#ভাগ্যের_সীমারেখা [০৫]
#ফারজানা_আক্তার
একটিবার শুধু আমার চোখের দিকে তাকাও। ভালোবাসি তোমায়, ভীষণ ভালোবাসি। প্লিজ এভাবে আর ইগ্নোর করিওনা, আমি পারিনা সহ্য করতে। তোমার বিরহে জেগে কাটিয়েছি সহস্র রাত, যেদিন তোমায় দেখেছি সেদিন থকে উড়ে গেছে দুই চোখের ঘুম আমার। ফিরিয়ে দিওনা আমায় ইনাইয়া। আমি পাগল হয়ে যাবো। তুমি ছাড়া আমি আর কিছুই ভাবতে পারিনা। আমার সবটা জুড়েই তোমার বসবাস। তোমার প্রতি ভীষন উইকনেস আমার। আমাকে আপন করে নাও প্লিজ।”
শাহিন কথাগুলো বলে ইনাইয়ার উত্তরের আশায় চাতক পাখির মতো হয়ে আছে ওর দিকে তাকিয়ে। ইনাইয়া কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে যায়। হাতের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে “দেখুন আমার জীবন সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেননা। আমার জীবনটা মোটেও অন্য পাঁচ টা মেয়ের মতো সহজ নয়। আমি সাধারণ এক মেয়ে। এসব ভালোবাসা প্রেম বুঝার মতো মনমানসিকতা আমার নেই। আমি আমার সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে দিবো আমার স্বামীকে। আমি আমার স্বামীর আমানত। সেই স্বামী নামক মানুষটার আমানত রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। আমি পারবোনা বিয়ে ছাড়া কোনো অবৈধ সম্পর্কে জড়াতে। আর আপনি যেভাবে আমার আগে পিছে ঘুরছেন বেশ কয়েকদিন ধরে অন্যকোনো মেয়ে হলে এতোদিনে পটে যেতো কিন্তু আমার মধ্যে তবুও কোনো অনুভূতি কাজ করছেনা কেনো জানেন? কারণ আমার জীবনের চাবি আমি আমার বোন আর দুলাভাইের হাতে তুলে দিয়েছি। আপনি যদি সত্যিই ভালোবেসে থাকেন তাহলে তাদের থেকেই চেয়ে নিবেন চাবিটা।
চলি, আসসালামু আলাইকুম। ”
ইনাইয়া একাই চলে গেলো। শাহিনের নাক লাল হয়ে গেছে রাগে। আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ে এভাবে ফিরিয়ে দেয়নি শাহিনকে। শাহিন যে মেয়ের দিকে নজর দিয়েছে তাকে বিছানা পর্যন্ত নিয়ে গেছে কতশত কৌশলে, মেয়েদের মন গলানোর ঔষুধ আছে শাহিনের কাছে। তবে ইনাইয়ার ক্ষেত্রে কোনো ঔষুধ-ই কাজে লাগছেনা। এতে শাহিনের রাগ আর বিরক্তি দু’টোই বেড়ে যাচ্ছে।
ইনাইয়া পড়ার টেবিলে বসে কান্না করছে। শান্তা বর্ণা রিহা অনেক বুঝিয়েও ওকে শান্ত করতে পারছেনা। রিহা আপাততঃ ইনাইয়াকে শান্ত করার জন্য বলেছে সামনের মাসেই তারা নতুন বাসা দেখবে।
এর মাঝেই কেটে গেছে বহুদিন। কলেজ টিউশনি আড্ডা চিন্তা সব নিয়েই চলতে লাগলো দিন। ইহানের এর মধ্যেই আরো কয়েকবার দেখা হয়েছে ইনাইয়ার সাথে। ইহান যতবারই ইনাইয়াকে দেখেছে ততবারই মুগ্ধ হয়েছে। ইহানের একটু একটু ভালো লাগতে শুরু করে ইনাইয়াকে। অথচ এখনোও ইনাইয়ার সাথে একটা শব্দ কথা বলতে পারেনি সে। যখনই ইনাইয়া ওর সামনে আসে ও ভীষণ নার্ভাস হয়ে যায়। লজ্জা লজ্জা একটা ভাব চলে আসে তার মাঝে।
