বিবাহ বিভ্রাট

#বিবাহ_বিভ্রাট

যাকে বলে ‘তীরে এসে তরী ডোবা’- তাই ই হলো শুভেন্দুর সঙ্গে। কালবৈশাখী মাথায় করে হাঁটু অব্দি জল-কাদা ডিঙিয়ে এতখানি পথ আসবার পর ঠিক গ্রামে ঢোকার মুখেই সর্বনাশ হলো, চাটুয্যেদের বাগানের বড় গাছখানার গুঁড়িতে পা আটকে বেকায়দা রকমে ছিটকে পরলো বেচারা। হাতের হালকা ব্যাগটা ঝড়ো হাওয়ার তালে তালে উত্তর দিকে যাত্রা করলো, চোখের চশমাটাও বোধহয় ‘ব্যাগখানা খুঁজে নিয়ে আসিগে দাদা’ বলে সেটার পিছু পিছু দৌড়লো। শোঁ শোঁ করে হাওয়া বইছে দিগ্বিদিক, তীরের ফলার মত বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি বিঁধছে গায়ে, কালবৈশাখীর তান্ডবে জগৎ জননী বেসামাল। আকণ্ঠ কাদায় ডুবে থাকা শুভেন্দু তখন হামাগুড়ি দিয়ে আতিপাতি চশমাটাকে খুঁজছে। ওটা ছাড়া যে সে একেবারেই অচল!

-‘চশমাটা খুঁজছেন বুঝি? এই নিন।’- একটা রিনরিনে মিষ্টি গলা বেজে ওঠে। কালবৈশাখীর তাণ্ডব, গাছেদের গায়ে গায়ে লেগে যাওয়ার ‘ঠক ঠকাস’ শব্দ, হাওয়ার শোঁ শোঁ গর্জন- সমস্তটা ছাপিয়ে দু’খানা ধ্বনি শুভেন্দুর কর্ণকুহর ভেদ করে হৃদয়ে যেয়ে বাজতে থাকে- ‘এই নিন! এই নিন!…’

-‘কী হলো? দেখতে পাচ্ছেন না বুঝি আমায়? আচ্ছা বেশ, ধরছি আমি। উঠে দাঁড়ান দেখি!’

পাখির পালকের মত নরম একখানা হাত সবলে টেনে ধরে শুভেন্দুর হাতখানা। মিনিট দুয়েক আগে উল্টে পরেও যে সর্বনাশটা হয়নি এবারে সেটাও হলো- ব্যাগখানা আর চশমাটার পর এবারে আজন্ম লালিত চার প্রকোষ্ঠের হৃদয়খানাও ‘দূর ছাই!’ বলে খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে এলো!

-‘চশমার কাঁচটা জলে ধুয়ে দিয়েছি, নিন। ব্যাগটা ওদিকে পরেছে। পুঁটি! বোন যা না ব্যাগটা নিয়ে আয়! আর কিছু ছিলো আপনার সাথে?’

-‘না!’- কেবল এই একটা শব্দ উচ্চারিত হয় শুভেন্দুর কণ্ঠনালী বেয়ে। অথচ তার বলার কথা ছিলো ‘হৃদপিণ্ডটা লাফাতে লাফাতে কোনদিক ছুটলো, দেখুন না, পান কি না?’ ঘোলা চশমাটা চোখে লাগিয়ে নিয়ে প্রাণপণে সম্মুখবর্তিনীকে দেখার চেষ্টা করে শুভেন্দু। কিন্তু ঝড়ের অন্ধকার, বৃষ্টির জল আর ঘোলা চশমা- এই তিন দুষ্টে মিলে সেই আপ্রাণ চেষ্টাটার প্রায় পুরোটাই ব্যর্থ করে দেয়।

-‘আমগুলো ভাল করে কোঁচড়ে বেঁধে নে পুঁটি! ফেলে দিবি নাহয়! সাবধানে যাবেন, সামনে পিছল জায়গা। আসছি!’- বলে ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়েই উল্টো পথে রওনা করে সে, এতক্ষণে যাকে শুভেন্দু নাম দিয়েছে -‘বনদেবী’।

হারিয়ে যাওয়া অঙ্গখানা কোত্থেকে উড়ে এসে টুপ করে বুকের ভেতর বসে পরে। ধমকে বলে- ‘চলে যাচ্ছে যে! হতচ্ছাড়া! পরিচয় টুকু অন্তত নিয়ে রাখ!’

