বোবা টানেল পর্ব -১১

#বোবা_টানেল (১১)
অসিফাকে হাসতে দেখে শিখন বুঝে ফেলে আসলে কোনো সা’প ওখানে ছিলই না। অসিফা মজা নেওয়ার জন্য তাকে ভয় দেখিয়েছে। শিখন রাগে ফোসফোস করতে করতে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,
“বউ তুমি যদি চলো ডালে ডালে তাহলে তোমার জামাই চলে পাতায় পাতায়।”
শিখন ভালো করে লুংগি গিট্টু দিয়ে পুনরায় ঘাটে নেমে আসে। পানিতে ঝাপ দিতেই যাবে অমনি অসিফা বিচলিত কন্ঠে বলে ওঠে,
“এই এই আপনি পানিতে নামছেন কেন?”
এক পা এক পা করে পানিতে নামতে নামতে শিখন বলে ওঠে,
“তোমাকে চু’ব’নি দেওয়ার জন্য।”
“দে..দেখুন আমি আপনার একটা মাত্র বউ। আমি মরে গেলে আপনার কি হবে বলুন?”
“কেন আর একটা বিয়ে করব।” (শিখন)
“ও আম্মু গো বাচাও। এই লোক আমাকে মে’রে ফেলার বুদ্ধি করছে গো। দেখেন আপনি আর এক পা নামলে কিন্তু আমি আপনাকে ভোট দেবো না বলে দিলাম।”
অসিফার কথা শুনে শিখনের চোখ গোলগোল হয়ে যায়।
“এই এই আজ কিন্তু আবার আপনার সেই বন্ধুর বাড়িতে ঘটা লুংগির ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে যাবে বলে দিলাম।” (অসিফা)
“ছাইড়া দে বউ। আর জীবনেও তোর সামনে লুংগি পড়তাম না।” বলতে বলতে লুংগি ধরে দৌড়ে উপরে উঠে যায় শিখন।
শিখন মনে মনে বলতে আরম্ভ করে,
“শিখনরে এই কি জিনিস বিয়ে করলিরে! এ তো তোকে হাটে বেচে দিয়ে আসার ক্ষমতা রাখে। ফাইসা গেছস রে শিখন ফাইসা গেছস।”

—–
পুকুর থেকে গোসল সেরে সকালের খাবার খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিয়েছিল শিখন ও অসিফা। দুপুরে জমিলা বেগমের ডাকেই ঘুম ভাংগে তাদের। দুপুরের খাবার দিয়েই তিনি চলে যান।বারান্দায় মাদুর পেতে খেতে বসেছে শিখন ও অসিফা। শিখন নিজে খাচ্ছে আবার অসিফাকেও খাইয়ে দিচ্ছে। আর অসিফা বসে বসে শিখনকে পাখা দিয়ে বাতাস করছে।

“লুংগি জামাই! আপনি কি রা’গ করেছেন আমার ওপর?”
অসিফার মুখে “লুংগি জামাই” ডাক শুনে শিখনের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়। হাত থেকে ভাতের থালাটা মেঝেতে রেখে অসিফাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
“তুমি এই অদ্ভুত অদ্ভুত নামগুলো কোথায় পাও অসিফা?”
“না মানে নামটা অনেক কিউট। আর আপনিও তো অনেক কিউট। তাই দুই কিউটকে একসাথে মিলিয়ে দিলাম আরকি।”
“তুমি দিন দিন যে কি পরিমাণ ফা’জি’ল হয়ে যাচ্ছো বউ। আর ফা’জি’ল হবেই বা না কেন? কার বউ তা দেখতে হবে না? কিন্তু বউ এই নামে তুমি আমাকে যত ইচ্ছা ডাকো। তবে মানুষের সামনে ডেকো না প্লিজ। নাও এখন হা করো।” বলেই ভাতের থালাটি পুনরায় হাতে তুলে নেয় শিখন।
অসিফা এক হাত দিয়ে বাতাস করতে করতে মুচকি হাসতে থাকে আর বিড়বিড় করে বলতে থাকে,
“আমাকে যেমন পু’ড়ি’য়ে’ছেন তার প্র’তি’শো’ধ আমি কিভাবে না নিয়ে পারি বলুন? তবে সেগুলো হবে মি’ষ্টি প্র’তি’শো’ধ।”
——
“বউমা পোলাটারে সুখে শান্তিতে রাইখো। একটা মানুষ এতো ভালোবাসবার পারে তা তোমার জামাইরে না দ্যাখলে আমি বুঝতাম না। গ্রামের সবাই প্রথমদিন তোমার জামাইর কান্ড দেইখা অবাক হইয়া গেছিল। তন্নতন্ন কইরা খুইজা আমাগো এই বাড়িটা খুইজ্জা বের করছিল। তোমার চাচায় তো কোনো ভাবে রাজি না এই বাড়িতে অপরিচিত কাউরে উঠতে দিতে। তোমার জামাই তারে কতভাবে বুঝাইলো। শ্যাষে যখন কইলো তোমার নাকি বিরাট শখ এরাম একখান গেরাম আইসা থাকবার। এরাম একখান মাটির ঘরে থাকবার। তোমার প্রতি এত ভালোবাসা দেইখাই হেয় রাজি হইয়া গেছিল। জানো রাইতে বাড়ি ফিররা কতো যে গল্প কইলো তোমার জামাইরে নিয়া। এমন জামাই লাখে একটা মিলে বউমা। আগলাইয়া রাইখো।”

