠে কথা সাজাতে ওর জুড়ি মেলা ভার সেখানে এই পুচকে মেয়ের সামনে আসলে শব্দরা হাওয়ায় মিলিয়ে যায় কেন ভেবে পায় না সে! ধরা পরে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল ওর।
“তোমার তাই মনে হলো? আমি কিন্তু এতটাও হ্যাংলা নই!” দৃঢ়ভাবে বলার চেষ্টা করলেও কিছুটা ক্লিশে শোনালো কথাটা। অতসীর দিকে তাকিয়ে মনে হলো কিছুটা সেজেছে ও, চোখে সরু কাজলের রেখা। বোকার মতো ভাবতে ইচ্ছে করল ওর জন্যই বুঝি নিজেকে কিছুটা রাঙিয়েছে মেয়েটা! কিন্তু তাতো আর সত্যি নয়। এই বয়সী মেয়েরা অকারণেই সাজায় নিজেকে।
“হ্যাংলাপনার বাকিও রাখেননি কিছু। জনে জনে এসব বলেছেন, লোকে কী ভাববে বলুনতো? ”
“লোকের ভাবনায় আপনার দেখছি অনেক কিছু আসে যায়!”
“না গিয়ে আর উপায় কী বলুন? সবাইকে নিয়েই তো চলতে হয়, একটু পরোয়া করতেই হয়। যদিও কে কী বলল সেসব নিয়ে আমার খুব একটা মাথা ব্যাথা নেই, তবুও আমার পরিবারের তো আছে। আর একবার আপনি একবার তুমি না বলে যেকোনো একটা বলুন, ভীষণ অস্বস্তি হয় আলাদা আলাদা সম্বোধনে।”
অতসী একটু বেশি কথা বলে, কিছুটা ঠোঁটকাটাও। মুখের উপর অপ্রিয় সত্য বলে দিতে পারে নির্দ্বিধায়।
“তুমিই বলি তাহলে, পুচকে একটা মেয়েকে আপনি বলতে আমারও অস্বস্তি হচ্ছিল ভীষণ।”
“আমি মোটেও পুচকে মেয়ে নই, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেব সামনে। আঠারোয় পা দিতে মাত্র দেড় মাস বাকি।” দৃঢ় স্বরে বলল অতসী, চোখে রাগ স্পষ্ট।
“বুঝলাম, অনেক বড় তুমি! তোমাকে কী বলে ডাকবো তবে, দাদী নাকি নানী?” ব্যাঙ্গাত্মকভাবে বলল আবিদ।
“আপনাকে খুঁজে বের করাই ভুল হয়েছে দেখছি! মহা ঝামেলাবাজ লোক তো আপনি!”
“আচ্ছা, স্যরি। এখন বলো কেন খুঁজছিলে আমায়? আর আমি মোটেও ঝামেলা করিনা।”

“আমি কোথায় খুঁজলাম আপনিই তো আঁতিপাঁতি করে আমার অনুসন্ধান চালালেন, আপনার প্রতি দয়া হলো, তাই চলে এলাম দেখা করতে।”
“আসলে আপনার ছবিগুলো দেবার ছিল, একটু কাজ বাকি, হলেই তোমারটা পেয়ে যাবে।”
“তো রেডি না করেই দেখা করার জন্য অস্থির হলেন কেন?”
আবিদ অসহায়বোধ করে অনেকটা, উত্তর হাতড়াতে থাকে কিন্তু ফল শূন্য। অতসীর দিকে তাকিয়ে দেখে ওর ঠোঁটের কোণে বিস্তৃত হাসির রেখা। চোখে ‘সব বুঝতে পেরেছি’ ধরনের হাসি। অতসী ওকে পড়ে ফেলেনিতো, শঙ্কিত হয় ও!
