#বিবর্ণ সিঁদুর
#পর্ব- ০২
# Writer Taniya Sheikh
বধূবরণের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে, রজনী বসে আছে শাশুড়ির রুমে। এতো বড় রুম আর এতো বড় বাড়ি এই প্রথম দেখল সে। রুমটা দামি আসবাবে সাজানো গোছানো। রজনীর শাশুড়ির বয়স পঞ্চাশের দোরগোড়ায় হলেও দৈহিক গড়নে বোঝার উপায় নেই। যৌবনে বেশ সুন্দরী ছিলেন দেখলেই বোঝা যায়, এখনও যথেষ্ট আছেন৷ বিধবা হয়েছেন অল্প বয়সেই। এরপর একাই মৃত স্বামীর রেখে যাওয়া ব্যবসা সামলে ছেলে দুটোকে বড় করেছেন৷ সাদা জামদানি শাড়ি, গলায় মুক্তোর মালা পরিহিত সারদা ব্যানার্জি পুত্রবধূর পাশে এসে বসলেন।জবুথবু হয়ে বসে ছিল রজনী। শাশুড়ি পাশে বসতেই নড়েচড়ে নিজেকে পরিপাটি করতে ব্যস্ত হলো।
” ঠিক আছে। ঠিক আছে। এখন তো পর না আমরা।”
সারদা হাসলেন। বড় চমৎকার সে হাসি। রজনীর ক্লান্তি কিছুটা যেন কমলো হাসিটুকু দেখে। সারদা পুত্রবধূর ঘোমটা খুলে পাশে রেখে, চুল পিঠের উপর ছড়িয়ে দিলেন। উঠে আলমারি থেকে আরামদায়ক একটা শাড়ি এনে তুলে দিলেন রজনীর হাতে।
“যাও কাপড়টা পাল্টে এসো।”
রজনী কিছুক্ষন চেয়ে রইল সারদার মুখের দিকে। মমতা ভরা মুখখানি। এই ভারী শাড়ি আর গহনার ভারে তার প্রাণটা হাসফাঁস করছিল এতোক্ষণ। শাশুড়ি ভালো মনের বলে বুঝেছেন হয়ত। রজনী এক চিলতে হাসি উপহার দিতে চাইল বিনিময়ে। কিন্তু এলো না হাসি। কাপড় হাতে ধীর পায়ে হেঁটে গেল ওয়াশরুমে। এতোবড় ওয়াশরুম এই প্রথম দেখা। রাজকীয় ধাঁচের কিছুটা। সোনালী রঙের নল, “ওটাকে নলই তো বলে তাই না?” রজনী মনে মনে ভাবল। নল ছাড়া এখানের আর কিছুর নামই সে বলতে পারল না। জীবনেও দেখেও নি বোধহয় এসব। কাপড় পাল্টে, হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলো সে। রুমে শাশুড়ির সাথে আরও একজনকে সে দেখল। ছোট বউদির বয়সে হবেন তিনি। দেখতেও ভারী সুন্দর। রজনীকে দেখামাত্রই মিষ্টি করে হাসল। এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে এনে বসাল খাটে।
” আমি তোমার ছোট জা হই বউদি।”
রজনী স্থির চোখে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। কথাবার্তায় তার মতো আঞ্চলিকতার রেশ নেই। শুদ্ধ, মার্জিত উচ্চারণ ও কথার বলার ধরণ। রজনী এবার একটু হাসল। হাসতেই ঠোঁটের শুকনো ঘা’টায় টান লাগে। যন্ত্রণা, ভীষণ যন্ত্রণা হয় তাতে। রজনী চেপে গেল সে যন্ত্রণা। ওর জা উঠে গিয়ে খাবার থালি নিয়ে এলো। কয়েক রকমের খাবার আর মিষ্টান্নে ভরা। ওদের পীড়াপীড়িতে দু’টো মিষ্টি আর পায়েস খেল শুধু। রজনীকে বিশ্রাম নিতে বলে ওরা রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বালিশটা ছুঁয়ে দেখল রজনী। নরম তুলতুলে বালিশ আর বিছানায় সে শোবে। বিনিময়ে তাকে কী চরম মূল্যই না দিতে হবে!