‘শুনুন! এরপরে চিনবো কী করে?’ – হৃদপিণ্ডের জোরাজুরিতে কণ্ঠ বড় ব্যগ্র হয়।

-‘তার কীসের প্রয়োজন?’- বনদেবীর কণ্ঠে আবছা কৌতুকের সুর।

-‘আছে! সে দেখা হলেই বলব!’

-‘বেশ তো! প্রয়োজন যদি সত্যিই থাকে তো আপনা-আপনিই চিনে নেবেন নাহয়!’- আবছা কৌতুকখানা এবারে স্পষ্ট হয়। বেঈমান চশমাটাকে আছড়ে ফেলার তীব্র ইচ্ছাটাকে দমন করে চোখ কুঁচকে তার অবয়বখানা মস্তিষ্কে গেঁথে নেবার শেষ চেষ্টাটুকু করে শুভেন্দু।

‘Mother sick, come home’- চার শব্দের টেলিগ্রামটা পেয়েই মাতৃভক্ত শুভেন্দু যখন তড়িঘড়ি ব্যাগপত্তর গোছাতে বসে গেলো, হোস্টেলের বাকি ছেলেরা তখনই পইপই করে বলে দিল- এসবই নাকি বিয়ে দেবার বাহানা।

উপেন আমসত্ত্ব চিবুতে চিবুতে বললো- ‘আহা! এবারে শুভটার ও ডাক এলো রে! আরে এসব ‘মাদার সিক, ফাদার সিক’ হচ্ছে ধরে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দেবার বাহানা। গেল মাসেই থার্ড ইয়ারের সুমন্তকে এইভাবে বাড়িতে ডেকে নিয়ে শ্রীমতী পুতুল ভটচায্যি কে গলায় ঝুলিয়ে দিলো, মনে নেই?’

সুনন্দটাও সাথে তাল মেলালো- ‘আরে! গেলো সপ্তায় ই তো মাসীমা চিঠি দিলেন, এর মধ্যে এতবড় অসুখ হয় বুঝি? উত্তর করে দে, পরীক্ষাটা শেষ হলে আসবি।’

কিন্তু শুভেন্দুর মাতৃভক্ত প্রাণখানা এসব স্তোতবাক্যে শান্তি পায়নি, পরদিন ভোরে ভোরেই দু’খানা জামা গুছিয়ে নিয়ে রেলগাড়িতে চেপে বসেছে। আসবার সময়েও নিচতলার জয়ন্তদা নাকে টেনে হেসে হেসে বলেছিলো- ‘যাযা, সুমন্ত ভেড়াটার মতন একখানা শ্রীমতী গলায় বেঁধে নিয়ে আসবি, বলে দিলুম!’

শুভেন্দু গম্ভীর গলায় জবাব করেছিলো- ‘সেরকম কিছু যদি দেখি জয়ন্তদা, তো বলে দিলাম জলস্পর্শ না করেই গৃহত্যাগ করবো।’

-‘ও বাবা! একেবারে ধনুর্ভাঙা পণ?’

-‘বলতে পারো তাই ই। আসছি জয়ন্তদা।’

নন্দী ঠাকুমা বাড় বাড়িতে এসেছিলেন তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালতে। ঠিক সেসময় তাঁর আদরের গোপাল কাদাপানি মাখা ভূতের রুপ নিয়ে উঠানে এসে দাঁড়ালো- ‘ঠাম্মা!’

