বিলম্বিত বাসর পর্ব ১১

#বিলম্বিত_বাসর
#পর্ব_১১
#Saji_Afroz
.
.
.
আয়ানের পাশে চুপচাপ মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে লামিয়া। মুখে কোনো কথা নেই তার। টপটপ করে তার শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। অথচ মাথার উপরে ভনভনিয়ে ফ্যান ঘুরছে। আচ্ছা, এভাবে কি সে আগে ঘেমেছে কখনো?
.
-এই মাইয়া?
.
মোরশেদার ডাকে চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলো লামিয়া।
মোরশেদার দিকে তাকাতেই তিনি বলে উঠলেন-
তোমার আয়ানের লগে কি দরকার? একটা পোলার লগে তোমার কি দরকার থাকতে পারে? যেভাবে তোমাগো এক লগে দেখছি, মনেতো হয়না তুমি ওর বান্ধবী। কে তুমি?
.
.
আয়ানের ফোন বন্ধ থাকায় অস্থির হয়ে ছিলো লামিয়ার মন। একপর্যায়ে তার মনে হলো আয়ানের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হলো তার বাসায় আসা। আর কিছু না ভেবেই আয়ানের খোঁজ নিতে ছুটে আসলো সে এই বাসায়। এসেই আয়ানকে সোফার উপরে বসে থাকতে দেখলো সে। ভেতরে প্রবেশ করতেই লামিয়াকে দেখে আয়ান চমকে গেলো। আর এদিকে আয়ানকে দেখতে পেয়ে লামিয়ার মনে যেনো প্রাণ ফিরে এলো। কোনো কিছু না ভেবে সে জড়িয়ে ধরলো আয়ানকে। ঠিক সেই মুহুর্তে আগমণ ঘটলো মোরশেদার। আয়ান আর লামিয়াকে এভাবে একসাথে দেখতে পেরে চেঁচিয়ে তিনি ফাতেমা বেগমকে ডাক দিলেন।
ফাতেমা বেগমও তার ডাকে ড্রয়িংরুমে এসে হাজির হলেন। সেই থেকে তাকে নানারকম প্রশ্ন করে চলেছেন মোরশেদা। কিন্তু নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লামিয়া। হুট করে এভাবে আসা তার উচিত হয়নি। নিজের বোকামির জন্য নিজেরই আফসোস হচ্ছে এখন।
.
লামিয়ার কাছে কোনো জবাব না পেয়ে ধমকের সুরে মোরশেদা বেগম বললেন-
কি হলো? কে তুমি?
.
এপর্যায়ে মুখ খুললো লামিয়া।
এই মুহুর্তে তার যেই কথাটি জানানো উচিত সবাইকে সেটিই জানালো সে।
আয়ানের দিকে তাকিয়ে ছলছলে নয়নে বললো লামিয়া-
আমি আয়ানকে ভালোবাসি।
.
একটা কথা শুনে পুরো রুমটাই স্তব্ধ হয়ে গেলো। একটা মেয়ের মুখে হঠাৎ করে এমন একটা কথা শুনতে পাবে ভাবতেই পারেনি কেউ।
মোরশেদা ও ফাতেমা বেগমকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে লামিয়া আবারো বললো-
আয়ানকে ভালোবাসি আমি।
.
ফাতেমা বেগম নিশ্চুপ থাকলেও মুখ খুললেন মোরশেদা। রাগে গিজগিজ করে তিনি বললেন-
আমার আয়ান বাবাজির মাথাডা নষ্ট করবার জন্য আসছো তাইনা তুমি?
.
-আহ মোরশেদা! থাম।
.
কথা বলে উঠলেন ফাতেমা বেগম।
লামিয়ার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় ফাতেমা বেগম জিজ্ঞাসা করলেন-
কি বললে? ভালোবাসো আয়ানকে?
-হু।
-বাসায় জানে?
-হু।
-আয়ান তোমাকে ভালোবাসে?
-হুম।
-মনেতো হয়না। যদি ভালোবাসতো তাহলে তোমার কেনো এখানে এভাবে আসতে হলো? এভাবে চোখের পানি, নাকের পানি এক করেছো কেনো? আসলেই তোমাকে আয়ান ভালোবাসে নাকি তুমি এক তরফা ভালোবাসো আয়ানকে?
.
ফাতেমা বেগমের কথা শুনে ঘাবড়ে গেলো লামিয়া। আয়ানের সাথে মান অভিমানের খেলা চলছে তার। এই মুহুর্তে ফাতেমা বেগমকে কি জবাব দিবে সে? আয়ান যদি রাগের মাথায় বলে বসে, সে লামিয়াকে ভালোবাসেনা!
