#বেলা_শেষে_ফেরা
#পর্ব_১৪
#লেখনীতে_Suchona_Islam
রাতে মুনিয়ার রুমে তূর্ণা বেডে শুয়ে শুয়ে তন্ময়ের কথা ভাবছে। আজ তন্ময় পাঞ্জাবী পরে আসে নি। এসেছিলো একটি হোয়াইট কালারের শার্ট পরো। তূর্ণা তন্ময়কে আগে কখনো’ই পাঞ্জাবী’তে দেখেনি। তাই একটু আফসোস হচ্ছে তূর্ণার।
অপরদিকে মুনিয়া সারা ঘরে পায়চারী করছে ফোন নিয়ে। মুনিয়া ভেবেছে আসাদকে জানিয়ে একটা প্ল্যান করা উচিত। কিন্তু আসাদ-এর ফোন বন্ধ কেন আসছে, তাতে’ই চিন্তা মুনিয়ার। কোনো বিপদ হলো না তো। তাই উপায় না পেয়ে তূর্ণার কাছে বসে কান্না’ই করে দিলো। তূর্ণা অন্যমনস্কে ছিলো, মুনিয়ার কান্নার আওয়াজ পেয়ে ধড়ফড়িয়ে বিছানায় বসে পরলো। চিন্তিত হয়ে তূর্ণা মুনিয়াকে বলতে লাগলো, “কিরে এভাবে কান্না করছিস কেনো? কি হয়েছে তোর?”
“মদন’টা আমার ফোন ধরছে না। আমার টেনশন হচ্ছে।” কান্না করতে করতে’ই জবাব দিলো মুনিয়া তূর্ণাকে। তূর্ণা ব্যাপারটা এবার বুঝতে পেরে মনে মনে ডেভিলনী (ফিমেল ভার্শন) হাসি দিলো। ফোন তো সে সুইচড অফ করে রেখেছে আসাদ-এর।
আসাদে’র তখনকার কথা মনে পরতেই তূর্ণা হেসে দিলো। মুনিয়া তূর্ণার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। তূর্ণা হাতসে হাসতে’ই মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ওমন করে কি দেখস!”
“তোকে!”
“কেন আমাকে জীবনে দেখিস নাই।”
“তুই আমার বান্ধুবী নাকি শত্রু আমি তাই’ই ভেবে পাই না আমি।”
“আমি কি করছি যে আমাকে তুই শত্রু’ই বানায় দিলি।”
“তো আমি কি হাসির কথা বললাম তোকে!”
“ওহ আচ্ছা এবার বুঝেছি, আমি তো অন্য কথা ভেবে হাসছি।”
“তা আপা শোনান আমাকে আপনি কি ভেবে হাসছেন। আমি’ও এই দুঃখের সময় হাসি একটু।”
“হু! আমার মনে হয় আসাদ নিশ্চয়ই বন্ধু বা কাজিনদের নিয়ে ড্রিঙ্কস করছে। না হলে তোর ফোন ধরবে না আর আমার ঘুমের তেরোটা বাজাবে না এটা হতেই পারে না।”
তূর্ণার এই কথা শুনে মুনিয়া তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। সে আসাদ’কে বারবার মানা করেছে যেন সে ড্রিংক না করে। কিন্তু মুনিয়া তো জানে না আসাদ-এর ফোন তূর্ণার কাছে। তূর্ণা আবার’ও হেসে দিলো। এবার মুনিয়া রাগে বেলকনিতে চলে গেলো। তূর্ণা জয়ের হাসি শুয়ে শুয়ে’ও হাসছে।
………………………
“ডার্লিং আমায় ভুল বুঝিস না। শয়তান্নী আমার ফোন নিয়ে গিয়েছে। আমি তো ভালোমত তখন ছিলাম’ই। তোকে দেখে’ই তো চলে আসছি। এখন ভাইয়ার ফোনটা একঘন্টার জন্যে রেখে দিয়েছি। তাই তোকে মেসেজ করলাম। সোনা ভুল বুঝিস না আমায়।”
মুনিয়া মেসেজটি দেখেই আসাদ-এর উপর রাগটা কিছু’টা কমিয়ে তূর্ণার উপর ক্ষিপ্ত হয়েছে। পরোক্ষনে’ই সে আসাদকে ফোন করতে বলে মেসেজের মাধ্যমে। আসাদ ফোন দিলে তন্ময়ের কথা বলে। তারা দু’জনেই ভেবে একটা প্রি-প্ল্যান করলো। তারপর তূর্ণার বলা ড্রিংকের কথা মনে পরতেই মুনিয়া প্রশ্ন তুলে ধরলো আসাদকে।
“তুই খেয়েছিস!”
