বেটারহাফ পর্ব ১৬+১৭

#বেটারহাফ
#নিশাত_তাসনিম_নিশি
| পর্ব ১৬ |

রাত্রি হাসি মুখ নিয়ে ঘরে ডুকছিলো কিন্তু সাগরকে দেখেই তার মুখের হাসি উবে গেলো। মনের মধ্যে ঝড় বইতে শুরু করলো।
রাত্রি চোখ টা সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রুমের দিকে যাচ্ছিলো।
সাগর তখন বলে উঠে,–” কই গিয়েছিলে?”

রাত্রি স্পষ্ট আওয়াজ করে বলে,–“স্কুলে গিয়েছি।”

কথাটা বলে কোনো কিছু শোনার অপেক্ষা না করেই সে চলে গেলো। কিছু শুনতে চায় না সে । মানুষ টার দিকে তাকালে তার রাগ উঠে, মন টা খারাপ হয়ে যায়। সাগরের সামনে সে পড়তে চায় না, ওর সামনে পড়লেই তার মুখের হাসি চলে গিয়ে ঘনকালো আধাঁর নেমে আসে। কেমন যেনো তীক্ততা কাজ করে সাগরের প্রতি। আগের মতো ভালোবাসা পায় না তার প্রতি।

সাগর হতভম্ভ হয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে প্রশ্ন করতে নিচ্ছিলো কেনো গিয়েছে তার আগেই চলে গেলো।

মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,–“ও স্কুলে কেনো গিয়েছিলো?”

শাহিনুর মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলে,–“ও স্কুলে চাকরী করে তাই।”

সাগর ভ্রু দুটি কুচকে গেলো। ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বলে,–“মানে? স্কুলে চাকরী করে মানে?”

শাহিনুর খুশি খুশি ভাব করে বলে,–“শখ করেছিলো তাই আমি রাজি হয়েছি। মেয়েটা সারাদিন বাড়ীতে থেকে থেকে এক ঘুয়ে হয়ে গিয়েছে। তাই আমি আর কিছু বলি নি।”

সাগর আর কিছু বললো না, চুপচাপ সেখান থেকে উঠে চলে গেলো। রাত্রি তার থেকে দূরে হয়ে যাচ্ছে সে বুঝতে পারছে। কী করা উচিত তার? কী করলে সবাই খুশি থাকবে? সে তো কাউকেই খুশি করতে পারছে না।

***
পরের দিন ভোরেই স্কুলে চলে যায় রাত্রি। সাগর এসেছে জেনে সকালেও প্রাইভেট পড়াবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাছাড়া ও কি করে না করে সেটাতে তো আর কারো সমস্যা হয় না। মাঝে মাঝে তার মনে হয় সে যে বাড়ীতে থাকে তাও বোধ হয় কারো চোখে পড়ে না।
স্কুলে এসেই সে সরাসরি ক্লাস রুমে চলে গেলো। মিনিট দুয়েক লেইট হয়ে গিয়েছে তার। ক্লাসে ডুকতেই দেখতে পেলো কালকের ছেলেটা বসে আছে সাথে তার বাচ্চা একটা ছেলে। ফকফকে সাদা চামড়া ছেলেটা। রাত্রির চোখে ভালোভাবেই বাচ্চা টা পড়লো।
সে মিষ্টি হেসে তার চুলগুলো হালকা নাড়া দিয়ে বলে,–“কেমন আছো বাবু?”
ছেলেটা গম্ভীর মুখ করে রাত্রির হাত সরিয়ে দিলো। রাত্রি অবাক হয়ে তাকালো।
হালকা হেসে বলে,–“ওরে বাবা, চুলের ফ্যাশন নষ্ট করে দিছি ম্যাম তাই না? আচ্ছা আর করবো না। ”
ছেলেটা কোনো কথা বললো না, চোখমুখে চরম বিরক্তি ফুটিয়ে দুই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে অন্যদিকে মুখ করে দাড়িয়ে রইলো।
রাত্রি কিছুটা বিব্রতবোধ করলো। সে এবার আরেকটু নরম সুরে বলে,–“তোমার নাম কী? ”

