বোবা টানেল পর্ব -১৩

#বোবা_টানেল (১৩)
“আমাকে আর আপনি আগের মতো ভালোবাসবেননা তাই না নেতা সাহেব?”

অসিফার এহেন প্রশ্নে চোখে পানি টলটল করতে থাকে শিখনের। অসিফার গালে হাত রেখে শিখন বলে ওঠে,
“তোমার এমনটা কেন মনে হচ্ছে অসিফা? আমার ওপর কি তুমি ভরসা করো না?”

প্রতিত্তোরে অসিফা গলার স্বর উচিয়ে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিয়ে বলে ওঠে,
“আপনাকে তো আমি নিজের চেয়েও বেশি ভরসা করি। কিন্তু আমি যে এখন দেখতে বি’শ্রী হয়ে গিয়েছি। আমাকে দেখে কি আপনার ভয় লাগেনা?”

“এই মেয়ে কিসব বলছো তুমি?”

মুখ হতে হাত সরিয়ে ভেজা চোখে শিখনের দিকে তাকিয়ে অসিফা বলে ওঠে,
“আমার ভয় হয়। মানুষের কথা শুনে যদি আমাকে আপনি আর ভালো না বাসেন? আমার জায়গা যদি অন্য কোনো সুন্দরী নারী দখল করে নেয়?”

অসিফার কথা অস্বাভাবিকভাবে নেয় না শিখন। সে জানে, বাঙালি নারীরা তাদের মাঝে তথাকথিত বিন্দুমাত্র কোনো খুত খুজে পেলে নিজেদের মনে ভয়ের সৃষ্টি হয়। “তাদের স্বামীদের যদি তখন অন্য নারীকে ভালো লেগে যায়!” কিন্তু শিখন তো মোটেও অসিফার মাঝে কোনো খুত দেখতে পায় না। এসিডে দ’গ্ধ কি সে আর নিজে যেচে হয়েছে!
অসিফার সামনে বসে পড়ে শিখন। অতঃপর অসিফার থুতনি উঁচু করে তার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

“একটা কথা মনে রেখো, তুমি যথেষ্ট সুন্দরী অসিফা। আজকের এই অবস্থার জন্য তো আর তুমি দ্বায়ী নও। তুমি এখনো সুন্দর। মানুষ বলে না? ‘ভালোবাসা রূপ দেখে হয়না।’ কে বলেছে রূপ দেখে হয়না? সবার চোখে কি আর সবাই সুন্দর হয়? প্রকৃত ভালোবাসার ক্ষেত্রে পুরুষ মানুষ নির্দিষ্ট একজনের সৌন্দর্যে আটকায়। যাকে ওই পুরুষ ভালোবাসে সেই নারী নির্দ্বিধায় সেই পুরুষের চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী। যে পুরুষ বলে, ‘আমি তোমার রূপ দেখে তোমাকে ভালোবাসিনি।’ সেই পুরুষের মাঝে নির্ঘাত ঝা’মে’লা আছে। কেননা প্রতিটা পুরুষের চোখে তাদের প্রেমিকা বা স্ত্রী হয় অশেষ সুন্দরী। আমার কিছুই তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে না। শুধু এটুকুই তোমার বিশ্বাসের খাতায় নোট করে রাখো যে, তোমার নেতা সাহেব তোমাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তার পৃথিবী একমাত্র তার তন্দ্রাহরণীই।”

শিখনের কথার মাঝেই নিলুফা বেগম আসিফ খন্দকারের হাত টেনে নিয়ে নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করেন।

অসিফার গাল বেয়ে টপটপ করে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে। হুট করেই তার মনের ভেতরটা কেমন যেন হালকা হয়ে গেল। এতদিন যে কথা ভেবে সে হীনমন্যতায় ভুগেছে, আজ সেই ভাবনা মুহূর্তের মাঝে ঘুচে গেল শিখনের বলা পাঁচ ছয় লাইন কথার জোরেই। এই ছেলের কথাবার্তায় কেমন একটা তে’জ তে’জ ভাব আছে। এই যে একটু আগেও তো সে আয়নায় নিজের মুখখানা দেখে কেমন কেপে উঠে পা’গ’লা’মি শুরু করেছিল। অথচ শিখনের বলা কথাগুলো তাকে একদম নিভিয়ে দিল। অসিফা ভেবে নেয়, তাকে শক্ত হতে হবে। খুব শক্ত হতে হবে। ভালোবাসা দিয়ে শিখনের সব ক’ষ্ট ভুলিয়ে দিতে হবে তাকে। অসিফা নিঃশব্দে শিখনের বুকে মাথা রাখে। এত দুঃখ, ক’ষ্টে’র মাঝেও সে কেমন যেন সুখ সুখ অনুভব করছে।
অসিফাকে স্বাভাবিক হতে দেখে ক্ষানিকটা অবাক হয় শিখন। ভোরে তাকে একটু অফিসে যেতে হবে স্মরণ হতেই দ্রুত অসিফাকে আড়কোলে নিয়ে ভাংগা কাচের টুকরো এড়িয়ে সন্তপর্ণে বেডরুমের দিকে অগ্রসর হতে আরম্ভ করে শিখন। সাথে একটা কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাসও ফেলে। এই স্বাভাবিকতা ঠিক কতক্ষণ অসিফার ভেতরে থাকবে তা নিয়ে সন্দেহ হয় তার।

