বেদনার রঙ নীল পর্ব -০৩

#বেদনার_রঙ_নীল
তৃতীয় পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

চোরকে চোর বললে রেগে যাবে। সেটাই স্বাভাবিক। তেমনি কিডন্যাপারকেও সরাসরি কিডন্যাপার বলা উচিৎ নয়। তুলি জীভ কেটে বলল,” স্যরি। আপনি এখানে কখন এসে দাঁড়িয়েছেন? মানে আমার কথা সব কি আপনি শুনেছেন? আমি কিন্তু ওগুলো আপনাকে বলিনি।”

পেছনের লোকটি মানে রিসেপশনিস্ট বললেন,” ভাইয়া এখানে প্রথম থেকেই দাঁড়িয়েছিল আপু। মানে যখন আপনি ফোনে কথা বলা শুরু করেছেন তখন থেকেই।”

তুলি গোমরা মুখে বলল,” ও আচ্ছা।” প্রণয় এখনও একদৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে আছে। তুলি ভয়ে ভয়ে রিসেপশনিস্টের উদ্দেশ্যে বলল,” আমি ফোনে যা বলেছি তার কিছুই সত্যি না। আপনি আবার উনাকে ভুল বুঝবেন না।”

রিসেপশনিস্ট বললেন,” আচ্ছা।”

তুলি প্রণয়ের গম্ভীর মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসার চেষ্টা করল। লাভ হলো না। প্রণয় কোনো কথা না বলে টেলিফোনের দিকে এগিয়ে এলো। তুলি সরে এলো ধীরপায়ে। প্রণয় টেলিফোন তুলে নাম্বার ডায়াল করছে কাউকে ফোন করার উদ্দেশ্যে। তুলি এইটা দেখে অবাক হয়ে বলল,” আমার কথা তো এখনও শেষ.. ”

প্রণয় আঁড়চোখে এমনভাবে তাকাল যে তুলি একদম চুপ হয়ে গেল। ওই পাশ থেকে ফোন রিসিভ হয়েছে। প্রণয় কথা শুরু করল,” মিষ্টি আপু, কোথায় তুমি?”

প্রণয়ের বড়বোন মিষ্টি অতি সুমিষ্ট কণ্ঠে বলল,” হসপিটালে আছি ভাই। তোর ফোন বন্ধ কেন? এটা কোথা থেকে ফোন করেছিস?”

প্রণয় বলল,” এটা একটা রেস্টরন্ট। আর আমার ফোনটা হারিয়ে গেছে আপু। ছোটমার এখন কি অবস্থা?”

” ভালো আছে। আজরাতটা এখানে থাকবো বুঝেছিস? কেবিন ভাড়া করা হয়ে গেছে। আর তুই ফোন হারালি কিভাবে?”

প্রণয় চাপা কণ্ঠে বলল,” পরে বলব। অনেক কাহিনী। আচ্ছা, গ্রীনলাইট কি বাড়িতে একা? ”

” হ্যাঁ। ব্যাপারটা নিয়ে আমিও খুব টেনশনে আছি। না জানি বাড়ির অবস্থা কি হবে! তুই কখন ফিরবি? সকালের মধ্যে ফিরে আয় ভাই। ও ঘুম থেকে জাগার আগে।”

” দেখি… ‌যে একটা আপদ জুটেছে কপালে! কবে ফিরবো আল্লাহ জানে।”

তুলি চোখ কুটি করে তাকাল। প্রণয় অন্যদিকে ঘুরে বলল,” আচ্ছা রাখছি। ছোটমার খেয়াল রাখিস।”

” আচ্ছা, তুইও নিজের খেয়াল রাখিস।”

তুলি ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে রইল। কি অদ্ভুত একটা নাম! গ্রীনলাইট! এমন নাম কি কোনো মানুষের হতে পারে? প্রণয় অল্পকথায় আলাপ শেষ করল। তারপর মোবাইল রেখে তুলির দিকে তাকাল। তুলি ভদ্র গলায় বলল,” কিছু মনে করবেন না। আমি তখন রাইফাকে আপনার ব্যাপারে…”

তুলিকে কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়েই প্রণয় গটগট করে হেঁটে চলে গেল। তুলি অপ্রস্তুত হয়ে তাকাল রিসেপশনিস্টের দিকে। লোকটি সাদা কাগজে কলম দিয়ে কিছু লিখছিলেন। কিন্তু তার মনোযোগ প্রণয়-তুলির দিকেই ছিল। তুলি ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে বলল,” আচ্ছা, উনি কি আমার কথায় মাইন্ড করেছেন? আপনার কি মনে হয়?”

