বেলাশেষে পর্ব -২১+২২

#বেলা_শেষে। [২১]

প্রকৃতিকে জ্যোতির অলংকার পরিয়ে নিঃশব্দ পায়ে সন্ধানামে পৃথীবিতে। প্রবীন দিনকে পিছনে ফেলে অচেনা অনবদ্য রুপে সন্ধারানী এসে হাজির হয়, তবে সন্ধা বড়ই চঞ্চলা। এসেই বিদায় নেয়ার জন্যে প্রস্তুুত হয়ে পড়ে।বড়ই রহস্যময়। কুলায় ফেরা পাখির মতো সন্ধা মানুষকে ফিরিয়ে আনে ঘরে। প্রকৃতির রং বদলাতে থাকে। বিষাদিত গভীর মমতায় গাঢ় ছায়া সন্ধাসাবিদা পশ্চিম গগনে ডুবে যায়। হালকা আধার চারিদিকে ছড়িয়ে পরে দূরের দৃশ্যবলি ক্রমশ অস্পষ্ট হতে হতে এক সময় আধারের সাথে মিলে একাকার হয়ে যায়। বড়ই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।এমনি একটা দৃশ্য দেখেও মন ভালো হচ্ছে না নয়নার। এক ঝাকা গাঁদাফুল গাছের সামনে দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে সে। ভূমিকা নিতু আর নয়নার ছোট বোন নীলা তাকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। নয়না কারো কোন কথাই কানে তুলছে না। আর না ওর কান্নার কারনটা বলছে। আজ নয়নার গায়ে হলুদ । কাল ওর বিয়ে। নয়নার বিয়ের কারনেই নিতু ভূমিকাকে নিয়ে ওর গ্রামে আসে। নিতু অনেক আগেই ভূমিকার সম্পর্কে তার বাবা মা-কে বলেছে যার কারনে তারা তাকে খুব বেশী আপন করে নিয়েছে। কিছুক্ষণ পর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। আত্মীয়স্বজন বাড়ি ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। নয়নাকে রেডি করতে হবে অথচ সে এখান থেকে উঠছেই না। বিয়ের সময় মানুষ কাঁদে এটা স্বাভাকিক তবে, সেটা তো বিদায়বেলায় তাহলে নয়না এখনি এত কাঁদছে কেন?

কিছুক্ষণ পর নয়নার মা এসে নয়না কে ডাক দিলো। মায়ের কন্ঠশ্বর কানে আসতেই চোখের পানি মুছে অধরে হাসি ফুটিয়ে তুলে সে। এখন নয়নাকে দেখলে কেওই বলবে না এতক্ষণ এই মেয়েটার চোখে অঝরে বৃষ্টি ঝড়ছিল।বাধ্য মেয়ের মতো মায়ের কথা শুনেই নিজের রুমে চলে যায় নয়না। আর ওর পিছনে যায় ভূমিকা,নিতু আর নিলা। নয়নাকে রেডি করতে।

দিগন্ত আর মিমি দুজনে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে আজ। এক্কেবারে সামাজিক, ও ইসলামিক নিয়ম মেনে বিয়ে করেছে তারা। মিমিদের বাড়িতেই বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছে। মাশহুদ ও তার গিন্নী কেও- ই আসেনি এই বিয়েতে। মিমির বাবা তার নিজ বাড়িতে ঘটা করে অনুষ্ঠান করে দুজনের বিয়ে সম্পন্ন করলেন। দিগন্ত আর মিমিকে নিয়ে মিমির বাড়ির সকলে অনেক খুশি। খুশি হবেই না কেন, এই দিগন্ত আজ বাদে কাল আণবিক সংস্থায় চাকরি করবে। হয়তো একদিন সে অনেক বড় সাইন্টিস হবে। এমন জামাই কে না চায়। বিয়ে শেষে দিগন্ত মিমিকে নিয়ে তার ফ্ল্যাটে ফিরে আসে। নিয়তির কি অদ্ভুত খেলা, একদিন এই ফ্ল্যাটেই সে ভূমিকাকে নিয়ে এসেছিল। তবে সেটা বউ করে নয়। কাগজে কলমে সই করে বউ নামক কাজের মেয়ে করে নিয়ে এসেছিলো সে। আর আজ সেই ফ্ল্যাটে বউ হয়ে এসেছে মিমি।