“না সোনা আমি খাই নি বিলিভ কর।”
“ওকে করলাম।”
পাশে থেকে আসাদ-এর এক কাজিন ভাই বলে উঠলো ফোনটা দিতে এবং পার্টিতে ড্রিংকের কথা উঠালো। ওরা তো কথা বলে চলেছে ফোনের লাইনটা আর কাটে নি। মুনিয়া যে-ই শুনেছে আসাদ এক বোতল শেষ করেছে, ওমনে’ই আসাদকে বকতে শুরু করলো, “আসাদ এর বাচ্চা। তুই মাত্রই না বললি ড্রিঙ্কস করিস নি। এখন এগুলা কি তোর বাচ্চা খেয়েছে।”
“না সোনা বাচ্চা তো তুই দিবি। তারপর না হয় বাচ্চা’কেও আমার মতো খাওয়াবো নি। হেহেহে।”
“হনুমানের বাচ্চা তুই কাল বিয়ে করতে আয় শুধু আমায়, তোর বিয়েতে’ই তোকে আমি কাবাব বানিয়ে খাবো।” এ বলে’ই রাগে লাইন কেটে দিলো মুনিয়া। আসাদ জানে কাল বিয়ের দিনে’ও মুনিয়া তাকে ছাড়বে না।
“ভাই দিলে তো আমার তেরাটা বাজিয়ে। কাল বিয়ে’ই হবে কিনা তাই সন্দেহজনক।”
“হেহেহে।”
“এখন বেয়াক্কলের মতো না হেসে নাও ধরো তোমার ফোন।”
বেচারা মন খারাপ করে ঘরে গিয়ে’ই শুয়ে পরলো।
“ওই শয়তান্নী। তূর্ণা উঠ।”
“কি সকাল হয়ে গিয়েছে!” ঘুমঘুম চোখে তূর্ণা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো এখনো রাত’ই। তাই বিরক্ত হয়ে সে মুনিয়াকে বললো, “সারাদিন তোর বিয়ের কাজ করি আর রাতে আমাকে শান্তিতে একটু ঘুমোতে’ও দিবি না। যা তোর বিয়েতে’ই থাকবো না আমি।”
“মহারাণী। আপনার আর উল্টা রাগ দেখানো লাগবে না। আর আপনি যে আসাদ-এর ফোন নিয়েছেন সেটা এখন ফিরত দেন।”
“কককি বলছি এএএসব।” আমতা আমতা করছে তূর্ণা। শেষে মুনিয়ার কাছে ধরা খেলো সেই।
“এতো আমতা আমতা করতে হবে না। ফোন দে। বেচারা আমাকে তার ভাইয়ের ফোন দিয়ে টেক্সট করে বলেছে সবটা।”
“এখন না সকালে দিবো।”
“না এখন’ই দিবি। সকালে তোকে আর পাবো কোথায় আমি। তন্ময় ভাইয়াকে দেখলে’ই তো তোর মনে কারেন্ট বয়ে যায়। তারচেয়ে বরং এখুনি দে।” তূর্ণাকে এখন একটু টাইট দিচ্ছে মুনিয়া।
তন্ময়ের কথা শুনে’ই তূর্ণার মন খারাপ হয়ে গেলো। তারপর রাগী দৃষ্টিতে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, “তুই ওকে কেনো দাওয়াত করলি তোর বিয়েতে। তুই জানিস না ওর জন্যে তোর আর আমার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়েছিলো ২ মাসের মতো।”
“হ্যা জানি সব। দোষ তো তোর’ই। তুই’ও ওকে ভালোবাসতি। আর আমাকে বলিস নি পর্যন্ত। উনি আমার ভাইয়ের মতো। ভাই’কে আসতে বলবো না তো কাকে বলবো বল।”
তূর্ণা আর কিচ্ছুটি বললো না। মুনিয়াকে আসাদ-এর ফোনটা দিয়ে শুয়ে পরলো। মুনিয়া তো আজ আসাদকে কল করতে পারবে না ভেবে সে’ও ঘুমিয়ে পরলো।
………………………
পরদিন মুনিয়ার বাবা তূর্ণাকে বলেছে তার মেয়ের বিদায়কাল সে যেনো সাথে যায়। তূর্ণা তো মহা মুশকিলে পরলো। তবু’ও বড়দের কথা সে ফেলতে পারবে না তাই মেনে নিলো। ভেবেছিলো বাসায় গিয়ে’ই আজ একটু শান্তির ঘুম ঘুমোবে তা আর হলো কই।
