ভাগ্যের সীমারেখা পর্ব -০১

গতরাতে অন্ধকারে তোর দেবর আসিফ আমার শরীর থেকে ওড়না সরিয়ে দিয়েছে রে আপা। যেই আমার গায়ে হাত দিবে হঠাৎ আমি জেগে যায় তখন। আমি জাগতেই সে হুড়মুড় করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আমি আর তোর বাসায় থাকতে পারবোনা রে আপা। আমি গার্লস হোস্টেলে থাকবো প্রয়োজনে।

তোর দেবরের চরিত্র এমনিতেও ভালো লাগেনা আমার। কেমন যেনো অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে। গায়ে পরা একটা ছেলে। আমার খুব অস্বস্তি লাগে রে আপা। তোর পায়ে পরি আপা আমাকে যেতে দে। আমার জন্য তোর সংসারে কোনো অশান্তি হোক তা আমি চাইনা।”

কান্নাজড়িতো কণ্ঠেই কথাগুলো বললো ইনাইয়া নাক টেনে টেনে। ইনাইয়ার বড় বোন আফরোজা চুপ হয়ে ইনাইয়ার সব কথা শুনলো। বোনকে কিছু বলার মুখ তার নেই। আফরোজার ভালো করেই জানা আছে তার দেবর তেমন সুবিধার নাহ। আফরোজাকেও কয়েকবার বাজে ইঙ্গিত দিয়েছে আসিফ। আফরোজার বিয়ে হয়েছে মাত্র ছয়মাস। আফরোজার পরিবারে ওর স্বামী দেবর আর শ্বাশুড়ি ছাড়া আর কেউ নেই। বিয়ের একমাস পরেই স্বামি আবরাহাম কে বলেকয়ে ইনাইয়াকে নিজের কাছে নিয়ে আসে আফরোজা। ইনাইয়া যখন মাত্র ১০বছর বয়সে পা রেখেছে তখনই এক দূর্ঘটনায় ওদের মা বাবা মা’রা যায়। আফরোজার বয়স তখন ১৫ বছর ছিলো।
মা বাবা মারা যা যাওয়ার পর দুই বোন খুব অসহায় হয়ে পরেছিলো। কোনো আত্মীয় স্বজন তাদের ছিলোনা কারণ তাদের বাবা মা ভালোবাসে বিয়ে করে অনেক দূরে চলে এসেছিলো নিজেদের পরিবার থেকে। কেউ মেনে নেয়নি তাদের সম্পর্ক। ইনাইয়ার নানা বাড়ি দাদা বাড়ি ঢাকায় আর ইনাইয়ার বাবা মা সংসার পেতেছে চট্টগ্রাম। ছোট থেকে ঢাকার কোনো আত্মীয়র সাথে কখনো পরিচয় হয়নি তাদের দুই বোনের তাই সাহস করে ঢাকাও যেতে পারছেনা তারা। আফরোজা মনে মনে খুব ভে’ঙে পরেছিলো ১০বছরের বোনকে নিয়ে সে কার কাছে যাবে এটা ভেবে। এভাবেই