রুমে প্রবেশ করে অসিফাকে খাটে শুইয়ে দিয়ে লাইট অফফ করে তার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে শিখন। অসিফাকে ঘুম পাড়ানোর উদ্দেশ্যে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিজেই যে কখন ঘুমিয়ে পড়ে তা আর টের পায়না শিখন৷ ঘুমন্ত শিখনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে অসিফা ফিসফিস করে বলে ওঠে,
“আমার নেতা সাহেব।”

“এখনো কি ভাবছো মেয়েকে কুমিল্লা নিয়ে যাওয়ার কথা? ছেলেটার দো’ষই বা কোথায় বলো?” (নিলুফা বেগম)

পানির গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে খাটের ওপর বসে নিলুফা বেগমের দিকে তাকিয়ে আসিফ খন্দকার বলে ওঠেন,
“আমি শিখনকে কিছু নিয়ে দো’ষ দিচ্ছি না। আমার মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে তো ভাবতে হবে নাকি?”

“তোমার এখনো মনে হচ্ছে শিখন অসিফার ব্যাপার নিয়ে হেলাফেলা করবে? নিশ্চিন্ত থাকো তুমি। মেয়েকে যখন শিখনের হাতে তুলেই দিয়েছো তবে পূর্ণ ভরসাটাও রাখো। আর পুলিশ তো তদন্ত করছেই ওই ঘটনা নিয়ে। যদিও আমরা জানি এর পেছনে কে আছে। কিন্তু আমাদের কাছে তো আর উপযুক্ত প্রমাণ নেই। তোমার জামাই ঠিকই কোনো না কোনো প্রমাণ খুজে বের করবেই দেখো।”

“আমিও সেই আশাতেই আছি। মেয়েটার দিকে যখন তাকাই তখন ওর চোখে-মুখে ভেসে বেড়ানো য’ন্ত্র’ণা গুলো আমাকে একটা সেকেন্ড শান্তিতে থাকতে দেয়না নিলুফা। মন চায় ওই জা’নো’য়ার’রটাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলি।”

“মাথা ঠান্ডা করো। মেয়েকে কখনো ভেংগে পড়েছ তা বুঝতে দেওয়া যাবেনা। আমরা একটু বুঝে-শুনে কাজ না করলে সব ইফেক্ট গিয়ে ওর ওপর পড়বে। আর কোনো আত্মীয়-স্বজনকেও আসতে বলার দরকার নেই। মেয়ে সুস্থ হবে তারপর তারা দেখা করতে আসবে। আমাদের সন্তানদেরকে বেশির ভাগ সময়ে ভেংগে দাবিয়ে দেওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় হাত থাকে আমাদের আত্মীয়-স্বজনদেরই।”

“এবার বুঝলাম তবে, কেন তুমি মেয়ের বোর্ড পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিনগুলোতে হাতে গোনা কিছু সংখ্যক আত্মীয়-স্বজন বাদে বাদ-বাকিদের কল কেন রিসিভ করতে না।” (আসিফ খন্দকার)

“জ্বী হ্যা মশাই। কারণ তারা কি বলতে পারে সেসব কথা-বার্তা আমার আগে থেকেই মুখস্থ। ‘এ প্লাস তো এখন সবাই পায়। এ আর এমন কি?’ এসব কথা-বার্তাই তাদের মুখ হতে শোনা যায়। তারা ভালোটাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করতে পারেনা কখনো। কোথা থেকে একটু খুত খুজে বের করা যায় এটাই তাদের মুখ্য কাজ। কে আমাকে কি ভাবলো তাতে আমার কিছু আসে যায়না। কেননা আমাদের দুঃসময়ে তাদের কখনোই আমরা পাশে পাব না। আমার সন্তানের খুশিই আমার কাছে সব। তবে সবাই যে সমান এমনটাও না। তুমি দ্রুত ঘুমিয়ে পড়। কাল তো তোমাকে কুমিল্লায় ফিরতে হবে।”

হ্যা যাচ্ছি যাচ্ছি। তার আগে চলো একটু চা খাই আর চাঁদ দেখি বারান্দায় দাঁড়িয়ে। তবে তবে.. আমার নিজের চাঁদটাই বেশি সুন্দর।” (আসিফ খন্দকার)

আসিফ খন্দকারের কথা শুনে লজ্জা পাওয়ার ভংগিমায় নিলুফা বেগম বলে ওঠেন,
“তুমি আর বদলালেনা। মেয়ে যে বিয়ে দিয়েছো তা কি মনে আছে?”