অদ্ভুত ভাবে ইনাইয়ারও ইহানকে দেখার পর কিছুক্ষণ মন খারাপ হয়ে থাকে। কেমন জানি স’র্ব’না’শা অনুভূতি হয় ইনাইয়ার ভেতরে বাহিরে। ইহানকে দেখলেই যেনো বুকের ভেতরে হাতুড়ি পি’টা শুরু হয়। ভালোলাগা কাজ করে। অসম্ভব ভালো লাগে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ইহানকে। ইহানের প্রতি অদ্ভুত টান অনুভব করে সে।
এর মাঝেই ইহান ভেতরে ভেতরে ইনাইয়ার সম্পর্কে সব খোঁজ খবর নিয়ে ফেলে। পরিবার থেকে ওকে বিয়ের কথা বলতেই ও জানিয়ে দিয়েছে একটা মেয়েকে ওর ভীষণ পছন্দ। সবাই মেয়েটা সম্পর্কে জানতে চাইলে ও বলে সময় হলেই জানিয়ে দিবে সবাইকে। সীমাকে যখন ইনাইয়া পড়াতে আসে তখন ইহান নিজের সব কাজ কর্ম ছেড়ে পড়ার রুমে গিয়ে বই পড়ার ভান ধরে আর আঁড়চোখে ইনাইয়াকে দেখে যায়, ইনাইয়া বেশ কয়েকবার লক্ষ করেও বলেনি কিছু। অযথা কোনো ঝামেলায় সে জড়াতে চাইনা। সীমা এতদিনে বুঝে গিয়েছে কিছু কিছু কিন্তু সে কাউকে কিছুই বলেনা কারণ সেও ইনাইয়াকে বেশ পছন্দ করে।
সীমা ইনাইয়াকে বলেছিলো তার হাতের সবজি খেয়ে ওর ভাই অনেক প্রশংসা করেছিলো সেটা। ইনাইয়া এটা শুনেই লজ্জায় নুইয়ে গিয়েছে। লাজুক স্বভাবের এক মেয়ে ইনাইয়া তবে প্রচুর স্ট্রং।
শাহিন আরো অনেকবার বিরক্ত করেছে ইনাইয়াকে। ইনাইয়া এড়িয়ে গিয়েছে ব্যাপারটা সবসময়ই। ইহান কয়েকবার দেখে ফেলেছিলো শাহিনের সাথে ইনাইয়াকে কথা বলতে কিন্তু সে ব্যাপারটা সাধারণ কিছু ভেবে এড়িয়ে গেছে যেহেতু শাহিনের সম্পর্ক রিতুর সাথে এটা সবাই-ই জানে ওদের পরিবারের।
আজ শুক্রবার। আফরোজা কল করেছে ইনাইয়াকে একটু যাওয়ার জন্য। ইনাইয়া তৈরি হচ্ছে বোনের কাছে যাওয়ার জন্য।
শান্তা এসে বললো “কোথায় যাচ্ছিস এতো রেডি সেডি হয়ে ইনু বেবি?”
“আপু ফোন করেছিলো। আসতে বিকাল হবে আমার।”
“তোর আপুকে দেখার খুব ইচ্ছে রে আমার।”
“তাহলে চল আমার সাথে, একটু ঘুরে আসি দু’জনে।”
শান্তাও তৈরি হয়ে নেয়। বর্ণা আর রিহা গতকালই বাসায় গিয়েছে। বিকালের দিকে চলে আসবেও ওরাও।
ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে লাগাতে শান্তা বলে “জানিস আমি একটা ছেলের প্রেমে পড়েছি। কিন্তু এখনো ছেলেটাকে বিষয়টা জানাতে পারিনি। খুব কষ্ট লাগে মাঝে মাঝে জানিস? আমি বুঝি ছেলেটাও আমাকে পছন্দ করে কিন্তু কোনো এক জড়তার জন্য বলতে পারেনা। দু’জনেই বুঝি তবুও অনুভূতি টা পারছিনা শেয়ার করতে। আর ছেলেটার বাড়ি তোর আপুদের বাড়ির ওখানে জানিস?।”
“ওওহ্ তাহলে এই কারণ আমার আপুকে হঠাৎ দেখতে ইচ্ছে হওয়ার।”