-‘ওরে সুবু দেখে যা কে এসেচে! ও গোপালঠাকুর, তোর চেহারার এই হাল কেন? ও সুবু দৌড়ে আয়, ছেলে যে ঝড়ের মুকে পরে ভিজে একেবারে এইটুকুনি হয়ে এসেচে রে!’- ঠাকুমার হাঁকডাকে কেবল সুবালা নয়, বাড়িসুদ্ধু সকলেই দৌড়ে আসে। সুবালার হম্বিতম্বি দেখে ছেলে আশ্বস্ত হয়, হোস্টেলের ছেলেদের কথাই ঠিক বটে!

সুবালা তাঁর ছেলের মতি জানেন। মায়ের অসুস্থতার খবরে ছেলে সব ফেলে দৌড়ে আসবে এ যেমন সত্য, তেমনি এইভাবে মিথ্যে খবর দিয়ে ডেকে আনা হয়েছে জানবার পর হয়ত আর দু’দণ্ডও বাড়িতে দাঁড়াবেনা। তাই শুরু থেকেই শুভকে এভাবে ডেকে আনাবার বিরুদ্ধে ছিলেন, তার ওপর সামনেই ছেলেটার নাকি পরীক্ষা! কিন্তু, শাশুড়ি সেসব বুঝলে তো! তিনি নাকি টের পেয়েছেন, দিন ঘনিয়ে আসছে তাঁর। তাই অগস্ত্য যাত্রার আগে নাতবউকে এ বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত করে যেতে চান। সে উদ্দেশ্যেই এত আয়োজন আর তার জেরেই শুভেন্দুর এমন দ্বিমুখী সর্বনাশ!

রাতে খাবার সময় নাতিকে হাতপাখায় বাতাস করতে করতে নন্দী ঠাকুমা কথা তুললেন। সুবালা কেবল ভয়ে ভয়ে ছেলের মুখপানে চেয়ে ছিলেন, এই বুঝি সব ফেলে টেলে উঠে যায় ছেলেটা। আহা, খাবার পরেই নাহয় কথাখানা তোলা হতো! পাত ফেলে যদি উঠে যায় ছেলে, মায়ের মুখে কি আর অন্ন রুচবে?

-‘কীরে গোপাল? কাল তবে যেয়ে কথাটা পাকা করে আসি? কথা তো প্রায় পাকা ই বলতে গেলে, বকুল সইকে তো তোর ছেলেবেলাতেই কথা দিয়ে রেকেচিলেম আমি, চারুকে তোর বউ করব। এবারে শুধু তোদের দু’জনার দেকাশোনাটা, তারপর তোর ঐ পরীক্কা না ছাই ওটা শেষ হলেই নাহয় বাকি কাজকর্ম…

চাটুয্যেদের বাগানে যে সর্বনাশের শুরু হলো, তার শেষ দেখে তবে ফিরবে পণ করেই আজ ভোরের সেই ধনুর্ভাঙা পণ আপাত স্থগিত করেছে শুভেন্দু। মনে মনে একখানা ছক ও কষে রেখেছে, সেইমত এগোতে হলে সবার আগে ঠাম্মার সেই চারুলতাটিকে দরকার। ভাত গিলতে গিলতে তাই কেবল দুটো শব্দ উচ্চারণ করে সে- ‘আচ্ছা, বেশ!’

সুবালা চোখ ছানাবড়া করে দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলের এই রূপ তো তার একেবারেই অজানা ছিলো এতকাল!

নন্দী গিন্নি কেবল মিটমিটিয়ে হাসছেন। ‘কী বলেচিলুম সুবু? ছেলের যে বয়স হয়েচে, রাজি হবেনে কেন?’