ছেলেটা ব্যাগের চেইন খুলে একটা খাতা বের করে দু পেইজ উল্টে রাত্রির সামনে ধরলো। রাত্রি ভ্রু জোড়া কুচকে খাতা টা নিলো। গোটা গোটা অক্ষরে ছেলেটার পুরো বায়ো ডাটা লেখা সেখানে। রাত্রি অবাক হয়ে সব দেখলো। পরক্ষণে ভাবলে ছেলেটা হয়তো কথা বলতে পারে না। তার মনটা ই খারাপ হয়ে গেলো। এত সুন্দর বাচ্চা অথচ কথা বলতে পারে না। রাত্রির মায়া হলো তার প্রতি।
সে শাওনের দিকে তাকিয়ে বলে,–” শাফি কথা বলতে পারে না তাহলে তো ওকে প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি করানো উচিত ছিলো আপনার। এখানে ওকে কীভাবে পড়াবো আমি?”

শাওন একরাশ বিরক্তি নিয়ে রাত্রির মুখের দিকে তাকালো। শাফির দিকে তাকিয়ে বলে,–“বাবা ম্যামকে গ্রিটিংস দাও!”
শাফি গম্ভীর সুরে বলে,–“গুড মর্নিং ম্যাম!”

রাত্রি অবাক হয়ে দুজনের দিকে তাকালো। সে বলে,–“এ্যাহ, ও কথা বলতে পারে? তাহলে আমি যে এত কথা বললাম কই ও তো কোনো কথা বললো না।”

শাওন গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,–” ও কথা কম বলে।”
রাত্রি দুজনের দিকে পরপর কয়েকবার তাকালো। কাগজ টা শাফির হাতে ধরিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এটুকু বাচ্চার কী গম্ভীরতা! রাত্রির একবার বলতে ইচ্ছে করলো,–“ও কথা কম নয় কথাই বলে না।” পরে কিছু বললো না এনারা দুজনেই যে তার উপর বিরক্ত সে বুঝলো। তাই সে আর কথা বাড়ালো না। বাচ্চা টাকে শাওন সবার সাথে বসতে বললো, সে চুপচাপ গিয়ে এক পাশে বসে পড়লো।
শাওন চলে যেতেই রাত্রি এসে ওদের সাথে বসে পড়লো পড়ানোর জন্য। সবাই হই চই লাগিয়ে দিয়েছে রাত্রির কোলে কে বসবে আজ।
রাত্রি আওয়াজ করে বলে–” সবাই চুপ করো।”
বাচ্চাগুলো সবাই শান্ত হয়ে গেলো। শাফি বিরক্তিকর মুখ করে ওদের দিকে তাকালো। সবাই চেঁচামেচি করছে কেনো?
রাত্রি সবার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে বলে,–” আজ আমাদের সাথে আরেকজন নতুন অতিথী এসেছে। আজ থেকে শাফি ও তোমাদের বন্ধু।”
সবাই মাথা নাড়ালো। সে দম নিয়ে আবারো বলে,–” আজ যেহেতু ও নতুন এসেছে, তাহলে ওকেই কোলে বসাই? ও তোমাদের ছোট নতুন বন্ধু তাই না! ”
রাত্রি সবাইকে সুন্দর করে বুঝাতে তারাও রাজি হয়ে গেলো। সে শাফির দিকে তাকিয়ে তাকে ডাকলো। শাফি উঠে আসতেই সে তাকে তার কোলে বসালো। শাফি চুপ করে বসে রইলো। রাত্রি হেসে ওর গালে কিসি দিলো, শাফি সাথে সাথে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে ফেললো। কপাল দুটো কুচকে বিরক্তিকর মুখে রাত্রির দিকে তাকালো। রাত্রি ওর দিকে তাকিয়ে একটু মিষ্টি করে হাসলো। এতে তার মুখের এক্সপ্রেশনের কোনো পরিবর্তন হলো না সে একইভাবে তাকিয়ে রইলো।
রাত্রি কাচুমাচু মুখ করে বলে,–“আচ্ছা, আর দিবো না।”
ছেলেটা আগের মতো মুখ করেই নিচের দিকে তাকালো। রাত্রি ফুশ করে নিশ্বাস ছাড়লো। বিরবির করে বলে, “বাপরে বাপ, এমন ভাবে তাকাচ্ছিলো যেনো খেয়ে ফেলবে!”
ওদের ক্লাস শেষ হতেই রাত্রি বেরিয়ে পড়লো অফিসের দিকে। ওর পিছন পিছন শাফি ও বের হলো। রাত্রি অফিসে ডুকবে এমন সময় দেখলো বাচ্চা ছেলেটা তার পেছনে। সে বলে,–“ক্লাসে গিয়ে বসো বাবু। এখনো অন্য সার যাবে তো।”
শাফি কোনো জবাব না দিয়ে দাড়িয়ে রইলো। রাত্রি আরো কয়েকবার বলে উপায়ন্তর না পেয়ে ওকে সহ অফিসে ডুকলো।
সে প্রিন্সিপ্যাল কে বলতে নিচ্ছিলো, –” স্যার এ বাচ্চা টা,, ”
পুরো কথা টা শেষ হওয়ার আগেই স্যার বলে উঠে,–” আরে শাফি। আসো আসো। এদিকে আসো!”
শাফি রাত্রির হাত ছেড়ে দিয়ে উনার কাছে চলে গেলো। রাত্রি বলে,–” স্যার ওকে চিনেন আপনি?”
প্রিন্সিপ্যাল বলে,–“হ্যা। ও হলো পরিদর্শকের নাতি। কাল যে ছেলেটা এসেছিলো, মিঃ শাওন উনি হলেন পরিদর্শকের ছেলে। তিনি কাল অসুস্থতার জন্য আসতে পারে নি তাই ছেলেকে পাঠিয়েছিলো। এসব কথা তিনিই আমাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে ছিলেন রাতে। ”
রাত্রি অবাক হয়ে উনার দিকে তাকালো। কি বলে?
স্যার আবারো বলে,–” ইউ নো আমাদের স্কুলকে উনারা বেস্ট বলে জানিয়েছে। বিশেষত শিশু ক্লাসের জন্য, উনি সব ভালো করে দেখে রিপোর্ট করেছিলেন। আমিও তোমার কথা বলেছি এরপর উনি বলেন তোমাকে পার্মানেন্ট করার ব্যবস্থা করে দিবেন উনারা।”
রাত্রি শুনে কিছুটা খুশি হলো। এরপর বলে,–“তাহলে স্যার বাচ্চা টাকে কেনো ভর্তি করিয়েছে?”

