ভালোবাসার ভেজা সন্ধ্যে পর্ব ২০

#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (২০)

“” শাড়িটা পড়লি না?””

ভাবীর কন্ঠে কেঁপে উঠলো রিপ্তি। গলায় ফুটলো ক্ষীণ ভয়! এতো সুক্ষ কম্পনটাও মিন্মির চোখে ধরা পড়েছে। রিপ্তির কাধ ছুয়ে বললো,,

“” ভুবন ভোলানো ভাবনায় কার মুখটা দেখছো?””

রিপ্তি খানিকটা ভড়কে গেলো। ভাবনার জলরঙের ছাপা অনুভবের মুখটা কি ভাবী দেখে ফেলেছে??

“” এতো উদাসীনতা কার জন্যে? দুইদিন ধরে ক্যাম্পাসে যাচ্ছোনা। কারো সাথে তেমন কথাও বলছোনা। শুধু দায়সারা জবার দিচ্ছো? কি হয়েছে রিপি?””

রিপ্তি এক পলক ভাবীর দিকে চেয়ে রইলো। নিজেকে সামলিয়ে জানালার পাশ থেকে সরতে সরতে বললো,,

“” ভালো লাগেনা,ভাবী। ওখানে চেনা-জানা কেউ নেই। একা একা ক্লাস করতে ভালো লাগে বলো?””
“” সেকি! বাবা যে বললেন,অনুভব ভাই ওখানেই পড়েন?””

এক মুহুর্তের জন্য রিপ্তির মনে ছোট ঝড় বয়ে গেলো,ব্যথার ঝড়! চোখ বন্ধ করে সেই ঝড় সামলিয়ে বললো,,

“” উনি থাকলেই কি,না থাকলেই কি? উনি কি আমার সহপাঠী? নাকি খামখেয়ালির বন্ধু? আমি উনার কিছু হইনা,ভাবী। উনি কেন আমার সাথে গল্প করতে আসবেন?””
“” তা ঠিক।””

রিপ্তি এই মানুষটাকে নিয়ে আর কথা বাড়াতে চায়লোনা। বিছানায় পড়ে থাকা হলুদ-লাল শাড়ীটা নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখছে। মিন্মি আগ্রহ নিয়ে বললো,,

“” শাড়ীটা কিন্তু বেশ সুন্দর। তোকে অনেক মানাবে। জলদি পড়ে ফেল। বান্ধুবীর বিয়েতে বান্ধুবীর আগে জেতে হয় আর তুই? হলুদ শেষ হলে যাবি?””
“” তৃণাটাও চলে যাবে!””
“” তুই তো একদিন যাবি!””
“” আমি কোথাও যাবোনা। আমি এখানেই থাকবো।””

মিন্মি মজার ছলে বললো,,

“” তাহলে তোর জন্য ঘরজামাই দেখি? কি বলিস?””

রিপ্তি চুপ। তার ধ্যান পড়ে আছে শাড়ীর লাল অংশে। হাতের তালু দিয়ে ছুয়ে ছুয়ে দেখছে। কিছু কি অনুভব করতে পারছে? কাকে? লাল ব্যাঙকে???

“” আমি পড়িয়ে দিবো?””

রিপ্তি শাড়ীটা বিছানায় ফেলে বললো,,

“” আমি শাড়ী পড়তে পারি,ভাবী। আমি যখন এইট থেকে নাইনে উঠলাম? তখন থেকেই আমি শাড়ী পড়তাম। রোজ!””

মিন্মির মুখে বিস্ময়ের ছাপ।

“” তাই নাকি? এতো অল্প বয়সে শাড়ী? তাও রোজ? বিশেষ কারণ ছিলো নাকি?””