ভদ্রলোক হেসে কাঁধ ঝাঁকালেন। তিনি কি বলতে চাইলেন সেটা বুঝল না তুলি। সে মোবাইল উঠিয়ে আবার ফোন করল রাইফাকে। সব ঘটনা ফোনে জানানো সম্ভব হলো না। রিসেপশনের লোকটি বার-বার ফোন রাখতে তাড়া দিচ্ছিলেন৷ এতোক্ষণ ধরে কথা বলার নিয়ম নেই। অবশ্য নিয়ম শুধু একটা বাহানা। কাস্টমার ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বললে তাদের বিল বাড়বে। তুলি সেটা বোঝে। সে ফোন রেখে প্রণয়কে খুঁজতে লাগল। দূরের একটা টেবিলে বসে নিঃশব্দে খাচ্ছে প্রণয়। তুলি হাসিমুখে তার সামনে গিয়ে বসল৷ প্রণয় একবার তাকে দেখে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল। তুলি ইতস্তত করে বলল,” আসলে আপনি তখন ওইভাবে ছু/রিটা আমার গলায় চেপে না ধরলে আমি এতো ভয় পেতাম না। আপনি কেন এমন..”

তুলি থামল। কারণ পাশের টেবিলের একটা ছেলে এমন ভয়ংকর কথা শুনে বড় বড় চোখ করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রণয় এতে আরও ক্ষীপ্ত হলো। হাতের চামচটা শব্দ করে প্লেটের উপর রাখল। তুলি কেঁপে উঠল। প্রণয় বিরক্ত হয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,” তারপর? আর কি করেছি আমি? আরও একটু লাউডলি বলুন! মাইক এনে দিবো? তাহলে সবাই জানতে পারবে যে আমি একজন টেরোরিস্ট। আপনাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছি। তারপর পুলিশ ডাকা হবে। আমাকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাবে।”

আশেপাশের সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে তাদের কথা শুনে। তুলি বিব্রত হয়ে বলল,” আচ্ছা আপনি এমন করছেন কেন এখন? আমি তো বললাম, স্যরি। ভুল হয়েছে।”

প্রণয় শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল। আসলে প্রণয়কে তুলির বিশ্বাস করতে একটু কষ্টই হচ্ছে। এই কথাটা আবার সরাসরি বলাও যাচ্ছে না। তাহলে প্রণয় আরও রেগে যেতে পারে। আপাতত চুপ থাকাই নিরাপদ মনে হলো তুলির। প্রণয় একটু পর মেন্যুবুক তুলির দিকে বাড়িয়ে বলল,” অর্ডার দিন।”

” আমি কিছু খাবো না। আপনি খান।”

” বিল নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আপনি যা ইচ্ছা অর্ডার করতে পারেন।”

তুলি সামান্য হেসে বলল,” খুব ভালো অফার। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। টেনশনে গলা দিয়ে খাবার নামবে না।”

” কিসের টেনশন?”

তুলি কিছু বলার আগেই প্রচন্ড শব্দ হলো। রেস্তোরাঁর বাইরে দাঁড়ানো দারোয়ানের চিৎকার শোনা যাচ্ছে।সাথে ভাঙচুরের আওয়াজ। ভেতরের সবাই আতঙ্কিত হয়ে উঠে দাঁড়াল। প্রণয়ের খাওয়া থেমে গেল। সে আহত দৃষ্টি নিয়ে তাকাল তুলির দিকে। তুলি ভ্রু কুচকে বলল,” কি হচ্ছে বাইরে?”

