-‘বিভীষিকা’-
-‘নূরজাহান আক্তার আলো’-
[০৫]
শব্দকলির শঙ্খরাজ
স্বপ্নচারির ভাঙা তাজ।
বিভাবরীর সেই রঙ্গশালা
ক্ষরণ ঘটিয়ে ক্ষান্ত তারা।
আবেশ ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। মেয়েটি আবার কিছু ঘটাতে চলেছে। তার প্রতিটা অক্ষরে অক্ষরে ‘কিন্তু’ লুকিয়ে আছে। অথচ সেই কিন্তু’টা ধরা যাচ্ছে না। আবেশ বার বার ছন্দটা পড়ে বোঝার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। এত কঠিন শব্দে ছন্দটা সাজানো যে কিছুই মাথাতে আসছে না। বরং সবটা গুলিয়ে যাচ্ছে। এই চারটা লাইনে এমন কিছু আছে, যা সুনয়নাকে খুঁজতে সাহায্য করবে। আবেশ শান্ত হয়ে বসে আবার পড়ল। না, তাও হচ্ছে না। ‘শব্দকলির শঙ্খরাজ ‘এর মানে কি? উফ, বিরক্তিতে আবেশ মুখ কুঁচকে নিলো। অযথা সময় নষ্ট। তখন ওর ফোন ভাইব্রেট হতে লাগল। অনবরত বাজতে থাকল, পকেটে থাকা ফোনটি। ওর দলেরই একজন বার বার কল করেছে। ওর পার্টি অফিসের পাশেই মারামারি হচ্ছে। আমজাদের লোকরা এসে অযথা ওদের লোকদেরকে মারছে। আবেশ শুনে কয়েকটা কথা বলে কল কাটল। ফোন পকেটে ঢুকিয়ে দরজা লক করে দ্রুত বেরিয়ে গেল। টেবিলে পড়ে রইল ভাঁজকৃত কাগজখানা। যেখানে রহস্যময় ছন্দটি লিখা।
নিজে ড্রাইভ করে আবেশ সেখানে পৌঁছাল। পরিস্থিতি খুবই খারাপ। ওকে দেখে কয়েকজন ছেলে এগিয়ে আসল। তাকে পুরো ঘটনাটা বিস্তারিত জানাল। তখনো মারামারি চলমান।
আমজাদের ছেলেগুলো মারছে আর চেঁচিয়ে বলছে,
-‘আমরা আমজাদ ভাইয়ের লোক রে শা**। এই রং ঢং কম দেখাবি নয়তো এখানেই মেরে পুঁতে দেবো।’
আবেশ ভ্রু কুঁচকে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। এমনিতে
মেজাজ বিগড়ে আছে তাতে আবার এরা ক্ষমতা দেখাচ্ছে।
যদিও বড়াই জিনিসটা কোনো কালেই ওর পছন্দ নয়। তবুও
সে ওদের থামানোর চেষ্টা করল, হলো না। বরং হই- হট্টগোল বাড়িয়ে একজন এসে সরাসরি আবেশের কলার ধরল। ভাব এমন যেন এক ঘুষি মেরেই দিবে। ততক্ষণে মিডিয়ার লোক এসে ছবি তুলতে লাগল। আবেশ বাঁকা হেসে কলার ছাড়িয়ে নিয়ে অফিসে ঢুকে গেল। আপাতত মিডিয়ার লোকরাই কিছু কাজ এগিয়ে দিলো। বাকিটা সে সামলে নিবে। ঘন্টা খানিক পরেই মারামারির ঘটনা নিউজে চলে আসল। ব্রেকিংনিউজ,
‘রাজনীতিবিদ আবেশ মুনতাসীরকে খুনের চেষ্টা।’
কলার ধরার সেই ছবিটির সঙ্গে উপরের ক্যাপশনটি।আবেশ
একপলক দেখে মৃদু হাসল। ওদিকে আমজাদ হোসেন রেগে