–” আসলে ও কারো সাথে কথা বলে না,মিশে না। ওকে স্বাভাবিক করার জন্যই এখানে ভর্তি করিয়েছে। ওর বাবা কাল দেখেছিলো সব বাচ্চা নাকি খুব হাসিখুশি ভাবে কথা বলছিলো।”
রাত্রি কৌতুহল নিয়ে বলে,–“কিন্তু ও কেনো এমন? না মানে এমন গম্ভীর গম্ভীর থাকে কেনো?”

প্রিন্সিপ্যাল উদাস মুখ করে শাফির দিকে তাকিয়ে বলেন,–” ওর মা নেই। জন্মের সময় মারা গিয়েছে। এরপর বাবা আর বিয়ে করে নি।একা একা ই বড় হয়েছে তাই ও এমন। ওর মেন্টাল কন্ডিশন ভালো না। স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতো নরমাল বিহেভ করে না ও। সবসময় নিজের মতো থাকে। একা একা খেলে, একা একা থাকে।”
রাত্রির বুকটা ধক করে উঠলো। ও জানে মা ছাড়া একটা বাচ্চার জীবন কেমন। কতটা কষ্ট সে খুব ভালো করেই বুঝে। ছেলেটার দিকে তাকাতেই ওর খারাপ লাগা টা বহু গুন বেড়ে গেলো। ও তো কয়েক বছর মা কে পেয়েছে। মা কেমন বুঝেছে। কিন্তুু শাফি? ও তো কখনো মায়ের আদর পায় ই নি।