“শোনেন, এরপর থেকে বাচ্চাদের বিরক্ত করবেন না আর। দু’দিন পরে এই সময় আমি এখানে থাকব, আপনি ছবিগুলো নিয়ে এখানেই আসবেন কিন্তু।” কথা শেষ করে আর এক মুহূর্ত ও অপেক্ষা করল না, ত্বরিত ঘুরে গটগট করে হেঁটে চলে যায়। বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে হতভম্ব আবিদ। নিজের মতো বলতে থাকে, “এই বয়সেই ভারী পেকেছে মেয়েটা!” সেদিনের পুচকে মেয়ের ছোঁড়া প্রশ্নের শেলে পুরোপুরি পরাস্ত সে।

এগারো.
আবিদের বন্ধুর কোন এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায় পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকছে ও, তাই থাকা খাওয়া নিয়ে কোন সমস্যা হচ্ছে না। ছবিগুলোর এডিটিং শেষ করে রেখেছে, সেইসাথে নিজেকে প্রস্তুত করেছে এবার নিজেও কিছু কথা শোনাবে। কথার আক্রমণ কথায় ফেরত দেবে। অন্তত মানসম্মান কিছুটা হলেও ধরে রাখা যাবে তাতে। আর কতবার নাজেহাল হওয়া যায়!
প্রস্তুতি পর্ব শেষ করে অতসীর বলে দেয়া জায়গায় গিয়ে বসে থাকে। বিশাল গাছের শেকড় ছড়ানো মাটির উপরেই। তাতেই আসন গেড়েছে। আজকের সূর্য এতটা রক্তিম না হলেও লালচে আভা ছড়াচ্ছিল।
বসে বসে বিরক্তি ধরে যাচ্ছিল, তখনই আগমন ঘটে কাঙ্ক্ষিত জনের।
“আপনি তো দেখছি খুব সময় মেনে চলেন! আমি পাস মার্ক দিলাম।”
বিরক্তি চেপে আবিদের উত্তর, “আমি ধন্য হলাম। এখন এটার পুরস্কার হিসেবে কী পাচ্ছি জানতে পারি?”
“না, পারেন না। আগে ছবিগুলো দেখব তারপর ভেবে জানাব। এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? মনে হচ্ছে ভূত ভর করেছে মাথায়!”
আবিদ চোখ রাঙানোয় এই কথা বলল অতসী।
আবিদ উত্তর না দিয়ে ছবিগুলো বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে দিল। খপ করে নিল সেটা ও। ছবি দেখে ভেতরে ভেতরে উল্লাসে ফেটে পড়ছিল, তা বোঝা যাচ্ছিল ওর অভিব্যক্তিতে।
“হায় আল্লাহ! এটা আমি! আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না!” ওর উদ্ভাসিত মুখ এত মায়াময় লাগছিলো যে আবিদের লোভ হচ্ছিল সেটাও ফ্রেমে আবদ্ধ করতে, কিন্তু সাহসে কুলায় না। আবার কোন দিক থেকে আক্রমণ শুরু হয় কে জানে!
“যান, মাফ করলাম আপনাকে, এটাই আপনার পুরস্কার।”
বিস্ময়ে হতবাক আবিদ জানতে চায়, “আমি কখন মাফ চেয়েছি তোমার কাছে? আর তাছাড়া অপরাধটাই বা কী ছিল তাও তো জানি না!”
ভ্রু কুঁচকে অতসী বলে, “সে কী! না বলে ছবি তুলেছেন, এটা অপরাধ মনে হচ্ছে না! সারা পাড়ায় ঢোল পিটিয়ে আমায় খুঁজেছেন, এটাও গুরুতর অপরাধ। স্যরি তো দূরের কথা, নিজের অপকর্মের কথাই বেমালুম ভুলে গেছেন দেখছি!”
অতসীর কাছে আরেকবার ধরাশায়ী হয়েছে ভাবতেই অস্বস্তি বোধ করলো আবিদ। এত বিপুল প্রস্তুতি কিচ্ছু কাজে আসেনি, ভেতরে কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে আসছে। নিজেকে এবার সত্যিই হ্যাংলা মনে হচ্ছে ওর!