অসহায় দৃষ্টিতে আয়ানের দিকে তাকালো লামিয়া।
লামিয়াকে নিশ্চুপ দেখতে পেয়ে তার দিকে আড়চোখে তাকালো আয়ান। লামিয়া তাকিয়ে আছে তার দিকে এক দৃষ্টিতে, নাক বেয়ে ঘাম ঝরছে তার, চোখ জোড়া ছলছলে। লামিয়াকে এভাবে দেখে বুকটা কেঁপে উঠলো আয়ানের। এই কয়েকদিনে মেয়েটা নিজের কি হাল করেছে! এটা কি সেই লামিয়া?
.
-জবাব নেই?
.
ফাতেমা বেগমের প্রশ্নে লামিয়ার দিকে তাকিয়েই আয়ান বললো-
আমি ভালোবাসি লামিয়াকে।
.
.
পেছন থেকে কেশে উঠলো আদুরে। আদুরের কাশির শব্দে তার দিকে ফাতেমা বেগম তাকালেন। আদুরেকে দেখতে পেয়ে তিনি বললেন-
বউমা? আমি ভেতরে যাচ্ছি মোরশেদাকে নিয়ে। তুমি একটু ওদের সাথে কথা বলে নাও। আমার মাথাটা ব্যথা করছে।
.
.
.
আদুরের সামনে বসে আছে আয়ান ও লামিয়া।
তাদের দৃষ্টি আকর্শন করার জন্য হালকা কেশে উঠলো আদুরে। আদুরের দিকে আয়ান ও লামিয়া নজর দিতেই সে বলে উঠলো-
কাহিনি কি?
-এই আয়ান ফোন বন্ধ রেখেছে আজ ৪দিন হচ্ছে। আমার চিন্তা হয়না বলেন? তাই আমি আর থাকতে না পেরে চলে এসেছি। আপনি জানেন ভাবী, আমি কতোটা কষ্টে ছিলাম?
.
লামিয়ার কথা শুনে আদুরে বললো-
তুমি আমাকে চেনো?
-হুম ছবিতে দেখেছি আপনাকে। আয়ান পাঠিয়েছিলো।
-আচ্ছা! সবটাই বুঝলাম এখন। তোমরা একটা কাজ করো। দুজনে কথা বলে মান অভিমানের পর্ব শেষ করো। আমি আসছি একটু।
.
.
.
নিজের রুমে এসে আবেশকে এখনো ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে অবাক হলো আদুরে। ঘরে এতো কান্ড হয়ে যাচ্ছে আর সে কিনা বাচ্চার মতো হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমোচ্ছে! কেমনে সম্ভব?
আবেশের কানের পাশে মুখটা নিয়ে কর্কশ শব্দে আদুরে বলে উঠলো-
উঠেন সাহেব!
.
এক লাফে শোয়া থেকে উঠে বসলো আবেশ। আদুরেকে পাশে দেখে তার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইলো সে।
মৃদু হেসে আদুরে বললো-
এভাবে কি দেখছো ডেবডেব করে? চোখ জোড়া বের করে নিবো।
.
হাই তুলতে তুলতে আবেশ বললো-
তা নাহলে বের করবে কিন্তু এভাবে ডাকলে কেনো?
-তোমার জন্য একটা সংবাদ আছে।
-ভালো না খারাপ?
-সংবাদটা তোমার জন্য ভালো না খারাপ বুঝতে পারছিনা। তবে অনেক ভালো সংবাদও সূক্ষ্মভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায় সংবাদটা আসলে ভালো না, খারাপ। আবার কোনো মন্দ মানে খারাপ সংবাদ ঠিকমতো বিবেচনা করলে…
-এত কথা না বলে সংবাদটা কি বলো?
-আয়ানের গফ আছে।
-ওহ! ভালো।
-মেয়েটি এখানে এসেছে। সবার সামনে বলেছে সে আয়ানকে ভালোবাসে।
-ওহ।
.
‘ওহ’ বলেই থেমে পড়লো আবেশ। আবারো সে বললো-
কি বললে?
-যা শুনেছো তাই।
.
আদুরে প্রথম থেকেই সবটা শোনাতে লাগলো আবেশকে।
.
.
.
একসাথে একই রুমে দুজনে বসে থাকলেও কারো মুখে কোনো কথা নেই।
আয়ান তাকিয়ে রয়েছে নিচের দিকে আর লামিয়া তাকিয়ে রয়েছে আয়ানের দিকে।
চারপাশে নজর বুলিয়ে আয়ানের হাতের উপরে হাত রাখলো লামিয়া।
আয়ানের হাতের উপরে নিজের হাতটা রাখতে পেরে অন্যরকম শান্তি অনুভব করছে সে।
কিন্তু আয়ান এভাবে চুপচাপ কেনো হয়ে আছে বুঝতে পারছেনা লামিয়া।
আয়ানের হাতটা চেপে ধরে লামিয়া বললো-
রাগ হয়েছে বুঝি আয়ানুর?
.
কিছু বলছেনা আয়ান। তা দেখে লামিয়া আবারো বললো-
কিছু না বললেও আমি জানি, তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো।
-মায়ের সামনে বলেছি বলে? সেটা তুমি ছোট হবে বলেই বলেছিলাম। আর কিছু নয়।
.
