বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব -০৩

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু #নুরুন্নাহার_তিথী #পর্ব_৩ রুহানী একটা সবুজ লম্বা গাউন পড়ে ডুপ্লেক্স কমিউনিটি সেন্টারের দ্বিতীয় তালার টেরেস থেকে রিহা ও জিহানের বিয়ে দেখছে। রহমত শেখ ও জাহানারা শেখকেও সেখানে থাকতে হচ্ছে। শত হোক মেয়ে তাদের! রহমত শেখ সেখানে থাকতে রাজি হচ্ছিলেন না কিন্তু পারিবারিক মনমালিন্য সবার সামনে আনতে নারাজ রুহানী। প্রায় ছয় বছরের মতো হচ্ছে রিহা বাড়ি ছেড়েছে। বর-কনের সম্মতিতে বিয়ে সম্পূর্ণ হয়। জাহানারা শেখ নিচ থেকে দোতালার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, রুহানী টেরেসে দাঁড়ানো। জাহানারা শেখ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের জল মুছে রুহানীর কাছে উপরে আসেন। তিনি এসে বুঝতে পারেন, রুহানী অন্যমনা হয়ে আছে। জাহানারা শেখ রুহানীর মাথায় হাত রেখে নরম স্বরে ডাকেন, “রুহানী?” রুহানীর ধ্যান ভাঙে। সে জাহানারা শেখের দিকে তাকালে, জাহানারা শেখ বলেন, “কষ্ট পাস না। জানি বলা সহজ কিন্তু মানা কঠিন। কিন্তু দেখবি, একদিন সব তোর অনুকূলে হবে। আজ আমারই মেয়ের জন্য তোর সাথে এরকমটা ঘটলো। তোর বিয়েটা ভাঙলো। আমি জানি রিহা তোকে পছন্দ করে না। ছোটো থেকেই ও এরকম। তোকে সহ্য করতে পারে না। তাইতো ৬ বছর আগে ওকে দেশের বাহিরে ওর মামার সাথে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর ব্ল্যা*কমে*ইল করে ২ বছর আগে ইটালির ব্রাঞ্চটা নিজের নামে করল। ভেবেছিলাম এতোদিন হয়তো ও বদলে গেছে। যেহেতু সে আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখেনি। কিন্তু কে জানতো? ও এসে এসব করবে! ওর জন্য আমি তোর কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাচ্ছি।” জাহানারা শেখ হাত জোড় করতেই রুহানী দ্রুত উনার হাত দরে ফেলে মাথা দুই পাশে নেড়ে নিষেধ করতে থাকে। তারপর মুচকি হেসে ইশারায় বুঝায় সে রাগ করে নেই। কিছুক্ষণ পর কনে বিদায়ের পালা শুরু হবে তাই রুহানী তার চাচিকে জোড় করে নিচে পাঠায়। জাহানারা শেখ নিচে যেতেই রুহানী তার গাউনটা সামনের দিকে হালকা উুঁচু করে নিজের হাঁটার উপযোগী করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। গাউনের দৈর্ঘ্য এতোটাই যে সিঁড়ি ঝা*ড়ু দেওয়ার কাজ হয়ে গেছে! রুহানীর খুব ইচ্ছে করছে রাতের বেলায় চা বাগানে ঘুরতে। চাচাকে অনেকবার বলেও রাজি করাতে পারেনি। তাই আজ নিজেই সেন্টারের সবার আড়ালে বেরিয়ে পরল। তাছাড়া মন খারাপের সময় সে এমন কিছু করতে চায় যার মাধ্যমে মন ভালো হবে। দারোয়ান, ড্রাইভারের নজর ফাঁকি দিতে তাকে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে কিন্তু ঢি*ল ছুঁ*ড়ে ঠিকই বেরিয়ে আসতে পেরেছে। এখন সে চা বাগানের শুনশান রাস্তায় নিজের গাউন সামলিয়ে হাঁটছে। আকাশে ভরা পূর্ণিমা না। দুই দিন আগেই পূর্ণিমা গেছে। তবে চন্দ্রমার জোৎসনার আলোয় রাস্তাঘাট কিছুটা হলেও পরিষ্কার। তাই সে প্রথমেই ফোনের ফ্লাশলাইট