তন্ময় আজ পাঞ্জাবী পড়েছে মুনিয়ার বিয়ে উপলক্ষে। তূর্জয় তন্ময়ের রুমে প্রবেশ করে জিজ্ঞেস করে বসলো, “কি ভাই আজ পুরা’ই তোকে বেগুনের মতো লাগছে। ফ্লার্ট করতে যাচ্ছিস নাকি। অবশ্য যা আমি’ই তোকে পারমিশন দিলাম। গুরুজনদের কথা মানতে হয় বৎস।” হাতটা একটু সাধুদের মতো করে বললো তূর্জয় তন্ময়কে।
তন্ময় হাল্কা হেসে তূর্জয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। এরপর কান ধরে মলে দিলো। তূর্জয় কান ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।
“হুহ, তুই আর আমার গুরু। অবশ্য গরু বললে’ও মানতাম। যাক সেসব আমাকে যে ভাল লাগছে তোর কথায় কিছু’টা আশস্ত হলাম।”
“হুহ, কে বললো তোকে বলদ ছাড়া সুন্দর লাগছে। তা আমাকে’ও নিয়ে যেতি। আমি’ও একটু আধটু ফ্লার্ট করে আসতাম।” চোখটেপ দিয়ে তন্ময়কে জানালো তূর্জয়।
তন্ময় ভাবলো বাসার কাউকে’ই সে এই দাওয়াতের কথা বলে নি। একে নিয়ে গেলে বিপদ। তারচেয়ে বরং কিছু একটা বলে দিলে হবে।
“আমার অফিসের একজন স্টাফের বিয়ের দাওয়াত দিয়েছে। সেখানে সব বয়স্ক লোক আসবে বেশি। ফ্লার্ট করলে তো একটু বয়স্কের সাথে’ই ফ্লার্ট করতে হবে। গেলে এখুনি রেডি হো গিয়ে।”
“থাক ডালে পান্তা মিশাতে হবে না। আমি বরং আমার বন্ধুদের সাথে ঘুরে আসি।” বিরক্ত হয়ে কথাটা বললো তূর্জয়।
“হ্যা তাই যা। তবে বলদের বেশে তোকে’ও পুরা মানিয়েছে।”
“থ্যাংকস ভাই।”
তন্ময়’ও বাসা থেকে রওনা হলো। গাড়িতে উঠে’ই ভাবছে আজ প্রেয়সীর সাথে মান-অভিমান শেষ করার পালা। মুনিয়া সকালে’ই তন্ময়কে জানিয়ে দিয়েছে তাদের প্রি-প্ল্যানডের কথা।
………………………
“লেগেঙ্গা তো আমার। তোর পরতে অসুবিধা’টা কোথায়?”
“এতো দামী লেহেঙ্গায় আমাকে ভালো লাগবে না। বিলিভ কর মোনা।”
“না আমি কিছু শুনছি না। তুই এটা’ই পরবি।”
“তাহলে যে শাড়িটা আমাকে তোর বিয়ে উপলক্ষে গিফট করলি সেটার কি হবে!”
“কাল বউ-ভাতের অনুষ্ঠান। তখন না হয় পরে নিবি শাড়ি। এখন এটা’ই তোকে পরতে হবে। আর দেখ লেহেঙ্গা’টা তোকে খুব সুন্দর মানাবে।”
“তবু”ও…”
“তুই পরবি নাকি না।” চোখ রাঙ্গিয়ে তূর্ণাকে ভয় দেখলো।
“ওকে ওকে ওকে পরবো।” ভয় পেয়ে লেহেঙ্গা’টা নিয়ে নিলো।
আসলে এটা তন্ময় মুনিয়াকে দিয়েছে তূর্ণার জন্যে কিনে। অফ-লাইট পার্পল কালারের লেহেঙ্গা, সাথে ম্যাচিং দুল পরেছে। এক হাতে কিছু কাচের কালো চুড়ি এবং আরেক হাতে একটি বেগুনি রঙের ঘড়ি পরেছে। লেহেঙ্গায় কালো রঙের পাথরের ডিজাইন করা। খুব’ই সুন্দর লাগছে। তূর্ণা আজ তেমন সাজে নি। মোটামুটি সিম্পল ভাবে’ই সেজেছে। যা দেখে তন্ময়কে ঘায়েল করে দিবে। অবশ্য তন্ময় এখন তার পাশে নেই। নিজেকে সম্পূর্ণ সাজে একবার আয়নায় দেখে তূর্ণা নিজেই নিজেকে দেখে ঘায়েল হয়ে গেলো। মনে পরে গেলো তার তন্ময় বলা কথা, “তোমার মাঝে কি কোনো ম্যাজিক আছে, না হলে এভাবে আমাকে ঘায়েল করো কেন?”