ফ্রেশ হয়ে একটা পাতলা সাদা শাড়ি পরে নেয় মিমি। হাতা কাটা ব্লাউজের সাথে সাদা শাড়িতে যে কাওকে অনেক মসৃণ লাগে। এই কোমলতা যে বড্ড বেশী ভয়ংকর। এই মসৃণতা বিবাহিতদের মনে এক নতুন ভালোবাসার আবাহন জানায় । তাদের আমন্ত্রণ জানায় এক অন্য দুনিয়ার। সেখানে ভালোলাগা আর ভালোবসায় একে অপরের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আর অবিবাহিতদের জন্যে এই ভয়ংকর মসৃণতা ডেকে আনে এক রাশ পাপের সম্রাজ্য।

ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে টাওয়ার দিয়ে চুল মুছছে মিমি। শাড়ির আঁচলটা তার হালকা করে পেটে গুজে দেওয়া। দিগন্ত এতক্ষণ বারান্দার ছিলো। রুমে আসতেই তার চোখ পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক স্নিগ্ধ রমনীর দিকে। যার কোমল হাতের স্পর্শে মাথার চুলগুলো বারবার কেপে উঠলো। কিছুক্ষণ সেই রমনীর দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্যে চোখ সামনের দিকে ফেরাবে তখন তার চোখ আটকিয়ে যায় মিমির আঁচল গুজে রাখা সেই নিষিদ্ধ স্থানে। মুহূর্তেই দিগন্তের চোখে এক প্রখর নেশা কাজ করে। ধীর পায়ে সে মিমির দিকে এগিয়ে যায়। মিমির কাছাকাছি এসেই সে মিমির উন্মুক্ত পেটে চেপে ধরে। সাথে সাথে মিমির হাত থেকে টাওয়াল নিচে পরে যায়। দিগন্ত আয়নায় থাকা মিমির প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে,

-কিছু দেখছে পাচ্ছো প্রিয়সি??

মিমির মুখে ঝেকে বসে একরাশ লজ্জা। সে লজ্জা নিবারণের জন্যে দিগন্তের বুকে মুখ গুজে দেয়। দু-হাতে দিগন্তের ট্রি-শার্ট খামছে ধরে বলে,

-প্রখর নেশা তোমার ওই দু-টি আঁখি জুড়ে।

-এই নেশা যে তোমাকে নেশাক্ত করতে চায় প্রিয়সী । দিগন্তের কথা শুনে মিমি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। হাত পা কাঁপছে তার। দিগন্ত মিমির উত্তরের অপেক্ষা করলো না। সে মিমিকে পাজা কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো।

লেপটপের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে রাকিব। কিছুক্ষণ আগে আরাভ তাকে কিছু কাজ দিয়েছে। ম্যানেজারের করা ভুলগুলি ঠিক করতে দিয়েছে তাকে। এতদিন আরাভ নিজেই করতো এসব কাজ। কিন্ত ভূমিকা আসার পর থেকে তো সেই করে যাচ্ছে এই কাজগুলা। আরাভের অভ্যাস চেঞ্জ হয়েগেছে। আরাভ তার চেয়ারে আরাম করে বসে তাকিয়ে আছে রাকিবের দিকে। রাকিবের চোখ তো লেপটপের দিকে কিন্ত ওর হাত আর মুখের রিয়্যাকশন বলছে রাকিব কোন কাজ করছে না। আরাভ কয়েকবার রাকিবকে ডাকলো কিন্ত রাকিব কোন রিসপন্স করলো না। আরাভ এবার সিউর হলো রাকিব কোন কাজ-ই করছে। কোন কিছু দুশ্চিন্তা করতে সে। ছোটবেলার বন্ধু রাকিব। একসাথে স্কুল কলেজ ভার্সিটিতে পড়েছে। ওরা একে অপরের মুখ দেখলেই সব বুঝতে পারে। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। রাকিবের মন খারাপ দেখে আরাভ গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালো তারপর লেপটপ বন্ধকরে দিলো। তাতেও রাকিবের হুস ফিরলো না। আরাভ রাকিবের কাদে হাত রাখলো। তখনি চমকে উঠে রাকিব। আর বলে,