প্রণয় বিপর্যস্ত গলায় বলল,” আমার গাড়িটা বাইরে আছে। সম্ভবত সেটাই ভাঙা হচ্ছে।”

” হায় আল্লাহ, এইবার কি হবে? কিন্তু আপনার গাড়ি কেন ভাঙা হচ্ছে?”

তুলি ভয় পেয়ে গেল। পরক্ষণেই তার মনে পড়ল চেয়ারম্যানের চ্যালাপেলারা এখানেও পৌঁছে যায়নি তো? হতভম্ব হয়ে একে-অন্যের দিকে তাকিয়েই রইল প্রণয়-তুলি। তারপর হঠাৎ প্রণয় প্রায় বাতাসের গতিতে তুলির হাত ধরে তাকে নিয়ে ঢুকে পড়ল রেস্তোরাঁর লেডিস ওয়াশরুমে। দরজা আটকে দিল ভেতর থেকে। তুলি চিৎকার করে বলল,” কি করছেন?”

প্রণয় তার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরল।

” শশশ, আপনাকে তুলতে এসেছে ওরা। যদি বাঁচতে চান তাহলে চুপ করে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন।”

তুলি থম মেরে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। তারপর প্রণয়ের আঙুলটা নিজের ঠোঁট থেকে সরাতে সরাতে আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল,” আপনি আসলে খুবই ভালো। শুধু শুধুই আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম। আই এম স্যরি।”

প্রণয় উত্তর দিল না। দুশ্চিন্তায় সে মরে যাচ্ছে। ধরা পড়লে যথেষ্ট ঝামেলা হবে। আর গাড়িটারও তো মনে হয় অবস্থা খারাপ করে ছাড়বে এরা। ইশ, প্রণয়ের কত শখের গাড়ি! দুইহাতে মাথা চেপে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারী করতে লাগল সে। তুলি বলল,” রিল্যাক্স! এতো প্যানিকড হবেন না। রেস্টরন্টে এতো মানুষ। এদের মাঝে থেকে আমাকে ওরা তুলে নিয়ে যেতে পারবে না।”

প্রণয় কড়া গলায় বলল,” আপনাকে নিয়ে আমি চিন্তা করছি না। আমার গাড়িটার এখন কি অবস্থা কে জানে? ওইটা কি আর চালানোর মতো আছে?”

” ও। আচ্ছা এতো টেনশন করবেন না। একটা গাড়ি ভাঙলে কি আসে-যায়? আমি আপনাকে আরও দশটা গাড়ি কিনে দিবো। আগে এই বিপদ থেকে নিস্তার পাই, তারপর।”

প্রণয় স্থির দৃষ্টিতে তাকাল। তুলিও কথাটা বলে ফেলার পর বোকা হয়ে গেল। জীভ বের করে বলল,” স্যরি। দশটা গাড়ি তো কিনে দেওয়া সম্ভব নয়। আসলে আমাকে বিক্রি করলেও দশটা গাড়ির টাকা হবে না।”

প্রণয় রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,” আমাকে এতোবড় ঝামেলায় না ফেললেও পারতেন। যখন থেকে আপনি আমার গাড়িতে উঠেছেন তখন থেকে একটার পর একটা লেগেই আছে।”

” কিন্তু এই ঝামেলাও তো আপনিই তৈরী করলেন৷ কে বলেছিল রেস্টরন্টে গাড়ি থামাতে?”

” আমি কি আর জানতাম যে আপনার বডিগার্ডরা এতোদূর চলে আসবে?”

” ওরা আমার বডিগার্ড না। আপনি যদি একটানে আমাকে নিয়ে ঢাকায় চলে যেতেন তাহলে ওরা খোঁজটাও পেতো না।”

” একটানে ঢাকায় যাওয়া এতো সহজ না। টায়ার্ড ছিলাম আমি। ফোনটাও বিয়ে বাড়িতে রয়ে গেছে আপনার জন্য৷ আমি এখানে এসেছিলাম যাতে ফোন করে বাড়িতে খোঁজ নিতে পারি।”

তুলি কোমরে হাত গুঁজে বলল,” আচ্ছা, ফোন হারিয়ে গেছে এটাও কি আমার দোষ?”