রিপ্তি জবাব দিলোনা। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো,,

“” তৃণার গায়ে হলুদে আমি থ্রি-পিস পড়বো। তোমার কাছে হলুদ ওড়না হবে? আমার ওড়নাটা খুজে পাচ্ছিনা।””
“” হলুদ ওড়না? দেখতে হবে। আচ্ছা তুমি রেডি হও। খুজে দেখছি।””
“” হুম!””

~~~
“” আমার বিয়েটা সাদামাটা হচ্ছে বলে,তুই সাদামাটা সাজেই এলি?””

তৃণার অনুরাগে রিপ্তির মনটাও খারাপ হয়ে গেলো। হুট করে বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে শহরে থাকে। কাপড়ের ব্যবসা। মার্কেটে দুটো দোকান আছে। ভাইবোন নেই। বাবা আর মা। তৃণার বাবারও কাপড়ের ব্যবসা। সে সূত্রেই পরিচয়,অতঃপর বিয়ে। সবকিছু খুব দ্রুত হচ্ছে। ছেলের মা অসুস্থ! মরণব্যাধিতে ভুগছেন। তার শেষ ইচ্ছে ছেলের বউ দেখে যাবেন। রিপ্তি মুখটা ছোট করে তৃণার পাশে বসলো। গালে হলুদ ল্যাপ্টে বললো,,

“” অমন টাকপড়া ছেলেটাকে আমি দুলাভাই বলবো? কি দরকার ছিলো বিয়ে করার? আমাদের তো একসাথে বিয়ের প্ল্যান ছিলো। এক পরিবারে!””
“” তাহলে অনুভব ভাইকে ডাকি?””
“” কেন? লাল ব্যাঙ এখানে এসে কি করবে?””
“” তোকে বিয়ে করবে!””
“” উনি আমাকে বিয়ে করতে যাবেন কেন?””
“” ভালোবাসেন যে তাই!””

রিপ্তি হলুদ ফেলে উঠে যেতে যেতে বললো,,

“” ছাই বাসে!””
“” উহু ভালোবাসে!””
“” তুই কি চাচ্ছিস,তোর হলুদ ছেড়ে চলে যায়?””
“” অনুভব ভাইয়ের সাথে?””

রিপ্তি তৃণার কাছে বসলো। কড়াচোখে বললো,,

“” ঐ নষ্ট ব্যাঙের নাম নিয়েছিস তো তোর বিয়ে ক্যানসেল!””
“” নামের সাথে বিয়ের কি সম্পর্ক?””
“” সে তো দেখতেই পাবি।””

রিপ্তি মানুষের আড়ালে চলে গেলো। তার বুকটা ভারী হয়ে আসছে। ব্যথার পাথরটার এতো ওজন কেন? পড়লি তো পড়লি আমার বুকেই পড়তে হলো?? আড়াল থেকেই তৃণার দিকে তাকালো রিপ্তি। হলুদসাজে তাকে সুন্দর লাগছে। সূর্যমুখীর মতো সুন্দর! সন্ধ্যার অন্ধকারের সাথে রিপ্তির চোখের দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে আসছে। সে তোকে মিথ্যে বলেছে তৃণা! উনি আমায় একটুও ভালোবাসেননা। ভালোবাসলে অন্য মেয়ে কি করে উনার বুকে মাথা রাখে? অন্য মেয়ের চোখের অশ্রু কি করে উনার কাধে পড়ে? অন্য মেয়ের হাতদুটো কি করে উনার পিঠ আকড়ে ধরে?? আমায় রিকসায় ফেলে কি করে ছুটে যায় অন্য মেয়ের ধারে?? তোকে ভুল বুঝিয়ে, মিথ্যে ভালোবাসার গীত গেয়েছে!