বিছানা গা এলিয়ে দিল কিন্তু ঘুম এলো না সহজে এই নতুন ঘরের নতুন বিছানায়। রজনী ভাবতে লাগল,
” আচ্ছা সবাই আশা বাঁধছে তার স্বামী একদিন তাকে মেনে নেবে। সংসারী হবে তাকে পেয়ে। এতোই কী সহজ বিষয়টা?” রজনী চোখ বন্ধ করে। ঝাপসা ভাবে ভেসে ওঠে স্বামী সৌমিত্রের চেহারা। দেখেনি সৌমিত্রকে ঠিক তেমন নয়। ঐ যে শুভদৃষ্টির সময় এক পলক দেখেছিল আবছা চোখে। তবে সেটা অস্পষ্ট। সৌমিত্রকে নিয়ে অনেক কিছুই ভাবনায় আসে। তার জীবনও কী নাটক সিনেমার মতো হবে? প্রথমে স্বামী মানবে না, পরে অনেক ভালোবাসবে। এমন কী হয়! সৌমিত্রের মতো পুরুষ যে কিনা তাকে সন্তান উৎপাদনের মেশিন মনে করেছে শুধু; সে কি আদৌ স্ত্রীর মর্যাদা দেবে তাকে?
” এমন দিবাস্বপ্ন তুই দেখিস না রজনী। যা হওয়ার নয় তা মনে বাঁধিস না। তার কাছে তুই কেউ না, কিছুই না।”
রজনী কাঁত হয়ে শোয়। কান্না গলায় আঁটকে আছে। বুকের পাশটা ভারী হয়ে আছে কষ্টে। তাকে এই ললাট লিখন মেনে নিতেই হবে। এ ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
এসব ভাবতে ভাবতে গত কয়েকদিনের ক্লান্তি তাকে ঘুমের রাজ্যে টেনে নিল। ঘুমের মধ্যেও সে এসবই দেখল। গা কাঁপছে তার ঘুমন্ত অবস্থায়ও।
সৌমিত্র ধুতি পাঞ্জাবি ছেড়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ায়। ছয় ফুট দীর্ঘদেহী সৌমিত্রের সারা শরীর ভিজে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বন্ধ চোখে, দু’হাত সামনের দেয়ালে রেখে ঝুঁকে ভিজছে।
আট’টা বছর সে ভুলে আছে মায়াকে। প্রতিজ্ঞা করেছিল জীবনে দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না। কিন্তু তার সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হলো মায়ের কারনে। নাতি -নাতনীর মুখ দেখবেন বলে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে মরতে বসেছিলেন মা। মা’কে বাঁচাতে তাকে তাই প্রতিজ্ঞা ভাঙতে হলো। সৌমিত্র জানে নাতি -নাতনি এসব বাহানা। তার মা তাকে সংসারী দেখতে চায়। কিন্তু মা কী জানে, সবার সংসার হয় না। মায়ার বিশ্বাসঘাতগতা তার বিশ্বাস সমূলে উঠিয়ে নিয়েছে। বিশ্বাস ছাড়া কী ভালোবাসা হয়? নাকি ভালোবাসা ছাড়া দু’টো মানুষ এক হতে পারে? সে মানুষটা যতোই পাষান, বদরাগী হোক তবুও কারো মন নিয়ে খেলবে না। তাই তো উদ্ভট একটা শর্ত জুড়ে দিয়েছিল। মায়ের জেদে রেগে সেদিন বলেছিল,
” ঠিক আছে। তোমার কথায় হবে। নাতি-নাতনি চেয়েছ তো। তাহলে বিয়ে আমি কেবল ঐ কারনেই করব। সন্তান জন্ম দিয়েই তাকে ত্যাগ করব।”
” এসব কী ধরনের কথা। এমন করে বিয়ে হয় নাকি?” সারদা ছেলের কথায় ঝাঁঝিয়ে ওঠেন। সৌমিত্র মুচকি হেঁসে বলেছিল,
” আমিও তো সেটাই বলছি। তার চেয়ে আমি সারোগেসির পদ্ধতিতে আগায়। এতে আমাকে বিয়েও করতে হবে না আর তুমি,, ”
সৌমিত্রকে থামিয়ে দেন সারদা। বলেন,
