বেটারহাফ পর্ব ১৪+১৫

#বেটারহাফ
#নিশাত_তাসনিম_নিশি

| পর্ব ১৪ |

মেয়েটা ভীষন অভিমানী! সে কোনো ভুল করলেই অভিমান করে মুখ টা ফুলিয়ে রাখতো। বেশিরভাগ সময় তার অভিমান হলে সে কথা বলা বন্ধ করে দিতো। বেশ খানেক সময় কথা বলতো না যতক্ষণ না তার রাগ ভাঙ্গবে। অবশ্য তার রাগ কেউ ভাঙ্গাতো না, সে নিজেই নিজেকে বুঝ দিয়ে নিজের রাগ ভাঙ্গাতো। বেশি রাগ উঠে গেলে সে নিজেকে কষ্ট দেওয়া শুরু করতো, সুইসাইড করার চেষ্টা করতো। যার জন্য সাগর অনেক বেশি কেয়ারফুল তার জন্য।

সাগর কথা বলার সময় বৃষ্টি অনেকটা ঘোরের মধ্যে ছিলো। তার মনে পড়ে গেলো সেদিন সে কতটা ই না খারাপ ব্যবহার করেছিলো রাত্রির সাথে। ঘরবর্তী মানুষের সামনে অপমান করেছিলো সে, উঠতে বসতে কটু কথা শুনাতো সে। রাত্রি চুপ করে নিজের কাজ করতো। তার ভেতর খারাপ লাগা শুরু করলো। নিজের মধ্যে অপরাধী টাইপ ফিলিংস কাজ করতে লাগলো।

গভীর ভাবনায় ডুবে সে নিজে নিজে বলে উঠে,–“আমি আমার প্রথম সন্তান রাত্রি আপুকে দিয়ে দিবো।”

সাগর দৃষ্টি ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকায়। সাগরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কারণে তার ধ্যান ভেঙ্গে যায়। সে চমকে উঠে, কী বলে ফেলেছে সে?

সে আমতা আমতা করে বলে,–“না, মানে আমি বলতে চাইছিলাম আর কি…. ”

সাগর কোনো রিয়েক্ট করলো না।
সে বৃষ্টিকে বলে,—” তুমি বলেছো আমি যেনো তোমার সাথেও স্ত্রীর মতো ব্যবহার করি, আমি করতেছি। আমি সাধারন স্বামী-স্ত্রীর মতো ব্যবহার করছি তোমার সাথে কিন্তু বিশ্বাস করো ভেতর থেকে আমি একটুও স্বাভাবিক নয়। দয়া করে, আমার এমন সাধারন ব্যবহার টা কে তুমি অন্য কিছু ভেবো না। আজ হোক কাল হোক তোমাকে বাচ্চা নিতেই হবে, না হলে হয়তো মা আমার আবারো বিয়ে দিবেন বাচ্চার জন্য। তাই আমি সম্পর্ক টা স্বাভাবিক করার জন্য স্বাভাবিক হচ্ছি তোমার সাথে। বুঝতে পারছো?”

বৃষ্টি মাথা নাড়ায়, সে বলতে চাইছে যে সে বুঝতে পেরেছে। তার ভেতর টা আবার কেঁপে উঠেছে তবে এবার তার নিজের জন্য। নিজের প্রতি নিজের মায়া আসছে। সে কী?আসলেই কী তার কোনো মূল্য আছে?

কাঁপা ঠোঁটে, ঝাঁঝালো গলায় সে বলে,
—” এটা কেমন কথা, বাচ্চা নাহলে আপনি আবারো বিয়ে করবেন? আপনি কি আসলেও মানুষ? আমাদের দুটো মেয়ের জীবন নষ্ট করে ফেলেছেন আপনি, আরো মেয়ের জীবন নষ্ট করতে চান? আপনাদের কাছে কি মেয়ে মানে কী বাচ্চা জন্ম দেওয়ার মেশিন? আপনার প্রতি আমার যা অনুভূতি ছিলো তা এখন ঘৃণায় পরিণত হয়েছে। ছিঃ, আপনি তো কাপুরুষ। আপনার এ পৃথিবীতে বাঁচার কোনো অধিকার নেই।”

