ভালবাসার প্রহর পর্ব ১৭+১৮

#ভালবাসার_প্রহর
#লেখনীতে_মায়া_মনি
#পর্ব১৭

পুরো দিনটাই গেলো বিষাক্ত প্রহরে।বিকেলে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে নাজমুল এবং জেরিন।আকাশটা এই মেঘলা আবার এই সচ্ছল।সুরহীন জীবনে স্পর্শের সাথে যতটুকু সময় থাকে সেটাই ভালবাসার প্রহর হয়ে দাঁড়িয়েছে জীবনে।কিন্তু আর কত দিন থাকবে স্পর্শ? এমন ঝামেলাময় মেয়ের স্বামী কেনো হতে যাবে সে!হাজার হাজার মেয়ে পগল এই ছেলের জন্য।জেরিন আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

—-“আমার জন্য স্পর্শকে বাজে কথা শুনতে হচ্ছে।নিহাত উনি ভালো মানুষ তাই শুনে যাচ্ছে।”

নাজমুল ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল,

—-“আমিও একটা কথা ভাবছি।স্পর্শ শুধু তোমার জন্য এখানে পরে নেই।ওর মনে তোমার জন্য অনুভূতি অবশ্যই আছে। ”

জেরিন বিষণ্ণ কন্ঠে বলল,

—-“সেই ভাগ্য কী আমার আছে বলো?বাবা মা যদি জানে সত্যি কী করবে?”

নাজমুল গম্ভীর মুখে বলল,

—-“হাসানের ঝামেলা দ্রুত শেষ না করে কিছু বলা যাবে না।নাজমুন আপু জানলে আজই হাসানের হাতে তুলে দিবে।”

—-“জীবনে এমন কিছু হবে আশাই করিনি।”

জেরিনের কথায় হতাশ গলায় বলল নাজমুল,

—-“কিন্তু খারাপ কিছু তো হয়নি।”

জেরিন চিন্তিত মুখে বসে রইলো ছাদের রেলিঙে। নাজমুল পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।জেরিন চিন্তিত কন্ঠে বলল,

—-“কিন্তু মামা, বাবা -মা যদি জানে এই কথা?অবশ্যই বলতে হবে কিন্তু, কিভাবে?”

নাজমুল মুখে হাত দিয়ে কিছু সময় ভাবল।উদ্বেগি গলায় বলল,

—-“আমি না হয় বলে দেখবো।কক্সবাজার হুট করে বিয়ে হয়েছে কিন্তু তুমি চিনো না । এটা কতটা মানবে সেটা জানি না!”

জেরিন গাল ফুলিয়ে শ্বাস নিলো।নাজমুল মৃদু হেসে মাথায় হাত রেখে বলল,

—-“এখন এতসব চিন্তা করতে হবে না। দেখো, শেষ বিকেলের প্রহর কত সুন্দর।”

জেরিন হেসে সম্মতি দিয়ে বলল,

—-“হ্যা অনেক।”

_____________________

স্পর্শ বসে আছে রুমে।পা সোজা করে বিছানায় ঠেস দিয়ে বসে বসে বই পড়ছিল।হঠাৎ চোখটা আটকে যায় দেয়ালে থাকা ছবিতে।মায়ের বিয়ের শাড়ি মাথায় ধরে হাস্যউজ্জ্বল জেরিনের মুখ।চঞ্চলিত দুচোখে মায়াভরা। শিতল স্নিগ্ধ মুখের হাসি।সম্ভবত কলজে পা রেখেই ছবিটা তুলেছে সে।স্পর্শ খুব মন দিয়ে ছবি দেখায় ব্যস্ত হলো।ব্যস্ত পায়ে রুমে প্রবেশ করতেই জেরিন থেমে গেলো।স্পর্শ পাশ ফিরে জেরিনকে দেখে খুব মনোযোগ নিয়ে বলল,

—-“শাড়িটায় যথেষ্ট মানিয়েছে আপনাকে।”

জেরিন চোখ বড় করে তাকাল।স্পর্শ হাত থেকে বইটা পাশে রাখল।পা ভাজ করে সোজা হয়ে বসে।মৃদু গলায় বলল,

—-“এখানে এসে বসুন।”