ছেলেগুলোকে প্রচন্ড মারলেন। একমাস পরে নির্বাচন আর এরমধ্যেই এই মিথ্যা মামলা। ব্যাপারটা ঠিক গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো অবস্থা। আবেশ যে বুদ্ধি খাঁটিয় করেছে বুঝতে বাকি নেই। নয়তো ওর কলার ধরার পরেও দাঁড়িয়ে দেখার ছেলে সে নয়। নিউজটা হওয়ার পর থেকেই কলের পর কল আসছে। এখন পদ থেকে বহিষ্কার না করলেই হয়। অথচ ভালো সাজার জন্য, বিগতদিনে উনি চার লাখ টাকার জিনিস গরীবদের বিতরণ করেছেন। ছবি তুলে ফেসবুকেও পোস্ট করিয়েছেন। বস্তিতে গিয়ে ভোট চেয়ে রিকশাওয়ালার
কাঁধে হাত রেখে উন্নয়ন করা কথা দিয়েছেন। যদিও এজন্য বার বার হাত স্যানিটাইজ করেছেন।নয়তো রিকশাওয়ালার
তেল চিটচিটে ঘর্মাক্ত শার্টে হাত দিয়ে বমি আসছিল। তবুও হাসিমুখে ব্যাপারটা সামলে নিয়েছেন। আর এই ছেলেগুলো সব শেষ করে দিলো। এখন টাকার জোরে ঝামেলা মিটলেই
হয়। তাছাড়া পাড়ায়-পাড়ায়, রাস্তাঘাট, চিপায়-চাপায়, এই মোড়ে-ও মোড়ে পোষ্টার লাগানোর কাজ চলছে। টং দোকান
গুলোতে চায়ের আড্ডায় সামিল হচ্ছেন। মাইকিং করে ভোট চাওয়ার অনুরোধ করছেন। সেই সঙ্গে চলছে প্রতীক নিয়েও রং ডং। রাস্তার এক পাশে মঞ্চ বানিয়ে বকৃতার আয়োজনও হচ্ছে। প্রতিদিন সেখানে বকৃতাও দিচ্ছেন। কতশত ওয়াদাও করছেন। এছাড়া,যারা ভোট চাওয়ার উদ্দেশ্যে রোজ রাস্তায় নামছে তাদেরও দিতে হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। যাতে এ কাজটা ভালো মতো করে। এবং টাকার বিনিময়ে মিছিলের জন্য ছেলেপেলের ব্যবস্থা করে।পাড়ার বখাটে ছেলেরা এই নিয়েও মাতামাতি করতে গিয়ে ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলেছে।
আজ উনি নিজে গিয়ে সমাধান করেছেন। অথচ আবেশের পোষ্টার নেই। সে ছাপায়ই নি। আর না হয় তার নামে কোনো মিছিল। তবে মাঝে মাঝে বক্তৃতা দিতে দেখা যায়। দাপটের সাথে একটা একটা বাক্য উচ্চারণ করে। কথা বলার বচন ভঙ্গিও চমৎকার। সুঠাম দেহের অধিকারী এ ছেলেটার মধ্যে
অন্যরকম তেজ সংশ্লিষ্ট। এজন্য উনি চাচ্ছেন টাকা দিয়ে’ই মানুষকে পটিয়ে নিতে যাতে ভোটগুলো উনাকেই দেয়।
আজ তিনদিন হলো সুনয়নার খোঁজ নেই। কোথাও নেই সে।
আবেশ একদিকে ওকে খুঁজছে অন্যদিকে নির্বাচনের কাজ।
চারদিকে লোক লাগিয়েও হদিস পাচ্ছে না।এজন্য বাড়িতেও ফিরে নি। শূন্য ঘরে ফিরলে ওর কষ্ট বাড়তো বৈ কমতো না।
তাছাড়া সুনয়নাকে যে বাড়িতে রেখেছিল সেটা ওর নিজের উপার্জনে তৈরী বাড়ি। মাসের সতেরোটা দিনই সেখানে থাকে সে। এছাড়া রয়েছে ওর বাবার তৈরী বাড়ি। আপন চাচা এবং ফুপির ছেলে মেয়েরা সেখানে থাকেন। সুনয়না একা থাকতে পছন্দ করে বিধায় তাকে সেখানেই রাখতে চেয়েছিল। যাতে মেয়েটি মর্জিমতো চলতে পারে। ওর সঙ্গে সহজ হতে পারে।সম্পর্ক গড়ার আগেও সময় নিয়ে ভাবতে পারে। অথচ সে!