প্রণয় দেয়ালে মাথা ঠেঁকিয়ে আফসোস করে বলল,” যদি আপনি আমার গাড়িতে না উঠতেন তাহলে আমি আবার ফিরে গিয়ে মোবাইল নিয়ে আসতে পারতাম৷ কিন্তু এখন আমি আর জীবনে ওই গ্রামে ঢুকতে পারব বলে মনে হয় না।”

তুলি চুপ হয়ে গেল। প্রণয়ের অস্থির লাগছে। বাইরে হৈচৈ শুধু বাড়ছে। যেকোনো মুহূর্তে বাথরুমেও হামলা হতে পারে। এটা কেমন বিপদে ফেঁসে গেল সে? তুলি হঠাৎ নিচু কণ্ঠে বলল,” এতো আফসোস করবেন না। গাড়ি কিনে না দিতে পারলেও আমি আপনাকে একটা ফোন অবশ্যই কিনে দিবো। একেবারে সেইম ডিজাইনের। আপনাকে মার্কেটে নিয়ে যাবো। আপনি একদম আগেরটার মতো চুজ করে নতুন দেখে কিনবেন। আর মোবাইলের দাম তো গাড়ির মতো না। মাত্র দশ-বিশ হাজার হলেই..”

প্রণয় স্থির কণ্ঠে বলল,” আমার ফোনের দাম ছিল দেড়লক্ষ টাকা।”

তুলি এই কথা শুনে চুপসে গেল। গলার স্বর দমে গেল। একটু পর আমতা-আমতা করে বলল,” এতো দামী ফোন দিয়ে কি হয়? বিশ হাজার টাকার ফোনে যে কাজ, দেড়লক্ষ টাকার ফোনেও তো একই কাজ। তাই না? দাম ছাড়া কি আর কোনো পার্থক্য আছে বলেন?”

” আপনার কাছে কি আমি ফোন চেয়েছি? বেশি কথা বলবেন না প্লিজ। এমনিতেও যথেষ্ট ঝামেলা পাকিয়েছেন৷ এখন দয়া করে মুখটা বন্ধ রাখুন।”

বাইরে মানুষের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। মোটা গলার গর্জনে সবাই আতঙ্কিত। চেয়ার উলটানো, গ্লাস ভেঙে ফেলা, বাচ্চা কেঁদে ফেলা ধরণের শব্দে কানা তালা লাগার মতো অবস্থা। এসব শুনে তুলি অধৈর্য্য হয়ে দরজা খোলার জন্য পা বাড়াল। প্রণয় ত্বরিতে বলল,” আরে, কি করছেন? পাগল নাকি? আপনাকে তো ধরে ফেলবে ওরা।”

তুলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,” ধরে ফেলুক। আমার জন্য এতোগুলো মানুষ বিপদে পড়েছে এটা আমি সহ্য করতে পারছি না।”

প্রণয় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তখনি দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। প্রণয় বলল,” যা বলছি তা শুনুন প্লিজ। আমার পেছনে লুকিয়ে থাকুন।”

তুলি প্রণয়ের পেছনে চলে এলো। প্রণয় দরজা না খুলে শুধু আওয়াজ করল,” কে?”

একজন ভদ্রলোক বললেন,” বাইরে আসুন স্যার। আমি এখানকার ম্যানেজার।”

প্রণয় আড়ষ্টভাবে বলল,” আমার ওয়াইফ খুব অসুস্থ। আমি ওকে হেল্প করার জন্য এখানে আছি। বের হওয়া সম্ভব নয় এই মুহূর্তে।”

” স্যার, লোকগুলো আপনাদেরকেই খুঁজছে। প্লিজ আপনারা দয়া করে বাইরে আসুন। নাহলে আমার রেস্টরন্টের বারোটা বেজে যাবে।”

” আপনার কেন মনে হলো যে ওরা আমাদেরই খুঁজছে?”