শুভেন্দুর মনে একটা ক্ষীণ দুরাশা ছিলো, ঠাম্মার সেই চারুলতাই সেদিনের সেই বনদেবী নয়তো? গণিতে হাত পাকানো শুভেন্দু জানে এমনটি ঘটবার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি, তবে শূন্য তো আর নয়! আর যদি সম্ভাব্যতার স্বাভাবিক সূত্রমতে চারুলতা অন্য কেউ হয়, তবে তাকেই ধরতে হবে সাহায্যের জন্যে। শুভেন্দুরা দুই ভাই, কোনো বোন-টোন নেই। এমনকি পাড়ার মেয়েদের সাথেও তেমন করে মেশেনি কখনও সে। ছেলেবেলা থেকেই লাজুক স্বভাবের শুভেন্দুর পক্ষে তো এবারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাকে খুঁজে বেড়ানো সম্ভব নয়! নিরুপায়ের শেষ উপায় তাই চারুলতা, ঠাম্মার সইয়ের নাতনি- সেই সুবাদে লতায় পাতায় একরকমের আত্নীয়াই বলা চলে। হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করলে তার মনে কি একটু দয়া হবেনা? সে নিশ্চয়ই বলতে পারবে সেই বনদেবীর পরিচয়! নেই নেই করেও বেশ অনেকখানি তথ্য জানে সে, মেয়েটার সাথে পুঁটি বলে কেউ ছিলো, ঝড়ের মধ্যে আম কুড়োতে গিয়েছিল ওরা। ঠাম্মাকে অবশ্য ছলে বলে জিজ্ঞেস করেছিলো, পুঁটি বলে কোনো ছোট মেয়েকে চেনেন কিনা। সদুত্তর মেলেনি, এ নামে গ্রামে কেউ নেই বলে জানিয়েছেন।

-‘চারুলতা, আমায় ভুল বুঝবেন না। এই বিয়েটা আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়!’

ঘোমটা পরা মেয়েটা চোখ তুলে তাকায়। বারোয়ারি বাড়ির তেতলার ছাদটার এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে দু’জনে। বড়রা নিচতলার বাগান মত জায়গাটায় বসে হাসিঠাট্টায় মগ্ন, পাত্র-পাত্রীকে নিভৃতে ছেড়ে দিয়ে। মেয়েটাকে একনজর দেখেই আশাভঙ্গ হয়েছে শুভেন্দুর, এ সে নয়! টকটকে ফর্সা গায়ের রং, আদুরে গোল মুখখানা যেন আলো বিকিরণ করছে, হাঁটু অব্দি মেলে দেওয়া চুল- যে কোনো লোকে এক দেখাতেই একে পছন্দ করে নেবে। অন্য কোনো সময় হলে শুভেন্দুও তাই ই করতো, কিন্তু এখন যে সব উলটে পাল্টে গেছে!

-‘ছেলেবেলা থেকে যে রূপের এত প্রশংসা শুনে আসছি, সে সবই তবে মিছে?’- চারুলতা চোখে চোখ রাখে।

-‘না! না! সেরকম কিছু নয়! আমি একজনকে খুঁজছি। তাকে ছাড়া অন্য কারুকে…

-‘সেই ঝড়ের রাতে যাকে দেখেছিলেন তাকেই খুঁজছেন তো?’

চারুলতার প্রশ্ন শুনে থমকে যায় শুভেন্দু। এ মেয়ে জানলো কী করে!

-‘আপনি…!

-‘যদি বলি আমিই সে?’- চারুলতা রহস্য করে হাসে।

-‘না, না! আপনি সে নন! আপনি নন!’- শুভেন্দু মৃদু গলায় জবাব দেয়।

-‘কেন নই? আপনি তো ভাল করে দেখলেন ই না সেদিন! আজকে দেখুন, ঠিক চিনবেন।’

শুভেন্দু বারবার করে মেয়েটিকে দেখে। সত্যিই কি এ সে? কিন্তু, সন্ধ্যে শুরুর আলোয় যে আবছায়া মুর্তিকে সেদিন বনদেবী নাম দিয়েছিলো শুভেন্দু, এ তো সে নয়! কই, একে দেখে তো হৃদয় সেদিনের মত উদ্বেল হলোনা! সমস্ত বিশ্বচরাচর থমকে গেলো না!

না!না! এ সে নয়!

