বিভীষিকা পর্ব -০৮

-‘বিভীষিকা’-
-‘নূরজাহান আক্তার আলো’-
[০৮]

অচেনা এক যাত্রাপথ
চাই না যেতে কেউ।
তোমার জন্য আছে সেথায়
অনাকাঙ্খিত কেউ।

আবেশ চিরকুট হাতে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেয়েটা বার বার ওকে বিপদে ফেলে দেয়। এ ধারার উত্তর পাওয়া এতটা সহজ নয়। কারণ সহজ হলে সুনয়না তাকে সমাধা করতে দিতো না। আবেশ পুনরায় পড়ল, ‘অচেনা এক যাত্রাপথ’ এর মানে অচেনা অথবা ভিন্ন এক পথের কথা বলা হয়েছে।’চাই না যেতে কেউ’ অর্থাৎ সেই যাত্রাপথে কেউই যেতে চায় না।
‘তোমার জন্য আছে সেথায় অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ’ তাহলে এই চার লাইনে মানে দাঁড়ায়, অচেনা পথ যেখানে কেউ যায় না বা যেতে চায় না। আর সেই পথেই ওর জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ আছে। এখন প্রশ্ন হলো, ‘সেটা কোন পথ? আর কে বা ওর অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ? আবেশ রুমজুড়ে পায়চারী করছে আর ভাবছে। না, তাও হচ্ছে না। তখন সুনয়না এসে একবার ওকে দেখে শুতে চলে গেল। অনেক রাত হয়েছে। সে জেগে আর কি করবে! যার কাজ সেই করুত সে আপাতত ঘুমাক।
তখনো আবেশ যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছে উত্তরটা খুঁজে বের করার। কাগজ কলমে লিখে লিখেও বোঝার চেষ্টা করছে। রাত ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল সময়ও দ্রুত গতিতে পেরিয়ে গেল।স্তব্ধ রুমে কেবল সুনশান নিরাবতা। ঘুমে চোখজোড়াও বন্ধ হয়ে আসছে। মাথাব্যথাও বেড়েছে। একমগ কফি পেলে বেশ হতো। কিন্তু শরীরে যে আর কুলাচ্ছে না। ক্লান্ত শরীরটা বিশ্রাম চাচ্ছে অথচ মন চাচ্ছে ওর প্রিয়সীকে নিজের করে পাওয়ার লোভ। সুনয়নাকে পুনরায় স্বাভাবিক করার তীব্র আকাঙ্খা। কিন্তু তা কি সম্ভব? ওর চিরকুট অনুযায়ী অচেনা যাত্রাপথের শেষ নেই। সেই যাত্রাপথেই অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ থাকবেই বা কেন? এ পৃথিবীতে বর্তমানে সুনয়না ছাড়া ওর আপনজন কেউ নেই। যারা আছে সবাই টাকার পোকা তাই অনাকাঙ্ক্ষিত কথাটা বার বার ভাবাচ্ছে। আবেশ সোফায় শুয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেল। ওর হাতের মুঠোয় এখনো সেই চিরকুটখানা। সিলিংয়ের বাতাসে তা মৃদুভাবে উড়ছে।

পরেরদিন সকালে সুনয়না নাস্তা তৈরি করে আবেশকে ডেকে তুলল। আবেশের মুখখানা তখনো বেশ থমথমে। হয়তো সে উত্তর খুঁজে পায় নি। ওর মুখভঙ্গি দেখে সুনয়না হেসে বলল,

-‘সময় তো প্রায় শেষের পথে। ‘
-‘মৃত্যু। ‘
-‘ ভুল অর্থাৎ আপনি হেরে গেলেন।’
-‘তাহলে সঠিকটা কি?’
-‘ফ্রেশ হয়ে আসুন নাস্তা দিচ্ছি।’