দেখতে দেখতে কয়েকমাস কাটলো দুই বোনের। বাবা মায়ের রেখে যাওয়া সব অর্থ শেষ হতে লাগলো আস্তে আস্তে, তারপর আবার বাড়িওয়ালাকে দিতে হয় ১০হাজার টাকা ভাড়া। দুটো বেডরুম দুটো ওয়াশরুম আর একটা কিচেনের একটা ভাড়াবাসা ১০হাজার টাকা। ১৫বছরের আফরোজা তখন পাগলপারা চিন্তায়। তারপর আবার দুই বোনের পড়ালেখার খরচ। সব মিলিয়ে আফরোজার চিন্তার শেষ ছিলোনা। তিন মাস ভাড়া আটকে ফেলার ফলে বাড়িওয়ালা তাদেরকে বের করে দেয় বাসা থেকে। আফরোজার চোখ মুখ যেনো অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিলো তখন। তারপর একদিন এক প্রতিবেশী আপা আফরোজাকে তার সাথে তার গার্মেন্টসে নিয়ে যায়। পরে এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত জবের পাশাপাশি আফরোজা নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যায় কোনোমতে। এভাবেই নিজের এসএসসির পরিক্ষার পর জব করে সংসার আর ইনাইয়ার পড়ালেখা চালিয়ে গেছে আফরোজা। সেদিন প্রতিবেশির সাহায্যে তিনহাজার টাকার এক রুমের একটা ভাড়া বাসা নেয় দুই বোনের জন্য। ১২হাজার টাকার জব করে সংসার বাড়ি ভাড়া ইনাইয়ার পড়ালেখার খরচ চালিয়ে মাসে আরো ৫০০ করে একটা মাটির ব্যাংকে জমা রাখতো আফরোজা। সেই টাকা দিয়ে ইনাইয়াকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পরে আবার কলেজে ভর্তি করে বই খাতা কিনে আর একটা স্মার্টফোন কিনে দিয়ে হাজার খানিক টাকা অবশিষ্ট ছিলো। সেই টাকা ইনাইয়ার হাতে দিয়ে আফরোজা বলে “আর ধরে রাখবোনা বোন তোকে। পড়ালেখার পাশাপাশি একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা করিস আর হ্যাঁ মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে আসিস বোন। তুই কোনো চিন্তা করিসনা তোর দুলাভাইকে বলে মাসে হাজার এক হাজার টাকা পাঠাবো আমি। ক্ষমা করে দিস বোন আমায়, তোর জন্য কিছুই করতে পারলাম নাহ। মন দিয়ে লেখাপড়া করিস।”