-‘আপনি নন! আপনি সে নন, আমি জানি। কিন্তু, আপনি কী করে সেদিনের কথা জানলেন? আপনি..’- কথা শেষ হয়না, তার আগেই শুভেন্দু বরফের মত জমে যায়। তার কি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? জলখাবারের থাল হাতে করে যে মেয়েটা সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে, সে কে? এইতো সে! নীলকণ্ঠী রঙের একখানা শাড়ি পরনে, হাতভর্তি চুড়ি, বেণী করা চুল, মুখে মিষ্টি হাসি- বনদেবী! শুভেন্দুর সেই বনদেবী!

একটানে চোখের চশমাটা খুলে হাতে নেয় শুভেন্দু। এইতো সেই! মস্তিষ্কে গেঁথে নেয়া সেই অবয়ব, সেই হাঁটার ধরণ… গলাটা কি একবার শুনে দেখবে না শুভেন্দু?

চারুলতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে সামনে দাঁড়ানো ছেলেটিকে। একফালি হাসির রেখা ঠোঁটে খেলা করে তার, মুহুর্তেই আবার মিলিয়ে যায়।

-‘কথা শেষ করলেন না যে?’

মেয়েটি ততক্ষণে একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

-‘দিদি! তোদের জলখাবারটা এখানে রেখে গেলাম, খেয়ে নিস। ওঁকেও দিস!’

না! আর সন্দেহ নেই! এই ই সেই!

চারুলতার কথা শুভেন্দুর কানে ঢোকেনি, তড়িঘড়ি করে চশমাটা পরে নিয়েছে ততক্ষণে। একদৃষ্টে চেয়ে আছে মেয়েটার দিকে, মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ এলোমেলো করে মিলিয়ে দেখছে- এই কি সে? জবাব আসছে- ‘হ্যাঁ! হ্যাঁ! হ্যাঁ!’ বুকের ভেতরে হৃদপিণ্ডটা ছটফট করছে, বোধহয় আবার ‘দূর ছাই!’ বলে বেরিয়ে আসতে চায় সে!

-‘ইনি কে?’- মেয়েটি চলে যেতেই চারুলতাকে প্রশ্ন করে শুভেন্দু।

-‘আমার ছোট বোন, আশালতা!’

-‘আশালতা!’- নামটা উচ্চারণ করে শুভেন্দু। তারপর এই নামটা ধুকপুক ধুকপুক করে তার প্রতিটা হৃদস্পন্দনের সাথে বাজতে থাকে- ‘আশালতা! আশালতা! আশালতা!’

-‘ওরে সুবু! এ কী দুম্মতি হলো রে তোর ছেলের! বারবার বলেচিলুম বুকের মানিকটাকে শহরে পাঠাস নি, পাঠাস নি! কেউ শোনেনি এই বুড়ির কতা। শেষকালে কীনা আশাকে বে করতে চাচ্চে! দু’দিনের মেয়ে… ওরে গোপাল, ঠিক সময়ে বে করলে ঐ আশার সমান মেয়ে থাকতো তোর ঘরে! হাঁটুর বয়সী মেয়ের সাথে বে! অ্যাঁ! ঘোর কলি কি এমনি এমনিই বলে?”- নন্দী গিন্নি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বিলাপ করছেন। একের পর এক চমকে সুবালা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সুবালার স্বামী নিত্যানন্দ হতভম্ব মুখে একবার বউয়ের মুখে পানি ঢালছেন, আরেকবার দৌড়ে গিয়ে মা’কে যেয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

মেয়ের বাড়ির লোকেদের ওপর যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়েছে। ‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ! ঘোর কলিকাল নাহলে এমন হয়!’- বলে মেয়ের পিসিমনি ঠাকুর ঘরে যেয়ে খিল দিয়েছেন। বিধবা পিসির পক্ষে এই অনাচার আর দেখা সম্ভব নয়। চারুলতার পিতা সৌমেন বজ্রাহতের মত বসে আছেন।

-‘সইয়ের নাতির কাচে নাতনি দেবো বলেচিলুম, তাই বলে সে আমাদের পুঁটিকে চেয়ে বসলো! হায় কৃষ্ণ, এ তোমার কেমন খেলা গো!’- চারুর ঠাম্মার দীর্ঘশ্বাসে চমকে ওঠে শুভেন্দু।

পুঁটি! পুঁটি তো সেদিনের সেই বাচ্চা মেয়েটার নাম! সে তো বিয়ে করতে চেয়েছে আশালতাকে! এরা কি তবে ভুল ভাবছে?