আজ যদি তন্ময় তাকে এভাবে দেখে তবে কি এই একই কথা তাকে আবার বলবে। নাকি রাগে ক্ষোভে দূরে ঠেলে দিবে।
তন্ময় অনেক পরে বাসা থেকে বেড়িয়েছিলো বলে বর যাত্রীর সাথে আসতে হয়েছে কমিউনিটি সেন্টারে। তবে দু পক্ষ থেকে’ই তন্ময় ও তূর্ণার দাওয়াত ছিলো। তাই উপায়ন্তর না পেয়ে বরের সাথে আসছে তন্ময়। মুনিয়ার কিছু কাজিন ও কয়েকজন বান্ধবীরা গেট ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো এবং কয়েকটা মহিলারা’ও সেখানে ছিলো। তন্ময় একটা কালো রঙের মাস্ক পরে আসছিলো। তন্ময়ের খুবই পছন্দের মাস্ক, সব জায়গা’তেই পরে যায়। তাই লোকেরা ভেবে’ই নিলো তন্ময়কে জামাই হিসেবে। গেটআপ’টাই এমন অনেক সুন্দর মানিয়েছে তন্ময়কে।
পার্পল কালারের একটি পাঞ্জাবী পরেছে। পাঞ্জাবীতে কালো সুতোর কাজ করা এবং কাজ করা জায়গায় কালো পাথর বসানো। হাতে কালো ঘড়ি, চুল জেল দেওয়া, কালো জুতা পরেছে, কালো চশমা, কালো রঙের মাস্ক। পাঞ্জাবীর হাতা কিছুটা উপর দিকে টেনে নিয়েছে। পুরো নজরকারা লুকিং।
তন্ময়কে দেখে অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেক মেয়েরাই পাগল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু একটা বয়স্ক মানুষ তন্ময়কে জামাই বানাতে অনেক মেয়ের মন ভেঙ্গে গিয়েছিলো। তবে আসাদ কান্না করে বলে দিয়েছে সে জামাই। তখন থেকে’ই মেয়েরা তন্ময়ের পিছু ছাড়ছে না। তন্ময় উপায় না পেয়ে সেন্টারের একটি রুমে প্রবেশ করলো মেয়েদের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে। মেয়েরা যেতে’ই লম্বা নিশ্বাস নিয়ে পিছনে ফিরে’ই ঘায়েল হয়ে গিয়েছে তন্ময়।
#বেলা_শেষে_ফেরা
#পর্ব_১৫
#লেখনীতে_Suchona_Islam
তন্ময় যে রুমে প্রবেশ করে, সেই রুমে মুনিয়াকে রেডি করানো হচ্ছিলো। সেখানে তূর্ণা এবং তিনটি বিউটিশিয়ান ছিলো। তন্ময় তো তূর্ণাকে দেখে’ই ঘায়েল হয়ে গিয়েছে। তবে তূর্ণা এখনো খেয়াল করেনি তন্ময়কে। কারণ অনেক লাউডে মিউজিক চলছিলো বাইরে। তাই তন্ময়ের প্রবেশ করা কেউ-ই টের পায় নি।
তন্ময় তূর্ণার সামনে গিয়ে তূর্ণাকে তার দিকে ফিরে দাঁড় করায়। এতে তূর্ণা কিছু’টা ঘাবড়ে যায়।
“এই মেয়ে তুমি সব সময় এমন করো কেনো আমার সাথে। তুমি কি কোনো ম্যাজিক জানো নাকি, প্রতিক্ষণে’ই আমাকে ঘায়েল করো তোমাতে।” তন্ময় দিক-বিদিক না দেখে’ই তূর্ণাকে কথাগুলো বলে চলেছে। রুমের সবাই অবাক হয়ে তন্ময়-তূর্ণাকে দেখে চলেছে। মুনিয়া’ও একটু চমকে গিয়েছিলো বটে, তবে পরে অনেক খুশি হয়েছে।
বিউটিশিয়ান’দের মাঝে থেকে একজন বলে উঠলো মুনিয়াকে, “মেড ফর ইচ-আদার। আমার তো মনে হচ্ছে আপনার না এদের বিয়ে হবে আজ হয়তো।”
“হয়তো তবে আজ আমার’ই বিয়ে। আর আমার বর হয়তো কোথা’ও কান্না করছে আমার এই ভাইটাকে দেখে।” এ বলে’ই মুনিয়া হেসে দিলো সাথে যোগ হলো বিউটিশিয়ান’রা।
তন্ময়ের এখন হুশ আসলো সে কোথায় এবং কি বোকার মতো কাজ করেছে। তাই সে ‘সরি’ বলে সেখান থেকে চলে গেলো। আর তূর্ণা থতমত খেয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। কি হয়ে গেলো একটু আগে। মুনিয়া বসা থেকে উঠে এসে তূর্ণাকে একটা ঝাঁকুনি দিলো। ওমনেই তূর্ণার হুশ ফিরে আসলো। তারপর ভয়ে ভয়ে বললো, “আমি বোধহয় ভুত দেখেছি। কি ভয়’টাই না পেলাম।”
“হ্যা তা তো বটে’ই তাও কার ভুত জানিস!”
