বিষণ্ণ বিকেলের গল্প
সাবিকুন নাহার
আমার বড় আপার নাম রেনু। আপাকে কোনোদিন আমরা কাঁদতে দেখিনি। জীবনে যত কষ্টই পাক তার মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকত। আমাদের বাবা যখন মারা গেলেন তখন আমরা তিন ভাই বোন ছোট। বড় আপা সে বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিলেন। তারপর আমার এক ভাই সেভেনে পড়তো, আমি ফাইভে আর আর ছোটজন টু তে। বাবা মারা যাওয়ায় মা দিশেহারা হয়ে গেলেন। বাবা ছিলেন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। তাই পরিবারের অবস্থাও ছিলো নুন আনতে পান্তা ফুরায় দশা। বাবার মৃত্যুর পর আত্মীয় স্বজনরা তেমন একটা খোঁজ খবর নিতো না। কোনো দরকারে তাদের কাছে গেলেও বিরক্ত হতো। এসব ব্যাপার নিয়ে মা খুব মানসিক টেনশনে ভুগতো যার ভুক্তভোগী হতেন বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই আপা। এক একবার কষ্ট চেপে রাখতে না পেরে কাঠ দিয়ে আপাকে মা মারতো তবুও আপা চুপ করে থাকত। টেস্ট পরিক্ষার পর বাবা মারা গেলে মা আর আপাকে পরীক্ষায় বসতে দেন নি। আপাও মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু তবুও আপা পড়াশোনা করতো। আমি জিজ্ঞেস করতাম, পরীক্ষা তো দেবেনা তবুও কেন পড়ছ??
আপা হেসে বলতেন, আগামী বছর তো দেব সেজন্য পড়ে রাখছি।
আমাদের সংসারের হাল খুব খারাপ হতে লাগলো। যতটা খারাপ হয়েছিল সেটা হয়েছিল মায়ের জন্য। বাবার অফিস থেকে মোটামুটি ভালো এমাউন্টের টাকা পাওয়া গেল, এছাড়াও আমাদের গ্রামের বাড়ির ধানের জমি বিক্রি করে নগদ টাকা এনে মা যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতো কিন্তু আমাদের রাখতো না খাইয়ে।
দেখা যেত প্রত্যেক বেলায় ই আমরা চার ভাই বোন পেট পুরে খেতে পারতাম না। এমনও দিন গেছে যেদিন সকালে আপা পান্তা ভাতটুকু আমাদের দিয়ে পানিটা সে লবন দিয়ে খেয়ে নিতো। তবুও তার মুখে হাসি লেগে থাকত। আর মা যেন এসব দেখেও দেখতেন না।
ঘরের সবকাজ আপা করতো তবুও মায়ের কাছে বিভিন্ন কারনে মার খেতো। বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের যা ও সহ্য করতে পারতো, আপাকে তা পারতো না।
এক দুপুরে মা জানালো আপাকে বিকেলে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। সেদিন প্রথমবার আপা মায়ের পা জড়িয়ে কেঁদে বলেছিল বিয়ে না দিতে। সে পড়তে চায়। ম্যাট্রিক পাশ করে এরপর নিজের খরচ নিজেই জুগিয়ে নেবে।
মা মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছিল, ম্যাট্রিক দিতে যে কতগুলো টাকা খরচ হবে সে হিসেব আছে!
আপা তখন অনুনয় করে বলেছিল, মা তোমার কাছে তো টাকা আছে সেখান থেকে দাও আমি পরে শোধ করে দেব।
মা রেগে বলল,
-ওই টাকার দিকে নজর দিবি না হারামজাদি। ওই টাকা দিয়ে আমি ছেলেদের পড়াবো। ছেলেদের না দেখলে তারা কি আমায় দেখবে!