সারাদিনের কাজকর্ম সেরে আবেশ রাত করে বাড়ি ফিরল। পরিবারের সবাই যে যার রুমে। শুধু চাচীমা জেগে আছেন তাও ওর জন্য। আবেশ দ্রুত ফ্রেশ হয়ে খেতে বসল। চাচীমা নিশ্চুপ হয়ে খাবার বেড়ে কথা না বলেই চলে গেলেন। এমন তো হয় না কোনোদিন। আবেশ ভ্রু কুঁচকে কয়েকবার ডাকল উনাকে। চাচীমা ফিরেও তাকাল না। উনার ব্যবহারের কারণ সে আন্দাজ করতে পারছে। তবুও কিছু করার নেই। উনার আবদার মানা তার পক্ষে সম্ভব নয়। প্লেটে খাবার নিয়েও সে খেতে পারল না। চেয়ার ছেড়ে উঠতেই দেখে,বাড়ির সকলেই ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সবার মুখটা থমথমে।তখন ওর ফুপি বললেন,
-‘এই মূহুর্তে লুবানাকে বিয়ে করবে নয়তো আমরা নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো।’
উনার কথা শুনে আবেশ ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত দুইটা সাতাশ বাজে। দুই পকেটে হাত রেখে লুবানার দিকে তাকাল আবেশ। লুবানা এক কোণে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। যেন
হাসির মাধ্যমেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছে। তখন আবেশ ওর ফুপিকে বলল,
-‘আচ্ছা যাও, তবে সাবধানে যেও।’
একথা বলে আবেশ প্রস্থান করল। ওর উত্তরে সকলে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন। উনারা এই জবাবটা আশা করেন নি। আবেশ ততক্ষণে রুমের দরজা আঁটকে দিয়েছে।
মাঝরাতে অবান্তর কথাবার্তার মানেই হয় না। তাছাড়া খুব ক্লান্ত সে। সুনয়নার খোঁজ পায় নি। মোড়ল সাহেবও কিচ্ছু জানেন না। আর লুবানাকে বিয়ে করার মানেই হয় না। বেঁচে থাকতে তো নয়ই। কারণ যে মেয়ে পোশাকের মতো প্রেমিক বদলায় তাকে আর যায় হোক বউ করা যায় না। মূখ্য কথা, লুবানা তাকে নয় তার ক্ষমতা আর টাকাকে ভালোবাসে। সে
যতই ফুপাতো বোন হোক তাকে সে প্রচন্ড ঘৃণা করে। এজন্য মারে এবং অপমানও করে। তবুও লজ্জা নেই। তাছাড়া ওর মনে বিশেষ কেউ আছে, সে একান্ত তার। আবেশ দু’চোখের পাতা এক করেও ঘুমাতে পারল না। অশান্ত বুকটাতে তুমুল প্রলয় শুরু হলো। সুনয়নার চোখজোড়া ওর চোখের সামনে ভাসছে। যে অনিচ্ছায় হারায় তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু যে স্বেচ্ছায় হারায় তাকে পাওয়া এতটা সোজা নয়। সুনয়না স্বেচ্ছায় হারিয়েছে। তবে ওর চেনা জায়গায় সে যায় নি।যদি
যেতো অবশ্যই খোঁজ পেতো।কারণ সবখানে লোক লাগানো আছে।
খুব সকালে আবেশ ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। পরণে তার হালকা আকাশী শার্ট। সে যে তাড়ায় আছে তার হাঁটাতেই তা স্পষ্ট। হঠাৎ হাতে টান পরাতে দাঁড়িয়ে গেল সে।বিরক্তসমেত পিছনে ফিরতেই আরোএকদফা বিরক্ত এসে জমা হলো ওর শ্যামবর্ণ মুখশ্রীতে। লুবানা ওর হাত ধরে আছে। আবেশ এক ঝটকায় হাত সরিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
-‘ফারদার যদি আমাকে স্পর্শ করিস কি করব করে বুঝিয়ে দিবো, ফালতু।’
আবেশ আর না দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। সকালটা খারাপ গেল না জানি সারাদিনে কী হয়।পার্টি অফিসে গিয়ে কাজ সেরে আবারো বের হলো। পরিকল্পিত জায়গাগুলোয় সমাবেশ করল। তারপর মিডিয়ার লোকদের সামলে গেল নির্বাচন অফিসে। মোট কথা, সারাদিন ব্যস্ততার মধ্যে কাটল তার। সন্ধ্যার দিকে খেতে বসতেই ওর বাড়ির দারোয়ান টুলু আলীর কল পেলো। কল ব্যাক করে কথা বলে ছুটল বাড়ির পথে। আর যাওয়ার আগে সানোয়ার নামের এক ছেলেকে এদিকটা সামলাতে বলল। সে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি পৌঁছে দেখে সুনয়না সোফায় বসে পানি খাচ্ছে। চারদিন পর সে ফিরেছে। গোলাপি শাড়িতে লাল রক্ত লেগে শুকিয়ে গেছে। আবেশকে দেখে সুনয়না হাসল। এত সুন্দর হাসি যা প্রকাশ করা মতোন না। আবেশ নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে, সামনের ওই নিষ্ঠুর হৃদয়ের মানবীর দিকে। যার মধ্যে অনুভূতি বলে কিচ্ছু নেই।
তখন সুনয়না মুখ খুলল,
-‘ কেবল একটাকে শেষ করলাম।’
-‘জানি।’
-‘বলুন তো কে?’
-‘অভিরাজ রওশান!’
To be continue…….!!