-কে – কে??

-রিল্যাক্স, ভয় কেন পাচ্ছিস।

-ওহ তুই??

-এভাবে মন খারাপ করে বসে আছিস কেন??এ্যনি প্রবলেম??

রাকিব তার অধরে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে বলল,
-নাহ, আই এম ফাইন।

-সেটা দেখতেই পাচ্ছি। বল কি হয়েছে। দেখ রাকিব এদম আমাকে মিথ্যে বলার চেষ্টা করবি ন। ডোন্ট টেল মি লাই। আরাভের কথা শুনে রাকিবের চোখ ছলছল করে উঠলো। রাকিব অস্ফুটভাবে বলে উঠলো,

-নয়না, আমার নয়নাকে ফিরিয়ে আনতে পারবি। বল পারবি।

রাকিবের কথা শুনে আরাভ মনে হয় আকাশ থেকে বলল। অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে রাকিবের মুখ পানে। রাকিব আবারও বলে উঠলো,

-আমি নয়নাকে ভালোবাসি, ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারবি।

– মিছ নয়না জানে এসব।

-হুম। আমরা দুজন দুজনকেই ভালোবাসি।

-তাহলে মন খারাপ করছিস কেন? মিছ নয়না ফিরে আসবে। কয়েকদিনের জন্যেই তো গেছে।

-আজ নয়নার বিয়ে। ওর বাবা ওকে বিয়ের জন্যে ডেকেছে। রাকিবের কথা শুনে চোখ দুটি ছোটছোট হয়ে এল আরাভের।

-মিছ নয়নার বাড়ির ঠিকানা জানিস তুই??

-হ্যাঁ জানি। কেন??

-এখন চল। যেতে যেতে কথা বলা যাবে। বলেই অফিস থেকে বেড়িয়ে যায় আরাভ। আর আরাভের পিছন পিছন যায় রাকিব।

সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে নয়নার কান্নার তীব্রতা যেন বহু গুনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর পক্ষ চলে এসেছে সেই কখন। সবাই নয়নার বর দেখতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হইবে।

নয়না আর তার হবু বরকে পাশাপাশি বসিয়ে রাখা হয়েছে। কাজি সাহেব এখনি তাদের বিয়ের কালেমা পাঠ করবেন। নয়না শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার সামনে থাকা মানুষগুলির দিকে। কেন জানি নয়নার মনে হচ্ছে রাকিব আসবে। তাদের ভালোবাসাটা এভাবে শেষ হতে পারে না। রাকিবকে আসতেই হবে । ঠিক সেটাই হলো। কাজি সাহেব বিয়ে কালেমা পাঠ করার আগেই আরাভ আর রাকিব চলে আসলো। রাকিবকে দেখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো নয়নার অধরে। সে লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে সকলের সামনে রাকিবকে জড়িয়ে ধরলো। রাকিবও তার প্রিয়সীকে শক্তকরে জড়িয়ে নিলো তার বুকে।

ওদের দু-জনকে এমন ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে উপস্থিত সকলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আসলে এখানে কি হচ্ছে সেটাই বুঝার চেষ্টা করছে সবাই। সকলে ধ্যান ভাঙিয়ে আরাভ বলে উঠলো,