জেরিন কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিলো, বসবে নাকি না!স্পর্শের দিকে তাকিয়ে ধির পায়ে বিছানায় বসে সে।দু-পা ভাজ করে নম্রভাবে প্রশ্ন করল,

—-“আপনার এখানে সমস্যা হচ্ছে না তো?আসলে আপনি অনেক বড় ঘরের ছেলে কিন্তু, আমি অতি সামান্য ঘরের।হয়তো ঠিক ভাবে দেখা শুনাও করতে পারছি না।”

স্পর্শ শব্দ করে হেসে দিলো।হুট করে দু-হাতে জেরিনের দু-হাত ধরে মৃদু কন্ঠে বলল,

—-“আমার তো বেশ লাগছে এখানে।প্রতিদিন অপেক্ষা করি, আজ কি কমেডি হবে দেখতে।জেরিন চোখ পাকিয়ে তাকাতেই স্পর্শ গলা পরিষ্কার করে গম্ভীর মুখে বলল,

—-“দুঃখিত এভাবে হাসার জন্য।”

জেরিন চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ফেলল।শান্ত গলায় বলল,

—-“আপনার আসলেই মজা লাগছে এসব?কিন্তু,আমার প্রতিদিন ভয় করছে।”

স্পর্শ গালে হাত দিয়ে ঠোঁট উল্টে ভাবনিত ভঙিমা করে বলল,

—-“চিন্তার বিষয়!”

জেরিন নাক ফুলিয়ে একটা বালিশ ছুড়ে মারলো।স্পর্শ বালিশটা ধরে নিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল,

—-“আরে আপনি তো দেখছি আমাকে মারতে চান।”

শুরু হলো ছোট খাটো যুদ্ধ। ৬-৭মাস আগে হঠাৎ হয়ে যাওয়া এক কান্ডে আজ দুজনের জীবন বাধা হয়ে আছে।জীবন দ্বিতীয় একটা সুযোগ দিয়েছে জেরিন কে।প্রাণ খুলে নিশ্বাস নেওয়ার জন্য স্পর্শের মৃদু হাসিই যথেষ্ট বলে বোধ হচ্ছে আজ-কাল।

____________________________

মাগরিবের নামাজ পড়ে সালাম ফিরালো জেরিন।তাজবি পড়ে বাম পাশে চোখ দিয়ে দেখলো স্পর্শ মসজিদ থেকে মাত্র এসে মাথার সাদা টুপি সাইড টাবিলে রাখলো।জেরিনের স্তির দৃষ্টি দেখে এক ভ্রু উঁচিয়ে স্পর্শ মৃদু হেসে শুধালো,

—-“নামাজ শেষ ম্যাডাম?”

জেরিন মৃদু হেসে বলল,

—-“হুম!”

স্পর্শ সাদা পাঞ্জাবির হাটা গুটিয়ে বিছানায় পা তুলে বসলো।জেরিন মুনাজ দিয়ে জায়নামাজ ভাজ করে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে মাথার ওড়না খুলে গায়ে জড়ালো।বিছানা বরাবর বিশাল কাচের জানালার পর্দা জরাতেই বাইরের শহর চোখে ভেসে উঠলো।অন্ধকার রাতের শহরে উঁচু উঁচু বিল্ডিং এবং রঙিন আলো।জেরিন জানালা থেকে সরে বিছানায় পা ঝুকিলে স্পর্শের সামনে বসলো।মৃদু কন্ঠে প্রশ্ন করল,

—-“চা খাবেন?”

স্পর্শ মোহিত চোখে তাকিয়ে সম্মতি দিয়ে বলল,

—-“তুমি খাওয়ালে খেতে পারি।”

জেরিন চোখ নামিয়ে শুধু হাসলো।

—-“এবাড়িতে জেরিন ছাড়া চা কে খাওয়াবে শুনি?”

মেয়েলি কন্ঠে দুজনেই ভ্রু কুঁচকে দরজায় তাকালো।হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে জেরিন প্রথমে বিস্ময় এবং পরে আনন্দিত কন্ঠে লাফিয়ে বলল,

—-“রিয়া তুই?কখন এলি জান?”