শাফি ছোট ছোট চোখ করে দুজনের দিকে তাকাচ্ছে, সে বুঝতে পারছে না কী বলছে উনারা! তবে এটুকু বুঝেছে ওর সম্পর্কেই বলছে না হলে দুজনে বারবার ওর দিকে তাকাতো না।
#বেটারহাফ
#নিশাত_তাসনিম_নিশি

| পর্ব ১৭ |

শাফি ছোট ছোট চোখ করে দুজনের দিকে তাকাচ্ছে, সে বুঝতে পারছে না কী বলছে উনারা! তবে এটুকু বুঝেছে ওর সম্পর্কেই বলছে না হলে দুজনে বারবার ওর দিকে তাকাতো না।

সে বিরক্তিকর মুখ করে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। বাবা কখন যে আসবে?

রাত্রি এগিয়ে এসে ওকে কোলে নিলো আদর করার জন্য। বাচ্চা টাকে দেখে ওর ভেতর মমতাবোধ জেগে উঠলো। ইশশ! মা হওয়ার অনুভূতি টা বুঝি খুব দামী যে স্রষ্টা তাকে তার স্বাধ গ্রহণ করতে দিলেন না? এ জগতের নিয়ম এমন কেনো? কেউ বাচ্চা পায় না, তো কেউ মা পায় না।

শাফি গম্ভীর কন্ঠে বলে,–“ডোন্ট ডেয়ার টু কিস মি!”
রাত্রি বড়বড় চোখ করে তাকালো। কি ডেয়ারিং বাচ্চা গো। এত কম বয়সে পটরপটর ইংলিশ বলতেছে।
সে মাত্রই কিসি দিতে যাচ্ছিলো, নিজেকে থামিয়ে নিয়ে বলে,–” না,না। বাবা আমি কিস করতে ছিলাম না তো। তোমাকে কোলে নিতে যাচ্ছিলাম।”

শাফি এমনভাবে তাকালো রাত্রির মনে হলো ও চোখ দিয়ে বলছে, ‘মিথ্যা কেনো বলছো?মিথ্যা কথা আমি পছন্দ করি না।’
শাফি কি আসলেও সেটা বুঝিয়েছে কিনা রাত্রি জানে না। তবে সে যে মিথ্যা বলেছে তা বাচ্চাটা ধরে ফেলেছে এটা ভালোই বুঝলো।
রাত্রি ওকে কোলে নিয়ে টেবিলে বসিয়ে দিলো। তার মুখের ভাবমূর্তির তেমন পরিবর্তন হলো না সে গম্ভীর মুখে বসে রইলো।
রাত্রি চট করে বুদ্ধি বের করলো ওকে খুশি করার। সে ব্যাগ থেকে পাঁচ টাকা দামের ডেইরী মিল্ক বের করে ওর সামনে ধরে বলে,–“এটা কে নিবে?”
রাত্রির মন-মুখ উৎফুল্লু হয়ে আছে, সে জানে শাফি এখন ঝাঁপিয়ে পড়ে বলবে,–“আমি নিবো।” মনে মনে একটা ভাব নিয়ে নিলো সে।

শাফি চুপ করে রইলো। রাত্রির মন টা ভেঙ্গে গেলো। সে ভাবলো হয়তো ওকে কেউ আগে এভাবে চকলেট দেয় নি তাই সে বুঝে নাই।
তাই সে বলে,–“এটা শাফি নিবে।ইয়েএএ!!”

শাফি ভ্রু কুচকে চকলেটের দিকে তাকালো, এরপর সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে বলে,–“নো!নেভার।”
রাত্রি অবাক হয়ে বলে–“কেনো?”
শাফি গম্ভীর কন্ঠে বলে,–” বিকজ ইট’স আন-হাইজেনিক ফর হেল্থ!”