” বিয়ের কনে পালিয়ে যাওয়ার কেইস। আর ম্যাডামের গায়ের শাড়ি বেনারসি। বাইরের গাড়িটাও আপনাদের। যেটা ওরা ভাঙচুর করছে।”

প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” আপনাকে আমি টাকা দিবো। প্লিজ আমাদের সাহায্য করুন।”

” স্যরি স্যার। বরং আপনারা আমাকে সাহায্য করুন। ঝামেলাটা বাইরে গিয়ে মেটান। আপনারা বের হলে তারাও বের হয়ে যাবে।”

প্রণয় দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,” ইম্পসিবল। ওদের সামনে আমরা গেলে কঠিন বিপদে পড়বো।”

” তাহলে কি আপনি বাইরে আসবেন না? আমি কিন্তু পুলিশ কল করব।”

প্রণয় দায়সারা কণ্ঠে বলল,” যা ইচ্ছা করুন।” তারপর সে তুলির দিকে চেয়ে ফিসফিস করে বলল,” পুলিশ এলে আমাদেরই তো লাভ। ”

তুলি মাথা নেড়ে বলল,” একদম ঠিক।”

রাত দেড়টা বাজে পুলিশের গাড়ি এসে রেস্তোরাঁয় পৌঁছালো। প্রণয় আর তুলিসহ মোট দশজনকে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। বাকি আটজন ছিল চেয়ারম্যানের পাঠানো পালোয়ান। তুলি তাদের নামে এফ আই আর করল। স্বয়ং চেয়ারম্যানকে ডাকা হলো। তুলির মামা হেলাল সাহেবও উপস্থিত হলেন। তিনি বার-বার তুলির দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন,” এটা তুই কি করলি মা? বিয়ে করবি না আমাকে একবার বললেই হতো। আমি কি তোকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছিলাম?”

নিজের মামাকে এমন গিরগিটির মতো রঙ বদলাতে দেখে তুলির গা শিরশির করছিল। দাঁত কিড়মিড়িয়ে সবার সামনেই সে বলল,” তুমি আমাকে সাতদিন ঘরে আটকে রেখেছো। মোবাইল পর্যন্ত দাওনি। আর এখন নাটক করা হচ্ছে?”

দারোগা সাহেব বললেন,” কে নাটক করছে আর কে সত্যি বলছে সেটা আমরা বের করব। তুমিও প্রেমিকের সাথে পালিয়ে খুব ভালো কাজ করোনি। মামা তোমাকে মানুষ করেছে। তাকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে যাওয়া কোনো বাহাদুরি না।”

তুলি আশ্চর্য হয়ে প্রতিবাদ করল,” আর একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়াটা কি খুব বাহাদুরির কাজ মনে হয় আপনার?”

দারোগা কটমট করে বললেন, ” গলা নামিয়ে কথা বলো। তুমি জানো না কার সামনে দাঁড়িয়ে কি বলছো।”

তুলি চেয়ারম্যান সাহেবের দিকে তাকাল। তিনি পায়ের উপর পা তুলে চা খাচ্ছেন। এই লোকটাই তো আসল কালপ্রিট। একে ধাক্কা মেরে হাজতে ঢোকানো উচিৎ। অথচ কি সুন্দর আদর-যত্ন করা হচ্ছে তাকে! যেন আসামী নয়, বিশেষ অতিথি এসেছে। তিনি শান্ত ভঙ্গিতে বললেন,” ঝামেলাটা আমাদের পারিবারিক। তাই পুরো ব্যাপারটা আমাদের উপর ছেড়ে দিলেই ভালো হয়। আপাতত আমরা কোনো মামলা-মোকদ্দমায় জড়াতে চাইছি না।”