“না তো।”
“তন্ময়ের ভাইয়ের ভুত।” এ বলে’ই মুনিয়া এবং বিউটিশিয়ান’রা হেসে দিলো। তূর্ণা লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলো।
……………………..
বিয়ের সকল ঝামেলা পার করে এখন কনে বিদায়ের পালা। কাল মুনিয়ারা প্ল্যান করেছিলো সব এখন একে একে কমপ্লিট হবে। বউয়ের সাথে তন্ময়’কেও পাঠানো হচ্ছে জেনে তূর্ণা অনেক অবাক হয়ে যায়।
আসাদ-এর বরযাত্রী যত-জন ছিলো, বউকে নিয়ে সবাই চলে গিয়েছে এখন মেয়ের বাসা থেকে শুধু তন্ময়-তূর্ণা যাবে। তন্ময় তূর্ণাকে নিজের গাড়িতে করে নিয়ে যাবে বলে গাড়িটা বের করতে গেলো। তূর্ণা এবার নিজেকে নিজেই বকে চলেছে। কেনো যে সে বড়দের কথা শুনতে গেলো। তাহলে তার আজ এমন পরিস্থিতিতে পরতে হতো না।
তন্ময় ড্রাইভ করছে তার পাশে’ই তূর্না বসে আছে। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। তূর্ণা রাতের শহর দেখছে জানালার বাইরে দিয়ে আর তন্ময় মাঝে মাঝে তূর্ণাকে। তূর্ণা এই নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো এতো রাত পর্যন্ত বাইরে রয়েছে। সে একবার চারিদিকে আলোর ছড়াছড়ি দেখছে, তো একবার আকাশের মস্ত বড় চাঁদ সাথে অজস্র তারা দেখছে। কি অপরূপ এই দৃশ্য। রাতের শহরে আশেপাশে মানুষের অনেক আনাগোনা’ও রয়েছে।
তন্ময় গাড়ি ড্রাইভ করছিলো কিন্তু সামনেই একটি ফুচকা’র দোকান দেখতে পেয়ে গাড়ি থামিয়ে দেয়। তূর্ণা হঠাৎ গাড়ি থামায় একটু বিস্ময় হয়ে যায়। তারপর সে দেখতে পায় তন্ময় তাকে রেখে কোথা’ও যাচ্ছে। তূর্ণা তো ভয়ে শেষ কারণ এতো রাতে তন্ময় আবার তাকে এখানে রেখে যাবে না তো।
তন্ময় বেশি টক দিয়ে ফুচকা কিনেছে, তবে ঝাল দিয়ে নয়। কারন ঝাল খেলে তূর্ণার শরীর খারাপ করবে। এমনি’তেই তূর্ণার এই কয়েকদিনে অনেক চাপ গিয়েছে তাই। এবার তন্ময় ফুচকা কিনে গাড়ির দিকে ফিরছে। গাড়িতে এসেই তন্ময় দেখে তূর্ণা জানালার দিকে তাকিয়ে কি যেনো ভাবছে। তন্ময় তূর্ণাকে ডাক দিয়ে ফুচকা হাতে তুলে দিলো। তূর্ণা তন্ময়ের ব্যবহারে অনেকটা অবাক হচ্ছে আজ। এতোদিন শুধু রাগ দেখিয়েছে কিন্তু আজ তার কি হলো।
তূর্ণা ফুচকা খেয়েছে তবে বেশি খেলো না। কিন্তু সে তন্ময়ের সাথে কথা বলে নি আর তন্ময়’ও কিছু বললো না। এমনি’তেই বিয়ে বাড়ির খাবার খেয়েছিলো তূর্ণা। আর এখন টক বেশি খেলে হয়তো গ্যাসীয় হতে পারে তাই ভেবে বেশি খায় নি ফুচকা। তবে তূর্ণার আইসক্রিম খেতে মন চেয়েছে। সে তন্ময়কে বলতে’ও পারছে না আবার খুব আইসক্রিম’ও চাই তার। দোটানায় পরে গেলো বেচারি। তন্ময় খেয়াল করলো তূর্ণা খুব উশখুশ করছে কিছু একটার জন্যে। তাই সে জিজ্ঞাস করে’ই বসলো কি হয়েছে তার। তূর্ণা কিছু’ই বলছে না।
তাই তন্ময় আবারও গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা তোমার সমস্যা’টা কি বলো তো! তুমি আমাকে কিছু একটা বলার জন্যে আকুপাকু করছো অথচ কথাই বলছো না।”
“নননা আমি আআআবার কি বলবো। আমার তো কিছু’ই বলার নেই।”
“এইতো আমতা আমতা করছো। তার মানে তোমার নিশ্চয়ই কিছু চাই।”
“না কিছু’ই চাই না।”
“তুমি আমাকে মিথ্যা বললে’ই যে আমি ধরে ফেলি এটা তুমি ভালো করে’ই জানো তূর্ণা।”
“আআআসলে আআমারর….”
