মিথিলা

মিথিলা
সাবিকুন নাহার

এক শীতের সকালে মিথির সাথে প্রথম আমার দেখা হয় নীলক্ষেতের মোড়ে। একহাতে দুই পায়ের জুতা আর কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মুখে হাসি হাসি ভাব এনে হেটে যাচ্ছিলো। ভাব এমন ছিলো যেন জুতা ছিড়ে যাওয়া কোনো আনন্দের বিষয়। কেন যেন ওকে আমার খুব ভালো লাগল। আমি ওর পিছু নিলাম। ও ফার্মগেটের লেগুনায় উঠলে আমিও উঠে গেলাম। ভাড়া দেয়ার সময় প্রথম আমি ওর কিন্নরী কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আমি প্রথমবার ওকে ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম। চাপা রঙের মধ্যে বড় বড় চোখ আর জোড়া ভ্রু দেখে আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল। মনে হলো এই মেয়েটার গায়ের রঙ যদি একটুখানি ফর্সাও হতো তবুও ভালো লাগতো না। এই রঙেই মানিয়ে গেছে।

মিথির সম্পর্কে আমি শুধু নাম আর কোথায় থাকে সেটুকুই জেনেছিলাম। গ্রিন রোডের এক গার্লস হোস্টেলে থাকে একটু জানতাম। আর নাম টা জেনেছিলাম ওখান কার দোকানদারের কাছ থেকে।

এরপর প্রায়ই আমি ওর হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কিন্তু আর ওর সাথে আমার দেখা হয়নি। এরপর প্রচন্ডরকম জ্বরে পড়লাম। আমার রুমমেট রা হসপিটালে ভর্তি করল। সেখানে সবসময় দেখে রাখত আমার কাছের বন্ধু কল্লোল।
জ্বরের কারনে খাওয়ার রুচি কমে গেছে তাই কল্লোল আমার খাওয়ার অন্য ব্যবস্থা করল। ওর খালাতো বোন রেঁধে নিয়ে আসবে। কল্লোলের জন্যই দ্বিতীয় বারের মতো আবারও আমি মিথির দেখা পেলাম। সেই কিন্নরী কন্ঠে যখন বলল, আমি মিথিলা।
তখন আবারও আমার ধুকপুকানি বেড়ে গেছে।

এরপর কল্লোলের সাথে মেলামেশা বাড়িয়ে দিলাম। কারণে অকারণে ওর সাথে মিশতে লাগলাম। যদি মিথির সাথে একটু দেখা হয়ে যায়। কিন্তু কল্লোল মিথির সাথে দেখা করতে যেত না খুব একটা। তবুও ভাগ্যসহায় ছিলো বলে একদিন দেখা হয়ে গেল। আমাকে দেখে সেদিন একটু হেসে কুশলাদি জিজ্ঞেস করল। কল্লোল ওর সাথে একটু দূরে গিয়ে কথা বলল। কি বলল আমি শুনতেও পেলাম না।

একবার হলের খাবার খেয়ে কল্লোলের ভয়ংকর পেট খারাপ হলো। একটু সুস্থ হওয়ার পর মিথি রান্না করে নিয়ে আসত ওর জন্য।

এরপর প্রায়ই আমার সাথে মিথির দেখা হতো। প্রতি শুক্রবার মিথি রান্না করে আমাদের ব্যচেলর বাসায় নিয়ে আসত। তখন দু একটা কথা হতো। আমি মুখিয়ে থাকতাম কথা বলার জন্য। কিন্তু ও তেমন কথা বলত না লজ্জার জন্য। তবে কল্লোলের সাথে হেসে হেসে কথা বলতো।

মাস্টার্স এর ফাইনাল পরীক্ষার পর ভাবলাম কল্লোল কে মিথির কথা বলবো। তার আগেই কল্লোল একদিন আমাকে ডেকে বলল,
-দোস্ত কিছু টাকা দিতে পারবি? আর্জেন্ট দরকার।

-কত টাকা?

-তুই যা পারিস। তোর কাছে যা আছে দে তো!

-কি করবি বল তো??

