লাভিং জার্নি

লাভিং জার্নি
লেখাঃ সাবিকুন নাহার নিপা
প্রথমবার যাকে দেখে বুকে ধুকপুকানি শুরু হয়েছিল সে ছিলো তাশিব। যেদিন আমাদের স্কুলে এসে নাইনে ভর্তি হয়েছিল সেদিন ওকে দেখে আমি হার্টবিট মিস করেছিলাম। এখন ও সেই দিনটির কথা আমার মনে আছে। ক্লাস টিচার যখন পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিল, ও হলো তাশিব আগে নরসিংদী থেকে পড়াশোনা করতো এখন তোমাদের সাথে পড়বে। আমি তখন ভালো করে ছেলেটাকে দেখেছিলাম। ফর্সা গায়ের রঙ, ঝাকড়া চুল, আর গোলাপি ঠোঁট এর ইনোসেন্ট ছেলেটাকে আমি অনেকক্ষন ধরে দেখেছিলাম।

এরপর প্রায়ই সুযোগ পেলে আমি ওকে দেখতাম। কিন্তু ও আমার দিকে ফিরেও তাকাতো না তেমন। ও শুধু আমার দিকে না, কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখত না।

কিন্তু এই ভালোলাগা বিরক্তির কারন হলো প্রথম সাময়িক পরীক্ষার রেজাল্টের পর যখন আমার প্রথম পজিশন কেড়ে নিলো। শুধু তাই নয় ডিবেটিং, ছবি আঁকা সবকিছুতে আমার পজিশন কেড়ে নিয়েছিল। স্কুলের অন্যসবাই যখন বলতো আনিশার জায়গা নিতে এখন সত্যিকারের একজন মানুষ আসল এতোদিনে। তখন আমার সেই সুন্দর ইনোসেন্ট ছেলেটাকে ঠাকুরমার ঝুলির দৈত্যর মতো মনে হলো।

যারা এতোদিন আমার জন্য পাগল ছিলো তারা আমাকে ভুলে তাশিবের দলে নাম লেখালো।

তবুও আমি সব ভুলে তাশিবের সাথে কথা বলার চেষ্টা করতাম কিন্তু সে আমাকে পাত্তাই দিতো না। একবার এনুয়াল ফাংশনে ওর জন্য নাচলাম কিন্তু ও আমার নাচ দেখলই না।

সেদিন বাড়ি গিয়ে সারারাত কেঁদে শেষমেস সিদ্ধান্ত নিলাম এবার থেকে শত্রুর মতো আচরণ করবো তবে যদি ও আমার দিকে ফিরে তাকায়।

যথারীতি আমি তাশিবের সাথে শত্রুতা শুরু করে দিলাম। যত প্রকার বিরক্ত করা যায় সবই করতাম। কখনো ও ক্লাসরুমে না থাকলে ওর খাতায় রাক্ষসের ছবি এঁকে দিতাম, আবার কখনো ওর বই লুকিয়ে রাখতাম কিন্তু ও ছিলো নির্বিকার। কিন্তু আমিও হাল ছাড়লাম না। এভাবেই বিরক্ত করা চলছিলো

হঠাৎ একদিন আমাকে তাশিব ডাকল ক্লাসশেষে। আমি খুশিতে গদগদ হয়ে যখন ওর কাছে গেলাম তখন ও আমার দিকে একটা আর্ট খাতা দিয়ে বলল,
-তোমার আর্ট খাতা তো শেষ তাইনা! এখন থেকে এটায় রাক্ষস, ভুতের ছবি এঁকো কেমন!

লজ্জা আর অপমানে আমার কান লাল হয়ে গেল। ক্লাসের সবাই জেনে গেল তাশিবকে আমি বিরক্ত করে।

এরপর আমি চুপ করে গেলাম। যথারীতি এনুয়াল পরীক্ষায় তাশিব আমার থেকে অনেক বেশী নাম্বার পেয়ে ফার্স্ট হলো। রেজাল্টের দিন হেডস্যার আমাকে ডেকে বলল,
-কেমন বোধ করছ আনিশা?? তোমার পজিশন তো এই ছেলেটা নিয়ে নিলো।
আমি সেদিন লজ্জা আর অপমানে চোখ নামিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু আড়চোখে তাশিব কে মুচকি হাসতে দেখে কেঁদে ফেললাম।