“হ্যা তোমার!”
“আইসক্রিম।”
“ওহ আচ্ছা এটা বললে’ই তো পারো আইসক্রিম চাই তোমার। ঠিক আছে তুমি গাড়িতে বসো আমি তোমার জন্যে অনেক গুলো আইসক্রিম আনছি।”
“এজন্যই আমার তোমাকে কিছু বলতে মন চায় না।”
“ওকে ওকে তোমার জন্যে দু’টো আনবো, বেশি না কেমন!”
“হু।”
…………………………
তূর্ণারা পৌঁছেছে আসাদ-এর বাসায়। অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। খুবই ভাল লাগছে তূর্ণার। তূর্ণা আগে কখনোই আসাদ-এর বাসায় আসে নি। তবে অলিগলি চিনতো।
তন্ময়ের’ও আসাদ-এর বাসা ভালো’ই লাগলো। তবে আজ তেমন জ্বালাতে পারবে না তূর্ণাকে তন্ময়, তাই একটু আপসেট। একে তো রাত হয়েছে আবার তূর্ণা অনেক বেশি’ই ক্লান্ত তাই একটু সদ্বয় হলো তন্ময় তূর্ণার প্রতি।
পরদিন বউ-ভাতের অনুষ্ঠান। তবে আসাদ’রা তাদের বাসাতে’ই বউ-ভাতের প্রোগ্রাম করেছে। আসাদ’রাও মুনিয়াদের মতো’ই ধনাঢ্য। তাই তো দুই পরিবার আর আপত্তি করে নি বিয়েতে।
তূর্ণাকে মুনিয়া একটি মেরুন কালারের শাড়ি গিফট করেছিলো। তূর্ণা সেটি’ই আজ পরিধান করেছে। আজ’ও মোটামুটি সিম্পল সাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছে তূর্ণা। আজ দু’হাতে লাল রঙের দু’মুঠো চুড়ি পরেছে, চোখে গাঢ় কাজল, কপালে কালো টিপ, ঠোঁটে মেরুন কালারের লিপস্টিক তাও হাল্কা ভাবে দেওয়া, গলায় ছোট একটি স্টোটের চেইন পরেছে। এতে’ই খুব সুন্দর লাগছে তাকে।
তূর্ণা আজ’ও মুনিয়ার পাশে দাড়িয়ে আছে। তবে আজ তো নতুন পরিবেশে এসেছে মুনিয়াকে যে রুমে সাজানো হচ্ছিলো সে রুমে মুনিয়ার শ্বশুরবাড়ির লোক বেশি। তারা’ও বউয়ের সাথে সাজগোজে ব্যস্ত। তূর্ণা এদের কাউ’কেই চিনে না। তাতে তূর্ণার একটু অস্বস্তি লাগলে’ও তবে চুপচাপ বউয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মুনিয়া একজন বিউটিশিয়ান’কে বলে তূর্ণার চুল কার্ল করতে বললো। তূর্ণা প্রথমে মানা করলে’ও বিউটিশিয়ান’রা ছাড়ছে না বলে তাই বাধ্য হয়ে চুল কার্ল করেছে। তবে মুনিয়া জোর করে বিউটিশিয়ান’দের বলেছে তার চুলে একপাশে দু’টি গোলাপ ফুল লাগিয়ে দিতে। প্রথমে আপত্তি করলে’ও ফুল দু’টি লাগানোর পরে তার কাছে’ও ভালোই লাগছে নিজেকে। তারপর মুনিয়ার সাজ কমপ্লিট হলো এবং তাকে স্টেজের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
তন্ময় সকালে বাসায় এসেছে রেডি হতে। আজ চকলেট কালারে একটি শার্ট ও জিন্সের প্যান্ট পরেছে। হাতা ফোল্ড করা, হাতে কালো ঘড়ি, চুলে জেল দিয়ে নিজের মতো স্টাইল করেছে, কালো স্নিকার পরেছে। চকলেট পারফিউম দিয়েছে। দেখতে পুরোই একটা চকলেট লাগছে তন্ময়কে। এতে’ই মেয়েদের পাগল করে দিবে সে। তূর্জয় তো তার ভাইকে দেখে অবাক। তবে ভাই এতো সাজগোজ করছে দেখে অবাক হয়েছে তূর্জয়। কারণ তার ভাই কিনা বয়ষ্কদের জন্যে এতো ড্যাশিং ভাবে রেডি হচ্ছে ভেবে তূর্জয় হাল্কা হেসে সেখান থেকে চলে গেলো। তন্ময় তূর্জয়কে দেখে ভাবলো ও হাসছে কেনো, পরে ভাবলো জেলাস হয়েছে হয়তো তাই। তন্ময় সম্পূর্ণ রেডি হয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো। তবে আজ আর মাস্ক পরলো না।