-এই বিয়েটা বন্ধ করুন।
উপস্থিত সকলে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে আরাভের দিকে।আরাভ আবার বলে উঠে, এই বিয়ে হবে না। বন্ধকরুন। ভূমিকা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়ি সবটা দেখছিলো। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না কেন নয়না এত কাঁদছিল?? নয়না রাকিব ভাইয়াকে ভালোবাসে এটা সে আগে কেন বলেনি । ভরা বিয়ের অনুষ্টানে তার বাবা মা-কে এখন অপমানিত হতে হবে। নয়না আপি যথেষ্ট শিক্ষিত মেয়ে। বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন, তাহলে এই ভুলটা সে কি করে করতে পারলো।

বিয়ের আসরে পর পুরুষকে জড়িয়ে ধরা মেয়েকে সহজে কেও বাড়ির বউ করবে না। নয়নার হবু বরের বাড়ির লেকেরাও সেটাই করলো। তারা বিয়ে ভেঙে চলে গেলো । এই রকম নির্লজ্জ বেহায়া মেয়েকে তারা তাদের বাড়ির বউ কিছুতেই করবে না।
#বেলা_শেষে। [২২]

বাড়ির উঠোনে মাদুর পেতে বসে আছে ভূমিকা নিতু নিলা ইভান নয়না রাকিব আর আরাভ। উঠোনের পাশে হাসনাহেনা ফুলের সুভাসে মো মো করছে চারিদিক। হাসনাহেনার মন মাতানো সৌরভে আজকের রাতটা আরো বেশী মধুময় হয়ে উঠেছে। মাথার উপরের চাঁদ মামা যেন আজ তার সমস্ত আলো বিলিয়ে দিয়েছে। চাদের জ্যোৎস্নার চারিদিক স্নিগ্ধ লাগছে। শহরের মতো গ্রামে হয়তো আকাশ ছোয়া দালান নেই। নাই রকমের লাইটিং। কিন্ত গ্রামের মতো স্নিগ্ধ সুন্দর পরিবেশ সাধারণত শহরে হয় না। কিছুক্ষণ আগেই নয়না আর রাকিবের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। তখন যখন নয়না সকলের সমনে রাকিবকে জড়িয়ে ধরলো। তখনি সকলে নয়নার নামে বাজে মন্তব্য করা শুরু করে দেয়। চারিদিকে সবাই যখন নয়নার নামে হাজারো কথা বলছিল তখন নয়নার বাবা হাতের মুঠি শক্তকরে চেপে ধরে জিহ্বা কামড়িয়ে শুনছিলো। এক পর্যায়ে তার ধর্যের রেখা অতিক্রম করে। আর সে নিজেকে সামলাতে না পেরে নয়নার গালো সজোরে চড় বসায়। টাল সামলাতে না পেরে নিচে পরে যায় নয়না। রাকিব ওকে উঠাতে চাইকে তার গালেও চড় বসায় নয়নার বাবা।

-এভাবে অপমান করলি আমাকে। কেন করলি এটা নয়ন। বলেই নয়নার বাবা আবারও নয়নার গালে চড় বসায়। নয়নার মা আটকাতে চাইলে তাকেও মারার জন্যে হাত উঠায় নয়নার বাবা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে মারতে পারে না

-কি করছো তুমি এটা? এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তুলছো। মাথাটা কি একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে তোমার? নয়নার মায়ের কথা শুনে নয়নার বাবা দিগুণ রেগে গেলে। সে ঝাঁঝালো গলায় বলল,

-আমার মাথা ঠিক আছে। এখনো যে ওকে কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়নি। সেটা ওর বাপের ভাগ্য ভালো। জিগ্যেস করো ওকে কেন আমাদের মান সম্মান এভাবে ধূলয় মিশিয়ে দিলো।