” চুপ কর! তোর চালাকি আমি বুঝি না ভেবেছিস? বিয়ে করতেই হবে তোকে সে একদিনের জন্য হোক কিংবা এক বছর।”
” আমার আপত্তি নেই তবে ঐ যে শর্ত, ওটাই বহাল থাকবে। এখন এমন মেয়ে যদি বাংলাদেশ অথবা কলকাতায় পাও তো দেখো।”
সৌমিত্রের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এ যাত্রা বিয়েটা হবে না। এমন শর্ত কোনো মেয়ে বা তার পরিবারই মেনে নেবে না। সুতরাং সৌমিত্র ঝামেলামুক্ত। কথায় আছে না মানুষ ভাবে এক হয় আরেক। তার স্বস্তির নিঃশ্বাসের গতি কমে এলো যখন তার মা হেঁসে বললেন, তিনি কনে পেয়ে গেছেন এবং তারা সৌমিত্রের সকল শর্ত মেনে নিয়েছে। সৌমিত্রের প্রথমে বিশ্বাস হয় নি। পরে সে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে অর্থের লোভে মেয়ে পক্ষ রাজি হয়েছে। ঘৃণায় মুখ শক্ত হয়ে গিয়েছিল সৌমিত্রের। সামান্য অর্থের জন্যে একটা মেয়ে নিজের সম্মান, মাতৃত্ব বেঁচতে পারে? মায়া শুধু একা নয় তাহলে! অসংখ্য মায়া আছে এই দেশে, এই পৃথিবীতে। সৌমিত্র একবুক ঘৃণা চেপে বিয়ে করে এলো। শুভদৃষ্টির সময় দেখল মেয়েটাকে। এতো সরল মুখশ্রী মেয়েটার, অথচ কী কপট আর নীচ! সৌমিত্র তো বিয়ে করবে না বলেই শর্ত দিয়েছিল। সে কি জানত তার শর্ত পূরণ করে ঐ নীচ মেয়েটি তাকেও নীচের কাতারে তুলে ফেলবে।
” মায়া, মায়া! ভেবেছিলাম তুমিই লোভী। কিন্তু না! এই আমার সহধর্মিণী সেও তোমারই মতো। অর্থের সামনে নিজেকে বিলিয়ে দিতেও কুন্ঠিত নও তোমরা। তোমাকে তো শিক্ষা দিতে পারি নি তবে এই মেয়েকে আমি বুঝিয়ে দেব তার অপরাধ। লোভের শাস্তি কতোটা ভয়ানক হয় প্রতিটি মুহূর্তে বুঝবে সে। ভালোবাসা আর মাতৃত্ব বেঁচার যোগ্য শাস্তি পাবে সে।”
ভেজা চুল মুছে তোয়ালে জড়িয়ে বের হয় সৌমিত্র। রাগে রক্তিম তার মুখ,চোখ। টাওজার পরে টিশার্ট গায়ে বসল সোফায়, ল্যাপটপের সামনে৷ পেন্ডিং থাকা গতদিনের কাজটা শেষ করতে লেগে গেল সে। যদিও কাজে মনোযোগ দিতে আজ তার বেশ বেগ পেতে হলো। বহুদিন পর মাথায় জেঁকে বসেছে মায়া। অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি সময় নিয়ে কাজটা শেষ করল সে। জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে এলো ব্যালকনিতে।
তেরো বছর আগে তার সাথে দেখা হয় মায়ার। আধুনিকা,সুশ্রী এক যুবতী। আগ বাড়িয়ে কথা প্রথম মায়ায় বলেছিল। মোবাইল নাম্বারটা নিয়েছিল যেচে। তিন বছরের বন্ধুত্বে কখন যে ভালোবাসাটা হয়ে গিয়েছিল ঠিক বোঝে নি সৌমিত্র। তারপর চুটিয়ে প্রেম শেষে বিয়ে করল ওরা। বিয়েতে প্রথমে কিছুটা আপত্তি করেছিল সৌমিত্রের মা। তার চোখে মায়া উত্তম পুত্রবধূ ছিল না। তবুও সৌমিত্রের মুখের দিকে চেয়ে একসময় মেনে নিলেন তিনি। যার প্রতিদান হিসেবেই দ্বিতীয়বার সৌমিত্রকে বিয়ে করতে বাধ্য করান। মায়ার সাথে দাম্পত্য জীবনের প্রথম এক বছর ছিল