বিয়েতে যখন তন্ময়-তূর্ণা দু’জন দু’জনকে দেখেছিলো তারা দু’জনেই দু’জনাতে ঘায়েল হয়ে গিয়েছিলো।
………………………….
সন্ধ্যার সময় মুনিয়া ও আসাদ’কে নিয়ে যাওয়া হলো মুনিয়াদের বাসায়। তবে শর্ত হলো তূর্ণাকে আজ’ও থাকতে হবে তাদের বাসায়। মুনিয়ার অনেক ইচ্ছে ছিলো বাসরঘর সাজানো’টা যেন নিজেদের’ই কেউ করে। খুব সুন্দর না হলেও তাতে আপত্তি নেই। তাই আসাদ আর মুনিয়া প্ল্যান করলো বাসরঘর সাজানোর দায়িত্ব তন্ময়-তূর্ণা’কে দেওয়া হোক। যেই বলা সেই কাজ, করতেই হবে। মুনিয়ার বাবা’ও তূর্ণাকে অনেক বার রিকুয়েস্ট করার পর তূর্ণা রাজি হয়। আর তন্ময় তো এক পা’য়ে রাজি হয়েছে। তবে এই দু’জন ছাড়া আর কাউ’কেই বাসর-ঘরের দায়িত্ব দেয় নি মুনিয়া। তূর্ণা মুনিয়াকে একবার চোখ রাঙ্গালে’ও মুনিয়া ডেভিলনী হাসি ও চোখটেপ দিয়ে তাকে উইশ করলো। তূর্ণা মনে মনে মুনিয়াকে বকে উদ্ধার করে নিয়েছে।
“বাসর-ঘরের ফিল’ই আলাদা বুঝলে!” খুশিতে গদগদ হয়ে বললো কথাগুলো তন্ময়।
“এই চুপ আমার সাথে কথা’ই বলবা না তুমি। চুপ না করলে একদম মেরে দিবো।” মনের ভিতরে ভয় কাজ করছে তূর্ণার। তা তন্ময় জেনেও এই সময়টা মজা করে উপলব্ধি করছে।
“আরে কিসের চুপ। আর তুমি এমন করে কাজ করছো কেনো?”
“আমি বললাম না তোমায় চুপ হতে।”
“আমি চুপ হবো কোন দুঃখে। আমার মুখ দিয়ে আমি চিল্লিয়ে গান গাইবো, শুনবে তুমি!”
তূর্ণার হাতে স্কোচটেপ ছিলো। সেটা তন্ময়ের মুখে লাগিয়ে দিলো।
“তুমি যদি এই স্কোচটেপ খুলেছো তবে আমি তোমায় ফ্লোরে ফুলের কাটা’তে শুইয়ে দিবো। আমার সাথে একদম কথা বলবে না।”
তন্ময়ের বলা কথা’তেও তূর্ণার ভীতি কাজ করছে। বেচারা তন্ময় কই ভাবলো তূর্ণাকে একটু ভয় দেখিয়ে নিজের বুকে টেনে নিবে। কিন্তু তূর্ণা তার ভাবনায় এক বালতি পানি ঢেলে দিলো। তাই স্কোচটেপ সহ’ই কাজ করলো তন্ময়।
তন্ময় জানে মুনিয়ার বাসরঘরে ওরা দুই কাপল’ই উপস্থিত। বিছানার নিচে লুকিয়ে সব শুনছে আর যতটুকু পারছে দেখছে।
তন্ময়ের বিছানার ডেকোরেশন শেষ হলে পরে স্কোচটেপ খুলে নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো। মুখে অনেকক্ষণ যে স্কোচটেপ ছিলো আঠা আঠা লাগছে। তূর্ণা তো ভয়ে ভয়ে সব কাজ আস্তে আস্তে করছে। তবে তন্ময় ওয়াশরুমে থেকে বেড়িয়ে দেখে তূর্ণা নিচে ফুলের কাটা তুলছে। তাই দেখে তন্ময় বললো, “গোলাপ ফুলের একটা রাস্তা বানিয়ে দিবো আর পাশে থাকবে ক্যান্ডল’স। একদম জোস লাগবে। কি বলো তূর্ণা!”