তাশিব কে আমি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলাম। আমি শুধু পড়াশোনায় মন দিতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। শুধু পড়াশোনা না সব কিছুই এক এক করে হারিয়ে যেতে লাগলো আমার জীবন থেকে। আমি ছবি আঁকতে গেলে সেখানে তাশিব চলে আসতো, খাতায় লিখতে গেলে আমার শুধু তিন অক্ষরের তাশিব নাম টা চলে আসত। এমনকি ভাতের প্লেটেও ওকে দেখতাম।

দিনে দিনে আমি বুঝে ফেলেছিলাম যে তাশিব কে ছাড়া আমার চলবে না। তাই আমি আর ওর পিছনে লাগতাম না। তবে আমি ওকে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করতাম যে ওকে আমি ভালোবাসি। ওর জন্যই আমি গেয়েছিলাম,
চলোনা যাই,
বসি নিরিবিলি,
দুটো কথা বলি, নীচুগলায়।

তাশিব আগের মতই রইলো। একটুও বদলালো না। আমি যে কতভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি কিন্তু ও বোঝেই না।

একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম। স্কুলেও সময় শেষ হয়ে আসছিলো। সামনে টেস্ট পরিক্ষা। এরপর তো তাশিব কে দেখতেও পাবোনা সেটা ভেবেই রাত পার করে দিতাম। মন মেজাজ খারাপ থাকত সবসময়। আর ঠিক সেরকম ই এক দিনে তাশিবের সাথে আমার ধুন্ধুমার লেগে গেল।

সেদিন ছিলো শুক্রবার। আমরা একই স্যারের কাছে ক্যামিস্ট্রি পড়তাম। সকালে আমি আগে গিয়ে ছেলেদের বসার জায়গায় বসলাম। অন্য মেয়েরা আসলে তাদের বসতে দিলাম মেয়েদের জায়গায়। তাশিবসহ আরও কয়েকজন ছেলে এসে আমাকে দেখে চমকে গেল। ছেলে দুটো আমাকে বার কয়েক রিকোয়েস্ট ও করল সিট ছেড়ে দেয়ার জন্য। আমি রাজি হলাম না। আমি মনে মনে চেয়েছিলাম তাশিব যেন কিছু বলুক। কিন্তু ও কিছু না বলে বেঞ্চ তুলে ফেলল আর আমি নিচে পড়ে গেলাম। সবাই হো হো করে হেসে ফেলল। রাগে ক্ষোভে আমি তাশিব কে ধাক্কা দিলাম গায়ের জোরে। তাল সামলাতে না পেরে দরজায় মাথা লেগে মাথা ফেটে গেল।

এরপর যা হওয়ার ছিলো সেটাই হলো। পুরো স্কুলের সবাই জেনে গেল ব্যাপার টা। হেড স্যার আমার বাবা, মা কে ডাকলেন। তারা তাদের মতো আমাকে শাসন করলেন। আমি ভেবেছিলাম এখন অন্তত তাশিব আমার হয়ে কিছু বলবে। আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে তাশিব চুপ করে থাকল। বাবা, মা আর হেড স্যারের কথায় আমি তাশিবের কাছে মাফ চাইলাম। তাশিব তখনও কিছু বলল না। আর আমি পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিলাম।

আমি নিজের মতো একা একা থাকতে শুরু করলাম। ক্লাসের সবার সাথে মেশা বন্ধ করে দিলাম। রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটাতাম কিন্তু পড়তেও পারতাম না।

প্রথমবার আমি টেস্টে সব সাবজেক্টে ফেইল করলাম। সবাই বিস্মিত হওয়ার সাথে সাথে এটা বুঝল যে আমি ইচ্ছে করেই করেছি।

বাবা তেমন ঝামেলা করলেন না৷ হয়তো বুঝতে পেরেছিল মেয়ের জেদ। মা খুব ঝামেলা করেছিল। আমি বাবাকে বলেছিলাম যে ওইবছরে আর পরীক্ষা দেব না। বাবা রাজি হলেন। কিন্তু আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো নানুর বাড়িতে। আমিও আর আপত্তি করিনি। সব ছেড়েছুড়ে নানুর বাড়িতে যাওয়ার সময় ভেবেছিলাম যে এ জীবনে তাশিবের সাথে আমার আর দেখা হবে না। কিন্তু ইউনিভার্স ঠিক করে রেখেছিল অন্যকিছু!!
————————————- ———————-