শান্তা লজ্জামাখা একটা হাসি দেয়। ইনাইয়া বলে “দেখ ভালোবাসা শব্দ টা শুনতে যতটা সুন্দর লাগে বাস্তবতা কিন্তু ততটা সুন্দর নয়। কোনো সম্পর্কে জড়ানোর আগে একবার ভেবে দেখবি ছেলেটা আসলেই সুন্দর মনের অধিকারী কিনা। নয়তো জীবন জলে ভরা বি’ষে’র মতো হতে সময় লাগবেনা। জীবন বড়ই অদ্ভুত রে।
জানিস আমার আপুর দেবর একটা সময় প্রচুর চরিত্রহীন ছিলো। আমার উনাকে দেখলেই গা রিরি করতো কিন্তু আপু বলেছে সে নাকি এখন একদম পাল্টে গিয়েছে। কোন একটা মেয়ের জানি প্রেমে পরে একদম শুধরে গিয়েছে। সে এখন পড়ালেখার পাশাপাশি একটা পার্ট টাইম জব করে। আপুকে নাকি মেয়েটার কথা বলেছে অথচ অদ্ভুত ব্যাপার কী জানিস উনি নাকি এখনো মেয়েটিকে দেখেওনি কখনো, না দেখেই ভালোবেসে ফেলেছে। এটা কী কখনো হয় বল? যে ছেলেটা নারী লোভী ছিলো সে নাকি এখনো সেই মেয়েটিকে বলে উঠতে পারেনি সে তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসা এমন হয় বুঝি? পুরো একটা মানুষকে সম্পূর্ণ চেঞ্জ করে ফেলেছে। বদলে দিয়েছে তার চরিত্র। মেয়েটাকে ফেলে তো আমি বলবো শোন বোন প্রেম করে সময় নষ্ট করিসনা, ডাইরেক্ট বিয়ে করে নিজের আঁচলে বেঁধে ফেল এমন লাজুক পুরুষকে।”
*************
আফরোজা ওর শ্বাশুড়ি আর দেবরের সাথে বসে গল্প করছে আর অপেক্ষা করছে ইনাইয়ার জন্য।
কয়েকদিন আগে খতিজা খাতুনের শরীর বেশ খারাপ হয়েছিলো। টানা ৮দিন নিজের খাওয়া দাওয়া ছেড়ে আফরোজা উনার সেবা করে গেছে। রাতেও নিজে না ঘুমিয়ে উনার পাশে বসে নির্ঘুমে রাত কাটিয়েছে। এতে খতিজা খাতন বেশ অনুতপ্ত হয়েছে নিজের কৃতকর্মের জন্য এবং তখন থেকেই মন থেকে মেনে নিয়েছেন আফরোজকে। ইদানীং তো আফরোজাকে চোখে হারান খতিজা খাতুন। আব্রাহাম মিষ্টি সন্দেহ আর আইসক্রিম এনেছে। নিজে গিয়ে ফ্রিজে সব রেখে এসে সবার সাথে বসে কথা বলছে আব্রাহাম। আজ এই পরিবারের সবার মুখেই হাসির রেখা, সবার চেহারা খুশিতে জ্বলজ্বল করছে। আফরোজা আজ বেশ লজ্জা পাচ্ছে, লজ্জা পেলে একটু বেশিই সুন্দর লাগে বুঝি নারী জাতিকে? মুগ্ধ নয়নে আব্রাহাম আফরোজার পানে চেয়ে আছে এতে আফরোজার লজ্জা যেনো বেড়ে চলেছে বহুগুন।
ইনাইয়া অটো থেকে নেমে ওটোওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে শান্তাকে বলে “এই যে সামনের টিনের চালের বাসাটাই আমার আপুর ছোট্ট সুখের নীড়। চল।”
শান্তা ইনাইয়ার সাথে পা মিলিয়ে ভেতরে গেলো। ইনাইয়া ঘরে প্রবেশ করে সবাইকে সালাম দিয়েই দৌড়ে গিয়ে আফরোজাকে জড়িয়ে ধরে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে ইনাইয়া। যেনো একজনম পর বোনকে কাছে পেয়েছে। আফরোজা মুচকি হেঁসে ইনাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে “আমার ছোট্ট ইনু সোনা কী জানে তার আদরে ভাগ বসাতে নতুন অতিথির আগমন হতে চলেছে খুব শীঘ্রই?”