রিয়া জেরিন কে জড়িয়ে ধরে এক গাল হাসি দিয়ে বলল,

—-“আমি যদি জান হই দুলাভাই কী শুনি?”

জেরিন স্পর্শের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।স্পর্শ মৃদু হেসে বলল,

—-“তুমি জান হলে আমি পৃথিবী! ”

স্পর্শের উত্তরে জেরিন অবাক হলো।রিয়া জেরিনের কাধ জড়িয়ে বিছানায় বসে বেশ উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,

—-“আসলেই আপনি পৃথিবী! নতুন জীবন তখনই পাওয়া সম্ভব যখন নতুন পৃথিবী থাকে।আমি রিয়া, ওর মামাতো বোন।”

স্পর্শ হেসে বলল,

—-“লতিফ সাহেবের…”

স্পর্শ কে থামিয়ে রিয়া বলল,

—-“না রাজ্জাক সাহেবের ছোট কন্যা।জেরিনের সাত মাসের ছোট আমি।”

স্পর্শ কপালে হাত দিয়ে নাক কুঁচকে বলল,

—-“শীট!তুমি তাহলে আমার সতীন!”

জেরিন চোখ বড় করে তাকালো।রিয়া চোখ পাকিয়ে বলল,

—-“এই কথা আপনার কানেও চলে গেছে?”

জেরিন বিভ্রান্ত হয়ে বলল,

—-“সবাই বলে তাই শুনেছে।আচ্ছা তোরা কী ঝগড়া করবি নাকি?কখন এলি কিছুই তো বললি না।”

রিয়া এবার স্তির হয়ে বসলো।শান্ত মাথায় বলল,

—-“একটু আগে এলাম।এসেই তোর রুমে চলে আসি।ভাইয়া কে চা খাওয়াবি না হুম?অবশ্য তুই ছাড়া কে বা দিবে?এ বাড়িতে ভাইয়াকে ফুপা ছাড়া কেউ খেয়াল করলেই তো।”

স্পর্শ রিয়ার মাথায় হাত রেখে মৃদু হেসে বলল,

—-“তোমার বোন চা দিলেই হবে।এই মেয়েটাকেই তো লাগবে আমার, অন্য কেউ না।”

জেরিন মাথা নিচু করে হেসে বলল,

—-“তোরা কথা বল আমি চা নিয়ে আসছি।”

দুজনেই সম্মতি দিলো।জেরিন চলে যাওয়ার পর রিয়া স্পর্শের হাত ধরে মিনতি কন্ঠে বলল,

—-“ভাইয়া আমি সব শুনেছি নাজমুল চাচ্চুর থেকে।জেরিন কে কী শুধু সাহায্য করছেন আপনি?আমার বোনটার প্রতি কী মায়া বা…”

—-“ভালবাসা আছে!”

স্পর্শের কথায় রিয়ার চোখ ঝলঝল করে উঠে।স্পর্শ রিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

—-“প্রথম বার আমি হলুদের সাজে দেখি জেরিন জাহান কে।রিসেপশন থেকে তার ডিটেইলস নিয়ে জানতে পারি আমার পাশের রুমটাই তার।সেদিন পুরো একটা সন্ধ্যা রিসোর্টের প্রগ্রামে জেরিন কে সাথেই রেখে ছিলাম।সব শুনে উপলব্ধি করলাম জেরিন একটা হিরার টুকরা।”

রিয়া মৃদু হেসে বলল,

—-“আব্বু বেচে থাকতে বলতো, তোরা ছেলে মেয়ে হলে আমি বিয়ে দিয়ে দিতাম।হাসান নাজমুল চাচ্চুর ক্লাসমেট ছিলো।জেরিন কে দেখে মাথা নষ্ট হয়ে যায়।মেয়েটার একটু স্নিগ্ধ স্পর্শ দরকার।যাতে ওই বাজে ছোঁয়া ভুলে যেতে পারে।”

স্পর্শ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

—-“চিন্তা করছো কেনো?আমার উপর ভরসা রাখো।জেরিনের জীবন না চাইতেও লেখা হয়ে গেছে আমার সাথে।এই পরিবার দূরে সরালেও মেহরাব পরিবার মাথায় করে রাখবে।”