~~~
“” আপনি অনুমতি দিলে,আমি আগামী মাসেই আম্মু-আব্বুকে নিয়ে আসবো,স্যার।””

অনুভবের কথায় কবির সাহেবের ঠোঁট দুটো প্রসারিত হলো। চোখ চিকচিক করছে। মুখের গম্ভীরভাবটা চলে গিয়ে,স্নিগ্ধভাব এসেছে।

“” তোমার জন্য আমার মেয়ে আবার হাসতে শিখেছে,রাগ করতে শিখেছে,জেদ করতে শিখেছে। আমি তো ভেবেছিলাম আমার মেয়েটাকে আমি হারিয়েই ফেলেছি। কিন্তু তুমি আমায় খুজে এনে দিয়েছো। আমি চায়না ও আবার হারিয়ে যাক। তারজন্য তোমার ওকে প্রয়োজন। খুব বেশিই প্রয়োজন। তুমি যেকোনো দিন বাবা-মাকে নিয়ে চলে আসতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই। রিপ্তিমার তোমার মতোই একজন জীবনসাথী প্রয়োজন!””

অনুভবের চোখে কৃতজ্ঞতা স্পষ্ট। দুজনে পাশাপাশি বসে ছিলো,কাঠের খাটে। অনুভব উবু হয়ে স্যারের পায়ে সালাম করলো। কবির সাহেব দুহাতভর্তি দোয়া করে দিলেন। দুজনের মধ্যে আরো বেশ শলাপরামর্শ চললো। কথাবার্তা শেষে অনুভবের বিদায় নেওয়া পালা। তাকে এখনি চলে যেতে হবে। রাত হয়ে যাচ্ছে। আটটায় ট্রেণ। ট্রেণ মিস হলে বাসে যেতে হবে। এতে বাসায় পৌছুতে মধ্যরাত হয়ে যাবে। অনুভব বিদায় নেওয়ার পূর্বে আরেকবার দরজার দিকে তাকালো। চোখের মনিদুটো অস্থিরতায় ভুগছে। এ বাসায় পা দেওয়ার পর থেকেই। এসেছে প্রায় দুঘন্টা। এর মধ্যে একটিবারের জন্যও রিপ্তির দেখা পায়নি। এমনকি কন্ঠটাও শুনতে পায়নি। কোথায় আছে মেয়েটা? সেদিন না বলে চলে আসলো। তারপর থেকে ক্লাসে অ্যাটেন্ডও করছেনা। ও কি বুঝেনা,ওর জন্য আমার হৃদয়পাখিটা সারাক্ষণ ছটফটে ডানা ঝাপটায়!

“” রিপ্তি রুমেই আছে। ঘুমুচ্ছে। বিকেলে তৃণার গায়ে হলুদে গিয়েছিলো। মনে হয় ক্লান্ত। ডেকে দিবো?””

অনুভব খানিকটা লজ্জা নিয়ে বললো,,

“” থাক। আমি আসছি,স্যার!””
“” হুম এসো।””

অনুভব দরজার কাছে এগুতে কবির সাহেব পেছন থেকে বললেন,,

“” তুমি চাইলে দেখা করে যেতে পারো। তোমার উপর বিশ্বাসটা আমার বরাবরের মতোই পোক্ত!””

অনুভবের মুখে বিজয়ের হাসি। দ্রুতকদম ফেলে রিপ্তির রুমের দিকে ছুটছে। দুটোদিন তুমি আমায় অনাহারে মেরেছো রজনীগন্ধা,ভালোবাসার অনাহারে,তোমাকে দেখার অনাহারে,তোমার লাল রাগের অনাহারে,তোমার কোকিল কন্ঠের ঝাঝকথার অনাহারে! একটু শোধতো তুলতেই হবে! অনুভব ঠোঁটে দুষ্টুহাসি নিয়ে রিপ্তির রুমে ঢুকলো। বিছানা ফাঁকা। তবে কি ঘুম থেকে উঠে পড়েছে?

“” রিপ্তিকে খুজছেন?””