সুবালার ততক্ষণে জ্ঞান ফিরেছে। মায়ের কানে কানে শুভেন্দু বলে-

-‘মা! তোমরা ভুল ভাবছো। আমি তো আশালতার কথা বলেছি, পুঁটি নয়!’

-‘ওরে হতচ্ছাড়া! সেই তো সে! চারুকে ফেলে ঐ ছ’ বছরের বাচ্চাটাকে কীনা তোর মনে ধরলো! ছিঃছিঃছিঃ! লজ্জায় মরে যাই!’

-‘কী যা তা বলছো মা! আশালতা ছ’ বছরের কেনো হতে যাবে! দিব্যি শাড়ি পরে জলখাবার নিয়ে এলো…’

-‘দিদির বিয়ে বলে শখ করে শাড়ি পরেছে বাচ্চা মেয়েটা, তাকেই তোর চোখে লাগলো? হতভাগা ছেলে, শহরে যেয়ে এই শিখেছিস?’

-‘বিশ্বাস করো মা! আশালতা মোটেও ছ’ বছরের নয়! আমি দেখেছি ওকে। তুমি ওঁদের বলোনা ওকে ডাকতে!’

-‘নিলাজ, বেহায়া ছেলে! তুই বলগে যা। নাতনির বয়েসী মেয়েকে কীনা ছেলের বউ করতে ডাকতে হবে, এই ছিল অদেষ্টে আমার!’

ঠিক এমন সময়ে প্রজাপতির মত নাচতে নাচতে পাঁচ-ছ’ বছরের একটি মেয়ে অকুস্থলে এসে ঢোকে। এক প্যাঁচে শাড়ি পরেছে, দু’পাশে কলাবেণী করে চুলগুলো ঝোলানো। উৎসবের বাড়িটাতে রণক্ষেত্রের থমথমে অবস্থা দেখে খানিক ভড়কে যায় মেয়েটা, তারপর মায়ের কাছে দৌড়ে যেয়ে বলে- ‘মা! আমায় ডাকছিলে?’

-‘হতভাগা! এই নে তোর আশালতা! নে এবারে একে কোলে নিয়ে ছাদনাতলায় গিয়ে দাঁড়াগে যা!’

মায়ের কথা শুনে বিষম খায় শুভেন্দু। একে তো সেদিনের সেই পুঁটি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু, ছাদে যাকে দেখলো সে তবে কে? কী বিপদ! এবারে এদেরকে কী করে কী বোঝাবে! নিজেরই তো সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

-‘হতচ্ছাড়ি! এখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখবি? চল, বেরো এবার!’- মাধবীলতা মৃদুস্বরে বোনকে বকে। এই বকুনি চারুলতার কানে ঢুকলে তো? সে ততক্ষণে হেসে কুটিকুটি হয়ে বিছানায় গড়িয়ে পরেছে।

তেতলার ছাদ থেকে ভ্যাবলাকান্তটাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই চিনেছিলো সে। আর তারপরেই নিজের বদলে বড়দিকে চারু সাজিয়ে ভ্যাবলাটার কাছে পাঠিয়েছিলো। মাধবীলতা, চারুলতা আর আশালতা- ওরা তিন বোন। আশাকেই আদর করে সে মাঝে মাঝে পুঁটি বলে ডাকে।