রাত্রি আরো অবাক হয়ে গেলো। সে সচেতন চোখে আশেপাশে তাকালো। প্রিন্সিপ্যাল নিজের কাজে ব্যস্ত, বাকি টিচার রা এখনো আসে নি। সে ফুশ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।ভাগ্যিস কেউ দেখে নি,নাহলে স্কুলে মান-ইজ্জত শেষ।

–“আচ্ছা, আচ্ছা। চুপচুপ কাউকে আবার বইলো না ম্যাম আমাদের আন-হাইজেনিক খাবার দেয়। নাহলে আমার চাকরী ওখানেই শেষ! তুমি না ভালো ছেলে, কাউকে বলবা না ঠিক আছে? তোমার বাবা আর দাদু কে তো একদম ই না।”

এ বলে রাত্রি চকলেট টা ফটাফট ব্যাগে ভরে নিতেই শাওন এসে ডুকলো। সে দেখলো তার ছেলে ক্লাস টিচারের সামনে বসে ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। শাওন মনে হলো খুব বড় ঝাঁটকা খেলো। তার ছেলে হেসেছে? বুকের মধ্যে ধুকধুক করে উঠলো। আজ কতদিন পর ছেলেকে হাসতে দেখেছে।
শাওন এগিয়ে যাচ্ছিলো তার দিকে। শাফি তাকে দেখে আগের মতো হয়ে গেলো। চুপচাপ নেমে যেতে লাগলো।

–“আরে,আরে।নামছো কেনো?পড়ে যাবে তো।কই যাবা আমাকে বলো আমি নিয়ে যাবো।”

শাফি কোনো জবাব না দিয়ে নেমে যেতে লাগলো। রাত্রি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ওকে নামাতে লাগলো। কী ছেলের পাল্লায় পড়লো? এর থেকে তো দশটা দুষ্টু বাচ্চা ভালো। যে কথা বলবে।

প্রিন্সিপ্যাল শাওনকে দেখে অস্থির হয়ে গেলো।
আসুন, আসুন, বসুন বলতে বলতেই শেষ তিনি। শাওন বলে,–“স্যার পরে বসবো। তাছাড়া ছেলেকে পার্মানেন্ট এখানেই ভর্তি করাবো। আমি বাবার সাথে স্কুলের ব্যাপারে কথা বলেছি উনি বলেছেন এ স্কুলে আরেকটা দালান করার জন্য এপ্লাই করবেন তিনি। আর বাবা নিশ্চই আমাদের ব্যাপারে সব বলেছেন, তাই আশা করি আমার ছেলের প্রতি সর্বোচ্চ যত্ন নেওয়া হবে।”
শাওনের কথায় তিনি অত্যন্ত খুশি হলেন। চোখমুখে খুশির ঝিলিক।

শাওন এসে শাফির হাত ধরে বলে,–” চলো বাবা!”

রাত্রি চোখ তুলে তার দিকে তাকাতেই সে থ্যাংকস বলে চলে যেতে লাগলো। রাত্রি ভ্রু কুচকে তাকালো তাদের দিকে, থ্যাংকস কেনো বললো? সে তাকিয়ে আছে তখন শাফি হাত উঠিয়ে বাই বলে চলে যেতে লাগলো।
রাত্রির মুখ খুশিতে ভরে উঠলো,সে এক গাল হেসে নিজেও বিদায় জানালো। ইশশ কি কিউট বাচ্চা! এমন বাচ্চা যদি তারও হতো, তাহলে খুব কি ক্ষতি হতো?
মুখে বিষণ্ণতার ছায়া নেমে আসতেই সে আবারো প্লাস্টিকের হাসি ঝুঁলিয়ে নিলো মুখে।

প্রিন্সিপ্যাল অতিরিক্ত খুশি হয়ে বলে,–“তুমি এ স্কুলের লক্ষী!তুমি ভাগ্যের প্রদীপ! দেখো, স্কুলে আসতেই কত কি হতে লাগলো। তুমি যার ভাগ্যে যাবে সে খুব ভাগ্যবান হবে। ”

রাত্রি চমকে উনার দিকে তাকালো। এদিকে অতিরিক্ত খুশির ঠেলায় কি বলতে কি বলে ফেলেছেন প্রিন্সিপ্যাল বুঝে উঠতে পারেন নি। তিনি কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গিয়েছেন।

রাত্রি তার যাওয়ার পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। অনুভব করলো উনার কথাগুলো তার কলিজায় লাগছে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে!