কথার মাঝে চায়ের ট্রে হাতে জেরিন রুমে এলো।মেয়েটাকে বেশ বউ বউ লাগছে।গায়ে আকাশি সাদা রঙের থ্রিপিস। গলায় চেইন, হাতে চিকন চুড়ি,স্পর্শের দেওয়া নাক ফুল।লম্বা চুল গুলো পিঠে ছেড়ে রাখা।রিয়া মুগ্ধকর চোখে তাকিয়ে বলল,

—-“জেরি তোমাকে তো জাস্ট অস্থির লাগছে।ভাইয়ার স্পর্শে তুমি একদম বউ বউ হয়ে গেছো।”

রিয়ার এমন কথায় দুজনেই হেসে দিলো।বেশ গল্প করে তিন জন।গল্পের মাঝে স্পর্শের ফোন বেজে উঠে।ভ্রু কুঁচকে বালিশের পাশ থেকে ফোন রিসিভ করে কানে দিলো,

—-“বলো সাদ?”

ওপাশ থেকে সাদ শান্ত গলায় বলল,

—-“স্যার একটা কথা ছিল।আমাদের নিউ প্রজেক্ট সাইন হওয়ার জন্য আপনাকে দুদিনের জন্য লন্ডন যেতে।”

স্পর্শ বেশ মলিন মুখে বলল,

—-“কবে যেতে হবে?”

—-“আজ রাতে গেলে কাল সাইন করে পরশু চলে আসবেন।”

—-“আচ্ছা!”

স্পর্শ ফোনটা রাখলে জেরিন মলিন মুখ দেখে বলল,

—-“সব ঠিক আছে?মুখটা মলিন হয়ে গেলো যে”

জেরিন এবং রিয়া উত্তরের অপেক্ষা করছে।স্পর্শ গম্ভীর মুখে বলল,

—-“সাদ কল দিয়েছে।আমাকে আজ রাতে লন্ডন যেতে হবে।পরশু ফিরে আসবো।”

জেরিনের মুখটাও কালো হয়ে এলো।রিয়াও চুপ হয়ে গেলো।স্পর্শ ওদের মুখ দেশে হাসার চেষ্টা করে বলল,

—-“আমার শালির কিছু লাগবে সেখান থেকে?”

রিয়া হাসার চেষ্টা করে বলল,

—-“সাবধানে আমার জেরির কাছে ফিরে আসুন।”

স্পর্শ হেসে সম্মতি দিলো।জেরিন আর রিয়া স্পর্শের ব্যাগ পেকিং করে দিলো।স্পর্শ রেডি হয়ে জেরিন কে বলল,

—-“আমি বাবার সাথে দেখা করে আসছি।”

জসীম সাহেব রুমে বসে পত্রিকা পড়ছেন।দুপুরে হাসানদের আসা নিয়ে বেশ বিরক্ত তিনি।বিশেষ করে স্পর্শ কে অপমান করেছে বলে বেশি রাগানিত।দরজায় টোকা পরতেই চোখ তুলে তাকালেন।স্পর্শকে দেখে তিনি বললেন,

—-“আরে তুমি?ভিতরো এসো।”

স্পর্শ সালাম দিয়ে ভিতরে এলো।জসীম সাহেব পত্রিকা পাশে রেখে স্পর্শ কে বসতে বলেন।স্পর্শ উনার বরাবর সোফায় বসে বলল,

—-“বাবা অফিসের কাজে আমি লন্ডন যাচ্ছি।”

জসীম সাহেব মৃদু অবাক হয়ে বলেন,

—-“সেকি,কবে আসবে?”

স্পর্শ হাল্কা হেসে বলল,

—-“জ্বি সব ঠিক থাকলে পরশু আসবো।দোয়া করবেন আর নিজের খেয়াল রাখবেন।জেরিন কে বলে দিচ্ছি বাকি টেস্ট গুলো করিয়ে দেখানোর জন্য।”

জসীম সাহেব স্তির চোখে তাকিয়ে উঠে স্পর্শের পাশে বসেন।মাথায় হাত রেখে বলেন,

—-“আল্লাহ তোমার ভালো করুক।যে কাজে যাচ্ছো তা সঠিক হোক।”

স্পর্শ সালাম দিয়ে রুম থেকে চলে গেলো।নাজমুন বেগম পুরো বিষয়টা দূর থেকে দেখে একটু থমকালেন।আজ পর্যন্ত এমন ভাবে হাসান ও দোয়া চায়নি।

—-“এই যে সব রেডি।”

জেরিনের গম্ভীর মুখে বলা কথাটা শুনে স্পর্শ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

—-“এভাবে বিদায় দিবে আমাকে?”

