বিভীষিকা পর্ব -১০

-‘বিভীষিকা’-
-‘নূরজাহান আক্তার আলো’-
[১০]

আবেশের প্রশ্নকে সুনিপুণভাবে এড়িয়ে সুনয়না হেসে বলল,

-‘আমি আপনাকে একটা উপহার দিতে চাই।’
-‘কী উপহার শুনি।’
-‘কবর।’

আবেশ বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কেউ কাউকে কবর উপহার দিতে পারে? সাতাশ বছরের জীবনে কখনো একথা শুনে নি। মেয়েটা পাগল নাকি তাকে বোকা বানাচ্ছে? যদিও অহেতুক ফাজলামি করার মেয়ে সে না। তবুও বলার আগে ভেবে তো বলা উচিত! যাতে শ্রোতা কিছু বলার ভাষা
খুঁজে পায়। তাছাড়া মুখ্যকথা, সে কার কবরে কথা বলছে?
তাও একবার নয় বারবার।আবেশ কৌতুহল দমাতে না পেরে পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,

-‘কার কবর?’
-‘ খুব কাছের কারো।’

কথাটা বলে সুনয়না মুচকি হাসল। আবেশ ভ্রুজোড়া কুঁচকে বিরক্ত নিয়ে তাকিয়ে রইল। মেয়েটাকে যা জিজ্ঞাসা করবে তাই বলবে বাড়তি একটা কথাও বলবে না। বললে যেন, খুব
ক্ষতি হয়ে যাবে। সুনয়না একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চুলে পুনরায় হাত ডুবালো। একমনে আবেশের চুল টানছে আবার মিটিমিটি হাসছেও। আবেশের গুরু গম্ভীর চিন্তিত মুখখানা তার কাছে বেশ লাগছে। তখন নিচে থেকে রণ সুনয়নাকে ডেকে উঠল। একের একের ডাক ভেসে আসছে, থামাথামির নাম নেই। ছেলেটা হয়তো তেঁতুল কিনে এনেছে। সকালবেলা বলেছিল কিনে আনবে তারপর দু’জন বসে গল্প করবে আর তেঁতুল খাবে। রণ ছেলে হয়েও প্রচুর টক খেতে পারে। বাসায় ওর জন্য নাকি আচার রাখা যায় না। একটু আধটু নয় পুরো বয়াম নিয়ে বসে সাবাড় করে। সেই তুলনায় সুনয়না টক খায় না। মূলত খেতে পারে না। কী কারণে সেও বুঝে না। বোঝার চেষ্টাও করে নি যদিও। রণোর হাকডাকে সুনয়না আবেশকে সরিয়ে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেল। কিছু একটা ভেবে পিছু ফিরে একবার তাকিয়ে হাসল। আবেশ দেখে কিছু বলল না।
সে নিশ্চুপ হয়ে উপরোক্ত কথাটা ভাবছে। সুনয়নার অতীত সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অবগত। এমনকি অভিরুপের কথাও। সে
এটাও জানে, মাঝরাতে প্রাসাদের দীঘিটিতে অভিরুপ রোজ গোসলে নামে। একদম গভীর রাতে, ডুব দিতে দিতেই মাঝে
থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। মূলত এটা করে সুনয়নাকে সে ভয় দেখাতে। যাতে সুনয়না ভাবে মানবটি অশরীরী কেউ। অভিরূপ দীঘির মাঝখানে গিয়ে ডুব দিয়ে একেবারে পাড়ে গিয়ে উঠে। এই কাজ করতে প্রশিক্ষণও নিয়েছে। কারণ সে একজন সাতারু। সময় ঠিক করে দীঘিতে নামে চর্চা করতে, কত মিনিটে পাড়ে পৌঁছাচ্ছে দেখার জন্য। এটা রাতে করলে দুটো কাজই সফল হচ্ছিল তার। কিন্তু দুঃভাগ্যবশত সুনয়না যখন ভয় পেলো না তখন সে অন্য পথ বের করল।প্রাসাদের ভৃত্যকে সুনয়নার খাবারে বিষ মিশাতে হুকুম দিয়েছিল। এই কাজ করেনি রমেলা নামক ভৃত্য। সেই রাগ তুললে রামেলার প্রতিবন্দী বোনকে ধর্ষন করেছে অভিরুপ। মেয়েটির লাশের
চিহ্নটুকুও রাখে নি। তখন আর আবেশ বসে থাকে নি। ওকে ধরে এনে চোখ মুখ বেঁধে উত্তম মাধ্যম দিয়েছিল। আটমাস হসপিটালে ছিল তবে ওকে কে বা কারা মেরেছিল আন্দাজ করলেও কিছু বলে নি। কারণ বললে আরেকদফা মারতো সে। যখন দেখল, ওরা সুনয়নাকে মেরে ফেলার ফন্দি করছে তখন মোড়লকে দিয়ে একটা দলিলে সই করিয়েছিল। তাতে লিখা ছিল সুনয়নার গায়ে আঁচর পড়লে মোড়লের কলিজা কেটে নিবে সে। তারপর থেকেই মোড়ল সুনয়নার নিরাপত্তা আরো জোরদার করেছিল। মোড়ল তার মামা হলেও সম্পর্ক সাপে নেউলে। তার একমাত্র কারণ সুনয়না। মোড়ল কিছুতে সুনয়নাকে প্রাসাদে রাখতে চাচ্ছিলেন না। কারণ সে উনার শত্রুর মেয়ে আর শত্রুর মেয়ে শত্রুই হয়।

