#বোবা_টানেল (০৩)
গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে দৌড়েও সেই স্কুটিওয়ালীর নাগাল পায় না শিখন। ব্যথাতুর দৃষ্টিতে হাটু গেড়ে রাস্তার ওপর বসে পড়ে হা’উ’মা’উ করে কেঁদে ওঠে সে। সাধারণত কোনো পুরুষ মানুষকে হা’উ’মা’উ করে কাঁদতে দেখে পরিচিত-অপরিচিত সকলেরই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়। তারপর আবার যার থেকে ওমন ধরনের আচরণ কখনো আশা করাই যায় না, তার থেকে সেই আচরণ পেলে মানুষ নির্ঘাত কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যাবে। শিখনের সাথে থাকা দলের লোকজনেরও ঠিক সেই অবস্থা। শিখনের অবস্থা দেখে সকলেরই কেমন মস্তিষ্ক খালি হয়ে গেছে। শিখন সেই বসা অবস্থাতেই কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে,
“সেদিনও যেমন ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছিলে আজও তেমন ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে। তোমায় কোথায় না খুজেছি! সারা কুমিল্লা জেলা চষে বেড়িয়েছি। কিন্তু তোমার দেখা পাইনি। এখনো সপ্তাহ ঘুরে বৃহস্পতিবার আসলেই কুমিল্লায় ছুটে যাই, যদি একবার তোমার দেখা পাই! কিন্তু তুমি যে আমার শহরেই লুকিয়ে বেড়াচ্ছ আমার থেকে। তোমার প্রেমিক ভালো নেই প্রিয় তন্দ্রাহরণী। তোমার অভিমান তাকে জ্বা’লি’য়ে পু’ড়ি’য়ে ছারখার করে দিচ্ছে। অভিমানের তেজ বুঝি এত জ্বা’লা’ম’য়!”
দলের লোকজন হন্যে হয়ে শিখনের কাছে ছুটে আসে।
“ভাই? আপনার কি হয়েছে? কাদছেন কেন?”
উক্ত প্রশ্নদয় শিখনের কানে পৌছাতেই হঠাৎ চুপ হয়ে যায় সে। সকলকে পুনরায় অবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবীর হাতায় চোখ মুছে নেয় শিখন। ধরা গলায় সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
“আমি ঠিক আছি। একটা কাজ করো, কেউ একজন সিএনজি ডাকো ফাস্ট। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। এমনিতেও বহুত সময় অপচয় হয়ে গেছে।”
কান্না চেপে কথাগুলো বলতে গিয়ে যেন শিখনের গলা ছি’ড়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল।
শিখনকে হেলেদুলে হাটতে দেখে দলের একজন ছেলে এসে কাপা কাপা হাতে শিখনকে ধরে নিয়ে হাটতে থাকে। শিখন তাতে কোনো হেলদোল দেখায় না। সিএনজি আসতেই তাতে চড়ে বসে সে।
–
এদিকে হাইস্পিডে কিছুদূর স্কুটি চালিয়ে এসে কন্ট্রোল হারিয়ে মাঝ রাস্তায় স্কুটি নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় অসিফা। মাথা ফে’টে র’ক্তে মাখামাখি হয়ে যায় তার সারা দেহ। “আমি তোমার মুখও দেখতে চাইনা” উক্ত বুলি আওড়াতে আওড়াতে চোখ বুজে আসে অসিফার। সকল চলন্ত গাড়ি রাস্তায় পড়ে থাকা অসিফার দেহের সামনে এসে থামতে শুরু করে। রাস্তার এপার-ওপার হতে লোকজন ছুটে এসে ঘিরে ধরে তাকে। সকলে ধরা-ধরি করে নিকটবর্তী হসপিটালে নিয়ে যায় অসিফাকে।
–
সিএনজি এসে ভার্সিটির সামনে থামতেই শিখনের চোখ-মুখ কুচকে আসে। ভার্সিটির সামনে ছাত্র-ছাত্রীদের ঢল ও পুলিশ ফোর্স দেখে তার মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে ওঠে। সিএনজি হতে নেমে দৌড়ে ভীড় ঠেলে ভার্সিটির ভেতরে প্রবেশ করে শিখন। পুরো ক্যাম্পাস খালি করে দিয়েছে পুলিশ। শুধু কয়েকজন প্রফেসর, ছাত্রদলের গুটিকয়েক সদস্য ও দুজন পুলিশ অফিসার সেখানে উপস্থিত রয়েছে। শিখন দ্রুত পায়ে তাদের নিকট এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে ওঠে,
“এখানে কি হয়েছে? আমাকে কল করে বলা হয়েছে ক্যাম্পাসে ছোটখাটো একটা ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু এখানে আসার পরে বুঝলাম ছোটখাটো না বেশ বড় রকমেরই কিছু একটা ঘটেছে।”
“ভাই আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী জয় ভাইয়ের ছেলেদের সাথে আপনাদের ডিপার্টমেন্টের কিছু ছাত্রের এক কথায় দুই কথায় মা’র’পি’ট লেগে যায় ক্যাম্পাসের ভেতরেই। তারপর ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ড. আসাদুজ্জামান স্যার ঝামেলা থামাতে আসেন। ওই মুহূর্তে জয় ভাইয়ের ছেলেদের মধ্যে একজন একটা ইট ছুড়ে মাড়ে আর তা সোজা স্যারের মাথায় এসে লাগে। তারপর ওই ঝামেলার মধ্যেই স্যারকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর এদিকে তো মা’রা’মা’রি আরও দ্বিগুণ হারে বেড়ে গেলে পুলিশ ফোর্স এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়। ক্যাম্পাসে আপনি ছিলেন না কিছুক্ষণ আর তার মধ্যেই কত কিছু ঘটে গেল।”
হিং’স্র কন্ঠে শিখন বলে ওঠে, “তা সেই মহা পুরুষেরা কোথায়?”
