ভালোবাসার প্রজাপতি পর্ব -০১+২

গভীর রাত, কালবৈশাখী ঝড়ের দাপটে মনে হচ্ছে গাছপালা ভেঙে যাবে। বজ্রপাতের শব্দে যেনো সকল প্রাণী ভয়ে সিটিয়ে আছে।
বজ্রপাতের আলোয় থেকে থেকে পরিবেশ আলোকিত হচ্ছে। ঝড়ের বেগ ক্রমশই বাড়ছে।
গ্রামে সামান্য বাতাস শুরু হলেও বিদ্যুৎ চলে যায়। কালবৈশাখী ঝড় শুরু হওয়ার আগেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে নেওয়া হয়েছে।

জানালা দিয়ে বর্ষণের পানি হালকা হালকা প্রবেশ করছে। সেই সাথে জানালার অপর প্রান্তে বসে থাকা মেয়েটির চোখ দিয়ে নোনাজল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
বাহিরে কালবৈশাখী ঝড়ের মতোই মেয়েটির মনেও বয়ে যাচ্ছে কালবৈশাখী ঝড়।
বর্ষণের পানির যেমন সকল ময়লা আবর্জনা ধুয়ে নিয়ে যায় সেইভাবে যদি মেয়েটার কষ্টগুলো ও কেউ মুছে দিতো।
কিন্তু আফসোস ভেঙে যাওয়া একজন কে এই সমাজ আরো ভেঙে দিতে প্রস্তুত। তারা ভাবে না পরবর্তীতে তার কি হবে।
মেয়েটি ভাবছে,,”ভালোবাসা বড্ড কষ্টদায়ক। আজ সে উপলব্ধি করছে। অনাথ দের হয়তো ভালোবাসা যায় নাহ।ভালোবাসা ওকি এখন স্বার্থপর হয়ে গেলো নাকি কিছু স্বার্থপর মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য ভালোবাসা নামক পবিত্র শব্দটিকেও ব্যাবহার করা শুরু করে দিয়েছে। আসলে সমাজ টাই এখন স্বার্থপর। স্বার্থ ছাড়া কেউ কারো নয়।”

মেয়েটি যখন নিজ ভাবনায় মশগুল তখনি মোমবাতি হাতে একজন মেয়ে তার পাশে এসে বসলো।
সে তাকিয়ে আছে অশ্রু বিসর্জন দেওয়া দেওয়া মেয়েটির দিকে। আজ সে আটকাবে নাহ তাকে কান্না করতে। শুনেছে কাদলে নাকি মন হালকা হয়।
তার পাশের মেয়েটাও মনটা হালকা করুক।

কিছুক্ষন বসে থাকার পর ক্রন্দনরত মেয়েটির কাঁধে হাত রাখলো। মেয়েটি চমকে পাশে তাকালো।
পাশে মেঘাকে কে দেখে ভাবতে লাগলো কে বলেছে তার কেউ নেই।এইযে এই মেয়েটি তাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে সবসময় আগলে রাখে।
মেয়েটি জরিয়ে ধরলো তার বোনের মতো আগলে রাখা মেঘা কে। মেঘা ও মেয়েটিকে জরিয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

কিছুক্ষন পর মেঘা বললো,,,,”কিরে নিহু,, আর কত কাদবি? অনেকক্ষণ ধরে দেখছি কান্না করেই যাচ্ছিস!
একটা বেঈমান, স্বার্থপর মানুষ এর জন্য এত দামী অশ্রু কেন অপচয় করছিস। হ্যা মানছি তোর কষ্ট হচ্ছে কিন্তু যার জন্য কষ্ট পাচ্ছিস সেতো এখন অন্য কাউকে নিয়ে ব্যস্ত।”
মেয়েটি কিছু না বলে মেঘাকে জরিয়ে ধরে বসে রইলো।
কিছুক্ষন পর মেয়েটি বললো,,,”মেঘা সেতো জানত তাইনা যে আমার কেউ নেই। আমি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি। সবটা জেনেও বলেছে সে আমায় ভালোবাসে আমার পরিবার কেত নয়। তাহলে আজ কেন এমন হলো। কেনো সে আমার সাথে এমনটা করলো।”