সাগরের রাগ উঠে গেলো, বার কয়েক সে বৃষ্টির কথাগুলো আওড়াতে লাগলো। তার জীবনে আছে কি? সবার কথা শুনছে সে তবুও কারো কাছেই ভালো নয়। এখন তার মনে হচ্ছে সে কেনো মেঝো ভাইয়ের মতো হলো না, বাহিরে কতগুলো অবৈধ রিলেশন করেও বউয়ের কাছে ভালো। বউকে খুশি করার জন্য পরিবারকে কাজের অজুহাত দিয়ে শহরে বাসা বাড়া নিয়ে থাকছে। কারো কথা না শুনে, নিজের মতো চলছে সবার কাছেই তো ভালো।

এজন্য পুরুষ মানুষের কখনো নারীর কথা শুনতে নেই। কারন শুনলেও সে সেই নারীর কাছেও ভালো থাকবে না বাকিরা তো বাদই। নিজের মতো চলা উচিত,নিজের বিবেক বুদ্ধি খরচ করে বাস করা উচিত।

আচমকা তার ভেতরের রাগ টা গলে গেলো, বৃষ্টি কি বলেছে, তার প্রতি বৃষ্টির ঘৃণা হচ্ছে?
তাহলে তো সেটা তার জন্য প্লাস পয়েন্ট। বৃষ্টিকে এখন থেকে তার প্রতি ঘৃণা করতে দিবে,কখনোই তার এ ফিলিংস নষ্ট করতে দিবে না। সে এখন থেকে তার কাছে খারাপ ই হবে।

সে অতিরক্ত রাগী সুর করে বলে,

—“হ্যা,আমি কাপুরুষ। আমি বাচ্চার জন্য বারবার বিয়ে করবো। এবার খুশি?”

বৃষ্টির মুখে এবার স্পষ্ট ঘৃণার রেশ ফুটে উঠলো। চোখমুখ স্পষ্ট বলে দিচ্ছে, যে এত ঘৃণা তার অন্য কারো প্রতি আর কখনোই হয় নি। তা দেখে সাগরের ভেতর টা শীতল হয়ে উঠলো। সে যা চাইছে সেটাই হচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে এখন আর তাকে পাওয়ার আশা দেখছে না সে।
আরো খারাপ ব্যবহার করলে হয়তো বৃষ্টি কখনো তার মতো মানুষকে চাইবে না।

সে না চাইতেও ইচ্ছা করে বৃষ্টির কাছে গেলো, আর বললো,–” এবার তো তুমি সব জানো। আশা করি এখন আর কোনো বাঁধা আসবে না, আমরা হ্যাপিলি সম্পর্ক টা এগুতে পারি। আমি কেমন পুরুষ সেটা এখনই যেনে যাবে তুমি।”

বৃষ্টি প্রচন্ড ঘৃণা নিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো। সাগর মনে মনে হাসলো,একদিন আগেও মেয়েটা ওকে কাছে পেতে চাইছিলো আর আজ? সাগর না চাইতেও বৃষ্টিকে বাজেভাবে স্পর্শ করলো, ওর হাত কাঁপছে। আর বৃষ্টি ছটফট করছে সরে যাওয়ার জন্য। সে আরো বাজেভাবে স্পর্শ করতে নিচ্ছিলো তখন দেখে বৃষ্টি কেঁদে দিয়েছে। সে সরে গেলো, বৃষ্টি অন্যপাশ হয়ে কাঁদছে। সাগর ভেতর থেকে প্রচন্ড কাঁপছে, তবুও শক্ত কন্ঠে বলে,–“আজ ছেড়ে দিলাম, নেক্সট টাইম কখনোই এমন হবে না।”

কথাটা কোনোরকম বলে সে ওয়াশরুমের দিকে ছুট দিলো। কল টা ছেড়ে বার কয়েক মুখে পানি দিতে লাগলো। ভেসিনের সামনের আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে চোখ পড়লো তার। নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো সে। এ জীবনে আরো কত কী করতে হবে তাকে কে জানে?

