বিভীষিকা পর্ব -০৭

-‘বিভীষিকা’-
-‘নূরজাহান আক্তার আলো’-
[০৭]

অভিরুপের সঙ্গে সুনয়নার সম্পর্কের সময়সীমা মাত্র একুশ দিনের। এই একুশ দিনেই মনপ্রাণ দিয়ে ভালবেসে ছিল সে। তবে অভিরুপ ফায়দা উঠাতে অভিনয় করেছিল। অভিনয়ে সে খুবই পারদর্শী। হবেই তো মোড়লের বড় ছেলে বলে কথা।
সম্পর্কের বাইশ দিনের মাথায় সুনয়না জানতে পারে, তারই প্রিয় মানুষটি নেশাখোর, ধর্ষক এবং মিথ্যাবাদী। আর এসত্য জেনেছিল ওর বাবার থেকে। তারপর নিজে খোঁজ নিয়েছে, এবং প্রমাণও পেয়েছে। তখন কষ্ট পেলেও নিজেকে সামলে নিয়েছে। অভিরুপকে এ ব্যাপারে কিছু না বললেও এড়িয়ে চলতে শুরু করে সে। যোগাযোগের মাধ্যমগুলোও বন্ধ করে নিজ হাতে। এর কয়েকদিন পরেই,অভিরুপ আসল ব্যাপার আন্দাজ করে ওকে হুমকি দেয়। যেন মুখ না খোলে আর সে যেন তাকে শরীর সপে দেয়। নয়তো ওর নামে খারাপ কথা রটাবে। সুনয়না রাজি ছিলো না ওর প্রস্তাবে। যেখানে তার ভালোবাসার মূল্য নেই। সেখানে এসব প্রস্তাব মানার প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া সে মানুষ নামক অভিরুপের আসক্তিতে ডুবেছিল। এই অমানুষের নয়। ওকে ভালো হওয়ার কথাও সে বলেছিল। এমনকি বিয়ের করার কথাও। অভিরুপ হেসে
ওকে নোংরা গালি দিয়েছে। তাছাড়া ওর বাবার সঙ্গে মোড়ল সাহেবের খুব খাতির। উনারা দু’জনেই হিরোইন কেনা-বেচা করতেন। সামান্য একটা ব্যাপারে উনাদের ঝগড়া হয় এবং
কথা বলার বন্ধ করে দেন। দিনকে-দিন দু’জনের রেষারেষি চলতে চলতে শত্রুতে রুপান্তিত হয়। ততদিনে অভিরুপ তার সীমা অতিক্রম করা শুরু করে। আগে সে নিজে নোংরা কথা
বলতো, পরে বন্ধুদেরও উসকে দিতো। সে বাইরে বের হতেও পারত না। একদিন অতিষ্ঠ হয়ে সুনয়না তার বাবাকে ব্যাপার সরাসরি জানায়। পরে এই নিয়ে ঝামেলা হয়ে পুরো গ্রামের লোক জেনে যায়। সবাইকে বোঝানো হয়, সম্পত্তির লোভে সুনয়নার বাবা মেয়েকে অভিরুপের পিছনে লেলিয়েছেন।
পুরো গ্রামের লোকজন দেখা হলেই ওদের অপমান করতো নয়তো খোঁচা মারত। কেউবা বাড়ি বয়ে এসেও কথা শুনিয়ে যেতেন। হঠাৎ’ই একদিন খবর আসে ওর বাবার গোডাউনে হিরোইন পাওয়া গেছে। পুলিশ উনাকে ধরে নিয়েও গেছেন।
এই খবরটা পুলিশকে দিয়েছিলেন, মোড়ল সাহেব। তিনমাস
সাজা ভোগ করে ওর বাবা ফিরেও আসে। তখন অভিরুপের লোকজন গ্রামে ছড়ায়, সুনয়না নাকি অভিরূপকে প্রতিদিন রাতে ডেকে নিতো। না আসলে গলায় দড়ি দেওয়া হুমকিও দিতো। এই খবর শুনে গ্রামবাসী চটে গেল আর তাদের গ্রাম ছাড়ার জন্য চাপ দিতে থাকল। সুনয়না ওদের গ্রামের স্কুলে পড়াতো। সেখান থেকেও তাকে অপমান করে বরখাস্ত করা হলো। পুলিশ ততদিনে ওর বাবার চালের গোডাউন বন্ধ করে দিয়েছে। অভাব-অনটন, গ্রামবাসীর কথার খোঁচা, অভিরুপ ও তার বাবার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিল ওরা। রান্নার জন্য একমুঠো চাল ছিল না ঘরে তাই চাল আনতেই সুনয়না বের হয়েছিলো। আর সেদিনই আবেশের লোকজন ওকে
কিডন্যাপ করে। বন্দি করে রাখে প্রাসাদের সুসজ্জিত ঘরে। তারপর আর জানা হয় নি ওর বাবা-মায়ের কী খবর। তবে মোড়ল নিজে এসে ওকে জানিয়েছে, ওর বাবা মাকে নাকি আবেশ খুন করেছে। উনারা নাকি আবেশের নামে পুলিশ কেস করতে চেয়েছিলেন। এটা আবেশের পছন্দ হয় নি তাই মেরে ফেলেছে উনাদের।