তারপর আবেশের কাছে বাধ্য হয়ে সুনয়নাকে রেখেছিলেন।তখন উনার মনে চলছিল অন্য ভাবনা। একের পর চেষ্টায়ও
যখন উনি ফায়দা উঠাতে পারলেন না তখন আবেশের নামে মিথ্যা গুজব প্রচার করলেন। বারবার বোঝাতে লাগলেন সে সুনয়নার বাবা -মাকে খুন করেছে। অথচ এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। অভিরুপ সুনয়নার পরিবারকে শেষ করেছে। কারণ উনারা অভিরুপের নামে কেস করেছিল এনিয়ে পুলিশ খুব ঝামেলা করেছিল। সেই রাগ তুললেই…!

আর সেদিন সুনয়নাকে বাজার থেকে ওর লোক তুলে আনে নি এনেছিল অভিরুপ লোকরা। অবলা মেয়েটার ক্ষতি হচ্ছে জেনে চুপ থাকতে পারে নি সে। সেইদি একটা কাজে গ্রামেই এখানেই ছিল। ভেবেছিল মেয়েটাকে বাঁচিয়ে ওরই আত্নীয় বা নিরাপদ কোনো স্থানে পৌঁছে দিবে। যাতে মেয়েটা প্রাণে বেঁচে যায়। কিন্তু সুনয়নাকে দেখে ওর মন অন্য কথা বলেছিল। নিষিদ্ধ অনুভূতির জাগ্রত হচ্ছিল। অকেজো মন প্রণয় নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাচ্ছিল। বাবা-মা হীন
জীবনে সে প্রাণের মায়া কখনোই করে নি। একাকী জীবনে কাউকে জড়াতেও চাইনি। প্রেম-প্রীতির প্রতি ব্যাপক অনীহা
বিধায় জড়ানোর আগ্রহ দেখায় নি। কিন্তু হঠাৎ’ই সুনয়নাকে তার ভালোলাগে। বিশেষ করে ওর চোখজোড়াতে আকৃষ্ট হয়েছিল সে। তারপর থেকে কারণে অকারণে ভালোবেসে ফেলে মেয়েটাকে। অদৃশ্য ছায়া হয়ে থাকে মেয়েটির পাশে।
তবুও মেয়েটি ওর প্রতি নিষ্ঠুর, পাষাণী। সে সর্বদা নিজেকে গুটিয়ে রাখে। ওর প্রতিটা বাক্যে রহস্যের জাল বিস্তার করে।
আবেশ শতচেষ্টা করেও সেই রহস্যজাল ছিঁড়তে পারে না।
ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে আবেশ বাজতে থাকা ওর ফোন হাতে নিলো। কথা বলে কল কেটে ওভাবেই শুয়ে রইল। আমজাদ হোসেনকে নির্বাচন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। উত্তাল জনতা বাদ দিতে বাধ্য করেছেন। এ নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে৷
আমজাদ সাহেব অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারে নি। হয়তো পারতেন, যদি না ড্রাগ কেনা-বেচার মিটিং ভাইরাল না হতো। বুয়াকে হুমকি দিয়ে ধর্ষণের গুঞ্জন না উঠতো। এই ঘটনার পর আমজনতা আরো ক্ষিপ্ত। মূলত একারণে উপর মহলে এমন সিধান্ত নিয়েছেন। নয়তো হিতে বিপরীত হতো।
আগামী সপ্তাহেই নির্বাচন। আবেশ জানে তার জয় নিশ্চিত।
এজন্য সে আপাতত চিন্তামুক্ত।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে। ধীরে ধীরে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে।
সন্ধ্যার পর পরই আবেশের সঙ্গে সুনয়না বাইরে বেরিয়েছে।
বাড়ির কেউ সরাসরি কিছু না বললেও ওরা যাওয়ার পরপর ফুপি খুব চেঁচামেঁচি করলেন। উনার আদরের মেয়েটা বাসায় আসতে পারছে না। আবেশের কড়া নিষেধ আছে। লুবানা বাবার কাছে গেছে। ওখানে ওর সৎমা কথায় কথায় খোঁচা মারছে। চলে যাওয়ার জন্য অপমান করছে। লুবানার বাবা দেখেও কিছু বলছেন না। মেয়েটা এখন বাসায় আসার জন্য কাঁদছে। মা হয়ে মেয়ের কান্না উনার সহ্য হচ্ছে না। তাছাড়া
উনার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করার পর উনারা এখানেই থাকেন।
ওদিকে পিছু ফিরেও তাকান না। অথচ মেয়েটার জন্য ফোন করে কিছু বলতে যেয়ে অপমানিত হতে হলো। উনার স্বামীও
অপরিচিতদের মতো আচরণ করল। সব হয়েছে ওই মেয়ের জন্য। নয়তো আবেশ এমন করার ছেলে নয়। নতুবা বোনের সঙ্গে কেউ এমন করে! লুবানা ওকে জ্বালিয়ে মারে কই এমন তো করে নি কখনো। অথচ ওই মেয়েটা আসতে না আসতেই সংসারে ফাটল ধরল। চাচা চাচীর কথাও আবেশ শুনবে না।
সে তার মর্জি মতো চলবে। বিয়ে করে আবেশ সত্যি পর হয়ে গেছে। এসব বিলাপ করে ফুপি কাঁদলেন। কথা আর কলি ফুপির কান্না দেখে মুখ টিপে হাসছে। তারা খুব খুশি হয়েছে।