নিজের হাতটা লামিয়ার হাত থেকে সরিয়ে নিয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলো আয়ান।
আয়ানের এমন কান্ডে হতাশ হলোনা লামিয়া। বরং সে আজ খুশি। অনেক বেশি খুশি! আয়ান যে সকলের সামনে বললো, সেও ভালোবাসে লামিয়াকে!
.
.
.
-আগে আইছে আদুরে এখন আবার এইডা! আসলে আমাদের বাবাজি গুলান ভীষণ ভালো কিনা তাই ওগো পেছনেই সব মাইয়া উঠে পড়ে লাগে। আবেশ বাবাজিরে তো আদুরের কাছ থেইক্কা বাঁচাতে পারলাম না। আয়ান বাবাজিরে এই মাইয়া থেইক্কা আমি…
.
মোরশেদার কথা থামিয়ে দরজায় দাঁড়ানো অবস্থায় আদুরে বললো-
আপনি প্রেমের বিয়ের বিরুদ্ধে কেনো?
.
আদুরেকে দরজায় দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেয়ে ফাতেমা বেগমের উদ্দেশ্যে মোরশেদা বললেন-
দেখছেন? বড়দের কথা কান পাইতা হুনতাছে এই মাইয়া।
.
মৃদু হেসে আদুরে বললো-
আমি কান পেতে শুনিনি।মায়ের সাথে কথা বলতে এসেছি এখানে। আপনার কথা কানে বাজলো।
.
-এদিকে এসো বউমা।
.
ফাতেমা বেগমের ডাকে তার পাশে এসে বসতে বসতে আদুরে বললো-
কথা হয়েছে আয়ান ভাইয়া আর লামিয়ার সাথে।
-কি বললো?
-তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসে। মান অভিমান হয়েছে দুজনের। ভাইয়া মোবাইল বন্ধ করেছে কয়েকদিন হলো। তাই চিন্তায় থাকতে না পেরে
লামিয়া ছুটে আসলো ভাইয়ার কাছে। ভালোবাসা না থাকলে কি এইরকম করে মা? বলুন?
-মেয়েটার নাম লামিয়া?
-জ্বী।
.
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফাতেমা বেগম বললেন-
আয়ানকে বলো লামিয়াকে যেনো বাসায় পৌঁছে দেয়।
-আচ্ছা।
.
আদুরে রুম ছেড়ে বেরুতেই মোরশেদা ভ্রু জোড়া কুচকে বললেন-
এই মাইয়া মন গলায়া ফেলাইলো আপনের?
-আমি কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেইনি মোরশেদা।
.
.
.
আদুরে লামিয়ার দিকে চামচ কেটে পায়েস বাড়িয়ে দিতেই তা খেয়ে নিলো সে।
আদুরে জিজ্ঞাসা করলো-
কেমন হয়েছে পায়েস?
-অনেক ভালো ভাবী। আচ্ছা ভাবী, এখন আমি আসি।
.
-কেনো বসো আরেকটু?
.
আবেশের কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো লামিয়া। সালাম দিয়ে সে বললো-
দেরী হয়ে যাচ্ছে ভাইয়া। আরেকদিন আসবো।
-তুমি আমাকেও চিনো?
-না চেনার কি আছে!
-আচ্ছা, আবার এসো। আয়ানকে নিয়ে যাও সাথে।
.
মুখটা ফ্যাকাসে করে আদুরে জানালো-
আমি আয়ানকে বলেছিলাম। সে কিন্তু আসতে নারাজ।
.
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে লামিয়া বললো-
আমি একা চলে যেতে পারবো। একা এসেছিতো।
-আরেনা। একা এসেছো কি হয়েছে! তোমাকে আবেশ পৌঁছে দিবে।
.
আবেশের দিকে তাকিয়ে আদুরে ইশারা করতেই সে বলে উঠলো-
কেনো নয়! তুমি আমার সাথে চলো লামিয়া।
-থাকনা ভাইয়া…
-আরেহ! এসো এসো।
.
.
.
ঘড়িতে সময় রাত ১১টা।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে থালা বাসন পরিষ্কার করে পেছনে ফিরতেই ভুত দেখার মতো চমকে গেলেন মোরশেদা।
তাকে নির্ভয় দিয়ে আদুরে বললো-
খালা আমি!
.
বুকে থুথু দিয়ে মোরশেদা বিরক্তিভরা কণ্ঠে বললেন-
-ওহ! তুমি? কি চায় এতো রাতে?
-একটা কথা জানতে চাই।
-কি?
-প্রেমের বিয়ে নিয়ে এতো কিসে আপত্তি আপনার?
.
আদুরে মুখে এই প্রশ্নটি শুনে মুখে নেমে এলো মোরশেদার এক রাশ অন্ধকার!
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here