জেরিন উত্তর দিলো না।স্পর্শ রিয়াকে কাছে এনে শান্ত গলায় বলল,

—-“আমার বউকে এই দুদিন তোমার হাতে তুলে দিলাম সতিন।আমার পরিবর্তে তুমি এই রুমেই ঘুমাবে।”

জেরিন না চাইতেও হেসে দিলো।নিচুস্বরে বলল,

—-“সাবধানে যাবেন।পৌছে আমাকে জানাবেন।”

স্পর্শ মৃদু হেসে জেরিনের গাল ছুঁয়ে বলল,

—-“অবশ্যই! আসছি।”
#ভালবাসার_প্রহর
#লেখনীতে_মায়া_মনি
#পর্ব১৮

চারপাশ খুব নির্জন এখন।মধ্য রাতে সবাই ঘুমে ব্যস্ত।বিশাল কাচের জানালা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে জেরিন।আজ তার চোখে বিন্দু মাত্র ঘুম নেই।রিয়া নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।বার বার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে আর নিজেকে বোমা হিসেবে উপলব্ধি করছে জেরিন।স্পর্শ কী চোখের পলকে চলে যাবে লন্ডন?সকাল পেড়িয়ে তবে না আসবে সেই মানুষটার ফোন।

—-“কিরে ঘুমাসনি তুই?ভাইয়া কিন্তু এসে আমাকে ধরবে।”

জেরিন কিছুটা চমকে পিছন ফিরে দেখে রিয়া আড় মোড়া ভেঙে দাঁড়িয়ে আছে।ছোট্ট করে শ্বাস নিয়ে আবারো নির্জন রাতের শহরে চোখ দিলো জেরিন।উদাসীন কন্ঠে বলে,

—-“ঘুম আসছে না রিয়া।তুই উঠলি যে?”

রিয়া বিষয়টা বুঝতে পেরে হাল্কা হেসে কাধে হাত রাখলো। জেরিনের পাশে দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,

—-“ভাইয়ার কথা ভাবছিস?চিন্তা করিস না ভাইয়া ঠিক আছে।”

জেরিন একবার চাইলো রিয়ার দিকে।আগের মতো বাইরে তাকিয়ে বলে,

—-“মানুষটার প্রতি একটু বেশি মায়া জন্মে গেছে।”

—-“জন্মানো তো স্বাভাবিক বোন।সারা জীবনের বাধন যে।”

রিয়ার কথায় জেরিন অসহায় চোখে তাকাল।বিছানায় এসে বসে মৃদু অস্থিরতা নিয়ে বলে,

—-“উনার জীবনটা ঝামেলা ছাড়া।আমার জীবনটা শুধুই কষ্টের।আমি চাই না আমার সাথে উনিও জড়িয়ে পরুক।”

রিয়া পাশে এসে বসলো।মুচকি হেসে বলে,

—-“কিন্তু জড়িয়ে যে গেছে ডার্লিং। ”

জেরিন ভ্রু কুঁচকে তাকালো।রিয়া মাথা দুলিয়ে বলে,

—-“ভাইয়ার চোখে তোর জন্য মায়া আর ভালবাসা দেখেছি আমি।যাওয়ার সময় কীভাবে দায়িত্ব দিলো তোর দেখলি না?”

জেরিন অস্থিরতায় রিয়াকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বালিশ বুকে চেপে উপর হয়ে শুয়ে পরে।গাল ফুলিয়ে বলে,

—-“কী বলছিস তুই?এতো বড় পরিবারে আমি যাবো?আমাকে মেনে নিবে তারা?”