মেয়েলিকন্ঠে অনুভব পেছন ঘুরলো। দরজার বাইরে মিন্মি দাড়িয়ে। হাতে চা,ধোয়া উঠছে।

“” ও তো মাত্রই তৃণাদের বাসায় গেলো। কাল তো তৃণার বিয়ে। তাই কি সব প্ল্যান করতে গিয়েছে।””

মিন্মির হাত থেকে গরম চা’টা এক চুমুকে গিলে খাচ্ছে অনুভব। মিন্মি হা’করে তাকিয়ে রইলো। মনে হচ্ছে,সে এই প্রথম কাউকে চা খেতে দেখছে। পিরিচের উপর খালি কাপটা রাখতে রাখতে বললো,,

“” চিনিছাড়া চা! চিনি হলে বেশি ভালো হতো। তোমার ননদকে বলে দিও,আমি চায়ে চিনি বেশি খায়।””

অনুভব ধপধপ পা ফেলে বেরিয়ে যাচ্ছে।

~~~

তৃণাদের বাসার সামনে গেট সাজানো হয়েছে। গোলাপি আর সাদা কাপড়ের সংমিশ্রণে। গেটের দুধার দিয়ে মরিচবাতি। গোলাপী আর সাদা আলো জ্বলছে নিভছে। অনুভবের মনে হলো এই আলোগুলো তারা। গোলাপীটা সে আর সাদা আলোটা রিপ্তি। একজন জ্বলছে তো আরেকজন নিভছে! তৃণাকে কল করেছে প্রায় দশমিনিট হতে চললো। মেয়েটা ফোনে বলেছিলো দুই মিনিটের মধ্যে আসছে। যদি একমিনিট সমান দশ মিনিট ধরা হয় তাহলে তৃণার আসতে আরো দশ মিনিট লাগবে। অনুভবের হিসেব ভুল করে দিয়ে পনেরো মিনিটের মাথায় তৃণা এসে হাজির।

“” ভেতরে আসলেই পারতেন।””
“” সময় নেই। তুমি একা এলে যে?””
“” আপনি তো সঙ্গে কাউকে আনতে বলেননি।””
“” জোড়াবান্ধুবী। একজনকে ডাকলেতো আরেকজনের এমনি আসার কথা।””
“” আপনি কি রিপ্তির কথা বলছেন?””
“” হুম। কোথায় সে? হৃদয় পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। তোমার সইটাকে কি দিয়ে পুড়াই বলো তো!””

তৃণা সামান্য হাসলো। হাসি সামলে বললো,,

“” ও এখানে আপনাকে কে বললো?””
“” কেন?””
“” রিপ্তি তো সন্ধ্যেবেলায় চলে গিয়েছে!””

অনুভব চুপ করে রইলো। মুখে আবার বিষাদের ছায়া। বিষন্নমুখে ক্লান্তিকর হাসি। হৃদয়টা তাহলে ঠিকমতোই পুড়াচ্ছো রজনীগন্ধা? অনুভব বিড়বিড় করে সুর ধরলো,,

নিঙরে নিবো সব
ধোপার মতো
তোমার বুকে
ভালোবাসা আছে যত!!(রোকসানা)

~~~
আজ পাঁচদিন বাদে ইউনিভার্সিটির মূল ফটকে উপস্থিত রিপ্তি। অচেনা সব,তবুও মনের ভেতর জোর আছে। হারাবে না সে। হারিয়ে যাওয়ার মতো দুর্বল মনমানসিকতাকে সে বিসর্জন দিয়েছে। আর গ্রহণ করবেনা। কখনোই না। এই কয়দিন অনুভবের সাথে তার বেশ ঘুরাফেরা হয়েছে। অথচ মানুষটা তাকে ক্যাম্পাসটাই ভালো করে ঘুরিয়ে দেখালো না। শুধু নিজের নোংরামীর অংশগুলোকে দেখিয়েছে। রিপ্তি রিকসা ডাকতে হাত ইশারা করলো। খালি রিকসাটা তার সামনে দিয়েই চলে গেলো। ডাকার জন্য যে কন্ঠশক্তি প্রয়োজন তা সে হারিয়েছে। সামনেই অনুভব। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে এদিকে আসছে। গুনগুন করছে হয়তো। তবে অস্পষ্ট! রিপ্তির কানে ঠিক পরিষ্কার বাজছেনা। অনুভব আরো নিকটে আসলে,রিপ্তি চোখের পাতা ফেললো। উচু হাতটা নামিয়ে নিয়ে একটু ডানদিক হয়ে দাড়িয়েছে। এখন কানে সুরটা পরিষ্কার,,,