মেঘা নিহুর মন অন্যদিকে নেয়ার জন্য হালকা রাগ দেখিয়ে বললো,,,,,” আচ্ছা আমি তাহলে তোর কেউ না, আমায় পর ভাবিস, আমায় পর করে দিলি। কোথায় ভাবলাম তুই আর আমি এক বাড়িতে বিয়ে করে জা হয়ে থাকবো কিন্তু তুই তো এখনি আমায় পর করে দিচ্ছিস।”
নিহু বললো ,,,,” আমি কখন বললাম তুই আমার কেউ না!”
মেঘা নেকা কণ্ঠে বলল,,,”একটু আগেই তো বললি তোর কেউ নেই।”
নিহু একটু হেসে বললো,,”দূর পাগলি তুই তো আমার সব। তুই না থাকলে এতদিনে হয়তো আমার অস্তিত্ব ই বিলীন হয়ে যেত।”
” আচ্ছা হয়েছে থাক থাক আমার আর গুণগান করা লাগবে না। এখন আয়তো ঘুমাবো। অনেক রাত হয়ে গেছে।”এই কথা বলে মেঘা নিহুর হাত ধরে বিছানায় শুয়ে দিলো, মোমবাতি নিবিয়ে কাঁথা গায়ে দিয়ে দিয়ে সেও নিহুকে জরিয়ে ধরে শুয়ে পড়লো।

নীহারিকা নিহা,,,, বয়স ১৯,,,, অনার্স প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত। শ্যাম বর্ণের শ্যামবতী। টানা টানা চোখ, যেই চোখে মিশে আছে অজস্র মায়া। প্রায় হাঁটুর সমান ঘন কালো চুল যে কারো নজর কাড়তে সক্ষম। আপন বলতে মেঘা আর মেঘার পরিবারই সব। সে জানেনা তার বাবা মা কে, কোথায় আছে তারা। ছোট থেকেই এতিম খানায় বড় হয়েছে। বাকিটা গল্পে জানবেন।

মেঘা হাওলাদার,,, বয়স ১৯,,, ফর্শা গাঁয়ের রং।
নিহুকে খুব ভালোবাসে। বাবা মা গ্ৰামে থাকে।
নিহা এবং সে একি কলেজে একি সেমিস্টারে অধ্যয়নরত। দুজন সবসময় একি সাথে থাকে যাকে বলে একজন একজনের ছায়া হয়ে থাকে। মেঘার বাবা মা ও নিহাকে তাদের মেয়ের মতোই ভালোবাসে।
#ভালোবাসার প্রজাপতি
#পর্ব ২
#মাহিয়া মুন

কলেজ ক্যাম্পাস,,,,,
কেউ কেউ কেন্টিনে বসে আছে তো কেউ হেঁটে হেঁটে কথা বলছে একজন আর একজনের সঙ্গে,, কয়েকজন বা গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে।

আইরিন, ইলমা, তাফসীর, জুবিন, আরিয়ান এই পাঁচ জন মাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে কারো অপেক্ষা করছে।
কিছুক্ষন পর ইলমা বললো,
“কি ব্যাপার বলতো, এই মেঘের বাচ্চা কি রোদ উঠেছে বলে আসতেছে না। নাকি বাসায় মহিলাদের কাজগুলো সে করে দিচ্ছে। কতক্ষন ধরে অপেক্ষা করছি।”
জুবিন বিরক্ত কণ্ঠে বললো,,
“তুই অপেক্ষা করার কথা বলছিস আর তুই যে আমার পকেট খালি করে দিয়ে কতোগুলো পেপসি তুই একাই খেলি। দেখিস তোর পেটে এগুলো সইবে না।”
“উলে আমার জানুটারে আমি একা খেলে তোর হাতে যেইটা আছে সেইটা কোথা থেকে আসলো। আর তোর পকেট খালি করবোনা তো কি পাশের বাসার আন্টির ছেলের পকেট খালি করবো। Okay fine,,, after all তুমি যদি চাও I have no problem।”
এই কথা বলে ইলমা একটা ডেভিল হাসি দিল।
জুবিন চোখ রাঙিয়ে তাকালো।
“এই তোরা থামবি, আধা ঘন্টা পার হয়ে গেল মেঘের আসার খবর নেই আর তোরা দুইটা শুরু করে দিলি।আর এই দুই ভাই বোনকে দেখ (আইরিন এবং আরিয়ান কে উদ্দেশ্য করে)পারে না যে বই এর মধ্যে ডুকে যাবে। সারাদিন যখনি সময় পাবে বই এর মধ্যে ডুকে যাবে।”
তাফসীর কিছুটা রাগী কণ্ঠে বললো।
আইরিন বিরক্ত হয়ে চোখের চশমা ঠিক করে বললো,
“তো কি করবো, বই নিয়ে আছি ভালো আছি। তোরা তো পারিস সারাদিন ঝগড়া করতে। আর তুই এই দুজনকে থামিয়ে আমার সাথে শুরু করলি কেনো?”
জুবিন কিছু বলবে তার আগেই আরিয়ান হাতের বইটা বন্ধ করে গেটের দিকে তাকিয়ে বললো,
“দেখো চলে এসেছে মেয়েদের ক্রাশ। তার এতক্ষনে আসার সময় হয়েছে।”