“সবাইকে থানায় নিয়ে গেছে ভাই। কিন্তু স্যারের অবস্থা খুব খারাপ শুনলাম। আপনি একটু দ্রুত হসপিটালে যান আমরা এদিকটা সামলাচ্ছি।”
পোশাক বদলে শিখন তার লোকজন নিয়ে হসপিটালের দিকে ছুট লাগায়। যেতে যেতে মাথায় বহু অংকের হিসাব মেলাতে থাকে। এই ‘জয়’ নামক ব্যক্তিকে তার ভিষণ সন্দেহ হয়। এমপির ছেলে হওয়ায় সারা ভার্সিটিতে দাপট দেখিয়ে বেড়ায় সে। ভার্সিটির ভিপি পদের নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এই জয়। কিন্তু নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর হতে সবসময় এই জয় তার দিকে কেমন হিং’স্র চোখে তাকিয়ে থাকে। আজকের এই ঘটনার পেছনেও যে তার হাত রয়েছে তা আর বুঝতে বাকি নেই শিখনের।
–
প্রফেসর ড. আসাদুজ্জামানের জ্ঞান ফিরেছে ঘন্টা খানেক হবে। সার্বিক তদারকি শেষে ড. আসাদুজ্জামানের কেবিন হতে বেরিয়ে আসে শিখন। যাত্রা পথে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড হতে দুজন নার্স স্ট্রেচার ট্রলি ঠেলে নিয়ে যাওয়ার সময় একপাশে সরে দাঁড়ায় সে। আচমকা ট্রলিতে অচেতন অবস্থায় শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে সে। গায়ের সর্ব শক্তি দিয়ে ট্রলিটা টেনে ধরে শিখন।
“একি আপনি করছেন কি? ট্রলি ছাড়ুন রোগীকে কেবিনে শিফট করতে হবে।” (নার্স)
শিখন ছুটে গিয়ে ট্রলিতে শুয়ে থাকা মানুষটার মুখখানা ধরে করুণ সুরে বলে ওঠে,
“এই অসিফা কি হয়েছে তোমার? তোমার মাথায় ব্যান্ডেজ কেন? এই মেয়ে কথা বলছ না কেন? আমার ওপর তোমার এত অভিমান?”
“আরে আপনি পা’গ’ল নাকি? দেখছেন না রোগীর এখনো জ্ঞান ফেরেনি?দেখি সরে দাড়ান পথ থেকে।”
“আগে বলুন আমার অসিফার কি হয়েছে? ওর মাথায় ব্যান্ডেজ কেন?”
“ভাই আপনি যদি এনাকে চিনে থাকেন তবে আমাদের রিসিপশনে যান। এনার পরিচয় ঠিকভাবে পাওয়া যায়নি আর এনার কোনো পরিবারের লোকজনদের সাথেও আমরা কন্টাক্ট করতে পারিনি।”
শিখন একবার অসিফার মুখের দিকে তাকিয়ে দৌড়ে হসপিটালের রিসিপশনে চলে যায়। দ্রুত ভংগিতে রিসিপশনিস্টকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
“এক্সকিউজ মি!”
“জ্বী স্যার বলুন?”
“যে পরিচয়হীন মেয়েটাকে ইমার্জেন্সিতে নেওয়া হয়েছিল তার পরিচিত আমি।”
“আপনি কি অসিফা খন্দকারের কথা বলছেন স্যার?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ।”
“স্যার উনি এ’ক্সি’ডে’ন্ট করে র’ক্তা’ক্ত হয়ে রাস্তায় পড়েছিলেন। তারপর পথচারীরা তাকে আমাদের হসপিটালে নিয়ে আসেন। আর তাদের মধ্যে থেকে একজন অসিফা খন্দকারের মোবাইল ফোন এবং স্টুডেন্ট আইডি কার্ড আমার কাছে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই স্টুডেন্ট আইডি কার্ড হতেই আমরা তার নাম জানতে পেরেছি। কিন্তু মোবাইল ফোনটা ভেংগে যাওয়ায় আমরা তার পরিবারের কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। পুলিশও তদন্ত করছে। স্যার আপনি অসিফা খন্দকারের কি হন?”