জমিলা বেগমের কথা শুনেই চোখ টলমল হয়ে আসে অসিফার। বারান্দা হতে উকি দিয়ে একবার রুমের ভেতরে খাটে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে থাকা শিখনের দিকে তাকায় সে।
“বউমা তুমিও এখন একটু ঘুমাও। আমি যাই তোমার চাচারে এখনো দুপুরের খাওন দেইনাই।”

জমিলা বেগম চলে যেতেই অসিফা রুমের ভেতরে চলে যায়। খাটে বসতে নিতেই খালি গায়ে উবুড় হয়ে শুয়ে থাকা শিখনের পিঠের দিকে নজর চলে যায় অসিফার। পিঠের তিন-চার জায়গায় বড় বড় পো’ড়া দাগ।দেখেই বোঝা যাচ্ছে গরম কিছু বারবার পিঠে ঠে’সে ধরা হয়েছে। চোখ উপচে জল চলে আসে অসিফার। হিচকি টানতে টানতে শিখনের পিঠের পো’ড়া দাগের জায়গাগুলোতে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে অসিফা।
—-
আকাশ বেয়ে নেমে এসেছে ঘন অন্ধকার। একফালি চাঁদও মাঝেমধ্যে মেঘের আড়াল হতে উঁকি দিচ্ছে। রাত প্রায় ১টার কাছাকাছি। ঘরের বারান্দায় শিখনের ঘাড়ে মাথা দিয়ে চোখ বুজে আছে অসিফা।
“একটা কথা জিজ্ঞাসা করি নেতা সাহেব?”
“হ্যা অবশ্যই।”
“আপনার পিঠে পো’ড়া দাগ গুলো কিভাবে এলো?”

অসিফার প্রশ্নে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিখন। অতঃপর শান্ত কন্ঠে বলতে আরম্ভ করে,
“অনেক ছোটবেলা থেকেই দেখেছি বাবা আর মায়ের মধ্যে ভিষণ ঝামেলা হতো মেয়েদের সাথে অবাধ মেলামেশার জন্য। আমার মা থাকতেও বাবা ওই সিতারা বেগমের সাথে প্রেমের সম্পর্কে লিপ্ত হয়। আমার মা এটা জানার পর হতে বাবার সাথে তার ঝামেলা আরও বাড়তে থাকে। একদিন হুট করে ওই সিতারা বেগমকে বিয়ে করে নিয়ে হাজির হয় বাবা। মা এই ঘটনা মেনে নিতে না পেরে আমাকে নিয়ে তখনই বাসা হতে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু!”