নানুর বাড়ি যাওয়ার পর আমি তাশিব কে ভোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। তবুও পুরোদমে পড়াশোনা করতে লাগলাম। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমি আবার বাড়িতে গেলাম। ভেবেছিলাম তাশিব হয়তো পরীক্ষা দিয়ে শহরে চলে গেছে। কিন্তু বাড়ি যাওয়ার একদিন পর মা বলল, তাশিব নাকি পরীক্ষা দেয় নি। সবাই অনেক করে বোঝানোর পর ও পরীক্ষা দিতে রাজি হয়নি। পড়াশোনাও আর করবে না।

পুরো ব্যাপার টায় আমি প্রচন্ডরকম শকড হলাম। কি এমন হলো! নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে শেষমেস আমি তাশিবের বাড়িতে গেলাম। ওকে না পেয়ে আন্টির কাছে সব শুনলাম। তাশিবের বাবা নেই। তাই একমাত্র ছেলের এই অবস্থার জন্য সে খুব মুষড়ে পরছিলেন।

তাশিব বাড়ি ফিরল সন্ধ্যাবেলা। আমাকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। আমি কিছু বললাম না। আসলে কিছু বলার মতো খুঁজেও পেলাম না। তবে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে আমার খুব খারাপ লাগলো। কিছু বলার খুঁজে না পেয়ে যখন চলে আসবো তখন তাশিব আমাকে ডেকে বলল,
-আনিশা আমি কিন্তু স্বপ্নেও চাইনি তুমি স্কুল ছেড়ে দাও।
আমি ওর দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। ও আবারও বলল,
-আমি তোমার প্রেমে পড়েছিলাম প্রথম ডিবেট ক্লাবে। তুমি যখন হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলেছিলে তখন আমার বুকের মধ্যে কি যেন হচ্ছিলো।
তুমি যখন আমার সাথে দুষ্টমি করতে তখন আমি মনে মনে বলতাম করুক আরও বেশি বেশি।
যেদিন তোমাকে আর্ট খাতা দিয়েছিলাম সেদিন তোমাকে আরও একটা কথা বলতে গিয়েও বলতে পারিনি যে এই খাতায় বেশী করে রাক্ষসীর ছবি এঁকে দিও। রাক্ষসের আর একা একা ভালো লাগেনা।

তুমি চুপচাপ হয়ে যাওয়ায় আমি ছটফট করতাম। তোমার পাগলামি না দেখে ভালো লাগছিলো না আর সেজন্যই সেদিন বেঞ্চ তুলে ফেলেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম এরপর হয়তো তোমার ঝগরুটে রুপ দেখতে পাব।

হেড স্যারের ওখানে তোমার থেকে বেশি কষ্ট আমি পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম একবার বলে ফেলি যে আনিশার দোষ নেই। কিন্তু বলতে পারিনি।

আমি বিস্মিত হয়ে তাশিবের প্রত্যেক টা কথা শুনছিলাম। তাশিব কি বলছে!

তাশিব আবারও বলল, ক্লাসে বইয়ে মুখ গুজে আড়চোখে আমি তোমাকেই দেখতাম। আর বাকী সময়ে সবসময় তুমি আমার মনে থাকতে বলেই আমি মনটাকে ঘোরাতে পড়াশোনায় ডুবে থাকতাম। কিন্তু সেটাই কাল হলো। যে পড়াশোনার জন্য তুমি আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেলে সে পড়াশোনার আর দরকার নেই।

আমি কিছু বলতে পারলাম না। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তাশিব আমার হাত ধরে ওর ঘরে নিয়ে গেল। খাতা বের করে দেখাতে লাগলো আমাকে। প্রতিটি পৃষ্ঠায় আমার নাম লেখা।
তাশিব আবারও বলল, এমন দিন নেই যে তোমাকে আমি মিস করিনি।

আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, তুমি আজ থেকে আবার পড়াশোনা শুরু করবে।

তাশিব কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আমার কাছে আসল। দুহাতে আমার গাল ধরে নাকের সাথে নাক ঠেকিয়ে বলল,
-ভেবেছি এই জন্মে শুধু বাউল হয়েই কাটিয়ে দেব। তুমি কি আমার সঙ্গী হবে বাউলরানী???