সুনয়না আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে চলে গেল।
টেবিলে খাবার সাজিয়ে সংবাদপত্র নিয়ে নিজেও বসল। সে মুখে খাবার পুরে সংবাদপত্রের পাতা উল্টাল্ছে আর খাচ্ছে। হঠাৎ নির্বাচনের খবরটা দেখে ওর চোখ আঁটকে গেল। বেশ অবাক হয়ে পড়লো লিখাগুলো । আবেশ মুনতাসীরকে নিয়ে তুখর সমালোচনা করা হয়েছে। আমজনতা ও বিপরীতপ্রার্থী কটাক্ষ করা কথাগুলোও তুলে ধরা হয়েছে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার, আবেশ ওর নামে নির্বাচনের পোষ্টার ছাপায় নি এবং তাকে উন্নয়নমূলক কাজেও কখনো দেখা যায় নি। যদি করতো তাহলে সোস্যাল মিডিয়াতে ছবি দেখা যেতো। অথবা বিভিন্ন ধরনের পোস্ট হতো। এসব কাজ করে নি বলে কারো চোখে পড়ে নি। টাকার মায়াতে বোধহয় পোষ্টার ছাপাই নি। অর্থাৎ সে প্রচন্ড কৃপণ। তার দ্বারা আমজনতার সেবা করার কথা ভাবাও বোকামি। দেখা যাবে, সরকারের দেওয়া টাকা সে তো নিজেই আত্নসাৎ করে বসে আছে। এখানে সব জেনে তাকে দায়িত্ব দেওয়া মানেই আমজনতাকে বিপদের সম্মুখে ফেলা। এইটুকু পড়ে সুনয়না ভ্রু জোড়াকুঁচকে নিলো। শব্দ শুনে সামনে তাকিয়ে দেখে আবেশ এসে বসেছে। তবে নাস্তা না নিয়ে চুপ করে আছে। মুখে বিরক্তের ছাপ স্পষ্ট। সুনয়না ওকে খাবার বেড়ে দিয়ে বলল,

-‘ কবর।’
-‘মানে?
-‘উত্তরটা হলো কবর।’

আবেশ হতবাক হয়ে সুনয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন ধাঁধার মানে কি! গতরাতে এত ভেবে ছন্দ অনুযায়ী ওর মনে হয়েছে উত্তরটা ‘মৃত্যু’ হবে। মৃত্যুর যাত্রাপথে কেউ যেতে চাই না। আবার মৃত্যু কারো জন্য অপেক্ষা করে না। অর্থাৎ তার ধারণা অনুযায়ী উত্তরটা ভুল। সুনয়নার উত্তর সঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো কবরে ওর অনাকাঙ্ক্ষিত কে আছে? কার কথায় বা বোঝানো হচ্ছে। এ কেমন গোলকধাঁধা? এখন জিজ্ঞাসা করলেও এই মেয়ে কিছু বলবে না। তাই মনের মধ্যে একটা কিন্তু নিয়ে খাওয়াতে মন দিলো। ওকে নিশ্চুপ দেখে সুনয়না জিজ্ঞাসা করল,

-‘পোষ্টার ছাপান নি কেন? আমজনতা আপনাকে না চিনলে ভোট পাবেন কিভাবে?’

-‘রাজনীতির কথা ছাড়ো। শাস্তি স্বরুপ কি করতে হবে?

-‘যথাশীঘ্রই জানিয়ে দিবো। তা নির্বাচন হবে কবে?’

-‘দেরি আছে।’

-‘তাহলে আজ রাতে আমরা বের হবো। কোথায়, কেন, তার উত্তর পরে পাবেন।’

একথা বলার পর আর কোনো কথায় থাকে না। দেখা যাক, আবার কোন গোলকধাঁধায় ফেলে। আবেশ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে হাত ধুয়ে উঠে পড়ল। আজকাল অকারণে মেয়েটার অবান্তর কথাবার্তা ও কাজকর্মে প্রশ্রয় দেয়। কেন জানি সে চাইলেও কঠিন হতে পারে না। আবেশের ওর কাছে একরুপ আর বাইরে অন্যরুপ। সুনয়না রান্নাঘরের সব গুছিয়ে রুমে গেল। আবেশ বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে আর ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছে। বোধহয় জরুরি কিছু ব্যাপার তার মুখভঙ্গি দেখে তাই’ই মনে হচ্ছে। সুনয়না পাশের রুমে গিয়ে নিজেও তৈরি হয়ে ছোট্ট ব্যাগে দরকারী জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলো। ড্রেসিংটেবিলে নিজেকে একবার দেখে বের হতেই আবেশের মুখোমুখি হলো। আবেশ ওর আপাদমস্তক দেখে বলল,

-‘কোথায় যাচ্ছো?’

সুনয়না ওর সামনে হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিলো,

-‘শশুড়বাড়ি, আমাকে পৌঁছে দিয়ে তারপর কাজে যান।’