রিয়া কিছুটা উঁচু গলায় বলে,

—-“কেনো মেনে নিবে না?তুই কী অসুন্দর নাকি আনএডুকেটেট?শুন,এইসব ছাইপাঁশ বাদ দিয়ে ঘুমাবি চল।”

রিয়া জোর করে জেরিনকে জড়িয়ে ধরে। না চাইতেও এক সময় চোখে ঘুম আসে।সব কিছু অদ্ভুত তাই না!যাদের আমরা চিনি না তারাই এক সময় আমাদের সব থেকে আপন হয়ে যায়।হয়ে উঠে প্রিয় থেকে অতি প্রিয়।ভালবাসার প্রহর জেনো সেই মানুষটার সাথেই থাকে।
.

.

.

.
নাস্তার টেবিলে আজ সবাই একটা কথাই বলছে। জেরিন কোথায়,এখনো আসেনি কেনো?সবার চোখ ঘুরে ফিরে একটা রুমের দরজায়।নাজমুন বেগম নাস্তা করতে করতে বার কয়েক সেদিকে তাকালেন।জসীম সাহেব তা দেখে কিছুটা তাচ্ছিল্য হেসে বলেন,

—-“এখন কী রুমের দরজায় দেখার দায়িত্ব দিয়েছে হাসান?”

নাজমুন বেগম বেশ লজ্জায় অপ্রস্তুত হয়ে নড়েচড়ে বসেন।সেলিনা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলেন,

—-“স্পর্শ নিশ্চয় এতো সময়ে পৌছে গেছে। ”

নাজমুল আপেলে কামড় দিয়ে চিবুতে চিবুতে বলে,

—-“রাত ৯টায় ফ্লাইট ছিল,এখন সকাল ১১ টার কাছে।ছেলেটা হয়তো এখন রিসোর্টে চলে গেছে।”

লতিফ সাহেব চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বলেন,

—-“কিন্তু জেরিন নাস্তা করতে আসছে না কেনো?রিয়া কেও দেখছি না।”

—-“এইতো কাকা আমি এখানে।”

কথার মাঝেই দুলতে দুলতে রিয়া চেয়ার টেনে বসলো।সেলিনা কে চা দিতে বলে সবার দিকে একবার চাইলো।নাজমুল রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—-“তুমি একা যে,জেরিন কোথায়?”

রিয়া চায়ের কাপ হাতে তুলে অতি স্বাভাবিক ভাবে বলে,

—-“ঘুমাচ্ছে জেরি।আসলে কাল রাতে ঘুমায়নি একটু ও মেয়েটা।”

রিয়ার কথায় নাজমুন বেগম কিছুটা ব্যস্ত গলায় বলেন,

—-“কেনো কী হয়েছে?”

নাজমুল ও একই প্রশ্ন করল।রিয়া চায়ে বার কয়েক চুমুক দিয়ে বলে,

—-“ভাইয়া নেই তো তাই।মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে দএখি জেরিন জালানা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।ভাইয়াকে ছাড়া ঘুমাতে একটু কষ্ট হয়েছে।”

রিয়ার এমন কাট কাট উত্তরে সবাই নড়েচড়ে বসে।নাজমুল পাশের চেয়ারে থাকায় ফিসফিস করে বলে,

—-“এমন কথা সবার সামনে বলতে হয় পাগল?”

রিয়া একটু ভেবে জ্বিব কামড়ে বলে,

—-“ভেবে বলিনি চাচ্চু।”

.

.

.

.
শান্ত মুখে আজ ক্লান্তির ছাপ।ক্লান্ত মুখে ঘুমিয়ে আছে জেরিন।কখন যে বেলা হয়ে গেছে বুঝতেও পারেনি সে।ফোনের তীব্র শব্দে চোখ মেলে তাকায় জেরিন।বালিশের পাশে হাতরে ফোনের স্ক্রিণে ণ দেখেই কানে তুলে নিলো।ঘুমু ঘুম কন্ঠে বলে,

—-“হ্যালো?”

—-“হ্যালো ম্যাডাম এখনো ঘুমাচ্ছেন?”

হঠাৎ স্পর্শের শিতল কণ্ঠস্বর শুনে উঠে বসে জেরিন।কান থেকে ফোন চোখের সামনে এনে অচেনা বাইরের নাম্বার আবিষ্কার করল।কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নিচুস্বরে বলে,

—-“কেমন আছেন আপনি?ঠিক ভাবে গেছেন তো?”