আপা আর কিছু বললেন না। পরদিনই বয়সে দ্বিগুণ এক লোককে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলেন। আপা একটুও কান্নাকাটি করলেন না। মা ও কাঁদলেন না, সে তখন ব্যস্ত ছিলো নতুন জামাইয়ের বাড়ি থেকে আনা দই মিষ্টি আগলে রাখতে।
আপা থমথমে মুখে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আমাকে বলে গেল, ভালো থাকিস মিনু।
এরপর আর কোনোদিন আপা আমাদের বাড়ি আসেননি। বিয়ের অনেকদিন পর ও যখন আসলেন না তখন মা আমাদের তিন ভাই বোন কে নিয়ে আপাকে দেখতে গিয়েছিলেন। আপা আমাদের দেখে খুশি হলেন না তেমন। তবে মা আপাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। আপার ফর্সামুখে মারের স্পষ্ট দাগ দেখা যাচ্ছিল। আমাদের আপ্যায়ন করা হলোনা খুব একটা। পাতলা মসুরের ডাল আর বাসী শিমের তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে আমরা ফিরে আসলাম। পুরো পথে মা একটাও কথা বলেনি।
তবে সেখান থেকে ফিরে আসার পর একটা পরিবর্তন হয়েছে সেটা হলো ভাইদের সাথে সাথে আমাকেও পেটভরে খেতে দিতো। এমনকি আগে পড়ার খরচ দিতে গড়িমসি করলেও এরপর আর করেনি।
দিনগুলো এভাবেই কাটলো। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে বিএ ভর্তি হওয়ার পর পর ই আমার বিয়ে হয়ে গেল। আমার গায়ের ফর্সা রঙ আর দুটো সার্টিফিকেটের জন্যই হাইস্কুলের টিচারের সাথে বিয়ে হলো। বিয়ের পর পর ই স্বামীর উদ্যোগে প্রাইমারী স্কুলে চাকরি নিয়ে পড়াশোনা জলাঞ্জলি দিলাম।
আমার মা তখন ও দুই ভাইকে নিয়ে থাকেন। বড়জন কোনোভাবে বিএ পাশ করে একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিল। পরবর্তীতে বসের মেয়েকে বিয়ে করে বিদেশে চলে যায়। মা তখনও আশায় ছিলো ছোট ছেলে তাকে খাওয়াবে।
ছোট ভাই কলেজে পড়ার সময়েই মারামারি গুন্ডামী করে বার দুয়েক জেলে যায়। আর মা ছাড়িয়ে আনে। আমি কখনও কিছু বললে বলতো, ছোট ভাইটাকে দ্যাখতে পারোস না হারামজাদি। অথচ তোর শইল্যের অর্ধেক গোশত তো অর ভাগের খাওন খাইয়া হইছে।
আমি এরপর আর কিছু বলতাম না। আপা তো সেই যে চুপ হয়ে গেছে আর মুখ খোলেননি।
একসময় মায়ের টাকা ফুরিয়ে গেলে আমার কাছে টাকা চাইতে আসলো। কিন্তু আমিও খুব বেশী দিতে পারলাম না। মা রাগে গজগজ করতে করতে চলে যায় তার ছোট ছেলেকে জেল থেকে বের করতে।
এরপর অনেক দিন গেছে। এক বিকেলে মা ফোন করে হাউমাউ করে কাঁদে। অনেকসময় পর বুঝতে পারলাম কান্নার কারন। বড় ভাই বিদেশ থেকে খবর পাঠিয়েছে যে মায়ের সাথে আর সম্পর্ক রাখবে না। কেন যেন সেদিন মায়ের কান্না শুনে আমার খারাপ লাগেনি। মা সবসময় দুই ছেলেকে জান প্রাণ দিয়ে আগলে রেখেছেন। ছোট মেয়ে বলে তবুও ছিটেফোঁটা আদর যত্ন পেয়েছিলাম কিন্তু বড় আপা সে তো তাও পায়নি।
মাঝে মাঝে আপার সাথে যোগাযোগ থাকলেও তার কাছে যাওয়া হতো না। আর সেও আসতেন না আমাদের কাছে। হয়তো অনুভূতি মরে গিয়েছিল। অনেক বছর পর আপার সাথে আবার দেখা হলো দুলাভাইয়ের মৃত্যুতে।
আপার স্বামী মারা গেছে তিন ছেলে মেয়ে রেখে। আপা মায়ের মতো একটুও ভেঙে পড়েন নি। মায়ের মতো ছেলেদের লাইফ সিকিউর করার জন্য মেয়ের বিয়েও দেয়নি। দুলাভাইয়ের রেখে যাওয়া বাড়ি ডেবলপার কে দিয়ে প্রথমে ভাড়া বাসায় ওঠেন। আত্মীয় স্বজনরা সহানুভূতি জানাতে এসে যে দুই, চারশ টাকা দিতেন সেটাও হাত পেতে নিতো। ডেবলপারের দেয়া এডভান্স টাকা আর জমানো টাকা দিয়ে ছোট একটা পার্লার দিলো বাসার পাশেই। আর ছেলেমেয়েরাও আগের মতোই পড়াশোনা করতে লাগলো।
বছর দুয়েক পর আপাকে দেখতে মাকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম। মা সেখানে বেশীক্ষন থাকতে চাইলেন না। মা এখন আমার সাথেই থাকে। আপাও মাসে মাসে কিছু টাকা দেয় মায়ের খরচবাবদ।
গাড়িতে বসে মা অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে। নিজের মেয়ের জিতে যাওয়া দেখে সে কাঁদছে। আমি তাকে থামতেও বলছি না। আমার মনে হচ্ছে এই কান্না তার দরকার। আমার খুব বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, কারও মুখের হাসি কেড়ে নিলে এভাবেই কাঁদতে হয় মা!
বিষন্ন বিকেলের গল্প