-‘আর হাসিস নে হতভাগী! ছোঁড়াটা হন্যে হয়ে খুঁজে মরছে, আর মেয়ের হাসির বহর দেখো! জানিস? সে বিশ্বাস ই করেনি যে আমিই সে? কত করে বললুম- সেদিন আমিই তো ছিলাম, ভাল করে দেখুন না! সে ছেলে মানলোই না! কেবল বলে ‘আপনি সে নন। আপনি সে নন!’ যা, যা! আর হাসিস নে বড়। এই বেলা না গেলে তোর জামাইবাবুকে ছেড়ে আমিই এঁকে বে করে নিবো বলে দিলুম! বাব্বা, শাখা-সিঁদুর লুকিয়ে কী নাটকটাই না করতে হলো তোর জন্যে!’- বোনকে টেনে দাঁড় করায় মাধবীলতা। হাসির দমকে চারুর শাড়ির কুচি এলোমেলো হয়ে পরেছে, টেনেটুনে সেগুলো ঠিকঠাক করে, মাথায় আঁচল তুলে দিয়ে বোনকে নিয়ে বারঘরে বেরোয়।

ওদের ঢুকতে দেখে সটান দাঁড়িয়ে যায় শুভেন্দু। তারপর ঝট করে আবার বসে পরে, ঠাম্মা’র কানে ফিসফিসিয়ে বলে-

-‘ঐ তো আশালতা! চারুলতার সাথে আসছে!’

-‘হতভাগা! ওর সাথেই তোর বে ঠিক হয়েচে! যে সঙ্গে করে নিয়ে আসচে সে মাধবীলতা, সবার বড় মেয়ে!’

এতক্ষণে অঙ্ক মেলে শুভেন্দুর। বনদেবী তবে এইভাবে পরিহাস করলেন! বাদবাকি সবাইকে বুঝিয়ে বলবার দায়িত্বটা মাধবী নিজের কাঁধে নেয়। হাজার হোক, এ নাটকের ভূমিকা দৃশ্য তো তারই অভিনীত! শেষ দৃশ্যটা মিলিয়ে দেবার দায়িত্ব তার ঘাড়েও বর্তায় বৈকি!

ছ’ মাস পরঃ

-‘ভেবেছিলে চিনব না তোমায়? এত সোজা?’- সাত পাকে ঘুরতে ঘুরতে প্রশ্ন করে শুভেন্দু।

-‘কচু চিনেছেন! আরেকটু হলে তো ছ’ বছুরে পুঁটিকে কোলে করে সাত পাক ঘুরতে হতো!’

-‘চাও তো তোমাকেও কোলে তুলে সাত পাক দিতে পারি। শুধু শুধু পুঁটিকে হিংসে করছো কেন? বলো, তাই করবো?’

-‘ছিঃ! কী অসভ্যের মত কথা!’- ঘোমটার নিচে মাথাটাকে নামিয়ে একেবারে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলে চারুলতা।

শুভেন্দু হো হো করে হাসে।

(সমাপ্ত)

বিঃদ্রঃ এই লেখাটি রবীন্দ্রনাথের ‘সমাপ্তি’ ছোটগল্প হতে অনুপ্রাণিত। আমি বিশ্বাস করি, এই একজন লোক তাঁর এক জীবনে এত কথা লিখে রেখে গেছেন যে দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তে যে-কোন বাংগালি যা-ই কিছু লেখুক না কেনো তাতে রবীন্দ্রনাথের কোনো না কোনো রচনার ছাপ পাওয়া যাবে। ‘যদি আরও কারে ভালবাসো, যদি আর ফিরে নাহি আসো। তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও…’- শুধু এই তিনটি বাক্য ঘিরে একটা ত্রিভুজ প্রেমের গল্প লিখে ফেলা সম্ভব!

তারমধ্যে, এই গল্পটা সেই শান্তিনিকেতনী সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা এবং বাস্তবিকই ‘সমাপ্তি’ হতে অনুপ্রানিত। তাই ‘রবীন্দ্রনাথকে কপি করেছেন’ বাক্যটি শুনবো- এই ভয়টুকু মাথায় নিয়েই এই লেখাটা লিখলাম। সচেতন পাঠকমাত্রই ‘কপি করে লেখা’ আর ‘অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা’র ফারাক ধরতে পারবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। সেই বিশ্বাসই আমার এই লেখাটুকু লেখার সাহস।

#_ছোটগল্প

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here