স্পর্শ নিঃশব্দে ওপাশ থেকে হাসলো।মৃদু কন্ঠে বলে,

—-“হুম এসেছি।এখন বলুন এতো বেলা অব্দি ঘুমাচ্ছেন?”

জেরিন আগের মতো নিচুস্বরে বলে,

—-“আসলে রাতে ঘুম আসেনি।শেষ রাতে রিয়া জোর করে বিছানায় আনে। ”

—-“শরীর ঠিক আছে তো? ঘুম আসেনি কেনো?”

স্পর্শের মৃদি অস্থিরতা জেনো লজ্জার ভুবন এনে দিচ্ছিল জেরিনের গালে।বালিশ বুকে চেপে লজ্জিত কন্ঠে বলে,

—-“সব ঠিক আছে।খেয়েছেন কিছু?”

স্পর্শ ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলে,

—-“আমি তো ভয় পেয়েছিলাম।আমি এখনো খাইনি।আপনার ঘুম যদি হয়ে যায় তাহলে নাস্তা করে ফেলুন।বাবার টেস্ট করানো এখনো বাকি।”

জেরিন মৃদু হেসে বলে,

—-“সব করে দিবো। আপনি শুধু নিজের খেয়াল রাখুন।”

স্পর্শ শিতল কন্ঠে বলে,

—-“আপনি ও সাবধানে থাকবেন।আচ্ছা আমি আবার ফোন করবো তবে,এখন যেতে হবে।”

জেরিন সম্মতি জানিয়ে রেখে দিলো।ফোনটা বুকে চেপে লম্বাশ্বাস নিলো।ধির পায়ে ফ্লোরে পা রাখে জেরিন।উদ্দেশ্য ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করবে।

_______________________

ভার্সিটি যেতেই মুখোমুখি বন্ধুদের সাথে।সাদিয়া জড়িয়ে ধরে প্রাণখোলা হাসি দিলো।শাওন মাথায় চাটি মেরে বলে,

—-“কিরে রাতে কল করেও পাওয়া যাচ্ছে না কেনো তোকে?”

জেরিন কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলো।সাকিব বাতাম চিবুতে চিবুতে বলে,

—-“নিশ্চয় প্রেম করছে মামা।”

রাফি ভ্রু কুঁচকে বলে,

—-“মামা তুই না বললি এইসবে যাবি না?”

জেরিন ফুস করে নিশ্বাস ফেলে বলে,

—-“ভাই থাম তোরা!বাবা অসুস্থ সেটা নিয়ে একটু হসপিটাল যাওয়া আসা।সামনে যে সেমিস্টার ফাইনাল সেটাও তো ভুলে গেছিস তোরা।”

জেরিনের কথায় সবাই দাত বেড় করে হাসলো।শাওন সবার থেকে দূরে কাধে হাত রেখে জেরিন কে নিয়ে গেলো।নিলয় মুখ বাকিয়ে বলে,

—-“ভাই সব সময় আলাদা কী কথা বলে ওরা?”

শাওন বট গাছের নিচে দাঁড়ায় জেরিন কে নিয়ে।জেরিন প্রশ্নভরা চোখে তাকালে শাওন বলে,

—-“ওদিকে সব ঠিক আছে?”

জেরিন হতাশ কন্ঠে বলে,

—-“এখনো আছে দোস্ত তবে বেশি দিন থাকবে না।মা যেভাবে হাসান কে নিয়ে লেগেছে নির্ঘাত আমি সুইসাইড করবো।”

শাওন পিঠে আঘাত করে কিছুটা রেগে বলে,

—-“আবার ফালতু কথা বলছিস?স্পর্শ আছে কেনো তাহলে?ভুলে যাচ্ছিস নাকি স্পর্শ হাসানের মতো না।”

জেরিনের চোখে ভেসে উঠে স্পর্শের সেই হাসি মুখ।স্নিগ্ধকর চাহনি নিয়ে বলে,

—-“মানুষটা ভালো শাওন তবে অনেক বড় ঘরের ছেলে।”

শাওন হাল্কা হেসে বলে,

—-“তোকে সেই সব ভাবতে হবে না।আল্লাহর ইশারায় চল শুধু।”