আবেশ ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়ের মাথায় কখন কি ঘুরে বোঝা মুশকিল। ওকে যে কিছু বলবে তার সুযোগ সুনয়না দেয়নি। বরং আগেভাগে গাড়িতে
উঠে বসে আছে। সেও বাড়ির দরজা লক করে ওকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। কালো রঙা কাঁচের মধ্যে দিয়ে সুনয়না বাইরে তাকিয়ে আছে। না জানি আবার কী ঘোঁট পাকাচ্ছে। এসব ভেবে আবেশ হাসল। সত্যি বলতে, ওকে বাসায় একা রেখে গেলে প্রচন্ড টেনশন হয়। কাজে মন দিতে পারে না। আজকে অন্তত কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকবে। এখন মুখ্য কথা, সকলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলেই হয়। ঘন্টা খানিক পর, আবেশ ওকে নিয়ে ওদের বাড়িতে প্রবেশ করল। যেখানে বাবা-মা ব্যতীত সবাই আছেন।সে আসার আগেই চাচীমাকে মেসেজ করে জানিয়েছে যাতে সকলেই উপস্থিত থাকেন। আছেনও তাই স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। আবেশ সুনয়নাকে সবার সঙ্গে নিজের অর্ধাঙ্গিনীর পরিচয়ে পরিচয় করিয়ে দিলো। এবং জানিয়ে দিলো, সে আজ থেকে এখানে থাকবে। বাড়ির বউ বাড়িতে থাকবে এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার। এই নিয়ে কথা বলার কী আছে,এভাবে চাচীমা বকলেন। আবেশের ফুপিও সুনয়নাকে সাদরে গ্রহন করলেন। সুনয়না চুপ করে বাড়ির সব সদস্যদের দেখছে। আবেশের ফুপির এক ছেলে রণ ও মেয়ে লুবানা। আর চাচীমার দুই মেয়ে কথা ও কলি। রণ এ বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য। বয়স চৌদ্দ। লুবানা কথা আর কলির চেয়ে চার বছরের বড়। কথা ও কলি দেড় দু’ বছরের ছোট বড়। রণ রা এখানেই থাকে। তার বাবার কথা সুনয়না জানে না। আবেশের চাচা টুকটাক কথাবার্তা বলে বেরিয়ে গেলেন। বাকিদের মধ্যে সুনয়নাকে নিয়ে টুকটাক কথাবার্তা চলতেই থাকল। উনাদের সবার মুখেই হাসি, কার হাসিতে কতটুকু ঘাপলা আছে আপাতত ধরা গেল না। তবে মিলমিশ দেখে ভালোই মনে হচ্ছে। তখন আবেশ জরুরি কল পেয়ে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল। আর যাওয়ার আগে চোখে চোখ রাখল সুনয়নার। সুনয়না মনে মনে হাসল। এ লোকটা
আসলেই পাগল। আর পাগল প্রেমিককে দূরে ঠেলতে নেই।
জীবনে একটা পাগল পুরুষ থাকাও ভাগ্যের ব্যাপার। যারা কারণে অকারণে প্রচুর ভালোবাসবে। স্বযতনে আগলে নিবে বুক্ষপিঞ্জিরায়।

এসব ভেবে সুনয়না পুনরায় মৃদু হাসল। জীবনে আরেকবার
ভালোবাসার যুদ্ধে সে নেমেছে। বারবার ঠকবে এমন তো নয়। তাছাড়া এবার একজন পুরুষের হাতকে আগলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কাপুরুষের নয়। কাপুরুষরা তো অভিনয়ের দ্বারা ঠকাতে পারে, খেলতে পারে। কখনো বা ভালোবাসার দোহাই কুৎসা রটাতে পারে। সুনয়না এসব ভেবে আশেপাশে তাকাল। ড্রয়িংরুমে বুলাতেই তার খেয়াল হলো বাকিরা কেউ কথা বলছে না। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই কেউ একজন ওর গালে দুই থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। আচমকা এমন হওয়াতে সে বুঝতে কিছুটা সময় নিলো। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে অতি সুন্দরী মেয়েটা ওকে মেরেছে। কিছুক্ষণ আগে যাকে ননদ বলে পরিচয় করে দিয়েছিলেন চাচী শাশুড়ী। নাম বলেছিল লুবানা। তবে মারের কারণ ওর বোধগম্য হলো না। লুবানা অকথ্য ভাষায় ওকে গালি দিতে থাকল। বাকিরা ওকে চুপ করতে বললেও লুবানা থামছে না। আবেশ ফাইল নিতে ফিরে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনাটাই দেখল। ওকে দেখে সুনয়না চুপ করে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। দেখা যাক সে কি করে!আবেশ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ঘড়ি দেখে বলল,

-‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যা। নতুবা তোর কি করি দেখতে দাঁড়িয়ে থাক।’

-‘ভাই তুই..!

-‘হুম আমি বউ পাগল আর কিছু? এবার বের হ। ‘

আবেশকে দেখে লুবানা হতবাক হয়ে গাঁইগুঁই করতে লাগল। কোনো কাজ হলো না। অবশেষে ভদ্রমেয়ের মতো বেরিয়েও গেল। সে এখন ছোট মামার কাছে গিয়ে নালিশ করবে।

(বিঃদ্রঃ- আজকে পর্বে রেসপন্স করে যাবেন আমি দেখতে চাই কেমন রেসপন্স এই গল্পে।)

To be continue…..!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here