অন করল না। আশেপাশে সমস্ত ঝিঁঝি পোকার ডাক কেমন একটা গা ছমছমে ভাব এনে দিচ্ছে সেই সাথে কেমন অদ্ভুত শিহরণ কাজ করছে। অবশ্য এই চা বাগানের ভেতরের রাস্তা দিয়ে তাদের বাংলোতে কিছুটা কম সময়ে যাওয়া যায়। এমনিতে বড়ো রাস্তা দিয়ে যেতে কিছুটা বেশি সময় লাগে। তাও মানুষজন এই শর্টকাট রাস্তা সন্ধ্যা হতেই পরিহার করার চেষ্টা করে কারণ এখানে ভীতিকর পরিস্থিতির উৎপন্ন হয়। রুহানীরও এখন মনে মনে ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে। তারউপর সে বিপদে পরলে কাউকে সাহায্যের জন্য ডাকতে পারবে না! এটা ভেবেই তার শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠছে। নিজের আবেগের জন্য সে যে কতো বড়ো নির্বুদ্ধিতার কাজ করেছে তা সে এখন বুঝতে পারছে। চা বাগানের ভেতর থেকে ঝিঁঝি পোকার সাথে মাঝেমাঝেই অন্যান্য প*শু-পাখির চলাফেরা ও মৃদু কিংকর শব্দ হচ্ছে। ভেতরের রাস্তার পাশে বড়ো বড়ো গাছে বাঁদুর ঝুলে আছে আবার ডানা ঝাপটানোর আওয়াজও আসছে। রুহানী বড়োসড়ো একটা ঢোক গিলে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অন করে দ্রুত চলতে লাগল। দূর থেকে দেখলে মনে করবে সে দৌঁড়াচ্ছে। পথ চলার সাথে সাথে তার হালকা কোঁকড়ানো কোমড় ছড়ানো খোলা চুলগুলো ঢেউ খেলছে। জামার রংটও চা বাগানের সাথে মিশে গেছে। ঠিক সেই মূহুর্তে কারও কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে রুহানী হকচকিয়ে ঘাবড়ে ওঠে। আচমকাই তার পা জায়গাতেই আটকে গেছে। ভয়ে কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝড়ছে তার। বৈশাখ মাসে এমনিতেই গরম, কিন্তু চা বাগানে হাওয়ার কারণে প্রশান্তি কাজ করে। কিন্তু এমতাবস্থায় তার মনে সকল প্রশান্তি যেন নিমিষেই উদ্বায়ি হয়ে গেল। “এই যে মিস! আমি আপনাকেই বলছি। এই রাতের বেলা এখানে এসেছেন কেন? তাও আবার একা!” রুহানী মনে মনে অনবরত আয়াতুল কুরসি পড়তে লাগল। কণ্ঠস্বরটা কোনো ছেলের যেটা তার পেছন থেকেই আসছে! ছেলেটি যে তার দিকে এগুচ্ছে সেটাও রুহানী অনুভব করতে পারছে। শুকনো পাতার মড়মড় ধ্বনির সাথে পদধ্বনি। যখনি বুঝতে পারল ছেলেটি তার খুব নিকটে তখনি রুহানী আচমকা ঘুরে ফোনের ফ্ল্যাশলাইটটা ছেলেটির চোখে-মুখে ফেলল। ছেলেটা রুহানীর থেকে হাত দেড়েক দূরে দাঁড়ানো। হঠাৎ তীব্র আলোর উজ্জ্বলতা ছেলেটির চোখে সইল না। সে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে নিয়ে বলল, “আরে লাইট বন্ধ করুন। আমার চোখে লাগছে।” ছেলেটির কথায় রুহানী মোটেও কর্ণপাত করল না। সে এক পা এক পা করে পিছাতে লাগল। ছেলেটি আবার বলে ওঠল, “আপনি কি আমায় ভয় পাচ্ছেন? প্লিজ ভয় পাবেন না। আমি কোনো ভূ*ত-জ্বী*ন নই। আমি তো হাওয়া খেতে এখানে এসে আপনাকে দেখেছি। আপনার বেশভূষা দেখে তো প্রথমে আমিই ভয় পেয়েছিলাম! ভেবেছিলাম, লোকমুখে কল্পকাহিনী তবে কি সত্যি নাকি?” ছেলেটির কথা শুনে রুহানী থামল। ভ্রুঁ কুঁচকে ছেলেটার দিকে চেয়ে আছে। ছেলেটি তাকে কী ভেবেছে তা জানার কৌতুহল হচ্ছে। ফ্ল্যাশলাইটটা এবার সে নিচের দিকে করল যার