প্রথম প্রেম নাকি ভোলা যায় না। হঠাৎ কোনো এক মুহূর্তে তাকে মনে পড়ে দীর্ঘশ্বাস হয়ে বক্ষপিক্ষিরায় বিঁধে থাকে। হোক সে ভালো অথবা মন্দ মানুষ। সর্বপরি সেই ছিল প্রথম অনুভূতি এবং কল্পনার পুরুষ। সুনয়নাও তার প্রথম প্রিয়কে ভুলতে পারে নি। আর পারবেও না। কারণ সে প্রিয়’ই তাকে তীলে তীলে শেষ করে দিয়েছে। প্রণয় নামক পবিত্র সম্পর্কে ঘৃণা আনতে বাধ্য করেছে। এখন জীবন তার, ইচ্ছেগুলোও তার। তাই ওই মানুষটা আজ গুরুত্বহীন, অস্তিত্বহীন। নয়তো
জীবন থমকে যেতো। সেও নিঃশেষ হয়ে পড়ত। হয়নি বলেই
জীবন থেকে বুঝেছে,

-প্রণয় ভয়ংকরী
-প্রনয় সর্বগ্রাসী
-প্রণয় হৃদভঙ্গকারী
-প্রণয় আর্তনাদের নীরব ঘাতক।

রাত তখন আটটা সাত। সুনয়না আবেশের কক্ষে শুয়ে বই পড়ছে। এত বড় বাড়িতে সে একা। ভয় লাগছেনা তবে কেউ থাকলে মন্দ হতো না। আবেশ সারাদিন আর বাড়িতে ফিরে নি। হয়তো নির্বাচনের কাজ নিয়ে মহাব্যস্ত। সুনয়না একাকী দিন পার করেছে। কখনো রান্না করে, টিভি দেখে, অথবা বই পড়ে। এছাড়া সারাদিনে সে অনেকেবার অনুভবও করেছে,
আবেশকে বিয়ে করে তার আফসোস হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না, জানেনা। তবে হচ্ছে না! আড়াইটা বছর ধরে লোকটাকে সে চিনে! আর যায় হোক আবেশ অভিরুপের মতো নয়। সে পাগল প্রেমি, ভালোবাসতে জানে আর প্রিয়জনকে আদায় করতেও জানে। তবুও তার প্রতি কোনো অনুভূতি কাজ করে না। ভালোবাসার সাহস জাগে না। বোধহয় মনটা অকেজো হয়ে গেছে। অনুভূতি দ্বার বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরেও বিয়ে করার কারণ ওর একটা আশ্রয় প্রয়োজন। নিরাপদ আশ্রয়।
আর সেটা আবেশ ছাড়া কারো থেকেই পেতো না। তখন খট করে একটা শব্দ হলো। সুনয়না উঠে বইটা রেখে ড্রয়িংরুমে গেল। আবেশ টান টান হয়ে সোফায় শুয়ে পড়েছে। হয়তো
প্রচন্ড ক্লান্ত সে। যদিও হওয়াটাই স্বাভাবিক। সুনয়না কেশে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে বলল,

-‘ফ্রেশ হয়ে আসুন, ক্ষুধা লেগেছে।’