ঝড় তুলেছো মনে মনে
কেমনে রই তুমি বিনে?!(রোকসানা)

রিপ্তিকে কেন্দ্র করে অনুভব ঘুরছে আর ছন্দ তুলছে। কয়েকপাক ঘুরে সামনাসামনি দাড়ালো,,

“” অবশেষে মহারানীর আগমন। ক্যাম্পাসটার ঘোমড়ামুখটা এবার বদলাবে। এতোদিন আসো নি কেন? আমি তো ভাবলাম কারো সাথে পালিয়েছো!””

রিপ্তি কোনো উত্তর দিলেনা। চোখ তুলে তাকালোও না। কাধের ব্যাগটাকে শক্ত করে চেপে ধরে,হাটা শুরু করলো। অনুভব কোনো বাধা সৃষ্টি করেনি। রিপ্তির পাশাপাশি হাটতে হাটতে বললো,,

“” ঐদিন না বলে চলে গেলে কেন?””

রিপ্তি থামলো। কড়াকন্ঠে বললো,,

“” তো কি করবো? আপনার নোংরাখেলা দেখবো?””
“” নোংরাখেলা? আমি কখন খেলতে গেলাম? খেলাধুলা তো ছোটবেলায় ছেড়েছি!””

রিপ্তি গরম চাহনি একে আবার হাঁটা ধরলো। অনুভবও তার পিছুপিছু।

“” আবার চুপ করে গেলে কেন? কোন খেলার কথা বলছো? ক্লিয়ার করে বলো!””

রিপ্তির আর কোনো উত্তর দিতে ইচ্ছে করছেনা। লোকটা সামনে আসার পর থেকে রিপ্তির শরীর জ্বলছে। এমন জ্বলনি নিয়ে ক্লাস করা যাবে? পিছুও তো ছাড়ছেনা। মনে হচ্ছে,আমার সাথে সাথে ক্লাসেও ঢুকে পড়বে। ঢুকলে ঢুকবে আমার কি? আমিতো ক্লাস করতে এসেছি। এই নোংরালোকটার জন্য ক্লাস কেন মিস করবো???

“” রজনীগন্ধা!””

রিপ্তি অনুভবকে ফেলে দ্রুত পা চালাতে শুরু করলো। অনুভব বকবক করেই যাচ্ছে। প্রত্যেকটা কথার শেষে একটা করে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসাচ্ছে। রিপ্তি সুযোগ বুঝে ক্লাসে ঢুকে পড়লো। অনুভবও ঢুকেছে। ফাঁকা সিটে বসতে বসতে রিপ্তি বললো,,

“” আমার সাথে ক্লাস করবেন?””

অনুভবের হুশ এলো। চারপাশে চোখবুলিয়ে বললো,,

“” বাইরে অপেক্ষা করছি!””

রিপ্তি মুখবাকিয়ে শক্তভাবে বসে রইলো। একে একে চারটা ক্লাস শেষে যখন ঘন্টা পড়লো তখনো রিপ্তি বসে। বাইরে অনুভবের মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু একা একা কতক্ষণ বসে থাকবে? তাও খালি ক্লাসে! রিপ্তির অনিচ্ছাসত্ত্বেও বের হতে হলো।

“” বাব্বাহ! এক বসায় তিন ঘন্টা পার? কোমড় ধরে এলোনা? তোমার যেই কোমড় আমি তো ভেবেছিলাম…””
“” ঐ নোংরা চোখে আমাকে দেখবেননা। ছিঃ একটা। আমার সামনে থেকে যান তো!””

অনুভব রাশভারী কন্ঠে বললো,,

“” কি হয়েছে রিপ্তি? তুমি কি কোনো কারণে আমার উপর রাগ?””