বৃষ্টি নিরবে শব্দহীন ভাবে কাঁদছে। চোখ দিয়ে মুক্তোর দানার মতো জল গড়িয়ে পড়ছে। শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে, সাগরকে নিজের করার যে ইচ্ছা টা হয়েছিলো আজ সেটা মন-মষ্তিষ্ক থেকে একদম চলে গেলো। সে কখনোই সাগরকে ভালোবাসবে না। সাগর একটা চরম বেয়াদপ ছেলে। ওর মতো ছেলেকে সে আর কখনোই জীবনে চাইবে না। কাঁদতে কাঁদতে বিরবির করে বলে উঠে,–“বেয়াদপ। সাগর বেয়াদপ ছেলে।খুব খারাপ সে। অতি মাত্রায় খারাপ।”

সাগর শব্দ করে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। বৃষ্টি সাথে সাথে নিজেকে কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে পড়লো। ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদার ফলে যে হেঁচকি উঠছিলো বৃষ্টির সেটা সাগরের কানে স্পষ্ট আসছে। সাগর হালকা হেসে ওর পাশে শুয়ে পড়লো। বৃষ্টির রাগ টাকে আরেকটু বাড়াতে ওকে কম্বল সহ জড়িয়ে ধরলো, বৃষ্টির ভেতর টা রাগে ফেটে পড়লো। সে ধস্তাধস্তি করলো ছাড়া পাওয়ার জন্য। কিন্তু সাগর ছাড়ে নি, তাই সে হার মেনে হাল ছেড়ে দিলো। সাগর যখন টের পেলো বৃষ্টি ঘুমিয়ে পড়েছে তখন সে ধীরে ওকে ছেড়ে দিয়ে সরে গেলো। সোজা ব্যালকনি তে চলে গেলো, পকেট থেকে সিগারেট টা বের করলো, প্রতিদিনের তুলনায় আজ হয়তো টান টা বেশিই হয়ে যাবে।

★★

সিলেটে সাত দিন কাটিয়ে, বাড়ী ফেরার উদ্দেশ্য রওনা দিলো সাগর আর বৃষ্টির। ওদের ট্রিপ স্বাভাবিক না হলেও অস্বাভাবিক ও ছিলো না। মোটামুটি ভালো ছিলো ট্রিপটা। সাগরের মন-মষ্তিষ্কে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক আর শান্ত হয়েছিলো। কারণ বৃষ্টি এখন নিজ থেকেই ওর থেকে দূরত্ব বজায় চলছে। যাক বৃষ্টিকে নিয়ে আপাতত ওর টেনশন নেই,টেনশন হচ্ছে রাত্রিকে নিয়ে। না জানি ওই মেয়ে উল্টা-পাল্টা কিছু করে বসেছে নাকি? মায়ের থেকে তো সে প্রতিটা সময়ের আপডেট নিয়েছে মা বলেছে রাত্রি নাকি ঠিক আছে। তবুও মায়ের কথাবার্তা শুনে সে আন্দাজ করলো মা তার থেকে কিছু লুকাচ্ছে। যাই হোক, রাত্রি ঠিক থাকলেই চলবে। মেয়েটার হাসিমুখ ছিনিয়ে নেওয়ার একমাত্র কারণ ই যে সে।

আর ওদিকে রাত্রি নিজেকে একদম গুছিয়ে নিয়েছে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত স্কুলে থাকে, সন্ধ্যায় কিছু বাচ্চাকে টিউশনি করায়। সে টিউশনি টা করাতে চাইছিলো না, কিন্তু কিছু বাচ্চার বাবা-মার জন্য পারে নি। তারা এমনভাবে রাত্রিকে জোর করছিলো যে সে না করতে পারে নি। স্কুলের প্রতিটা ক্লাসে রাত্রির নাম শুনলে বাচ্চাদের হই হই লেগে যায়। সব বাচ্চা রাত্রি বলতে পাগল। এ নিয়ে অফিস কক্ষে বেশ কানাঘুষো চলছে, সাতদিনে কেউ কীভাবে এত প্রিয় হতে পারে বাচ্চাদের কাছে?