দারোগা চেয়ারম্যানের কথা মেনে নিলেন। তুলি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। তার কথার মূল্য কেউই দিচ্ছে না। দারোগা কেবল চেয়ারম্যানের প্রতিটি কথায় মাথা নেড়ে যাচ্ছেন৷ অথচ তুলি যে মাত্র এফআইআর করল? সেটা বুঝি কিছুই না? একটু পর দারোগা তুলিকে ভংচং বুঝিয়ে বাড়ি যেতে নির্দেশ দিলেন। এতোক্ষণে তুলি বুঝতে পারল তার কথায় কোনো কাজই হবে না। শেষমেষ পুলিশ তাকেই সাপোর্ট করবে যার ক্ষমতা বেশি। তুলি আশা হারিয়ে ফেলল পুরোপুরি। তার শুধু কান্না পাচ্ছে এবার। চেয়ারম্যান ঠিকই তুলিকে এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছেন৷ দিনশেষে কি ওই অশিক্ষিত, অসহ্য মানুষটিকেই নিজের স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে হবে তুলিকে? কি নির্মম! চেয়ারম্যান তুলির মাথায় হাত রেখে বললেন,” আমি তোমাকে মাফ করে দিয়েছি মা। এই বয়সে ভুল সবাই করে। তবে আমি কখনও কথার খেলাফ করি না। তোমার মামাকে কথা দিয়েছিলাম, তোমাকেই পুত্রবধূ করব। তাই আমার বড়ছেলের বউ তুমিই হবে।”

হেলাল সাহেব খুশিতে গদগদ হলেন। তুলি ঘৃণায় নিজের মাথা সরিয়ে নিল। পারলে সে লোকটার গায়ে থুতু মারতো। চলে যাওয়ার সময় সে প্রণয়কে আশেপাশে খুঁজতে লাগল। প্রণয় গেছে থানার ওসির সঙ্গে কথা বলতে। এখনও কি তাদের আলাপ শেষ হয়নি? তুলির মামা তুলিকে টেনে-হিঁচড়ে থানা থেকে নিয়ে যাচ্ছে। প্রণয় কি এই জুলুম দেখেও কিছু করবে না? এখন সে-ই তুলির একমাত্র ভরসা!

বাইরে এসে প্রণয়ের সঙ্গে দেখা হলো। ওসি সাহেবকে নিয়ে প্রণয় বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল৷ তারা কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলছে৷ তুলি করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রণয়ের দিকে। প্রণয়ের নজরও হঠাৎ তুলির দিকে পড়ল। তুলি তখনি দৌড়ে তার কাছে ছুটে এসে বিচলিত গলায় বলতে লাগল,” আমাকে বাঁচান প্লিজ। ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে!”

প্রণয় শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইল,” কোথায়?”

” বাড়িতে। ওই লোকটির সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়ে যাবে। কিন্তু আমি বিয়ে কর‍তে চাই না।”

তুলি করুণ কণ্ঠে কাঁদতে লাগল। প্রণয় একবার তুলির পেছনে দাঁড়ানো চেয়ারম্যান আর হেলাল সাহেবের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তারপর শক্ত গলায় বলল,” আপনাকে কেউ নিয়ে যেতে পারবে না।”

তুলি যেন আশা ফিরে পেল এই কথায়। প্রণয় ওসি সাহেবের দিকে তাকাল। ওসি সাহেব চোখের ইশারায় নিশ্চিন্ত হতে বললেন। তারপর তিনি চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে বললেন,” মেয়েটিকে নিতে পারবেন না। আপনারা ফিরে যান। পুলিশ পাঠানো হবে ইনভেস্টিগেশনের জন্য।”

চেয়ারম্যান ক্ষীপ্ত হয়ে বললেন,” কিসের ইনভেস্টিগেশন? আমি তো বললাম, কোনো মামলা-মোকদ্দমায় জড়াতে চাই না৷ এটা আমাদের পারিবারিক ইস্যু। বাচ্চা মেয়ে না বুঝে ভুল করেছে।আমরা নিজেরাই আমাদের ঝামেলা মিটিয়ে নিবো।”

” কিন্তু আপনাদের নামে কেইস করা হয়েছে।প্রণয় আহসানের গাড়ি ভাঙচুর করেছেন এবং তুলনা সরকারকে অপহরণের চেষ্টা করেছেন।”

তুলি চমকে উঠল। সে ধরেই নিয়েছিল ওসি সাহেব এই কেইস নিবেন না। চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে চাইলেই কেইস করা যায় না। তুলির কেইসও নেওয়া হয়নি। কিন্তু অবাক কান্ড, প্রণয়ের কেইস নেওয়া হলো! তুলি বিস্ময় আর আনন্দ নিয়ে প্রণয়ের দিকে তাকাল। চেয়ারম্যানের চোখে জ্বলে উঠল হিংস্রতা। তুলির একটু ভয় লাগছিল। চেয়ারম্যান বললেন,” কেইস তোলার জন্য আপনাকে কত দিতে হবে?”

