“নেতা সাহেব! আপনাকে কালো রঙয়ের পাঞ্জাবীতে মা’রা’ত্ম’ক সুন্দর লাগে।
সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে অসিফার কথা শুনে দোতলার সিড়িতে এসে আচমকা থেমে যায় শিখন। গম্ভীর কন্ঠে অসিফার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“ধন্যবাদ।”
অতঃপর পুনরায় সিড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলেই পেছন থেকে অসিফা বলে ওঠে,
“শুনুন! দ্রুত বাসায় যান আর এই পাঞ্জাবী বদলে অন্য কিছু পরে আসুন। আমি চাইনা আমি ব্যতীত অন্য মেয়েরা আপনাকে দেখে পাগল হোক।
বিরক্তিতে ছেয়ে যায় শিখনের মুখ। বড় বড় পা ফেলে সিড়ি টোপকে দোতলায় ফিরে এসে বাজখাঁই কন্ঠে বলে ওঠে,
“তোমার ইচ্ছা মতো চলতে হবে আমাকে? মনে কি লজ্জা বা ভয় বলতে কিছুই নেই তোমার? সামনে না তোমার পরীক্ষা? যাও পড়তে বসো গিয়ে।”
ধপাধপ পা ফেলে পুনরায় সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায় শিখন।
বাড়ি থেকে বের হয়ে তিন-চার কদম এগোতেই কোথা থেকে যেন ঝমঝম করে পানি এসে শিখনের ওপর পড়ল। ভিজে একাকার হয়ে যায় শিখন। পানি যে কোথা থেকে এসে পড়েছে তা বুঝতে এক মুহূর্তও সময় লাগল না তার। শিখন আগুন ঝরা চোখে দোতলার খোলা বারান্দার দিকে তাকাতেই বড় আকারের একটা খালি বালতি নিয়ে ছুটে রুমের ভেতরে চলে যায় অসিফা। রা*গে সারা শরীর কাপতে শুরু করে শিখনের। এক প্রকার ছুটে আবার বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে সে। সিড়ি বেয়ে যেই দোতলায় পা রাখল শিখন ওমনি ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে অসিফা।
“ভালোয় ভালোয় বলেছিলাম পাঞ্জাবী বদলে যেতে। আমার কথা তো শুনলেন না। নিন এখন শা’স্তি ভোগ করুন।”
ঝড়ের গতিতে এসে অসিফার গালে ঠাটিয়ে একটা চ’ড় বসিয়ে দিয়ে শিখন বলে ওঠে,
“তুমি কি সত্যিই পা’গ’ল অসিফা? তোমার জন্য আজ আমার কত বড় ক্ষ’তি হয়ে গেল তুমি কল্পনাও করতে পারবেনা। আজকে ভার্সিটির ফাংশনের মেইন অরগানাইজর আমি। অথচ তোমার এই পা’গ’লামির জন্য এখন আমি শত চেষ্টা করেও সঠিক সময়ে ভার্সিটিতে পৌছাতে পারব না। তোমার পাগলামি দিনকে দিন অতিমাত্রায় বেড়ে যাচ্ছে। তুমি বুঝতে কেন চাও না যে তোমাকে আমার পছন্দ না? আর তোমার বয়স কত সেদিকেও চেয়েছো তুমি? একটুখানি একটা মেয়ে মনে ভ’য়’ড’র নেই একটুও? লজ্জা থাকলে আর কখনো আমার সামনে এসো না তুমি।
-ভ’য়’ড’র থাকলে কি আর এই ভ’য়ংক’র মে’জা’জি নেতার প্রেমে পড়তে যাই? এই চোখ দিয়ে আপনাকে অন্য কারো সাথে না দেখা পর্যন্ত আপনার এই ধ’ম’ক আমার ওপর কোনো প্রতিক্রিয়া ফেলবেনা। আর আপনার এই ধ’ম’ক আমার কাছে সবসময় মিছাই থেকে যাবে। কেননা আপনি একান্তই আমার।
আর পেছরে ঘুরে তাকায়নি শিখন। রা’গে ফোসফোস করতে করতে সিড়ি বেয়ে চারতলায় চলে যায় চোখের পলকে। বাসা থেকে ফুরফুরে মে’জা’জ নিয়ে বের হলেও এই মেয়েটার জন্য মুহূর্তের মাঝে তা আবার হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। দিন দিন এই মেয়ের পা’গ’লা’মি যেন অতিমাত্রায় পৌছে যাচ্ছে। যা এক চরম বি’র’ক্তির কারণও হচ্ছে ক্রমশ। এইটুকু মেয়ে কিনা পড়াশোনা বাদ দিয়ে ভ’য়’ড’রহীনভাবে নিজ জানের মায়া ত্যাগ করা এক নেতার পেছনে ছুটছে! যার কিনা পুরো মনোনিবেশ একমাত্র রাজনীতিতেই সদা ধার্য করা!