বাবার কথা শুনে ভয়ে কাঁপছে নয়না। তার বাবার রাগের সম্পর্কে সে আগে থেকেই অবগত। এই মেয়েটা কোন দিনও তার বাবার সামনে মাথা উচু করে কথা বলে দেখে নি। ছোট বেলায় একবার নয়নার পা ভেঙে ছিলো। আম গাছ থেকে আম পারতে গিয়ে গাছ থেকে পরে গিয়েছিল। সেদিনও নয়নার বাবা আদর করার পরিবর্তে ওকে মেরেছিলো। নয়নার একটাই অপরাধ সে কেন গাছে উঠলো। নিচের দিকে তাকিয়ে সমান তালে কেপে যাচ্ছে নয়না। তার বাবার কোন কথাই তার কান পর্যন্ত পৌছাচ্ছে না। ভূমিকা দূরে দাঁড়িয়ে নয়নাকে দেখে যাচ্ছে। এই নয়না কে বড্ড অচেনা লাগছে তার কাছে। একদিন এই নয়না তাকে সাহস যুগিয়েছিল। দিগন্তর থেকে আলাদা হওয়ার মতো একটা কথাও বলেছিলো সে। অথচ আজ সেই মানুষটা নিজের ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে বলতে পারছে না ।

নয়নার বাবা মেয়েকে মেরে কিছু কথা শুনিয়ে শান্ত হয়ে চেয়ার বসে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন। হয়তো কিছু ভাবছেন তিনি। আরাভ এতক্ষণ ওনার রাগ দেখছিলেন। আর নয়নার দিকে তাকাচ্ছিল, হয়তো নয়না কিছু বলবে। না, নয়না সেটা করলো না। সে যে নিচের দিকে তাকাচ্ছে তো তাকাচ্ছে, মাথাতুলে সামনে তাকানোর মত অপরাধ সে কিছুতেই করবে না। হয়তো এটাই পণ করে নিয়েছে সে। রাকিব নয়নার পাশেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আরাভ দু-হাতে নয়না আর রাকিবের হাত ধরে নয়নার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর রাকিব আর নয়নার সম্পর্কের কথা তাকে বললেন। নয়নার বাবা কোন প্রতিক্রিয়া করলো না। এখনো আগের ন্যায় মাথা নিচু করে বসে রইলো। অতঃপর আরাভ বলল,

-এভাবে চুপ করে থাকবেন না আংকেল। হয় ওদের শাস্তি দেন আর নয়তো ওদের মাফ করে দেন। আরাভের কথা শুনে মাথা তুলে সামনে তাকালো নয়নার বাবা।অতঃপর আরাভ আবারও বলে উঠলো,

-প্লিজ আংকেল, ডোন্ট বি সাইলেন্ট। মানছি ওরা ভুল করেছি। ওরা তো দুজনেই ছেলে মানুষ। আপনি তো বাবা ওদের মাফ করে দিন। আপনার উচিৎ ওদের ভূলগুলো মাফ করে ওদের সঠিক পথ দেখানো।

-ওরা যে ভুল করছে তার কোন ক্ষমা হয়না। নয়নার বাবার কথায় আশাহত হলো আরাভ। ভেবেছিলো সে ওদের ভালোবাসাকে মেনে নিবে। রাকিব গিয়ে নয়নার বাবার সামনে হাটুগেরে বসে পরলো। তারপর সে হাত জোড় করে তার কাছে মাফ চাইতে লাগলো। আর নয়না আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। কেননা তার সহস নেই বাবার সামনে নিজের ভালোবাসার কথা বলার।

অবেশেষে অনেক বুঝানোর পর নয়নার বাবা ওদের ভালোবাসা মেনে নেয়। ওদের বিয়েও দেয়। শর্ত একটাই। বিয়ের পর নয়না রাকিব কেওই ওনার বাড়িতে থাকতে পারবে না। আরাভ ও কম কিসে। সে সিদ্ধান্ত নেয় যতক্ষণ না নয়নার বাবা ওদের দুজনকে মেনে নিবে ততক্ষণ ওরা এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। তাইতো উঠোনে মাদুর পেতে বসে আছে।