-তুই কাউকে বলিস না। আমি মিথি কে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি। আরে বলা নেই, কওয়া নেই হুট করে ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলল ওর পরিবার।

আমি স্তব্ধ হয়ে রইলাম কিছুক্ষন। কিছু বলার মতো খুঁজে পেলাম না। শেষমেস কোনোভাবে জিজ্ঞেস করলাম,
-মিথি তোকে ভালোবাসে?

-কি যা তা বলছিস? ভালো না বাসলে পালাবে কোন দুঃখে!

আমি ওদের ট্রেনে উঠিয়ে দিলাম। মিথি আমাকে দেখে বলল,
-আপনার উপকার সারাজীবন মনে থাকবে ভাইয়া!

আমি হেসে বললাম, ভালো থেক মিথিলা!
মিথিলা তার কিন্নরী স্বরে বলল, আপনিও ভালো থাকবেন ভাইয়া!!

ট্রেন ছাড়ার পর যতক্ষন দেখা যায় আমি মিথিকে দেখে নিলাম। কারন আমি ভেবেছিলাম এটাই হয়তো মিথির সাথে আমার শেষ দেখা। মিথিও আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো জানালা দিয়ে। তবে আমার ঝাপসা হওয়া চোখ দেখেছিল কি না সেটা জানিনা!

এরপর যখন মিথির সাথে দেখা হলো তখন আমি এক মেয়ের বাবা। মিনাবাজারে বাজার করতে গিয়ে দেখা হলো। উচ্ছ্বল, প্রানবন্ত মিথিলার সাথে ওই মিথিলার ছিলো আকাশ পাতাল পার্থক্য। তবে সেই কিন্নরী সুরের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমাকে দেখে স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করল,
-আপনি ভালো আছেন তো?
আমি কোনোরকম জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ভালো আছো মিথিলা?

-হ্যাঁ।

আমার কাজ শেষ হওয়ার পরও আমি মিথির জন্য অপেক্ষা করলাম। মিথিকে জিজ্ঞেস করলাম,
-কল্লোল কোথায় মিথি?
মিথি ম্লান হেসে বলল, জানিনা!

-মানে? ও তোমার স্বামী না?

-না। বিয়ে হয়নি। সিলেট যাওয়ার তিনদিন পর খালু আমাদের খুঁজে পেল। কল্লোল ভাই বলল আমি নাকি তাকে জোর করে এনেছি তার আসার ইচ্ছে ছিলো না!

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সেদিনের পর আমি আর কল্লোলের সাথে যোগাযোগ করিনি তাই এসব কিছুই জানিনা। আসলে রাগ থেকেই আমি আর কল্লোলের সাথে যোগাযোগ করিনি।

আমি ব্যথিত গলায় বললাম, বিশ্বাস কর আমি এসব জানতাম না।

-আপনি জানলে বা কি করতেন? আপনি নিজের ভালোবাসার কথা জানাতে পারেন না,,,,,
ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তুমি বুঝেছিলে আমার ভালোবাসা??

-প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো আপনার ঝাপসা চোখ দেখে আমি বুঝে গিয়েছিলাম নিবিড় ভাই। তবে আপনি যদি একবার বলতেন,,,,,,

-তুমি তো কল্লোল কে চেয়েছিলে!

-কল্লোল ভাই সুইসাইড করার কথা বলেছিল আমার বিয়ের খবর শুনে।

আমি কিছুক্ষন বাকরুদ্ধ হয়ে রইলাম।

মিথি যাওয়ার আগে আমাকে বলেছিল, আপনার ডায়েরির কবিতাগুলোর স্নিগ্ধতা যে আমি ছিলাম সেটা কল্পনায়ও ভাবিনি। যদি ভাবতাম তবে আজ হয়তো,,,,,

মিথি কথা না শেষ করে চলে গেল। আমার আর বলা হলো না যে আমার চার বছরের ছোট মেয়ের নাম ও মিথিলা। সেও যখন তার আদো বুলিতে কথা বলে তখন আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি।

ছোটগল্পঃ মিথিলা
লেখাঃ সাবিকুন নাহার নিপা
(অনেক দিন আগের লেখা। হঠাৎ আজ চোখে পড়ল)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here