রাত্রি বাচ্চাদের এমনভাবে পড়ায় যেনো সবাই তার নিজের বাচ্চা। সবগুলো বাচ্চাকে দেখলে তার ভেতর টা কেমন করে উঠে, ভেতর টা অস্থির হয়ে উঠে। ইচ্ছা করে সবগুলো বাচ্চাকে নিয়ে চলে যেতে। তার সবচেয়ে প্রিয় হলো শিশু ক্লাসের বাচ্চাগুলো।

সে শুধু ভাবে সবগুলো বাচ্চা এত কিউট কেনো? হোয়াই? পড়ানোর সময় সে সবসময় একটা না একটা না বাচ্চাকে কোলে নিবেই। সবগুলো বাচ্চা এমন ভাবে ওর সাথে ব্যবহার করবে যেনো সে তাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। রাত্রি প্রায় প্রতিদিন পালা করে বাচ্চাগুলো থেকে একটা একটা চুমু খায় আর দেয়।

রাত্রির প্রতি হেডস্যার অনেক খুশি। তাদের স্কুলের সুনাম চারপাশ থেকে ভেসে আসছে। বাচ্চাদের প্রতিও সার এখন মুগ্ধ। এইতো কালকের ঘটনা,

অফ পিরিয়ডে সব স্যার রা অফিসে বসে ছিলো, তখন ক্লাস ফোরের স্টুডেন্ট ক্যাপ্টেন এসে বলে,–” স্যার আসতে পারি?”

–“হ্যা,আসো,আসো। আলেয়া( দপ্তরি) গিয়ে বলেছে তো যে তোমাদের পরের বিষয়ের স্যার আজ ক্লাস নিবে না। আসলে উনারী বাড়ী থেকে জরুরী তলব এসেছে তাই উনি চলে গিয়েছেন।”

বাচ্চাটি সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে বলে,–“জ্বি, স্যার। উনি বলেছেন।”

স্যার আদেশের সুরে বলেন,–” আচ্ছা,তাহলে এখন গিয়ে সবাই চুপচাপ বসে থাকো। কোনো আওয়াজ করো না। ঠিক আছে?”

–“স্যার বলছিলাম কি, ইকবাল স্যার তো ক্লাস নিবেন না। তাহলে উনার পরিবর্তে রাত্রি ম্যামকে না হয় পাঠিয়ে দিন আমাদের ক্লাস নেওয়ার জন্য। স্যার ক্লাসের সবাই এটাই চাইছে।”

হেডস্যার অবাক হয়ে গেলেন ওদের কথায়, মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছিলো না। যে বাচ্চারা ক্লাসের সার গেলেও তারা ক্লাস করতে চায় না। সবাই হইচই করতে থাকে, তারা নিজ থেকেই বলছে অন্য জনকে ক্লাস নেওয়ার জন্য! এটা কি স্বপ্ন? তার ভেতরটা খুশিতে টগবগ করে উঠলো। তিনি রাত্রির দিকে তাকাতেই, সে মাথা নাড়িয়ে উঠে গেলো। সব বাচ্চারা দরজার আড়ালেই ছিলো,সবাই হইহই করে চিল্লাতে লাগলো। অফিসের সব স্যার তো অবাক হয়ে ছিলেন। রাত্রি হাসিমুখে ছেলেটার মাথা ভর্তি চুলগুলে হাতিয়ে দিয়ে খুশিমনে ক্লাস করতে গেলো।

কাল ছুটির সময় স্যার তাকে বলে দিলেন আজ যেনে সে তাড়াতাড়ি যায়। আজকে স্কুলে নাকি স্কুল পরিদর্শক আসবে। তাই সকাল থেকেই রাত্রি তাড়াহুড়ো করে তৈরি হচ্ছে। সাগরের মা এসে তাকে তৈরি হতে দেখে বলে,–“আজ এত তাড়া কেনো? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি স্কুলে?”