চাঁদের স্নিগ্ধ ভূমিকার মুখে পরে ওর মুখটাকে আরো বেশী মায়াবি করে তুলেছে। আরাভ আড় চোখে বারবার ভূমিকাকে দেখছে। ওর মনে হচ্ছে সে এই মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে কাটাতে পারবে কয়েক যুগ। এত মায়া কেন এই চোখ দুটিতে। এই চাহনিতে যে আমি খুন হয়ে যাই বারংবার। সে কি জানে সেই কথা। তার প্রতিটা হাসিতে খুন হই আমি। মুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সে ভূমিকার দিকে।

সবাই চুপচাপ বসে আছে দেখে নীলা বলে উঠলো, সবাই কি এভাবে মুখে আঙ্গুল দিয়া বইসা থাকবা নাকি। আমাদের আসরটাকে একটু জমাও। বর বউ নিয়ে বসে আছি আমরা এভাবে চুপচাপ থাকলে চলে নাকি।

শহরে মানুষ আসর জমানো বলতে তারা একটা বুঝে ড্রিংক করা ওয়াইন, রাম ওয়িস্কি, বিয়ার ছাড়া যেন তাদের আসর জমেই না। তাই রাকিব বলে উঠলো,

-কি দিয়ে আসর জমাবো?? এখানে তো কিছু নেই।

-কি দিয়ে আসর জমাবো মানে। চলুন আমরা ট্রুথ আর ডেয়ার গেম খেলি। তবেই দেখবেন আমাদের আসর জমে উঠছে। নিলার কথায় সম্মতি দেয় সবাই।

গিন্নী ছেলেমেয়েগুলো কি এখনো উঠোনে বসে আছে?? বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে জিগ্যেস করলো নয়নার বাবার। তার কথার প্রতিউত্তরে নয়নার মা বলল,

-কি আর করবো, তুমি তো ঘরে থাকতে দিলা না। আজ রাগটুকু উঠোনে থেকে, শুনছি কাল নাকি শহরে চইলা যাইবো। আমার মেয়েটাকে এভাবে পর কইরা দিলা তুমি।

-ওগো সবাই রে ঘরে আইয়া শুইতে কও। শহরে থাকে, ডরভয় পাইলো পরে আমাগোই বিপদ অইবো। কথাটা বলেই বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে রইলেন তিনি। তার কথায় নয়নার মা মৃদু হাসলো অতঃপর বলল,

-মানুষটা নিজেকে যতটা কঠিন দেখয়। ভেতরে ঠিক ততটাই নরম।

চারিদিকে গোল হয়ে বসে আছে সবাই। ওদের মাঝখানে রয়েছে একটা বোতল। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বোতলের দিকে। ইভান বোতলটা ঘুড়িয়ে দিয়ে। সেটা গিয়ে থামলো নিতুর দিকে। নিতু আগেই ট্রুথ নিয়ে বসলো। আর ওকে প্রশ্ন করলো নীলা,

-তোর বয়ফ্রেন্ডের নামটা যেন কি?? ভ্রু নাড়িয়ে জিগ্যেস করলো নীলা।

-এসব প্রশ্ন করার কি মানে? একটু রেগে গিয়ে বলল নিতু।

-নিতু তোর বয়ফ্রেন্ড আছে। অবাক হয়ে জিগ্যেস করলো নয়না। ওর সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ভূমিকা।

-আগে তো কখনো বলিস নি আমাদের।

নিতু আড় চোখে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল, ইভান ই তো বলতে নিষেদ করেছে। আর ওই আমার বয়ফ্রেন্ড।নিতুর কথা শুনে নয়না নীলা আর ভূমিকা বড় বড় চোখ করে তাকালো। ওদের চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম। ইভার ইভার অন্যদিকে ঘুরে তাকালো। সে এই মুহূর্তে কারো কথা শুনতে নারাজ।