কয়েক ঘন্টা পর আবেশকে নিয়ে সুনয়না প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করল। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বর্তমানে এখানে কেউ আসে না। সুনয়না যাওয়ার পর ভৃত্যরা মোড়লের বাড়ি কাজ করে। যদিও তারা আগে মোড়লের বাড়িতে নিয়োজিত ছিল। বর্তমানে কারো প্রবেশের অনুমতি নেই প্রাসাদে। কড়া নিষেধ মোড়লের। এমনকি ঝাড়মোছ করতেও না। তাছাড়া ওদের আসার খবর কেউ জানে না। এমন হুট করে আসার কারণ আবেশের অজানা।তবুও বিরক্ত নিয়ে সুনয়নার হাত ধরে সামনের দিকে এগোচ্ছে। হাতে একটা টর্চ লাইন। ওটার সাহায্যে পথ দেখে দেখে ওরা হাঁটছে। সুনয়না ওকে নিয়ে নিচতলার এক বন্ধ রুমের সামনে দাঁড়াল। হাতের মুঠোয় থাকা একগোছা চাবি থেকে একটা চাবি নিয়ে তালা খোলার খুব চেষ্টা করল। মরিচাধরা তালা খুলতে কিছুটা সময় ব্যয় হলো।আবেশ খুব অবাক হলো ওর কাছে রুমের চাবি দেখে।
তাও কিছু জিজ্ঞাসা করল না বলার হলে সে এমনিই বলবে।
দু’জনে খুব সাবধানে ভেতরে প্রবেশ করল।অনেকদিন যাবৎ রুমটা বন্ধ থাকায় গন্ধ বের হচ্ছে। আবেশ টর্চ দিয়ে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিলো। রুমের আনাচে কানাচে মাকশড়া বাসা বেঁধেছে। তাও পুরো রুমের দেওয়াল জুড়ে। দু’একটা ইঁদুর ছুটাছুটি করছে। চার দেওয়ালেই নর্তকীরদের অশ্লীল ছবি টানানো। যেগুলো দেখে দ্বিতীয়বার দেখার রুচি আসবে না। এই রুমটা বোধহয় বাঈজীদের নৃত্যখানা ছিল। তাদের দল বেঁধে দাড়ানো ছবিও আছে। তাছাড়া, নাচ গানের কিছু
বিভিন্ন সরঞ্জামও আছে। তাতে ধুলোবালি জমে আছে। যেন কত বছর কারো হাতের ছোঁয়া পায় নি।এক পাশের দেওয়াল ঘেষে রাখা ঘুঙুরের বক্স। উপরে ঢাকনা খোলা বিধায় দেখা যাচ্ছে। সেগুলোতে জং ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। সুনয়না এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আবেশের দৃষ্টি পরীক্ষা করছিলো। আবেশ যখন ওর দিকে তাকালো তখন ইশারায় মেঝের মাঝখানে তাকাতে বলল। আবেশ তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কী আছে সেখানে? বেশ উচুঁ করে মাটির ঢিবি তৈরী করা। আবেশ এবার মুখ খুলল,