রাত্রি শাড়ির আঁচলে সেইফটি পিন মারতে মারতে বললো,–“না মা। আজ পরিদর্শক আসবে, সব দেখতে। স্কুল কেমন চলছে?পরিবেশ কেমন,বাচ্চারা কেমন এসব দেখতে আর কি।”

সাগরের মা মাথা নেড়ে বলে,–“ওহ। আচ্ছা সাবধানে ক্লাস করাস, এরা খুব খারাপ হয়। কোনো ভুল দেখলেই চাকরী থেকে বের করে দিবে। ”

রাত্রি বলে, –“আচ্ছা মা।”

রাত্রি চলে যাচ্ছিলো, শাহিনুর বেগম আবারো বলে উঠে,–” আরে দাড়া। টিফিন নিবি না? ”

–“ওহ,সরি ভুলে গেছি।”

রাত্রি ফিরে এসে টিফিন টা ব্যাগে ভরতে লাগলো। তখনই শাহিনুর বেগম বলে উঠে,–“শুন, কাল ছুটি নিয়ে নিস, শিফাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো।”

রাত্রি আচ্ছা মা বলে বের হয়ে গেলো। শাহিনুর বেগম চেয়ে আছেন তার যাওয়ার দিকে। মেয়েটা এত ভালো কেনো? তিনি কত খারাপ বিহেভ করেছেন তার পরেও সে এতটা স্বাভাবিক ব্যবহার কীভাবে করে! বিশেষ করে উনার সাথে, যেনো তিনি তার সত্যিকার অর্থে মা।
#বেটারহাফ
#নিশাত_তাসনিম_নিশি
| পর্ব ১৫ |

শাহিনুর বেগম চেয়ে আছেন তার যাওয়ার দিকে। মেয়েটা এত ভালো কেনো? তিনি কত খারাপ বিহেভ করেছেন তার পরেও সে এতটা স্বাভাবিক ব্যবহার কীভাবে করে! বিশেষ করে উনার সাথে, যেনো তিনি তার সত্যিকার অর্থে মা। ইদানীং রাত্রির সাথে উনার ব্যবহার একদম স্বাভাবিক। আগে যেমন বিদ্বেষ কাজ করতো তার প্রতি এখন আর তেমন করে না। শিফাকে রাতদিন মানসিক-শারীরিক উভয় ভাবে সাহায্য করে সে। উনার মনে হয় রাত্রি পরিবর্তন হয়ে গেছে,অনেক পরিবর্তন। যার জন্য হয়তো তাকে পঁচতাতে হবে।

স্কুলে পৌঁছেই রাত্রি হাঁপাতে লাগলো।
দশটায় আসবেন পরিদর্শক। আর এখন বাজে নয় টা আট। সে দ্রুত যেতে লাগলো টিউবওয়েল এর দিকে। টিউবওয়েলের দুকদম দূরে থাকতেই তার সামনে ক্লাস ফাইভের দুজন বাচ্চা চলে আসে পানি নিয়ে। সে একটু হাসি দিয়ে পানি টা ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। বাচ্চা দুটোর মাথাভর্তি চুলগুলো আলতে হাতে স্পর্শ করে হাসিমুখে তাদের বিদায় দিয়ে অফিসের দিকে চলে গেলো।
আজ পুরো স্কুল একদম পরিষ্কার। কোথাও কোনো আবর্জনা নেই। রাত্রি হাঁটছে আর চারপাশ পরিক্ষা করছে। অফিসে গিয়ে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো সে। সে ছাড়া আরো চার জন মহিলা শিক্ষক রয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন ওর বয়সী, শিমলা আর চৈতী। বাকি দুজন একটু বয়স্ক, উনাদের বাচ্চা রা কলেজে পড়ে।
শিমলা ম্যাম বিবাহিত, উনার বিয়ের ছমাস চলছে। আর চৈতী, এখনও বিয়ে করে নি। হেডস্যার বাদে পুরুষ টিচার তিনজন। তিনজনের তিনজনই বিবাহিত। উনাদের বয়স চল্লিশের কৌটা পেরিয়ে গিয়েছে।
রাত্রি স্কুলে গেস্ট টিচার হিসেবে জয়েন করেছে, এখনও ও পার্মানেন্ট হয় নি। তাই সে সব টিচার কে অনেক সম্মান করে। টিচার রা প্রায় সবাই ওর প্রতি মুগ্ধ। তবে তার সফলতা দু-তিন জনের হিংসার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। তার দুটো কারণ।
এক. সব স্টুডেন্টের কাছে সে প্রিয় টিচার এবং প্রায় চারপাশে ওর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে।
দুই. টিউশনি। সব স্যার থেকে বাচ্চারা আস্তে আস্তে সরে ওর কাছে পড়তে চাইছে।
এজন্য কারো সফলতা শুনতে নেই। মনের মধ্যে আপনাআপনি ইর্ষা আর কূট বুদ্ধি চলে আসে।