.
.
.
.
বাবার সব টেস্ট করিয়েও জেনো জেরিনের দিন কাটছে না।মৃদু অস্থিরতা লেগেই আছে মনে।রিয়া এতো গল্প বলেও প্রাণ খোলা হাসি আনতে পারেনি।দুপুরে
ঠিক ভাবে খাওয়া ও হলো না জেরিনের।সব কিছুই জেনো বিষাদময় লাগছে।মেয়ের এমন পরিবর্তন দেখে জসীম সাহেব হয়তো খুশি হলেন।সারাদিন স্পর্শের ফোন আসেনি।আসবে কীভাবে, রাত যে সেখানে।বহু অপেক্ষার পর রাতে এলো তার কল।সে কী অস্থিরতা মনে।লজ্জা,অস্থিরতা সব নিয়ে জেনো অন্য রাজ্যে হারিয়ে যায় জেরিন।

—-“কথা বলবেন না? ”

স্পর্শের গলা শুনে লাল হয়ে এলো গাল।লজ্জিত মুখে বলে,

—-“বলবো!”

স্পর্শ শান্ত গলায় বলে,

—-“তাহলে বলুন?”

জেরিনের মনে এক অদ্ভুত অস্থিরতা। হঠাৎ মনে এলো ভয়ানক চিন্তা।স্পর্শ কী বুঝে মনের ভাব প্রকাশ?এক রাশ অভিমান নিয়ে প্রশ্ন করল,

—-“খেয়েছেন?”

স্পর্শ আগের মতোই বলে,

—-“মাত্র খেলাম।আপনি নিশ্চয় খান নি।”

জেরিন অবাক হয়ে বলে,

—-“কী ভাবে জানলেন?”

স্পর্শ হেসে বলে,

—-“সে বুঝলাম আমি, কেনো খান নি শুনি?”

জেরিন ঠোঁট উল্টে বলে,

—-“ইচ্ছে নেই তাই।”

—-“তা বললে তো হবে না।রিয়াকে যে দায়িত্ব দিলাম মনে হচ্ছে পালন করছে না।”

জেরিন মৃদু ব্যস্ত হয়ে বলে,

—-“করছে তো পালন।”

স্পর্শ মৃদু গলায় বলে,

—-“তাহলে না খেয়ে আছেন কেনো?”

জেরিন উত্তর দিলো না।কীভাবে বলবে স্পর্শ কে ছাড়া খেতে ইচ্ছে করছে না?স্পর্শ কী মানবে সে কথা নাকি,দূর করে দিবে এমন উত্তর?এমন হাজার প্রশ্ন ঘুরে চলেছে জেরিনের মাথায়।

__________________________

হসপিটালে আশরাফ মেহরাবের কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জেরিন।স্যার আসলেই বাবার রিপোর্ট সাবমিট করবে সে।শুনেছে নাম করা ব্যক্তি তিনি।কিছু সময় পায়চারী করার পর আশরাফ মেহরাবকে ব্যস্ত পায়ে কেবিনে যেতে দেখে।কয়েক মিনিট পর এস্যাসটেন্ট এসে বলে,

—-“স্যার যেতে বলেছে ম্যডাম।”

জেরিন সম্মতি দিয়ে কেবিনে নক করে প্রবেশ করল।আশরাফ মেহরাব কে সালাম দিয়ে চেয়ার টেনে বসে জেরিন।রিপোর্টের ফাইল টেবিলে এগিয়ে দিলে তিনি একবার জেরিন কে দেখে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল,

—-“নাম কী তোমার?”

জেরিন নম্রভাবে বলে,

—-“জেরিন জাহান! ”

ভদ্রলোক ফাইল ভালো করে দেখে বলেন,

—-“আমি কিছু ওষুধ দিচ্ছি, নিয়মিত খাওয়াবে।আজ তোমার বাবা আসেনি?”

—-“না স্যার আমি একাই এসেছি।”

আশরাফ মেহরাব জেনো স্বস্তি পেলো কথাটা শুনে।গলার সুর নরম করে বলেন,

—-“স্পর্শের সাথে তোমার সম্পর্ক কী?”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here