“কিন্তু কি” (অসিফা)

“কিন্তু সেদিন রাস্তাতেই মা হার্ট ফেল হয়ে মারা যায়। আমি সেদিন রাস্তার ওপর ” আমার মাকে এনে দাও” বলে চিৎকার করেছিলাম আর গড়াগড়ি খেয়েছিলাম। আমার মা ছিল আমার নানীর একমাত্র মেয়ে। নানী নানার মৃ’ত্যু’র পর হতে নানার পেনশনের টাকা দিয়েই কোনো মতে খেয়ে-পরে থাকত। আমাকে দেখার মতো অত সামর্থ্যও ছিল না তার। আমাকে বাবা বাসায় নিয়ে যাওয়ার পরে নানী তাকে কল দিয়ে হু’ম’কি দিয়েছিল,”আমার যত্নে যদি কোনো ঘাটতি হয় বা আমার লেখাপড়া নিয়ে যদি হেরফের করা হয় তবে সে বাবার নামে থানায় মা’ম’লা ঠুকে দেবে। আমার জন্যই আমার নানী মায়ের মৃ’ত্যু’র পেছনে দায়ীদের নামে মা’ম’লা করেনি। যেন আমার ভবিষ্যতের ওপর কোনো ইফেক্ট না পরে। বাবা জে’লে চলে গেলে আমার খাওয়া-পরা আর লেখাপড়া কোনোটারই সুযোগ থাকত না। বাবাও ওই হু’ম’কির জন্য ভয়ে ভয়ে থাকত। কিন্তু আমার সৎ মায়ের আমার ওপর আ’ক্রো’শ দিনদিন বেড়েই যাচ্ছিল। আমাকে ঠিকঠাক খেতে দিতো না। আমার বই-খাতা ছিড়ে ফেলতো। এইযে আমার পিঠে পো’ড়া দাগ দেখছো? ওই মহিলাই গরম খু’ন্তি আমার পিঠে ঠে’সে ধরেছিল। বাবাকে কিছু না বলে দেই তাই ভয় দেখাতো। নানীও ঠিক দুই বছরের মাথায় মা’রা যায়। অনেক কষ্টে নিজের লেখাপড়াটা টিকিয়ে রেখেছিলাম। পরে ওই মহিলার আদেশে বাবা আমাকে বোর্ডিং স্কুলে রেখে আসে। তারপর হতে বোর্ডিং স্কুলেই বড় হতে থাকি। নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত করতে থাকি যেন কেউ অন্যায় করে আমার সামনে হতে বেচে যেতে না পারে। এসএসসি শেষ করার পরে আমি বোর্ডিং স্কুল হতে বাসায় ফিরে যাই। আর তারপর হতে শুরু হয় আমার অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। এত রা’গ,এত জে’দ, এই ঠোঁট কা’টা স্বভাব শুধু শুধু আসেনি আমার মাঝে। জানো মা মা’রা যাওয়ার পরে আমাকে কেউ ভালোবাসেনি। কেউ একটু খাইয়ে দেয়নি, ঘুম পাড়িয়ে দেয়নি। অন্ধকার রুমে একা একা ঘুমাতে ভয় পেতাম আমি। কিন্তু কেউ কখনো বোঝেনি যে, ওই ছোট বাচ্চাটার অন্ধকারে ভয় লাগতে পারে। আমার বাবা আমার সাথে বোর্ডিং স্কুলে দেখাও করতে যেতোনা। এক ছিল নানী। সেও আমায় একা ফেলে চলে গিয়েছিল। ওসব মনে পড়তেই মাঝে মাঝে যে বুকের মধ্যে কেমন ব্য’থা করে বুঝবেনা অসিফা। ওদের কাউকে আমি ক্ষমা করব না। সবাইকে প’স্তা’তে হবে। আমি মাতৃহারা হয়েছি শুধু ওদের জন্য।”
কথার মাঝেই শিখন টের পায় অসিফা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। অসিফার দিকে ফিরে তাকাতেই অসিফা ঝাপিয়ে পড়ে শিখনকে জড়িয়ে ধরে।

“আপনার বুকের মধ্যে এত ক’ষ্ট, এত ব্য’থা কিন্তু আমাকে কেন একটু বললেন না? আমি কখনো আপনাকে ছেড়ে যাব না নেতা সাহেব। এইযে ঠিক এভাবে আপনাকে বেধে রাখব আমার সাথে। আপনার সব ক’ষ্ট আমি মুছে দেব। অনেক অনেক ভালোবাসব আপনাকে।”

শিখন বুঝতে পারে তার চোখ উপচে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। ক্ষানিকটা হেসে অসিফার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে ওঠে,
“আমার পাগলি বউরে।”
——–
ভোর প্রায় পাঁচটার দিকে উঠে শিখন অসিফাকে ডাকতে আরম্ভ করে।
“অসিফা ওঠো নামাজ পড়বে না? তোমার জন্য কিন্তু একটা সারপ্রাইজও আছে।”
অসিফা ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে ওঠে,
“একটু পরে উঠি না প্লিজ।”