বাকি চারজন গেটের দিকে তাকালো। বাইক পার্ক করে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে একটি ছেলে। ক্যাম্পাস এর বেশিরভাগ মেয়েই তাকিয়ে আছে। এইটা তাদের রোজকার অভ্যাস।

মেঘ চৌধুরী,,, চৌধুরী পরিবারের মেজো ছেলে। কলেজ এর টপার বয়,,, বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়ান। স্যারদের চোখের মধ্যমনি। দেখতে মাশা আল্লাহ। ফর্সা গায়ের রং, প্রায় ছয় ফুটের মতো লম্বা যদিও ছয় ফুট না। প্রায় অধিকাংশ মেয়েদেরি ক্রাশ। চেহারায় গাম্ভীর্য থাকলেও তা সবসময় প্রকাশ করে না। হাসি খুশি থাকতেই পছন্দ করে।

মেঘ এগিয়ে এসে আরিয়ান এর পাশে দাড়াতেই আইরিন বললো,,
“কিরে এত্ত লেট কেনো হলো,,আর চোখে মুখেরি বা এই অবস্থা কেনো। রাতে কি ঘুমাস নাই?”
তাফসীর কিছুটা ব্যাঙ্গ করে বললো,
“কিভাবে ঘুমাবে বল। ঘুমালে কি আর সারারাত জেগে থেকে মেঘার সাথে কথা বলতে পারবে। তাদের প্রনয় তো এখনো টিনেজার দের মতো। আমরাই সারাজীবন সিঙ্গেল রয়ে যাবো রে আরিয়ান। একজন কে যা বুঝাতে চাই সে বুঝেও বুঝে না।”
মেঘ কিছুটা বিরক্ত কন্ঠে বললো,
“মার খেতে মন না চাইলে চুপ থাক। আর রাতে মেঘার সাথেও কথা হয় নি।”
ইলমা কিছুটা উৎকণ্ঠে বললো,
“কেনো, ঝগড়া হয়েছে নাকি। তোরা তো আবার কথা না বলে থাকতে পারিস না।”
“না,,, ঝগড়া হয় নি। তোরা তো জানিস যে মেঘা আর নিহা মেঘার কোনো এক কাজিনের বিয়েতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছে।কাল সকাল এ মেঘা একটা মেসেজ দিয়ে বললো যে কোনো একটা প্রবলেম হয়েছে। সে আমায় বিকাল এ কল দিবে। বিকাল এ কল দিয়ে বললো যে তারা খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে আর এসেই বলবে কি হয়েছ।এখন বলতে পারবে নাহ। এখন নাকি নিহার সাথে থাকা খুব দরকার।”
বিরস কণ্ঠে বলল মেঘ।
আরিয়ান কিছুটা চিন্তিত কণ্ঠে বললো,,,
“তোকে কিছুই জানায় নি?”
“না। তবে যতটুকু বুঝলাম যে নিহার কিছু একটা হয়েছে। কলেজ আসার সময় আর কল দেইনি, হয়তো ঘুমাচ্ছে। যাই হোক চল, ক্লাস এর সময় হয়ে গেছে।”

এই কথা বলে তারা ক্লাস এ চলে গেলো।
*
*
*
বাহিরে পাখির আওয়াজ এ নিহার ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। সূর্যের আলো জানালা ভেদ করে এসে চোখে পরায় চোখমুখ কুচকে উঠে বসলো।
পাশে তাকিয়ে দেখে মেঘা একদম বিছানার কিনারে গিয়ে শুয়ে আছে। কোলবালিশ টাও মেঝেতে পরে আছে।
“এই মেয়েটা আর ঠিক হলো না। যদি জানতো ঘুমের মধ্যে কি অবস্থা করে। আল্লাহ জানে মেঘ ভাইয়ার কি অবস্থা করবে।”
একটা হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে উঠে মেঘাকে ঠিক করে দিয়ে কোলবালিশ টা বিছানায় রেখে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
“চোখ মুখ অনেক ফুলে গেছে। রাতে ঘুম ও হয় নি। আচ্ছা সে এখন কিভাবে আছে, নিশ্চই বউকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।”
এসব ভাবতে ভাবতে আবারো চোখের পাতা ভিজে উঠলো।
“নাহ। আমি আর তার কথা ভাববো না কিন্তু চাইলেই কি সব ভুলা যায়। ভাবতে না চাইলেও ভাবনায় চলে আসে।”
চোখের পানি মুছে ওয়াশ রুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে গায়ে ওড়না জড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here