“তুমি আমার জন্য যা করেছো কারো মা বাবাও কারো জন্য এতো বেশি করেনা আপা। আমার গায়ের চামড়া দিয়েও যদি তোমার পায়ের জুতা বানিয়ে দিই তবুও এই ঋণ শোধ হবেনা। অনেক ভালোবাসি তোমায় আপা।”

“আমার বোনটা অনেক বড় হয়ে গেছে দেখছি। আর বড় হওয়া লাগবেনা, আমার কাছে সবসময়ই সেই ছোট্ট ইনু হয়ে থাকিস, তাতেই হবে।”

ইনাইয়া নিজের জামাকাপড় বই খাতা আর সব প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে একটা ওটোতে উঠে গেলো। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আফরোজার শ্বাশুড়ি খতিজা খাতুন থেকে বিদায় নিতে গিয়েও শুনতে হয়েছে কিছু কটু বাক্য। এই বাড়িতে আসার পর থেকে কখনোই খতিজা খাতুনের থেকে বিন্দু পরিমাণ স্নেহ দুই বোন পাইনি তবুও আফরোজার জন্য দাঁত কাঁমড়ে পরে ছিলো ইনাইয়া এই বাসায়। খতিজা খাতুন আফরোজাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি কারণ আফরোজা গার্মেন্টস কর্মী তাই। মা বাবা নেই, না জানি কিভাবে ছিলো মেয়েগুলো, চরিত্র কেমন মেয়েগুলোর এসবই ভেবে গেছেন খতিজা খাতুন সবসময়ই। আফরোজার বিয়ের পর থেকে আজ অব্ধি ওর সাথে একটা বাক্যও সুন্দর করে উচ্চারণ করেননি খতিজা খাতুন। আফরোজার স্বামী আব্রাহাম ভালো চরিত্রের ভালো মনমানসিকতার ছেলে বলেই আফরোজা সংসার করতে পারছে। স্বামীর দিক থেকে আফরোজা যেনো পৃথিবীর সবথেকে সুখী নারী তাই সে শ্বাশুড়ির কটুবাক্যে তেমন মন খারাপ করেনা কিন্তু ভেতরে ভেতরে কষ্টরা হাহাকার করে শুধু পারেনা সব বাঁধা পেরিয়ে চিৎকার টা বাহিরে বের হয়ে আসতে। আফরোজা যে গার্মেন্টসে জব করতো সেই গার্মেন্টসের সুপার ভাইজার আব্রাহাম। আফরোজার সরলতা চরিত্র আর মায়াবী হাসি মুগ্ধ করেছে আব্রাহামকে। তাই এক প্রকার মায়ের বিরুদ্ধে গিয়েই সে আফরোজাকে বউ করে নিয়ে আসে। যদিও আব্রাহাম বিয়ের আগে বিভিন্ন ভাবে খোঁজ নিয়েছে আফরোজার সম্পর্কে কিন্তু কোনো খারাপ ক্লু পাইনি তাই আব্রাহামের মুগ্ধতা আর ভালোবাসা আরো গাঢ় হয় আফরোজার প্রতি।
ইনাইয়া খতিজা খাতুনের রুম থেকে বের হয়ে বোনের কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কান্নায় ভে’ঙে পরে। ছোট থেকে কখনো আলাদা থাকেনি দুই বোন কিন্তু ভাগ্যের সীমারেখা আজ দুই বোনকে আলাদা করেই দিলো। আসিফ আড়ালে তাকিয়ে ইনাইয়ার পুরো শরীরে নজর বুলাচ্ছে আর আফসোস করছে। মেয়েটার তৃষ্ণা বুঝি থেকেই যাবে? মানতে পারছেনা আসিফ। ইনাইয়াকে একটিবার নিজের করে পাওয়ার নেশা আসিফের মনে আজন্ম বোধহয় থেকেই যাবে।
আব্রাহাম এখনো বাসায় আসেনি। মাত্র বেজেছে বিকাল ৪টা। আব্রাহাম আসতে এখনো অনেক সময়। সন্ধ্যা ৬টার পর বাড়ি ফিরবে সে। ইনাইয়া আফরোজাকে বলল “দুলাভাইকে বলিও আপা উনার প্রতি কোনো রাগ নেই আমার। আমি আমার পড়ালেখার সুবিধার জন্যই কলেজের কাছাকাছি চলে যাচ্ছি বলিও নয়তো দুলাভাই খুব মন খারাপ করবে। আর হ্যাঁ আপা তুমি একটু সাবধানে থেকো, কোনো সন্দেহ হলে সরাসরি দুলাভাইকে বলে দিও নয়তো আসিফ ভাইয়া সুযোগের পায়দা উঠাবে। চলি আপা।”