শিখন ভেবে নেয় এবার তাকে কিছু একটা করতেই হবে।
পরপর বার কয়েক কলিংবেজ বাজতেই সিতারা বেগম ছুটে এসে সদর দরজা খুলে দেন। শিখন ভেজা শরীর নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই সিতারা বেগম ক’র্ক’শ কন্ঠে বলে ওঠেন,
“ম্যানারলেসদের মতো এতবার কলিংবেল বাজাচ্ছিলে কেন? আমরা কি কালা হয়ে গেছি? আর তুমি এভাবে ভিজে এসেছ কোথা থেকে? রিক্তা মাত্র ফ্লোর মুছেছে। আর তুমি এই ভেজা শরীর নিয়ে ভেতরে যাবে ফ্লোর আবার নোং’রা করে ফেলবে।
সিতারা বেগমের কথায় যেন শিখনের রা’গের মাত্রা দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়। অতঃপর বাজখাই কন্ঠে বলে ওঠে,
“আমাকে দেখে নিশ্চয়ই মনে হচ্ছেনা যে,আমি ইচ্ছা করে ভিজে এসেছি? রিক্তা? ক’ষ্ট করে ফ্লোরটা আবার একটু মুছে দিও তো বোন। তোমাকে আমি এক্সট্রা কিছু টাকা দিয়ে দেব পরে।”
ছুটে এসে রিক্তা বলে ওঠে,
“এমা ছি ছি। কি কন এসব ভাইজান? আমারে কোনো টাকা দেয়া লাগবেনা। আপনি ঘরে যান আমি ফ্লোর মুইছা দিচ্ছি।”
“আচ্ছা। আর শোনো? আজকের পর হতে আমি আসলে যেন এই মহিলা দরজা না খোলে। আমি কারো মুখ থেকে আমার ম্যানারস সম্পর্কে কিছু শুনতেও চাইনা।”
ছেলের মুখে এহেন কথা শুনে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হাতের চায়ের কাপটা বেশ শব্দ করে ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখেন সাকলাইন খান। বেশ জোরেই ক্রু’দ্ধভাবে শিখনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন,
“শিখন! দিন যাচ্ছে আর তুমি অ’ভ’দ্র হচ্ছো। কাকে তুমি ‘এই মহিলা’ বলছ? ভুলে যেও না যে, সে তোমার মা হয়।”
“উহু আপনার কথায় একটু ত্রু’টি আছে। ‘মা’ এর আগে আরও একটা শব্দ বসবে। সৎ মা বলুন মিঃ সাকলাইন খান।”
“তুমি নিজেকে নেতা বলে দাবি করো কোন বিবেকে? যে নিজের বাবাকেই সম্মান দিতে জানেনা সে অন্য মানুষদেরকে কিভাবে সম্মান দেবে?” (সাকলাইন খান)
সাকলাইন খানের কথায় হোহো করে হেসে ওঠে শিখন। কোনো মতে হাসি থামিয়ে বলে ওঠে,
“আমি কি একবারও নিজ মুখে আপনার সামনে নিজেকে নেতা বলে দাবি করেছি? আপনিতো লোকমুখেই শিখন খানের নামের আগে নেতা শব্দটি শুনেছেন। আর এখানে কথা আসছে সম্মান দেবার? তবে আমিতো এই মুহূর্তে আপনার কিছু পুরোনো ইতিহাস টেনে আনতে চাইছিনা একদম। কি করি এখন বলুন তো? বাবা শব্দটির মূল্য কি আপনি কখনো দিয়েছিলেন? আপনি নিজেও ভালো করে জানেন আমি নিজের জায়গায় ঠিকই আছি। আপনারা কেন রোজ রোজ কাহিনী করছেন আমার সাথে? আমিতো শুধু একটু ভালো থাকতে চাইছি। আমিতো আপনাদের কোনো পাকা ধানে মই দেইনি! আপনি ও আপনার স্ত্রী এবং সন্তানেরা তো ভালোই আছেন। আমি কি কিছু করেছি বলেন? তবে কেন আমাকে একটু শান্তি দিচ্ছেন না আপনারা?