আমাদের আর বাউল হওয়া হয়নি। এরপর আমরা দুজনে একটা লম্বা জার্নিতে একসাথে ছিলাম। সম্পর্কের ১১ বছর পর আমাদের বিয়ে হয়েছিল। এরমধ্যে যে কতবার ব্রেকাপ হয়েছে তার হিসেব নেই। একসাথে এসএসসি এইচএসসি পার করে আমি মেডিকেল কলেজে আর তাশিব রাজশাহীতে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়। আমাদের সম্পর্কের কথা ফ্যামিলি জানতো শুরু থেকেই। আমাদের জেদের কারনে তারা আর কিছু বলেনি। তবে তাদের ধারণা ছিলো অল্প বয়সে হওয়া এই সম্পর্ক এক সময়ে ভেঙে যাবে কিন্তু জীবনের নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে আমাদের সম্পর্ক টিকে ছিলো।

মেডিকেল কলেজে সিনিয়র ভাইয়ারা তাশিব কে নানারকম গসিপ বানিয়েছিল আমি পাত্তা দেয়নি। আমাদের মধ্যে যেমন আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিলো তেমনি ঝগড়াও ছিলো। ঝগড়া আমি করতাম আর ও চুপ করে শুনতো। আমি রেগে গিয়ে ফোন ভেঙে ফেলতাম কিন্তু ও ফোনে না পেয়ে পরদিন ভোরে আমার হোস্টেলে এসে উপস্থিত হতো। আর আমি ওর মুখ দেখে সব ভুলে যেতাম। এরকম যে কতবার রাগারাগি আর ব্রেকাপ হয়েছে তার হিসেব নেই।

রাঙামাটি ট্যুরে গিয়ে মোবাইল হারিয়ে যাওয়ায় একবার যোগাযোগ করতে পারিনি। পরদিন ঠিকই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয় তাশিব। আমি রেগে দু এক কথা শোনাতে গেলেই মুচকি হেসে বলেছিল,
-আমি তো তোমার এই রাগ দেখার জন্যই এতো কষ্ট করে ছুটে এসেছি ডাকুরানি।

আমাদের বিয়ে হয়েছিল দুজনে স্ট্যাবলিশড হওয়ার পর। বিয়েতে যারা এসেছিল তাদের সবার প্রশ্ন ছিলো তোদের সম্পর্ক এখন ও আছে! বাবা মায়েরাও অবাক হয়ে বলেছিল তোরা তো গিনিস বুকে নাম লেখিয়ে ফেলবি।

বিয়ের দিন যখন পাশাপাশি বসি তখন আমি ফিসফিস করে বলেছিলাম,
-এই যে আমার এতো রাগ, এতো জেদ সারাজীবন সইতে পারবে তো!
ও হেসে বলল, এগারো বছর কি কম সময়??
-কেন সব মেনে নিতে?
-ভালোবাসার চেয়েও বড় শক্তি হচ্ছে বিশ্বাস। কতো মানুষ আমার নামে খারাপ কথা বলেছে অন্যকেউ হলে ঠিকই বিশ্বাস করতো কিন্তু কই তুমি তো বিশ্বাস করোনি! এতো টা বিশ্বাস যার আমার জন্য ছিলো তার ওইটুকু রাগ তো সহ্য করা যায়।

আমাদের বিয়ের ও অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। না ভালোবাসা বদলায় নি। রোজ রাতে ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি তাশিব কে দেখি। খুশিতে চোখে পানি এসে যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে তাশিবের চিঠি পাই যেখানে লেখা থাকে,
আমি গেলাম। সারারাত তো আমাকে দেখেই কাটিয়েছ তাই আর ঘুম ভাঙালাম না।

অনেকে বলেছিল সমবয়সী রিলেশন টিকবে না। কিন্তু আমরা সেকথা কানে তুলি নি। আমি বিশ্বাস করি ভালোবাসা কখনো বদলায় না। সময়ের সাথে সাথে আবেগ কিংবা ভালোলাগা বদলাতে পারে কিন্তু ভালোবাসা বদলায় না।
সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here