ওটো চলছে আপন মনে। বাতাসে যেনো গা শিউড়ে উঠছে ইনাইয়ার। বোনের জন্য মনটা ছটপট করছে খুব। দুলাভাই যদি ভুল বুঝে এভাবে চলে আশায় সেটাও ভাবছে সে। #ভাগ্যের_সীমারেখা কোথায় গিয়ে থামে কেউ বলতে পারবেনা। ইনাইয়া পড়ালেখা করতে চাই। পড়ালেখা করে বোনের কষ্টকে সার্থক করতে চাই। জীবনে প্রথম বোনের কাছে থেকে দূরে যাচ্ছে ইনাইয়া তাই কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে বুকের ভেতর। অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা ভাবনা হানা দিচ্ছে হৃদয়জুড়ে। প্রায়ই ২০মিনিট ধরে চলছে ওটো। হঠাৎ ওটো থেমে যাওয়ায় কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে গেলো সে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো পুরো রাস্তা জ্যাম। ইনাইয়ার আর বুঝতে বাকি রইলোনা যে আজ সন্ধ্যার আগে আর হোস্টেলে যাওয়া হবেনা, এইদিকে ইনাইয়ার বান্ধবীরা ওকে কল করেই যাচ্ছে। ইনাইয়ার একটুও ইচ্ছে করছে না এই মুহুর্তে কারো সাথে ফোনে কথা বলতে। কারণ জার্নি করার সময় ফোন হাতে নিতে ভীষণ বিরক্ত লাগে ওর। সামনেই ট্রেন রাস্তা, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার একটা ট্রেন এই মুহুর্তে যাবে সামনের রাস্তা দিয়ে তাই ১৫মিনিট আগে থেকেই গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইনাইয়ার মন খারাপের সাথে এবার যুক্ত হলো বিরক্তি, প্রচুর বিরক্ত লাগছে এই জ্যামে বসে থাকতে। হঠাৎ ইনাইয়ার চোখ গেলো ডানদিকে বাইকে বসে থাকা এক নবদম্পত্তির দিকে, মেয়েটি তার স্বামীকে দুই হাতে জড়িয়ে আগলে রেখেছে যেনো বাধন হালকা হলেই স্বামী নামক মানুষটা উড়ে যাবে বাতাসে। ১৭বছরের কিশোরীর মনে হলো এই দম্পত্তির মতো হয়তো একদিন তারও একটা নিজের মানুষ হবে যাকে সে ঠিক এভাবেই আগলে রাখবে নিজের বাহুডোরে। এসব ভাবতে ভাবতেই ওটো চলা শুরু করলো।
প্রায়ই ১০মিনিট পর ওটো এসে থামলো গার্লস হোস্টেলের সামনে। ১০তলা বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়েই যেনো মাথা ঘুরে যায় ইনাইয়ার। সিঁড়িতে উঠানামা করার অভ্যাস খুবই কম ইনাইয়ার, এক তলা ভাড়া বাসায় থাকতো দুই বোন সবসময়ই। ৩০মিনিটের পথ ৪৫মিনিট লাগিয়েছে আজ। অটোওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে বান্ধবীদের ফোন করে নিচে ডাকলো ইনইয়া কারণ এতো জিনিসপত্র একা হাতে নিয়ে যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়। ইনাইয়া মনে মনে চিন্তা করলো হাতে টাকা পেলে সবার আগে একটা বড়সড় লাগেজ কিনতে হবে তাকে।
বান্ধবী রা এসেই একজন একেকটা জিনিস নিয়ে হোস্টেলের ভেতর প্রবেশ করলো, ইনাইয়া সবার সাথে পা মিলিয়ে গেলো ভেতরে।
সকালে আফরোজার সাথে কথা বলেই ইনাইয়া ওর বান্ধবীদের বলে দেয় ওর জন্য একটা রুম দেখার জন্য। হোস্টেলে এডভান্স দেওয়া নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছিলো ছোটখাটো কিন্তু ওর বান্ধবীরা সেটা ম্যানেজ করে নিয়েছে। খাওয়া থাকা সব মিলিয়ে মাসে হোস্টেল ভাড়া ১০হাজার পরেছে। ইনাইয়ার তিন বান্ধবী এই হোস্টেলে থাকে। এই তিনজন ছাড়া ইনাইয়ার আর কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। ওরা ইনাইয়াকে ভরসা দিয়েছে কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু তবুও খুব ভয় কাজ করছে ইনাইয়ার।
হঠাৎ করে ইনাইয়ার মাথাটা ঘুরে উঠলো, দাঁড়ানো থেকে চট করেই সে বসে পরে বিছানায়। ওর বান্ধবীরা অস্থির হয়ে কি করবে বুঝতে পারছেনা।
জীবনের নতুন যাত্রাই ইনাইয়া ভীষণ ক্লান্ত।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

#ভাগ্যের_সীমারেখা [০১]
#ফারজানা_আক্তার

ফিরে এলাম নতুন গল্প নিয়ে আবারও। আশা করি ছোঁয়া+শুভ্রর মতো ইনাইয়া+ইহানও সবার ভালোবাসা পাবে।
ভুলত্রুটি মার্জনীয়। আসসালামু আলাইকুম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here