দ্রুত পায়ে নিজের রুমের দিকে এদিয়ে যায় শিখন। সাকলাইন খান পুনরায় নিজের মুখে গম্ভীরতা ফুটিয়ে তুলে চায়ের কাপটি হাতে তুলে নেন। রিক্তার যে এই শিখনের জন্য অনেক মায়া হয়। চোখ ফে’টে মাঝে মাঝে কান্না বে’রিয়ে আসতে চায়। এই বাসায় কাজ করছে সে প্রায় পনের মাস হতে চলল। এতদিনে এই পরিবারের টুকটাক অনেক ঘটনাই সে জেনে গেছে। শিখনের এই ঠোঁট কা’টা ও রা’গী স্বভাব যে তার মনের ভেতরে জমে থাকা বিরাট ক’ষ্টের স্তূপের জন্যই জন্ম নিয়েছে। আর তার শিখন ভাইজানের এত ক’ষ্টের সাথে যে সাকলাইন খান ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা বুঝতে কষ্টও হয়না রিক্তার। বাবার দ্বিতীয় বিয়ে যে শিখনের মস্তিষ্কে খুব বা’জেভাবে আ’ঘা’ত হেনেছিল ছোটবেলাতে। আর সৎ মায়ের অ’ত্যা’চার যে কতটা য’ন্ত্র’ণাদাক তাতো রিক্তা সবচেয়ে ভালোভাবে জানে। সে নিজেও তো ছোট হতে সৎ মায়ের হাতে অ’ত্যা’চা’রিত হতে হতে বড় হয়েছে।
দশ মিনিটের মাথায় পোশাক পরিবর্তন করে পুনরায় রেডি হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় শিখন। তবে এবারও সে একটা কালো রঙয়েরই পাঞ্জাবী পড়েছে। নিজের ইচ্ছা বা কাজের মাঝে অন্যের বা হাত প্রবেশ করানো শিখন একদম পছন্দ করেনা।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে শিখনের যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে অসিফা। কি একটা কারণে যেন সপ্তদশীর মনে প্রচন্ডভাবে আ’ঘা’ত লাগে। তবে সে তা গায়ে মাখেনা। এমন আ’ঘা’ত তো সে প্রতিনিয়তই পেয়ে চলেছে। এ আর নতুন কি? প্রেমিকের দেয়া আঘাত কি আর তেতো হতে পারে? এ সপ্তদশীর কাছে যে তা মধুর লাগে।
———
এক ভরদুপুরে আকাশ বেয়ে অঝর ধারায় বৃষ্টি নামে। এ বৃষ্টি যে গ্রীষ্মের আবদারকৃত বৃষ্টি নয়, এই বৃষ্টি ক’ড়া শীতের অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি। এই বৃষ্টিভেজা ভরদুপুরেই ছাতা মাথায় কোচিং হতে ফিরছিল অসিফা। কিছুদিন বাদেই তার মাধ্যমিক পরীক্ষা। আচমকা অসিফার চোখ আটকে যায় একই ছাতার নিচে হেটে আসা এক যুবক ও যুবতীর দিকে। যুবকে চিনতে একদম হেরফের করেনি অসিফা। শিখনের পাশে অন্য এক মেয়েকে দেখে শরীর জ্বলে ওঠে তার। পরক্ষণেই আবার নিজেকে শান্ত করে নেয় অসিফা। মেয়েটা তো তার ব্যাচমেট বান্ধবীও হতে পারে। একটা ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলের বান্ধবী থাকাটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়! এই শান্ত ভাব আর দীর্ঘ সময় স্থায়ী হলো না অসিফার মনে। নিজ হতে যেচে মেয়েটার হাত শিখনকে ধরতে দেখে চোখ রসগোল্লার ন্যায় আকার ধারণ করে তার। ডান হাতের তালুতে ভেজা চোখ মুছে নিয়ে উলটো ঘুরে বিপরীত পথে ছুট লাগায় অসিফা। আর কখনো সে এই ছেলেটাকে দেখবে না। লুকিয়ে উকি-ঝুকি দিয়েও দেখবেনা। কখনো তার সামনেও যাবেনা। সপ্তদশীর হৃদয় প্রথমবারের মতো ভে’ঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।
