বেলাশেষে
অন্তরা
আমার বউ আমার সাথে প্রায়শই এমন করে। সামান্য কিছু হতেই ঘোষণা করে ‘ব্রেকআপ’।
আমাদের বিয়ের আগের প্রেমের সম্পর্ক ছিল সাড়ে তিনবছরের। দীর্ঘ এই সম্পর্ক চলাকালীন সময়ে যতবার আমি ওর অভিমান ভাঙাতে বলেছিলাম- ‘ভালোবাসি তো লক্ষ্মী’ ঠিক ততবারই ওর জবাব ছিল- ‘আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না!’ ওর সেই ‘না’ বলায় অদ্ভুত এক মাদকতা কাজ করতো। আর আমি তাই ওর সেই ‘না’ বলাটা শুনার জন্য কারণে অকারণে ওকে রাগিয়ে দিতাম। ব্যাপারটাকে ও মজা নয় সিরিয়াস ভাবে নিয়ে নিতো। রাগ করতো না তবে অভিমানে গাল ফুলিয়ে থাকতো। ওর শহর থেকে ক্রোশ কয়েক দুরে অন্য একটি শহরে নির্ঘুম বিছানায় আমিও সেটা বেশ অনুধাবন করতাম। বুঝতে পারতাম- অভিমানী আমার অভিমানে গাল ফুলিয়ে আছে। আর সেই সুযোগ টা কাজে লাগিয়েই বলতাম, ‘লক্ষ্মী! ভালোবাসি তো….’
জবাবে শুনতাম সেই বহুল আকাঙ্খিত শব্দ- কিন্তু আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না।
অদ্ভুত মাদকতায় ডুবে যেতাম পুনঃবার।
কিন্তু ওর সেই ‘না বলাটা’ একটা সময় হারিয়ে যায়।
ব্রেকআপের ৮মাস পর আমার সাথে ওর অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়েটা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি ও। যার ধরুন অভিমানে ও নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
তারপর অসংখ্য বার বলেছি ওকে নিজের ভালোবাসার কথা৷ পূর্বের নিয়মে ভাঙাতে চেয়েছি অভিমান। কাছে গিয়ে দু’গাল স্পর্শ করে বলেছি- ‘লক্ষ্মী! ভালোবাসি তো!….’
কিন্তু জবাবে আর কখনোই শুনিনি ওর মুখ থেকে সেই মাদকতায় ভরপুর বুলি- কিন্তু আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না!
বড্ড মিস করতাম আমি আমার আগের পাগলীটাকে। মাঝে মাঝে তো দু’চোখ গড়িয়ে জল নামতো। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। কারণ ওই যে! আমি ওর পরিবারের মতই ওর সিদ্ধান্তের কোন মূল্য দেইনি। স্বার্থপরের মতো বিয়ে করে ফেলেছি ওকে।
তারপর অনেকগুলো দিন কেটে যায়। কষ্টের পাহাড় গলতে শুরু করল। আমার মা তো প্রায়ই বলত, এটা নাকি সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত রহমত ছিলো!
যেই অভিমানী সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতো, আমার থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতো, নিজেকে কষ্ট দেয়ার নামে আমাকে কষ্ট দিতো, সেই অভিমানী কিনা নিজ থেকে আমায় কল করতো, ফোন এসএমএস করত। কখনো বা ছুটে চলে আসতো আমার গ্রামের বাড়িতে। আমার পরিবারের মানুষজনের কাছে।
জানি না, কোন সে বাঁধনে দিন সাতেকের ভেতর ও আমার পরিবারের প্রত্যককে বেধে ফেলে।
ও যখন বাসায় থাকতো পুরো বাড়ি জেগে থাকত। তেমনিভাবে ও যখন চলে যেত মনে হতো যেন বাড়িতে কিছু একটা হয়েছে। অদ্ভুত এক গুমোট বাধা পরিবেশ বিরাজ করতো চারিদিকে।
মাঝে মাঝে আমাকে না জানিয়ে ও ঢাকায় আমার কাছে ছুটে আসতো। চমকে দিতো আমাকে।
আমিও ওকে দেখে অমাবস্যার চাঁদ দেখার ন্যায় খুশি হতাম।
বহুদুর থেকে এসেছে। ক্লান্ত ও৷ নিজস্ব কাজ সেরে দ্রুত ছুটতাম রান্নাঘরের দিকে।
রান্না করতাম নিজ হাতে। আমার অভিমানী বউ এসেছে ঘরে। ওকে আজ নিজ হাতে খাওয়াতে হবে যে।
রান্না সেরে আমি যখন ওয়াশরুমে যেতাম তখন ও কিচেনে আসতো। ওয়াশরুম থেকে ফিরে দেখতাম ওর খাওয়া শেষ।
মনে ক্ষাণেক অভিমান জমতো কিন্তু বুঝতে দিতাম না ওকে।
রাতে রুমে গেলে পুরনো সেই নিষেধাজ্ঞা। খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু। একদম কাছে আসবেন না।
ভিষণ রাগী। না জানি কখন কি করে বসে। ভয়ে আমিও তাই পূর্বনির্ধারিত স্টাডিরুম টা ওর জন্য ছেড়ে দিয়ে নিজ রুমে চলে যেতাম।
দিন তিনেক এভাবেই চলতো। দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটি। কখনো বা দৃষ্টির আলাপন।
মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে ওর খুব কাছে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। জাপটে ধরে চুমু খেতাম ওকে।
সেবার প্রথম যখন ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ালাম ও কাঠের পুতুলের ন্যায় ব্যলকনীতে দাঁড়িয়ে ছিল ঘন্টাখানেক।
ব্যলকনী থেকে ও যখন রুমে ফিরে আসে তখন ওর চোখ আগুনের গোলার মতই লাল ছিল।
সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি পুরোটা দিনে একটা বারের জন্য ওর মুখ থেকে টু-শব্দটা পর্যন্ত আমি শুনিনি।
রাতে চুপটি করে রুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয়।
সেধেছিলাম আমি। খায়নি। পরে জানিনা রাতের খাবার খেয়েছিল কি না। সাহসও হয়নি দরজায় কড়া নাড়ার।
পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙার আগেই ও চলে যায়। ঘুম থেকে জেগে মাথার কাছেই টেবিলের উপর ওর ছোট্ট চিরকুট পাই। ‘বাসার জন্য মন কেমন করছিলো! তাই ভোরেই চলে গেলাম। বিদায়।’
সেদিন পাগলের মতো গেঞ্জি গায়েই বাসস্টপে ছুটে গিয়েছিলাম আমি। তবে পাইনি ওকে।
ফোন দেবো? সে সাহসও পাচ্ছিলাম না। বাসায় এসে কিছুক্ষণ হো, হো করে কেঁদে চেম্বারে চলে যাই।
বিকেলে চেম্বার থেকে ফিরে সেদিনই প্রথম সিগারেটে হাতে নেই। এক টানও দিতে পারিনি।
তার আগেই ওর কল। রিসিভ করে ওর সালামের জবাব আর দিতে পারিনি। সিগারেটের ধোয়ায় কাশি শুরু হয় আমার।
বুড়ো মানুষের মতই কাশছিলাম অনেকক্ষণ। ও সেটা নিরবে শুনে কলটা কেটে দেয়।
রাত্রি নয়টার দিকে শ্বশুর আব্বার কল আসে। ওনার ভাষ্যমতে আমার যক্ষা হয়েছে। সেটা শুনে ওনার মেয়ে সবার চোখ এড়িয়ে বিকেলের দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যায় ঢাকার উদ্দেশ্য।
কোথায় রান্না, কোথায় কি? ফোন হাতে পাগলের মতো ছুটলাম বাসস্টপের দিকে।
ও তখন ওভার ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে কোথাকার গাড়ি কোথায় যাচ্ছে সেই হিসাব মেলাতে ব্যস্ত।
সেদিনই প্রথম জোরে কয়েক টা থাপ্পর দিয়েছিলাম ওকে।
ঠোঁট বাকিয়ে ছোট বাচ্চাদের ন্যায় কান্না করে দেই ও।
বুকে চেপে ধরি ওকে। শক্ত করে বুকে চেপে ধরি আমি ওকে।
বুকে জড়ানো অবস্থায় দাঁড়িয়ে থেকেই ওর জবাব আসে, ব্রেকআপ। তোর সাথে আমার ব্রেকআপ। ছাড় আমাকে। ছাড় বলছি….
বুক থেকে সরিয়ে দু’গাল স্পর্শ করি ওর।
চোখে আনন্দ অশ্রু আর মুখে হাসি আমার। প্রশ্ন করলাম, কি যেন বলছিলা? আবার বলো তো….
চেঁচিয়ে ওঠে ‘ও’। তোর সাথে আমার ব্রেকআপ।
ওর চেঁচানো শুনে অদুরেই দাঁড়িয়ে থাকা দু’জোড়া কপোত কপোতী ছুটে আসে আমাদের কাছে।
কি আপু! সমস্যা কি? ওনি কি কিছু বলেছে আপনাকে? আই মিন টিজ….
যুবকটার পুরো কথা শেষ হতে পারেনি তার আগেই ও আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে।
ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে যায় ওরা। আমিও যে চমকে যাইনি তাও কিন্তু নয়।
বিনীত ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল যুবক টি। তখনি আমার বউয়ের কন্ঠস্বর ভেসে আসে- বললাম তো তোর সাথে আমার ব্রেকআপ। আগামী তিন দিন কোন রকম কথা হবে না তোর সাথে আমার।
সুখের কান্নাটা আর আটকাতে পারিনি। পারিনি হাসিটাও লুকাতে। টপ করে যখন দু’ফোটা জল চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে তখনি উঁচু গলায় হেসেও উঠি।
আমার হাসিতে চারিদিক মুখরিত। লক্ষ্য করলাম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জোড়া কপোত কপোতীও অদ্ভুত হাসিমুখ নিয়ে গন্তব্যে ফিরছে।
জানি না ওদের হাসির কারণ কি? হতে পারে আমাদের পাগল ভেবেছে। তাতে কি? বেলা শেষে পাখি তার আপন নীড়ে ফিরেছে এটাই বা কম প্রাপ্তি কিসের?
#বেলা_শেষে
রচনায়- অনামিকা ইসলাম ‘অন্তরা’