সবাই আলাপ-আলোচনা করছিলো এমন সময় দরজায় টোকা নাড়ে অল্প বয়সী এক যুবক। ধবধবে সাদা গায়ের রং। বাদামী রং এর ঈগলের মতো চোখ দুটো। গায়ের কালো শার্ট টা যেনো তার শরীরের রং টা আরো ফুটিয়ে তুলেছে। হাতের কুৎসিত ব্ল্যাক ওয়াচ টার সৌন্দর্য ও ফুটে ওঠলো সাদা চামড়ার ফলে।
হাসলে হয়তো তার সৌন্দর্য আরো তিনগুন হবে, কিন্তু সে গম্ভীর মুখ করে দাড়িয়ে আছে। ফর্মাল গেট আপ, দেখে মনে হচ্ছে অফিসে যাচ্ছে না হয় অফিস থেকে আসছে।
রাত্রি ছাড়া সবাই তার দিকে তাকালো। প্রিন্সিপ্যাল বললেন,–“জ্বি, আসতে পারেন।”

সে ডুকেই হালকা কেশে উঠলো কারণ সবাই এখনো ওর দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে। কাশির শব্দে চৈতী আর শিমলা ম্যামের হুশ ফিরে আসলো। উনারা মাথা নিচু করে কাজ করতে লাগলেন।

প্রিন্সিপ্যাল সহজ ভাষায় বলেন,–” জ্বি, কীভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে?”

ছেলেটা বলে উঠে,–“আসলে আব্বু আমাকে,,”

বলেই থেমে যায় ছেলেটা। এরপর কথা টা ঘুরিয়ে বলে,—” আসলে এই স্কুলে আমি একজন স্টুডেন্ট এডমিট করাতে চাই।”

অতি চমৎকার কন্ঠ শুনে রাত্রি চোখ তুলে তাকায়। সে কাগজে সিগনেচার করছিলো কিন্তু এত মধুর কন্ঠ শুনে না তাকিয়ে থাকতে পারলো না। এতকাল শুনেছে মেয়েদের কন্ঠ কোকিলের মতো হয়, কিন্তু আজ প্রথম কোনো ছেলের কন্ঠ এতটা নেশা ধরানো লাগছিলো।
এক পলক তাকাতেই তার সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় ছেলেটার।রাত্রি চোখ নামিয়ে ফেলে।

প্রিন্সিপ্যাল বলে,—“জ্বি। কোন ক্লাসে ভর্তি করাবেন? বয়স কত বাচ্চার?”

–“সাড়ে চার বছর। শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করাবো।”

প্রিন্সিপ্যাল বলে এত ছোট বাচ্চাকে ভর্তি করাবেন না। পাঁচ বছর হলে নিয়ে আসতে। ছেলেটা বলে,–“তাহলে এখন এমনি কয়দিন যাওয়া আসা করুক।”
প্রিন্সিপ্যাল শায় দিলেন। তিনি বলেন কাল থেকেই যেনো দিয়ে যায়। ছেলেটা গম্ভীর গলায় বলে,–” স্যার আমি কি একবার ক্লাস গুলো দেখতে পারি?না মানে সবকিছু কেমন সেটা দেখতে আর কি। ”

তিনি মাথা দুলিয়ে অনুমতি দিয়ে বলেন,–“শিউর। আপনি বরং শিশু শ্রেণির ক্লাস টিচারের সাথে যান। উনি আপনাকে সব দেখিয়ে বুঝিয়ে দিবে। ”