সাথে সাথেই আফরোজাকে ছেড়ে দিয়ে সবার সামনে ইনাইয়া ওর পেটে কান লাগিয়ে বলে “সত্যি আমার গুলুমুলু সোনা টা আসতে চলেছে? আমি বিশ্বাসই করতে পারছিনা। এই পিচ্চু তুই কী শুনতে পাচ্ছিস তোর পিচ্চি আম্মার কথা? শোন তুই একদম অন্যকারো মতো হবিনা, সম্পূর্ণ আমার কপিরাইট হয়েই আসবি পৃথিবীতে, বুঝলি আমার সোনা ময়না?”
সাথে সাথেই আসিফ বলে উঠলো “হু বললেই হলো? আমার ভাতিজা আমার মতোই হবে, তার ছোট্ট আব্বুর মতো, তাইনা ছোট্ট বেবি টি?”
ইনাইয়া চুপ হয়ে আফরোজার ডানপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আসিফ বুঝতে পেরেছে ইনাইয়া এখনো সেই রাতের ব্যাপারটা নিয়ে অস্বস্তিবোধ করছে তার সামনে। আসিফ সবার সামনেই মনে সাহস যুগিয়ে বলে “সরি ইনু সেদিন রাতের জন্য। আমি বুঝতে পারিনি আমার সামান্য ভুলের জন্য তুমি এভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। ক্ষমা করে দাও প্লিজ যদিও আমি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নাহ। আমি সত্যিই খুব অনুতপ্ত। আমি আর আগের সেই আসিফ নেই ইনু বিশ্বাস করো। সব ভুলে কী আমরা বন্ধু হতে পারিনা ইনু? আমি বুঝেছি এখন এক নারীতে আসক্ত হতে পারা কতটা সুখের, কতটা শান্তির, আমার জীবনেও হয়েছে কোনো এক না দেখা পরীর আগমন। আমি অনেকদিন ধরে তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য কল দিতে গিয়েও দিতে পারিনি, আমি ভেতরে ভেতরে দ’গ্ধ হচ্ছিলাম কঠিন অ’গ্নি’তে। প্লিজ ক্ষমা করে দাও, নয়তো আমি নিজের কাছে নিজে সারাটা জীবন অপরাধী হয়ে রয়ে যাবো।”
“আপু আমাকে যখন বলেছে আপনি সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছেন নিজেকে। না দেখেই এক রমনিকে প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসে ফেলেছেন আর নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়েছেন তখনই আমি মন থেকে আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি আসিফ ভাইয়া।”
আব্রাহাম বললো “তাহলে এবার তোদের ঝামেলা শেষ হলো।
আফরোজা বললো “এটা কে রে ইনু? তোর বান্ধবী?”
“হ্যাঁ আপু এটা আমার বান্ধবী শান্তা। আমরা চার বান্ধবী একসাথে থাকি। দুইজন দেশের বাড়িতে গেছে, বিকালের দিকে চলে আসবে ওরা। আর শান্তা একা হয়ে যেতো আমি চলে আসলে তাই সাথে নিয়ে আসলাম ওকে।”
“ভালো করেছিস।”
শান্তা সবাইকে সালাম দিলো। সবার সাথে পরিচয় হয়ে শান্তার খুব ভালো লাগছে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে আসিফকে দেখে। শান্তা ভাবতেই পারেনি এই ঘরেই সে তার স্বপ্নে দেখা পুরুষের দেখা পেয়ে যাবে। সাথে সাথেই মা বাবার কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে যায় ওর, এমন মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়েকে বিয়ে দিতে কখনোই রাজি হবেননা ওর বাবা মা। শান্তা বারংবার আসিফের দিকে তাকাচ্ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। আসিফ বার কয়েকবার লক্ষ করেছে ব্যাপারটা। হঠাৎ আসিফের মনে হচ্ছে শান্তা বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে তাই সে একটু জোরেই বলে ফেলে “এই মিস সমস্যা কী আপনার? এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন কেনো? আমাকে কী জুকার মনে হয়?
দেখুন আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসুন বা লাজুক হাসুন তাতে কোনো লাভ হবেনা, আমি অলরেডিই আমার না দেখা পরীর হয়ে গিয়েছি বুঝেছেন।”
এবার কুটকুট শব্দে হেঁসে ফেলে শান্তা। শান্তাকে এভাবে হাসতে দেখে সবাই ওর দিকে চোখ বড়সড় করে তাকায়।
#চলবে_ইনশাআল্লাহ
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।