-কত দিনের রিলেশন তোদের? [নীলা]

-আমার ট্রুথ পালন করা শেষ। তাই দ্বিতীয় কোন প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য নয় আমি। ইভান আবারও বোতলটা ঘুড়িয়ে দিলো। এবার বোতল থামলো দিয়ে রাকিবরে দিকে। ভূমিকা আগেই বলে উঠলো, আমি ডেয়ার দিবো।

-কিন্ত আমিতো ডেয়ার চুজ করিনি।

-করতে হবেও না। শুধু আপনার আর নয়না আপুর একটা কাপল ডান্স দেখতে চাই। ভূমিকার কথায় তাল মিলালো নিতু ইভান আর নিলা। রাকিব আড় চোখে আরাভের দিকে তাকালো। সেই চোখের ইশারায় রাকিবকে ডান্স করতে বলল।। রাকিব ইনোসেন্ট মুখ করে বলল ওকে ডান। তারপর নয়নাার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। নয়না লজ্জায় মাখা মুখ নিয়ে রাকিবের হাতে হাত রাখে অতঃপর তারা দুজনে মিলে কাপল ডান্স করে। তৃতীয়বারের মতো বোতল ঘুরে গিয়ে আরাভের দিকে। তখনি রাকিব বলে উঠে আমি প্রশ্ন করবো।

আরাভ ভেবেছিল সে ডেয়ার নিবে। কিন্ত আগেই রাকিব বলে উঠে সে প্রশ্ন করবে। তাই তাকে ট্রুথই নিতে হলো।

-আজকাল তোর কথা বার্তা চালচলন দেখে মনে হয় তুই কারো প্রেমে পরেছিস। এটা কি সত্যি। আর যেই সুভাগ্যবতির প্রেমে পরেছিস তার সম্পর্কে কিছু বল। আমারও জেনে নেই কেমন আমাদের ভাবি। [রাকিব]

-একজনকে খুব করে ভালোবেসেছি আমি। তার চোখে দিকে যখন তাকাই মনে হয় পুরো পৃথীবিটা কত সুন্দর। কারন তার চোখে আমি আমার পৃথীবি দেখতে পাই। তার হাসি দেখলে আমার মনটা এমনিতেই হেসে উঠে। কারন সব চাওয়ার মধ্যে তার হাসিটাই আমার কাছে প্রধান। তার হাসিতে আমি এক পৃথীবি সমান সুখ খুজে পাই। কথাগুলো বলেই উঠে দাঁড়ালো আরাভ। সবার থেকে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়ালো। পকেটে দু-হাত গুজে তাকিয়ে রইলো ও জ্যোৎস্নাময় চাদের দিকে। আরাভের পিছু পিছু রাকিবও এসে দাঁড়ালো ওর পাশে। সে আরাভের কাদে আলতো করে হাত রাখলো। তারপর বলল,

-সেই সৌভাগ্যবতীটা কে যাকে আমার বন্ধু এতটা ভালোবাসে।রাকিবের কথা শ্রবণ করতেই পিছন ফিরে তাকায় আরাভ। ভূমিকার দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে আনমনেই বলে ফেলে,

-আমার মায়াবতী।

আরাভের দৃষ্টি বারবার রাকিব তার দৃষ্টি রাখে। যখনি তার দৃষ্টিতে ভূমিকার মুখ পরে তখনি সে আরাভের দিকে তাকিয়ে বলে,

-এটা তুই কি করছি আরাভ। আগুন জেনেও ঝাপ দিচ্ছিস। কয়লা হয়ে উঠবি। রাকিবের কথা শুনে মৃদু হাসে আরাভ। অতঃপর সে রাকিবের গালে আলতো করে স্পর্শ করে বলে,

-দহন না হলে প্রেমিক হবো কি করে।

চলবে,,,,,,

#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here