“আজব! মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সাথে এই কথার সম্পর্ক কি? মেয়ে বিয়ে দিয়েছি তো কি হয়েছে? আমার কি শখ আহ্লাদ নেই?”

“তোমার সাথে আমি কথা বলে পারব না। তুমি বারান্দায় গিয়ে বসো তো যাও। আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
——
ভোর ছয়টা নাগাদ শিখন অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। আজ প্রায় দেড় মাস পরে সে অফিসে যাচ্ছে। এতদিন তার ম্যানেজারই সকল প্রকার তথ্যাদি তাকে হোয়াটসঅ্যাপ এবং ই-মেইল এর মাধ্যমে দিয়ে এসেছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফাইলে সাইন করার তাগিদেই মূলত আজ ছুটে যেতে হচ্ছে তাকে। অসিফা ঘুম থেকে জাগার আগেই তাকে ফিরতে হবে আবার।

সকাল দশটা,
আড়মোড়া ভেঙে শোয়া হতে উঠে বসে অসিফা। পাশে ফিরে তাকাতেই দেখে শিখন নিজের কপালে হাত দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। সন্দেহপ্রবনতায় ভুক্ত অসিফা তাপমাত্রা পরীক্ষা করার জন্য শিখনের কপাল ও গলায় হাত ছোয়ায়। হালকা জ্বর আছে অনুভব করে আঁতকে ওঠে সে।
কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে তাকায় শিখন। অসিফাকে৷ চিন্তিত ভংগিতে বসা দেখে শিখিন দ্রুত উঠে বসে।

“তুমি উঠে গেছো?”

“আপনার জ্বর এসেছে?” (অসিফা)

“আর বলো না অফিস থেকে আসার পর হতে মাথা ব্য’থাটা যে এত বেড়েছে! এখন দেখছি হালকা জ্বরও এসেছে। ঠিক হয়ে যাবে এটা। তুমি চিন্তা করো না তো। বাথরুমে চলো ফ্রেশ হবে।”

“আপনি শুয়ে থাকুন। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

মাথাব্যথা তীব্রতর হওয়ায় আর কথা বাড়ায় না শিখন। আস্তে করে বালিশে মাথা এলিয়ে দেয়।
অসিফা দ্রুত পায়ে বাথরুমে চলে যায়।
বাথরুমে প্রবেশ করতেই হঠাৎ গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে যায় অসিফার। হঠাৎ হঠাৎ তার নিজেকে কেমন যেন পা’গ’ল পা’গ’ল মনে হয়। তবে এত ক’ষ্টের মাঝেও তার মনে সুখ বিরাজ করছে। ক’জনের কপালেই বা এমন স্বামী জুটে? যে কি না সকল পরিস্থিতিতেই তাকে উ’ন্মা’দে’র মতো ভালোবাসে। দিনকে দিন ভালোবাসা বাড়ছে বৈকি কমছে না।

টিভি খুলতেই সকালের ব্রেকিং নিউজ দেখে চমকে ওঠেন আসিফ খন্দকার ও নিলুফা বেগম। বাবা-মায়ের উল্লাসের শব্দ শুনে দ্রুত ড্রইং রুমে প্রবেশ করে অসিফা।

টিভিতে জয়ের বি’ধ্বস্ত অবস্থার একখানা ছবি দেখানো হচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে কে যেন তাকে বে’ধ’ড়’ক পি’টি’য়ে র’ক্তা’ক্ত করে ফেলেছে। আর তার নিচে একটা কথাই ভাসছে, “অসিফা খন্দকারের ওপর এসিড নিক্ষেপের দ্বায়ে নিজের হাতেই ছেলে জয়কে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন জনাব জাহিদ মির্জা এমপি।”

টিভির ভলিউম বাড়ানো থাকায় বেডরুম থেকেই সব শুনতে পায় শিখন। একা একাই হেসে ওঠে সে। অতঃপর মুখ থেকে তার একটা শব্দই বেরিয়ে আসে,

“ফাইনালি!”

চলবে…

#আফিয়া_অন্ত্রীশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here