-‘কি এটা?’
-‘কবর।’
-কার, বাঈজীদের নাকি?’
-‘না, আপনার বাবার।’

সুনয়নার কথা শুনে আবেশ বজ্রহতের দৃষ্টিতে তাকাল। সে ভুল শুনেছে ভেবে পুনরায় জিজ্ঞাসা করল। সুনয়না নিষ্ঠুরের মতো একই জবাব দিলো। আবেশের বিষ্ময়কর চাহনি। সে এত বছর বাবাকে খুঁজে কোনো হুদিস পায় নি। কেউ উনার খোঁজ দিতে পারে নি।আবেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুনয়নাকে
বলল,

-‘কোন ভিত্তিতে একথা বিশ্বাস করবো?’
-‘জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ আপনার বড় মামী।’
-‘তোমার বলা কথা যদি মিথ্যাে প্রমাণ হয়?’
-‘আমার রক্ত দিয়ে আপনাকে গোসলে ব্যবস্থা করে দিবো।’

আবেশ কবরটার দিকে দু’পা এগিয়ে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। ওর বাবার কবর কি না এই নোংরা জায়গায়। অথচ
সে ছেলে হয়ে সে জানেই না। বাবার এ করুণ পরিণতি দেখে আবেশ হতবাক। কে এত পাষাণ? কার এত বুকের পাটা? তার কী একাজ করতে বুকে কাঁপে নি? বিবেকেও নাড়া দেয় নি? পৃথিবীর বুকে কী আর কোনো জায়গায় ছিলো না, যে এখানে কবর দিতে হলো! এসব ভেবে আবেশের অশ্রু গড়ার আগে ওকে টেনে দাঁড় করালো সুনয়না। ইশারায় চুপ থাকতে বলে আবেশের হাত ধরে রুমের তালা আঁটকে দিলো। খুবই দ্রুত দু’জন বেরিয়ে গেল প্রাসাদ থেকে।এখানে এখন থাকা বিপদজনক। বিশেষ করে মোড়ল জানলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে। আবেশ গ্রাম থেকে বেরিয়েই হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে সিটে মাথা হেলিয়ে দিলো। ওর শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। এমন কিছু দেখবে আশা করে নি সে। চরম সত্যের মুখোমুখি সে এখন। এই সত্যি মারাত্মক ভয়ংকর। সুনয়না ওর অবস্থা দেখে সেও সিটে মাথা হেলিয়ে বলল,

-‘জানেন, আমার মা একজন পতিতা আর আমি উনার জারজ সন্তান ।

To be continue………….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here