স্বপ্নের মতো। কিন্তু ধীরে ধীরে মায়া বদলে যায়। ধীরে ধীরে সৌমিত্র বুঝতে পারে, সে মায়ার মায়ায় ডুবে সত্য দেখতে পারে নি। তার সাথে বিয়েটা স্রেফ অর্থের লোভে করেছিল মায়া। বড়লোকের ছেলের অঢেল সম্পদের অংশীদার হবার আকাঙ্ক্ষায়। মায়ার সে আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাৎ হয় সৌমিত্রের মায়ের কারনে এবং সম্পদের পরিমাণ ভাবনার চেয়ে বেশ কম হওয়ায়। সারদা দেবীর নামেই সব সম্পদ। দুই পুত্রের নামে কতোটুকু কী উইল করেছেন সেটা সবার অজানা৷ ছেলেদুটোও তার রাম,লক্ষণ। মা’ই ওদের সব,বাকি কিছুই যেন প্রয়োজন নেই।
মায়া এক সময় হয়ত মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু তার মতিভ্রম হয় বিনয় চৌধুরীর সাথে পরিচয় হবার পর। সৌমিত্র নিজের বিজনেস শুরু করেছিল তখন। পার্টনার হিসেবে ছিল বন্ধু জামিল আব্দুল্লাহ এবং বন্ধু সমবৎ দূরসম্পর্কের বড় দা বিনয় চৌধুরী। নামেই সে ছিল বিনয়। আদৌতে এক নাম্বারের দুশ্চরিত্র। সৌমিত্র বিনয়ের চরিত্রের এইদিকটা সম্পর্কে জেনেও উপেক্ষা করেছিল। কারণ চরিত্রের এই দিকটা তার খারাপ হলেও ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে বিনয় মন্দ ছিল না। তাছাড়া সেধে এসে পার্টনার হতে চেয়েছিল বলেও সৌমিত্র ফেরাতে পারে নি। বন্ধু জামিল অবশ্য রাজি ছিল না পরে সৌমিত্রের কথায় রাজি হয়।
ব্যবসায়ের কাজে হোক কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ধরে, বিনয় প্রায় আসত সৌমিত্রদের বাড়িতে। এই আসা যাওয়া মধ্যে একসময় মায়া এবং বিনয়ের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক শুরু হয়। সৌমিত্র কিছু বুঝে ওঠার আগেই মায়া ডিভোর্স পেপারে সাইন করে চলে যায় বিনয়ের সাথে। এরপর আর দেখা হয়নি সরাসরি ওদের।
এই শোক থেকে বেরোতে সৌমিত্রকে কী কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করতে হয়েছিল, কেবল সেই জানে। দিন রাত তার কাছে সমান যন্ত্রণার ছিল। ধোঁকা যে খেয়েছে সেই জানে, এর ক্ষতটা কতো গভীর আর ব্যথাটা কতো তীব্র হয়। এখনও সেই ক্ষত দগদগে হয়ে ওঠে যখন কেউ মায়ার প্রসঙ্গ তোলে অথবা ফেসবুকে ফ্রেন্ড লিস্টে কারো আপলোড করা ছবিতে মায়াকে দেখতে পায়। হাস্যোজ্জ্বল মায়া। যে বিনয়কে এক মেয়ের সাথে এক বছরের বেশি দেখা পাওয়া ভার ছিল। সেই বিনয় আজ আট বছর যাবত মায়াকে নিয়ে সংসার করছে। তার প্রাচুর্যের অভাব নেই বরং বাড়ছেই যেন।
সৌমিত্রের মাঝে মাঝে মন চায় একবার গিয়ে মায়াকে বলতে, কেন এমন নিষ্ঠুর ভাবে তার মন ভাঙল সে? কী এমন দোষ ছিল, কী এমন ভুল ছিল তার ভালোবাসায়! কিন্তু পরক্ষনেই ঝেড়ে ফেলে দেয় ভাবনাটা। সে ঢের ভালো আছে ঐ ছলনাময়ীকে ভুলে। ভালোবাসা ভালো তবে অন্ধ ভালোবাসা ক্ষতিই করে। যেমনটা তার করেছে মায়া। অপূরণীয় ক্ষতি।
চলবে,,,