দরুণ ছেলেটি পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাল। ছেলেটি বলল, “খোলা চুল, মাটি ছোঁয়ানো গাউন, পায়ে নুপুর!” ছেলেটির মুখে নুপুরের কথা শুনে রুহানীর নিজের পায়ের দিকে নজর যায়। সে যে নুপুর পড়ে আছে তা তার খেয়ালে ছিল না। ছেলেটি বলল, “এমন নিশুতি কুহিকিনীর বেশে কোথায় যাচ্ছেন?” রুহানীর থেকে কোনো জবাব না পেয়ে ছেলেটি আবার বলল, “কী হলো? কথা বলছেন না কেন? ভয় কি এখনো কাটেনি? আপনি চাইলে আমার হাতে চি*মটি কেটে দেখতে পারেন। আমি মাইন্ড করব না। তাও আমাকে ভয় পাবেন না। আমি খুব সুইট, নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ। ওই দূরে আমার একটা ছোটো হাওয়া ঘর আছে। হাওয়া ঘর মানে ঘরটার আসলে উপরে ছাউনিটা ও দুই পাশ বদ্ধ। উত্তর, দক্ষিণ মুখী করে খোলা। বেশ শীতল হাওয়া আসে। তাই এখানেই এসে বসে থাকি। আজকাল যা গরম পরেছে! অবশ্য বৈশাখ মাস বলে কথা! তা মিস, আপনিও কি চা বাগানে হাওয়া খেতে এসেছেন? নাকি ভূ*ত-প্রে*তদের নিমন্ত্রণ করতে এসেছেন?” ছেলেটির অহেতুক বা*চালতায় রুহানী বেশ বিরক্ত। সে ঘুরে চলে যেতে নিলে ছেলেটি দ্রুত তার সামনে এসে দুইপাশে দুই হাত ছড়িয়ে রম্যস্বরে বলে ওঠে, “আরে মিস, আপনি তো রাগ করে বসলেন! আমি তো আপনার সাথে মজা করেছিলাম। তা মিস, আপনার নাম কী? কোথায় যাবেন? আসুন আমি পৌঁছে দিচ্ছি।” ছেলেটির প্রস্তাব অস্বিকার করে রুহানী ছেলেটির হাত সরিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। ছেলেটিও রুহানীর পিছু পিছু যেতে যেতে বলতে লাগল, “মনে হচ্ছে, আপনার রাগ, অভীমানের পাল্লা বেশ ভারী! এতক্ষণ যাবত আমি এতো কিছু বললাম কিন্তু আপনি একটা টু শব্দও করলেন না! মনে হচ্ছে, চা বাগানের বো*বা ভূ*ত আপনার উপর ভর করেছে!” রুহানী এবার থেমে গেল। তার চোখে পানি জমে ওঠেছে। তার ইচ্ছে হচ্ছে, এই রাতের চা বাগানের মধ্যেই নিজের সকল আক্ষেপ রেখে যেতে। চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু তা করতে না পেরে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। ছেলেটি রুহানীকে আচানক থেমে যেতে দেখে আবারও সামনে এসে দাঁড়ায়। সে বুঝতে পারছে না, মেয়েটি হুট করে এমন বিহেভ করে কেন? তার একটা কথারও জবাব দেয় না। তবে মেয়েটির জোড়ে নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে ছেলেটি জিজ্ঞেসা করে, “আর ইউ অকে? আপনার অ্যা*জমা আছে? দাঁড়ান, আমার পকেটে সবসময় একটা ইনহেলার থাকে। দিচ্ছি আপনাকে।” এই বলে ছেলেটি পকেট থেকে ইনহেলার বের করতে নিল, তখনি রুহানী ফোনের লাইটটা দিয়ে নিজের মুখশ্রী দৃশ্যমান করিয়ে হাতের ইশারায় ও হালকা গোঙানির মতো করে বুঝাতে চাইল, সে কথা বলতে পারে না। সে বো*বা। ছেলেটি রুহানীর কথা বুঝল কী-না রুহানী জানে না কিন্তু ছেলেটিকে অপলক তার দিকে দৃষ্টি স্থির রাখতে দেখে ভীষণ অপ্রস্তুত হলো। সে আবারও নিজের মতো হাঁটতে লাগলে ছেলেটি পেছন থেকে বলে ওঠল, “আমি আপনাকে দেখেছি মিস!” চলবে ইনশাআল্লাহ, ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here