সেদিনের পর হতে আর কখনো অসিফা শিখনের সামনে আসেনি। কিছুদিন স্বাভাবিক কাটলেও এখন শিখনের কেমন খালি খালি অনুভূত হয়। প্রতিদিন দোতলার সিড়ি থেকে ওঠার সময় মিনিট দুয়েক ফ্ল্যাটের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু না অসিফা আর দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকেনা। রোজ ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় এবং ফেরার সময় দোতলার বারান্দার দিকে তাকায় শিখন। কিন্তু সেখানেও আর মেয়েটা এসে তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকেনা। মেয়েটার এই পাগলামিগুলো যে তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে তা আর বুঝতে বাকি নেই শিখনের।
দেখতে দেখতেই দেড় মাস পার হয়ে গেছে। দুদিনের ট্যুর শেষ করে মাত্র ফিরেছে শিখন। কাধে ভারী ব্যাগ নিয়ে ক্লান্ত শরীরে দোতলায় এসে দাড়াতেই চোখ আটকে যায় বাম পাশের সেই ফ্ল্যাটটার দিকে। দরজায় বড়সড় একটা তালা ঝুলছে। আ’তংকে ভরা দৃষ্টিতে পাশে তাকাতেই বুকের মাঝে চিনচিন ব্যথা আরম্ভ হয়ে যায়। দরজার একটু পাশেই দেয়ালে টু-লেট বোর্ড ঝোলানো।
রিক্তার কাছে শুনে জানতে পারে অসিফার বাবার ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছিল মাস খানেক আগেই। কিন্তু অসিফার পরীক্ষার জন্য তখন তারা যেতে পারেনি। শিখনের আর বুঝতে বাকি নেই ট্রান্সফার অফিসের আদেশে হয়েছে নাকি অসিফার বাবা তার মেয়ের জোরজবরদস্তিতে পড়ে অন্য শহরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
সেদিন মেয়েটাকে দূরে সরানোর জন্য অমন নাটক করলেও আজ শিখন বুঝেছে জীবনের বড়সড় একটা ভুলই ছিল সেটা। মেয়েটা তার কথা রেখেছে তবে। তার সেদিনের ধ’ম’ক তবে আসলেই মেয়েটার ওপর প্রতিক্রিয়া ফেলেছে। মেয়েটা কখনোই আর তার সামনে আসেনি। হয়তো আর কখনো আসবেওনা। সেদিন যদি সে জানতো ওই ধমকই তার রাতে নিশ্বাসের পাল্লাকে কঠিন থেকে কঠিনতর ভারী করে তুলবে তবে অমন ধমকও সে কখনো দিতোনা। মেয়েটা যে না পাওয়ার য’ন্ত্রণায় পু’ড়ে’ছে এবং এখনো পু’ড়’ছে তা যে সংক্রামিত হয়ে আজ তাকেও পু’ড়িয়ে ছাড়খার করে দিচ্ছে। বিছানার পাশ হতে গিটারটা নিয়ে নিজের রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় চলে যায় শিখন। ভ’য়ং’কর এক হৃদয় পো’ড়া’নো সুর তোলে গিটারের কর্ড দ্বারা।
চলবে…
#বোবা_টানেল
#সূচনা_পর্ব
#আফিয়া_অন্ত্রীশা