আবেশ চোখ বন্ধ করে মৃদু হাসল। এতদিন বাসায় এসে কথা বলার মতো কেউ ছিলো না। অথচ আজ! বাহ্, বিয়ে করার সুফল বেশ মিষ্টি তো! আবেশকে হাসতে দেখে সুনয়না চলে গেল। একে একে খাবার বেড়ে টেবিলে রাখল। আবেশ ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে টেবিলে নানান পদে খাবার সাজানো। তাও কিছু বলল না। নিঃশব্দে চেয়ার টেনে বসল, সুনয়না সামনের চেয়ারে ওর মুখোমুখি বসে নিজেও খাচ্ছে। যেন কেউ আর নেই এখানে। আবেশ খুব সীমিত খাবার নিয়ে খাওয়া আরম্ভ করল। মাথাব্যথায় অতিষ্ঠ সে। আজকে রোদে রোদে ঘুরতে
হয়েছে। মাঠে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ বক্তৃতা দিতে হয়েছে। কড়া
রোদে ঘেমে নেয়ে পরিহিত শার্ট শরীরেই শুকিয়েছে। জিরিয়ে নেওয়ার সময়টুকুও পায়নি সে। তাছাড়া প্রচন্ড ধকল যাচ্ছে নির্বাচনের কাজ নিয়ে। আর কিছু দিন পরই নির্বাচন। তখন খানিকটা মুক্তি মিলবে। আবেশ আড়চোখে সুনয়নার দিকে তাকাল, সে একমণে খাচ্ছে। তাই আবেশই মুখ খুলল,

-‘আজ আমাদের ফাস্ট নাইট।’
-‘হুম।’
-‘এই রাতে নাকি বর বউকে কিছু উপহার দেয়। তোমার কী লাগবে, বলো?’
-‘যা চাই দিতে পারবেন না। তাই বলার প্রয়োজন মনে করছি না।’
-‘শুনি।’
-‘ সুস্থ, সুন্দর, একটা জীবন। যেটা দেওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। মুখ্য কথা, রাজনীতিবিদদের জীবন সুন্দর হয় না। এদের ব্যাক্তিগত বলে কিচ্ছু থাকেও না। তাই চেয়ে বৃথা এনার্জি নষ্ট করলাম না।’

আবেশ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।মুখে তার মিটিমিটি হাসি। সুনয়না দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালে আবেশ বলল,

-‘একটা বিবাহিত মেয়ের জীবন সুন্দর হয় তার স্বামী- সন্তান নিয়ে। সন্তানের কথা নাহয় বাদ-ই দিলাম। গাঢ় ভালোবাসার বাঁধনে আঁটকে রাখে স্বামীকে নামক মানুষটিকে। খুব যতনে আগলে রাখে তার সংসারকে। এরমধ্যে কোনোটাতেই তুমি
আগ্রহী নও, তাহলে? সুন্দর জীবন পেতে গেলে নিজেকেও
কিছু করতে হয়, তবেই না ইচ্ছে পূরণ হয়।’

সুনয়না হাতে প্লেটটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ধীরে পায়ে রান্নাঘরে প্লেট ধুয়ে রেখে পানি খেয়ে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে পিছু ফিরে বলল,

-‘আর যায় হোক একা একা তো আর সংসার হয় না। এজন্য
অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়।’

-‘আর কি প্রয়োজন?’

-‘মায়া, টান, অনুভূতি, আর বিশ্বস্ত একজন মনের মানুষ। ‘

-‘সে আছে, শুধু একটাবার সুযোগ দিয়েই দেখো।’

আবেশ মায়াবী চাহনিতে কথাটা বলল। সুনয়না রুমে গিয়ে একটা চিরকুট লিখে আবেশকে এনে দিলো। আজ রাতের মধ্যে উত্তরটা দিতে পারলে সুনয়না সব পিছুটান ভুলে যাবে। আবেশেকে আপন করে নিবে আর দ্বিধা রাখবে রাখবে না।
কষ্টকে বিতাড়িত করে নতুন সুনয়নাকে উন্মোচিতও করবে।
আর যদি না পারে তাহলে আবেশকে মাথা নত করতে হবে।
এবং অধিকার হারাবে।

অচেনা এক যাত্রাপথ
চাই না যেতে কেউ
তোমার জন্য আছে সেথায়
অনাকাঙ্খিত কেউ।

To be continue…..!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here