শিখন এক হাতের মুঠোয় ব্রাশ আর পেস্ট নিয়ে অসিফাকে পাজকোলা করে পুকুর ঘাটে নিয়ে নামিয়ে দেয়।
“তাড়াতাড়ি ব্রাশ করে, ওযু করে রুমে চলো। ওয়াক্ত পার হয়ে যাচ্ছে।”
অসিফা ঘুম ঘুম চোখে ব্রাশ করতে করতে আকাশের দিকে তাকায়। চারদিকে এখনো হালকা হালকা অন্ধকার বিরাজমান। সূর্যের আলোর দেখা এখনো মেলেনি। শিখন ঘাট হতে উঠে ওপরে গিয়ে দাড়িয়েছে টর্চলাইট নিয়ে।

নামাজ শেষ করে একটা সাইকেল নিয়ে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে অসিফাকে ডেকে ওঠে শিখন। অসিফা বাইরে বেরিয়ে এসে শিখনকে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে যায়। সে ঠিক যা যা বলেছিল শিখন ঠিক তা-ই করছে।

“কি ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? নাকি যাবে? রোদ বেড়ে গেলে সাইকেলে গ্রাম ঘুরে মজা পাবেনা।
” আপনি সাইকেল চালাতে পারেন?”
“ওই একটু আধটু পারি।
” আমার কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছেনা নেতা সাহেব!”
“আরে উঠেই দেখো না।”

অসিফাকে সাইকেলের সামনে বসিয়ে সারা গ্রাম ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায় শিখন। বিলে গিয়ে নৌকা ভ্রমণ, বিলের শাপলা তুলে গহনা বানিয়ে অসিফাকে পরিয়ে তার দিকে হা হয়ে শিখনের চেয়ে থাকা। সবই যেন আজ স্বপ্ন মনে হচ্ছে অসিফার কাছে। অসিফা বারবার প্রার্থনা করছে, সময় এখানেই থেমে যাক। সে আর শিখন এভাবেই থাকুক আজীবন।
—-
দুদিন পরে ঢাকায় ফিরে আসে অসিফা ও শিখন। ঢাকায় ফিরেই দুজনের ব্যস্ত জীবন শুরু হয়ে গেছে। এর মাঝে তারা বাসাও পরিবর্তন করে ফেলেছে।

ক্লাস শেষে ভার্সিটির সামনে দাড়িয়ে শিখনের জন্য অপেক্ষা করছিল অসিফা। প্রতিদিন শিখনই অসিফাকে ভার্সিটিতে পৌছে দেয় আবার নিয়ে যায়। আজ ভার্সিটিতে শিখনের শেষ ক্লাস থাকায় আসতে একটু লেট হচ্ছে। অসিফা বারবার রাস্তার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর হাত ঘড়িতে সময় দেখছে। হঠাৎ একটা কালো রঙয়ের হেলমেট পরিহিত এক লোক মোটরসাইকেল নিয়ে থামে অসিফার সামনে। অসিফাকে কিছু ভাবার সময় না দিয়েই কালো হেলমেট পরিহিত মোটরসাইকেল ওয়ালা বলে ওঠে, “হ্যাপি ম্যারিড লাইফ।” আর হাতে থাকা একটা বোতলের মুখ খুলে তরল পদার্থ ধরনের কিছু একটা অসিফার মুখে ছুড়ে দিয়ে মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে যায়।
এটা যে এ’সি’ড ছাড়া আর কিছুই না তা বুঝতে সময় লাগেনা অসিফার। অসহ্য য’ন্ত্র’ণা’য় দুই হাত দিয়ে মুখখানা চেপে ধরে ছটফট করতে করতে রাস্তাতেই পড়ে যায় সে। এমন দৃশ্য দেখে আশেপাশের মানুষজন দিগবিদিক দিয়ে ছুটে আসতে আরম্ভ করে।

চলবে…

#আফিয়া_অন্ত্রীশা

[এবার নিজেদের মনকে শক্ত করে নিন। হ্যাপি রিডিং💓]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here