ওসি সাহেব রেগে বললেন,” আমাকে ঘুষখোর মনে হয়? উকিল ঠিক করুন। কেইস অনেক জটিল হতে যাচ্ছে এটা। তৈরী থাকুন।”

তারপর ওসি সাহেব প্রণয় আর তুলির উদ্দেশ্যে বললেন,” আপনারা চিন্তা করবেন না। আপনাদেরকে নিরাপদে ঢাকায় পৌঁছানোর জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ভেতরে গিয়ে বসুন।”

তুলির আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করল। হেলাল সাহেব হতাশ হয়ে তুলিকে আরেকবার অনুরোধ করতে এলেন যেন সে অন্তত কেইসটা তুলে নেয়। প্রণয় কঠিন গলায় বলল,” অসম্ভব। ”

তুলি কোনো জবাবই দিল না। চেয়ারম্যান ক্রোধপূর্ণ কণ্ঠে হুমকি দিলেন,” পস্তাবে তোমরা।”

প্রণয়-তুলি একদম পাত্তা দিল না৷ তারা চলে গেলেন। তুলি মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলল,” আমার যে কত্ত মজা লাগছে! আপনি কি ম্যাজিক দেখালেন বলেন তো? চেয়ারম্যানের থোতা মুখ একদম ভোঁতা হয়ে গেল।”

প্রণয় মুচকি হেসে বলল,” আপনি খুশি?”

” খুশি মানে? দেখছেন না, আমি কিভাবে হাসছি? আমার হাসি তো থামছেই না। আচ্ছা, ওসি মামা আপনার কেইস কিভাবে নিলেন? আমিও মামলা করেছিলাম। কিন্তু দারোগা বেটা পাত্তাই দিল না।”

প্রণয় কিছু না বলে জানালায় তাকাল। তার ঠোঁটে অল্প হাসি। তুলিও এই বিষয়ে আর প্রশ্ন করল না। সে প্রণয়ের উদ্দেশ্যে বলল,” বাই দ্যা ওয়ে, আমি তুলনা সরকার। আপনি আমার নাম কিভাবে জানলেন?”

” জেনেছি। আপনার মামারা যখন বলছিলেন তখন শুনেছি।”

” মামারা না, আমার একজনই মামা। তবে এখন থেকে আমি তাকে ত্যায্য মামা করেছি। আমার না আপনাকে স্যরি বলতে ইচ্ছে করছে। আমার জন্য আপনি একের পর এক বিপদে পড়লেন। প্রথমে আপনার মোবাইল হারাল। তারপর গাড়িটাও গেল। আর এখন, এই রাত তিনটা বাজে থানার করিডোরে বসে থাকতে হচ্ছে।”

” ঠিক বলেছেন। এতো এডভেঞ্চারাস নাইট আমার জীবনে আগে কখনও আসেনি। আচ্ছা আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

” কি কথা?”

” আপনি বিয়ে করতে চান না কেন? ছেলেটা কি বেশি খারাপ?”

” ছেলে খারাপ না। কিন্তু আমাকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে হবে। এই বিয়ে হয়ে গেলে আমার পড়ালেখার স্বপ্ন ধূলিসাৎ। তাছাড়া আমি অনেক বড় হতে চাই।”

তুলির চোখ দু’টি স্বপ্নাতুরের মতো জ্বলে উঠল।তার পকপক করে কথা বলার অভ্যাসটা প্রথম দিকে বিরক্ত লাগলেও এখন প্রণয়ের ভালো লাগতে শুরু করেছে। তার মানে এই নয় যে সে তুলির প্রেমে পড়ে যাচ্ছে! আসলে এতোদিন শুধু মেয়ে মানুষের সঙ্গ খুব বিরক্ত লাগতো তার। তবে তুলির সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে মনে হচ্ছে, মেয়ে মানুষের সঙ্গ খুব একটা খারাপ না!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here