মানুষের বেখেয়ালি কথাগুলো অন্যকে সত্যিই মরণ যন্ত্রণা দিতে পারে।

সারাদিন ক্লাস করে অনেক দেরীতে বাড়ী ফিরে রাত্রি। খুব ক্লান্ত সে। এত এত খাটুনি তার শরীর মানছে না। এবার স্কুলের প্রথম বেতন পেলে সে মাসে যাতায়াতের জন্য আলাদা কিছু টাকা রেখে দিবে যাতে সে সেগুলো দিয়ে যাওয়া-আসা করতে পারে। এত দূর হেটে যাওয়া আসা করতে করতে তার হাত-পা ব্যাথা হয়ে যায়।
রুমে এসেই ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুমে চোখ দুটো ভার হয়ে আসছে।

২১.
নিস্তব্ধ রজনী! চারপাশ অন্ধকারে ঢাকা। পাশের বাগান থেকে ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের ডাক ভেসে আসছে। আশপাশের পরিবেশ টা কেমন ভূতুড়ে হয়ে আছে। ঘরের প্রত্যেক টা মানুষ নিজ নিজ কামরায় রয়েছে। কোথাও কোনো কোলাহল নেই।

সিগারেট হাতে নিয়ে রাত্রির রুমে দুবার টোকা মারলো সাগর। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো রেসপন্স আসছে না। সাগর আরো একবার টোকা মেরে রাত্রিকে ডাকলো। কিন্তু ভেতর থেকে সে কোনো জবাব দিলো না।

শাহিনুর নিজের রুমে যেতে নিচ্ছিলেন তখন দেখলেন সাগর রাত্রির রুমের সামনে। তিনি হনহন করে সাগরের সামনে গিয়ে বলে,–“তোমাকে কি বলেছিলাম আমি? বলেছি না ওর থেকে দূরে থাকতে।”

সাগর উনার কথার পাত্তা দিলো না সে আরো জোরে জোরে ধাক্কাতে লাগলো। মেজাজ বাজে ভাবে বিগড়ে গেলো তার।

শাহিনুর আবার কথা বলতে নিচ্ছিলো সে কঠোর কন্ঠে বলে,–“মা, এখান থেকে চলে যাও। নাহলে আই সোয়ার আমি খুব খারাপ কিছু করে ফেলবো। ”

শাহিনুর আবারো ফোসফোস করে “সাগর” বলে কিছু বলতে নিচ্ছিলেন তখন সাগর পাশের টেবিলে রাখা ফুলদানী টা হাতে নিয়ে ঠাস করে ফ্লোরে ছুড়ে মারলো আর চেঁচিয়ে বলে উঠে,–“মা, আমি তোমাকে যেতে বলেছি না?”

শাহিনুর বুঝলো ছেলে তার খুব রেগে গিয়েছে। তাও রাত্রির উপর হয়তো। সাগর সহজে রাগে না, কিন্তু রাগলে সে কার সাথে কিসের সম্পর্ক সব ভুলে যায়। কিন্তু কেনো রেগে আছে? রাত্রি আবার কি করেছে?

শাহিনুর বেগম আদেশের সুরে বলে,–” সাগর তুমি আমাকে কথা দিয়,,,!!”

পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই সাগর দরজায় খুব জোরে লাথি মারলো। মূলত রাগ টা দরজার উপর তুললো সে।

সে জোরে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলো,–” হ্যা জানি আমি, আমি আপনাকে কথা দিয়েছি, মিসেস শাহিনুর বেগম যে আপনি রাত্রিকে মেনে নিলে আপনার সব কথা মেনে চলবো। কিন্তু যার জন্য কথা দিয়েছি সেই যদি না থাকে তাহলে আমি আপনার কথা কেনো রাখবো মিসেস শাহিনুর বেগম। ”

–“সাগর তুমি আমাকে নাম ধরে ডাকছো কেনো? আমি তোমার মা !”

সাগর মা বলে হা হা হা করে হেসে উঠলো।
গলা উঁচু করে বলে,

–” মা নয়, সৎ মা। স্টেপ মাদার!”

চলবে!
চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here