তন্ময়ের আওয়াজ পেয়ে তূর্ণার হাতে কাটা বিঁধে গেলে মুখ থেকে অস্পষ্ট শব্দ বেড়িয়ে গেলো। তবে তন্ময় বুঝতে পারে নি তূর্ণার হাতে কাটা বিঁধবে। তাই সে তূর্ণার কাছে গিয়ে তূর্ণার যে আঙ্গুল থেকে রক্ত পরছে, সে আঙ্গুলে মুখ লাগিয়ে দিলো। তূর্ণার শরীরে হাল্কা শিহরণ জাগলেও, কয়েক মিনিট পরে সে তন্ময়ের বিয়ের কথা ভেবে হাত সরিয়ে নিলো। তন্ময় বিস্ময় হয়ে গেলো তূর্ণার এমন ব্যবহারে।
বিছানার নিচে থেকে আঙ্গুল মুখে দেওয়া ছবি তুলে নিয়েছে মুনিয়া ও আসাদ। দু’জনের একসাথে কতগুলো ছবি তুলেছে। কিন্তু তূর্ণা যখন হাত সরালো, তখন’ই ওরা বিছানার নিচ থেকে বেড়িয়ে আসে। তূর্ণা তো অবাক হয়ে গিয়েছে ওদের দু’জনকে দেখে। মুনিয়া তো বিরক্তি নিয়ে তূর্ণাকে বলে’ই বসলো, “তূর্ণা তুই একটা আন-রোম্যান্টিকের ডিব্বা। তোর জন্যে ঠিক মতো তোর আর ভাইয়ার ছবি’ও তুলতে পারলাম না। সব আশায় এক বালতি পানি ঢেলে দিলি।”
“শয়তান্নী সব তোর দোষ। আমাকে এমন পরিস্থিতিতে ফাঁসিয়ে ছবি তোলা হচ্ছে। তোর বিয়ের সব পর্ব শেষ আমি আর থাকবো’ই না। হারামী, শাঁকচুন্নি, তোর জামাইয়ের কপালে বউ নাই।” রাগে তূর্ণার শরীর গিজগিজ করছে।
“হেহেহে, আফা আমারে দেখ বিয়া কইরা বউ নিয়া তোর সাথে ভাইয়ার ছবি’ও তুইল্লা নিছি।” আসাদ বেয়াক্কলের মতো হেসে কথা বলছিলো। তন্ময় তো বেশ উপভোগ করছে আর তা দেখে তূর্ণা তেলে-বেগুনে জ্বলছে।
“চুপ বেয়াকুব। তুই ছাগলের মতো হাসবি না। আমি আর থাকবো’ই না।” এ বলে’ই তূর্ণা চলে যাচ্ছিলো কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে আসাদকে বললো, “আসাদ-এর বাচ্চা। বাসর-ঘরের বকশিশ দিয়ে দিবি। অনেক কষ্ট হয়েছে। কাল বকশিশ যদি না পাই তবে তোর কি হবে ভেবে নিস হুহ!” এ বলে’ই চলে গেলো তূর্ণা। সবাই ‘হা’ করে তূর্ণার ব্যবহার দেখেছে। তূর্ণা বিয়ে-বাড়িতে আর থাকে নি, বাসায় চলে গিয়ে একটা ঘুম দিয়েছে।
#ক্রমশ…
(গল্পটি কেমন হলো মতামত জানাবেন। ভুল-ত্রুটি ক্ষমাপার্থী।
স্ববিনয়ে পড়ুন এবং ধন্যবাদ সকলকে।)
আগের পর্বের লিংক নিচে দেওয়া হলো
#ক্রমশ…
(গল্পটি কেমন মতামত জানাবেন। ভুল-ত্রুটি ক্ষমাপার্থী।
স্ববিনয়ে পড়ুন এবং ধন্যবাদ সকলকে।)