“আমি মাত্র দুইজন বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। মোটেও সারা পাড়ায় ঢোল পিটাইনি!” গলাটা কাতর শোনায়।
মুখ চেপে হাসি আটকে অতসী বলে, “আপনাকে একদম চোর চোর লাগছে এখন।”
এতক্ষণ সহ্য করলেও এবার আর পারল না, “কী মনে কর নিজেকে, এসব উদ্ভট কথাবার্তার মানে কী?” প্রায় চিৎকার করে জানতে চায় ও।
অতসী ভড়কে না গিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে, “সদ্য প্রেমে পরা যুবক যখন তা লুকাতে চায় তখন তার মধ্যে ধরা পরে যাবার ভয় থেকে চোর চোর ভাব চলে আসে তেমন লাগছে আপনাকে! কারও প্রেমে ডুবেছেন নাকি!”
এতটা সরাসরি মন্তব্যে একেবারে দিশেহারা বোধ করলো আবিদ। এত দ্রুত এভাবে নিজের অনুভূতি কেউ পড়ে ফেলেছে ভাবতেই অসহায়বোধ করে ভীষণ রকম। ভেতর থেকে কেউ বলে উঠে, “ভেতরে যা জমিয়েছিস কয়েক দিনে সব বলে দে সব। এমন মোক্ষম সুযোগ আর কখনো পাবি না!”
ক্ষণিকের বিমর্ষতা কাটিয়ে মনের ডাকে সাড়া দিয়ে দুঃসাহসিক কাজ করে ফেলে ও, “হ্যাঁ, সদ্যই প্রেমে পরেছি। কোন এক অপার্থিব অষ্টাদশীর। যে ভীষণ রকম ঠোঁটকাটা। মুগ্ধতা দিয়ে শুরু হলেও তার ভালোবাসায় ডুবন্ত এখন আমি। এই পড়ন্ত বসন্ত বেলায় আমি তোমার হাতটা ধরতে চাই, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। ধরবে আমার হাত?”
মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে আছে অতসী, ঝাপসা হয়ে আসছে দৃষ্টি। “বিশ্বাস যদি ভেঙে যায়? কিছুই জানিনা আপনার সম্পর্কে। সহসা জন্মানো ভালোবাসা যদি মুহূর্তের আবেগ ভেবে ভুলে যান, কি করব তখন? আমিও কখন ভালোবেসে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি, এজন্যই এতটা জ্বালিয়েছি আপনাকে। আমার পাগলামি কতটা সহ্য করতে পারেন তা তো জানতেই হতো!”
আবিদের কাছে মনে হলো এটা স্বপ্ন, কোনভাবেই এটা সত্যি নয়। এই আরাধ্য রমণীকে এত সহজে কিভাবে পাবে তাই ভাবছে ও।
“তোমার বয়সটা আবেগের আমারটা তো নয়। আমি এই কয়েক দিনে সহস্রবার ভেবেছি, এটা শুধু মোহ নাকি ভালোবাসা! মন বারবার বলেছে এটা ভালোবাসা না হয়ে পারে না।”
চোখ ভর্তি জল নিয়ে আবিদের বাড়ানো হাতটা ধরলো অতসী। বসন্ত রঙে ছেয়েছে যেন চারপাশ! আকাশটা মুহূর্তে যেন আরও রক্তিম হলো! দুজনের মনে তখন সহস্র প্রজাপতি উড়াউড়ি করছিল যেন! সবকিছু এত সুন্দর লাগছে কেন? বসন্ত বুঝি এতটা রঙিন হয়!
কিন্তু এত সহজে পাওয়া কিছু যে ভীষণ ক্ষণস্থায়ী হয় যতই অপার্থিব হোক, তা বেমালুম ভুলে গিয়ে ভালোবাসার আকাশে ডানা মেলে দিল সদ্য ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এক জোড়া কপোত আর কপোতী। সামনে যে কী ভয়াবহ নির্মম পরিনত অপেক্ষা করছিল তার আঁচও পায়নি ওরা!
………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here