কথা বলেই তিনি রাত্রিকে ইশারা করলেন। রাত্রিও ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি দিয়ে উঠে দাড়ালো। ছেলেটা আড় চোখে ওর দিকে একবার তাকালো, তারপর চুপচাপ ওর সাথে বের হয়ে গেলো।
রাত্রি আগে আগে হাঁটছে আর ছেলেটা পিঁছন পিঁছন। রাত্রি দূর থেকেই ক্লাস টা দেখিয়ে বললো,–“ওটা শিশু ক্লাস!”
ছেলেটা তাকায় বামদিকে। দুজনে সমান তালে হেটে যাচ্ছিলো। রাত্রি রুমে ডুকতে নিচ্ছিলো তখন ছোট বাচ্চা তানহা এগিয়ে এসে রাত্রির শাড়ী ধরে দাড়ায়। দুজনেই তাকায় ওর দিকে। রাত্রি কিছু টা ঝুঁকে বলে,–“কী হয়েছে,তানহা?কিছু লাগবে আম্মু?”
তানহা মাথা নাড়ায়। রাত্রি ওকে কোলে তুলে বলে,–“কী লাগবে তানহা বাবুর?”
তানহা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,–“আমি হিসু করবো। ও আমাকে নিয়ে যাচ্ছে না।”
রাত্রি সিরিয়াস হয়ে গেলো। এখানের কিছু বাচ্চা এখনো অনেক অবুঝ, তারা পানিটুকুও খেতে পারে না, ধরে খাইয়ে দেওয়া লাগে।
রাত্রি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলে,–” এটা শিশু ক্লাস। আপনি দেখুন, আমি একটু ওকে নিয়ে আসছি।”
কথা টা বলে কোনো কিছু শুনার অপেক্ষা না করে রাত্রি তানহাকে কোলে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে লাগলো।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই রাত্রি ফিরে আসে তানহাকে নিয়ে। এসেই ছেলেটাকে বলে,–“সরি, আসলে ওরা এখনো অনেক কিছুই জানে না। কিছু কিছু বাচ্চা মেন্টালি একটু উইক। ”
ছেলেটা কিছু বললো না,গম্ভীর মুখেই দাড়িয়ে রইলো। রাত্রির মনে হলো উনি হয়তো রাগ করেছেন,তাই সে আবারো মিস্টার বলে সম্বোধন করছিলো তখন ছেলেটা গম্ভীর কন্ঠে বলে,–” শাওন। শাওন আমার নাম।”
রাত্রি হালকা হেসে বলে,–“জ্বি। মিস্টার শাওন আপনি এখন সব দেখতে পারেন। এই যে ওরা সবাই নিচের মাদুরে বসে আর আমি,,, ”
পুরো কথা শেষ করার আগেই শাওন বলে,–“আপনি ওই চেয়ারে বসেন।”
রাত্রি কিছু বলতে নিচ্ছিলো তার আগে বাচ্চারা হই হই করে বলে,–“না, না, আম্মু আমাদের সাথে বসে। প্রতিদিন আমাদের কোলে নিয়ে পড়ায়!”
শিশু ক্লাসের সবাই রাত্রিকে আম্মু ডাকে। আর রাত্রি নিজেই ওদের ডাকতে বলেছে।
বাচ্চাদের কথা শুনে ওরা দুজনেই কথা বন্ধ করে ওদের দিকে তাকায়।
শাওন ভ্রু কুচকে বলে,–“ওরা সবাই আম্মু ডাকছে কেনো?”
বাচ্চা রা বলে,–“কারণ উনি আমাদের আম্মু।”

রাত্রি আর কিছু বললো না। শাওন ঘুরাঘুরি করে সব দেখলো,দু একটা বাচ্চাকে ছড়া আর বর্ণমালা জিজ্ঞেস করলো,সবাই ঠিকঠাক বলতে পারছিলো। রাত্রির মুখে কিছুটা হাসি ফুটে ওঠলো।