শিখন আমতা আমতা করে বলে ওঠে,
“বন্ধু। আচ্ছা ওই আইডি কার্ড এবং মোবাইল ফোনটা আমাকে দেন তো। আমি ওর সিমটাকে আমার ফোনে এ্যাক্টিভেট করে আংকেল-আন্টির সাথে কন্টাক্ট করছি।”
“গুড আইডিয়া। নিন স্যার।”
“ধন্যবাদ। আর বিল যা হয়েছে আমার নামে করে দিন। আমি পরিশোধ করে দেব।”
রিসিপশনিস্টের থেকে অসিফার আইডি কার্ড এবং মোবাইল ফোনটা নিয়ে অসিফাকে শিফট করা কেবিনে প্রবেশ করে শিখন। বেডের পাশে থাকা চেয়ারটায় নিঃশব্দে গিয়ে বসে পড়ে। মিনিট কয়েক অসিফার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর শিখন লক্ষ্য করে তার চোখে পানি চলে এসেছে। দুপুরের মতো এখনো গলার ভেতরটা কেমন যেন ছি’ড়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।
ধরা ধরা গলায় অসিফার দিকে তাকিয়ে শিখন বলে ওঠে,
“ভেবেছিলাম আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাওয়ার পর বোধ হয় তুমি সুখেই আছো আর আমিই বোধ হয় একা পু’ড়’ছি। কিন্তু তোমার এই মুখশ্রী আজ আমায় জানান দিয়ে দিল যে, আমার চেয়েও শতগুণ তুমি পু’ড়ে’ছ এবং পু’ড়’ছ। আজ দুপুরে তোমার কান্ড আমায় জানান দিয়ে দিল তোমার অভিমানের গভীরতা সম্পর্কে। তিন তিনটে বছর ধরে জমানো তোমার এই অভিমান কি অতি সহজে তোমার নেতা সাহেব ভাংগাতে পারবে প্রিয় তন্দ্রাহরণী?
ক্ষানিক দম নিয়ে শিখন পুনরায় বলতে আরম্ভ করে,
“আমার জন্যই তোমার আজ এই অবস্থা। কিভাবে আমি নিজেকে ক্ষমা করি বলো?” শিখনের চোখের পানি আর বাধ মানেনা। টুপটুপ করে গড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে অক্ষিকোটর হতে। এর মধ্যেই কেবিনে একজন নার্স এসে বলে ওঠে,
“দেখুন! রোগীর জ্ঞান না ফেরা অব্দি আমরা কাউকেই তাদের কেবিনে ঢুকতে দেইনা। কিন্তু আপনার অনেক রিকুয়েস্টের জন্য আমরা বাধ্য হয়ে আপনাকে ঢুকতে দিয়েছি রুমে। প্লিজ কোনো শব্দ করবেন না রোগীর পাশে বসে।”
চোখ মুছে নিয়ে শিখন বলে ওঠে,
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
এর মাঝেই অসিফার জ্ঞান ফিরে আসে। কেবিনে ডাক্তার ও নার্সরা ছুটে আসতেই শিখন দ্রুত কেবিন হতে বেরিয়ে যায়। আপাতত সে চায়না অসিফার সামনে যেতে। নতুবা মেয়েটা এই অবস্থাতেই চি’ল্লা’পা’ল্লা করে উঠতে পারে তাকে দেখে। অসিফার রেস্টের প্রয়োজন দেখে ডাক্তারের ইশারায় একজন নার্স এসে ঘুমের ই’ঞ্জে’ক’শ’ন পুশ করে দেয়।
শিখনের কল পাওয়ার পরে রাত নয়টার দিকে কুমিল্লা হতে ঢাকায় ছুটে আসেন আসিফ খন্দকার ও নিলুফা বেগম। সারাটা পথ কা’ন্না করতে করতে এসেছেন নিলুফা বেগম। আসিফ খন্দকার বেশ অবাক হয়েছেন তার স্ত্রীর এহেন আচরণ দেখে। আগে কখনো তিনি নিলুফা বেগমকে এভাবে ভেংগে পড়তে দেখেননি।
ঘুম ভাংতেই মাথার পাশে নিলুফা বেগমকে বসে থাকতে দেখে মুচকি হেসে ওঠে অসিফা। নিলুফা বেগম বিচলিত ভংগিতে জিজ্ঞাসা করে ওঠেন,
“এখন কেমন লাগছে মা তোর?”
অস্পষ্ট স্বরে অসিফা বলে ওঠে,
“ভালোই লাগছে। বাবা কোথায়?”
“এইতো একটু আগেই কেবিন হতে বেরিয়ে কোথায় যেন গেল। হয়তো ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেছে।”
মা ও মেয়ের কথার মাঝেই কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে এসে দাঁড়ায় শিখন।”
নিলুফা বেগমের বুক কাপতে শুরু করে। এই বুঝি তার মেয়ে ছটফট করা আরম্ভ করবে বা চি’ল্লা’পা’ল্লা করে উঠবে। কিন্তু নিলুফা বেগমকে অবাক করে দিয়ে অসিফা বেশ স্বাভাবিকভাবেই বলে ওঠে,
“উনাকে এখান থেকে চলে যেতে বলো মা।”
চলবে…
#আফিয়া_অন্ত্রীশা