শাওন রাত্রিকে বলে বাকি ক্লাসগুলোও দেখে নিলো। বাচ্চারা সবাই খুব চুপচাপ বসে ছিলো। রাত্রিকে দেখেই তাদের মুখে হাসি ফুটে ওঠলো। সব ক্লাসের স্টুডেন্ট একবার একবার বললো যে ম্যাম আজকে আমাদের ক্লাস নিতে আসবেন প্লিজ।
শাওনের বিষয়টা কেমন যেনো লাগলো। একজন টিচারের সব ক্লাসেই একটা একটা সাবজেক্ট আছে?বাট হোয়াই? গেস্ট টিচারকে সব ক্লাস নিতে কেনো দেওয়া হচ্ছে? তাহলে তো সারাদিনে মাত্র একটা ক্লাস তিনি সময় পান।
শাওন নিজের মনের কথা মনে রেখে প্রিন্সিপ্যালের সাথে আরেকবার দেখা করে চলে গেলো।

★★★
পুরো পথ জার্নি করে মাত্রই বাসায় এসে পৌঁছায় সাগর আর বৃষ্টি। দুপুর গড়িয়ে বিকাল নেমেছে। তিনটা-সাড়ে তিনটা বাজে হয়তো। সাগরকে দেখে শাহিনুর সহ সবাই এগিয়ে আসে। মিনিট বিশেকের মতো চলে ফ্যামিলি ফর্মালিটি। শিফার চোখমুখ কেমন শুকনো শুকনো লাগছে সাগরের কাছে। রাত্রিকে আশেপাশে চোখে পড়লো না, ভাবলো সে হয়তো তার আশার খবর শুনে লুকিয়ে আছে।
সাগর খুব ক্লান্ত, তাই সে ভাবলো পরে রাত্রির সাথে দেখা করবে আগে ফ্রেশ হয়ে আসা যাক।
সাগর আর বৃষ্টি ফ্রেশ হয়ে আসতেই শাহিনুর ওদের গরম ভাত আর গরম তরকারী দিয়ে খাবার দিলেন।
সাগর খাবার টা মুখে দিতেই অন্যরকম স্বাদ পেলো, বুঝলো যে এটা রাত্রি রান্না করে নি। তার মা রান্না করেছে। মনে মনে ভাবলো আজ হঠাৎ মা রান্না করলো কেনো? পরক্ষণেই ভেবে উঠলো হয়তো তার জন্য রেঁধেছে।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সাগর সোফায় এসে বসলো, শাহিনুর তো ছেলেকে পেয়ে খুশিতে আটখানা। তাকে এটা সেটা প্রশ্ন করতে লাগলো।

সাগর সব প্রশ্ন এড়িয়ে মাকে বলে,–” মা,শিফাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো? মনে হচ্ছে ও খুব অসুস্থ! চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে আছে।”

শাহিনুর চুপ করে গেলেন। কী বলবেন তিনি? এতদিন তিনি ছেলেকে বাড়ীতে ঘটে যাওয়া কোনো কিছুই জানায় নি। ছেলে চলে আসতে চাইবে তাই।
এখন আর কিছু লুকালো না, শিফার সব বলে দিলো। কি কি ওর শশুড়-শাশুড়ি বলেছে সেসব!

সাগরের চোয়াল রাগে লাল হয়ে গেলো। সে রেগে গিয়ে কিছু বলতে নিচ্ছিলো তখন ই দেখে রাত্রি কাঁধে ব্যাগ ঝুঁলিয়ে বাসায় ডুকছে।
সাগর ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকালো, এত পরিপাটি হয়ে কই গিয়েছে সে?

রাত্রি হাসি মুখ নিয়ে ঘরে ডুকছিলো কিন্তু সাগরকে দেখেই তার মুখের হাসি উবে গেলো। মনের মধ্যে ঝড় বইতে শুরু করলো।
রাত্রি চোখ টা সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রুমের দিকে যাচ্ছিলো।
সাগর তখন বলে উঠে,–” কই গিয়েছিলে?”

চলবে!
পাঠক হারিয়ে যাচ্ছে।লেখায় কি সমস্যা হচ্ছে? আপনারা যদি ভালো/খারাপ বিষয়গুলো না বলেন তাহলে আমি কীভাবে বুঝবো?
চলবে!
এক ঘন্টায় কি লিখছি কে জানে? আপনারা একটু আগে বলেছেন দেখেই আমি লিখতে বসেছি, সবার মতামত আশা করছি,ভালো খারাপ জানালে খুশি হবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here