রিপ্তি চুপ। মুখ অন্যদিকে ঘুরানো। অনুভব রিপ্তির কাধে ধরে ওকে নিজের দিকে ঘুরালো,,

“” চুপ করে থাকলে বুঝবো কিভাবে? রাগের কারণটা তো বলবে।””
“” কতগুলো কারণ বলবো?””
“” সবগুলো। আমার হাতে সময় আছে। শুরু করো।””
“” কিন্তু আমার হাতে সময় নেই। আসছি!””

রিপ্তি চলে যাচ্ছে। অনুভব স্থিরভাবে দাড়িয়েই রইলো। রিপ্তির রাগ সে দেখেছে। কিন্তু কখনো খারাপ লাগেনি। আজ লাগছে। এটা রাগ নয়,অনুরাগ। অনুরাগটা এই প্রথম দেখছে। রিপ্তি অনেকদুর চলে গিয়েছে। অনুভব হঠাৎ করেই রিপ্তির দিকে ছুটলো।

রিপ্তি স্টেশনে পৌছুতে পৌছুতে ট্রেণ চলে গিয়েছে। পরের ট্রেণ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। রিপ্তি ট্রেণের অপেক্ষা করবে নাকি বাস ধরবে?? আগে কখনো দুর পথের বাসে চড়েনি সে। ভয় ভয় লাগছে। আরেকটা সমস্যাও আছে। বাসের গন্ধ সহ্য করতে পারেনা সে। বমি আসে। মুখ তেতো হয়ে যায়। একা একা যাওয়া ঠিক হবে কি??

“” একা কোথায়? আমি আছি তো রজনীগন্ধা। আরামসে ভাবো। কোনো সমস্যা নেই!””

রিপ্তি বিরক্তের চরম পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এই মানুষটাকে হঠাৎ করেই বখাটে ছেলে মনে হচ্ছে। যারা স্টেশনে সারাদিন পড়ে থাকা। কোনো সুন্দরীকে পেলেই নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে! রিপ্তি ভ্রযুগলে বিরক্তের ঘাম নিয়ে বললো,,

“” আপনি আছেন বলেই সমস্যা!””
“” তাহলে চল দুজন মিলে সমাধান বের করি।””

রিপ্তি স্টেশন ছাড়লো। মেইনরোডের একটি বাসে উঠে পড়লো। অনুভব পেছন থেকে শঙ্কিতকন্ঠে বললো,,

“” আরে করছো কি? ওটা নরসিংদীর বাস না।””
“” না হলে নাই আমি এটাতেই চড়বো।””
“” মাঝপথে নামিয়ে দিবে।””
“” দিলে দিবে।””

অনুভব রিপ্তির পাশেই ধপাস করে বসে পড়লো। ওড়নার আঁচল তার নিচে পড়েছে।

“” বাচ্চাদের মতো করছো। এটা কেমন জিদ? কিছু বলছো না,কথাও শুনছোনা। যা বলছি তার উল্টো করছো।””

রিপ্তি ওড়না টানতে টানতে বললো,,

“” মাসে মাসে গন্ডায় গন্ডায় বাচ্চা জন্ম দিলে তো চোখে শুধু বাচ্চাই পড়বে।””

অনুভব চোখ কপালে তুলে বললো,,

“” আমি মাসে মাসে গন্ডায় গন্ডায় বাচ্চা জন্ম দেই?””
“” তা নয় তো কি? এখানে বউ,ওখানে গার্লফ্রেন্ড,সকালে বলেন বাবু হবে,দুপুরে বাবু নিয়ে হাজির,বিকেলে ছেলে হোটেলে ওয়েটারগিরি করছে। আমার তো মনে হচ্ছে আপনার পেছনে স্পাই লাগালে হাজারটা বাচ্চার খোঁজ মিলবে। আপনার উপাধি হবে ‘হাজার সন্তানের পিতা'””

অনুভব কয়েক সেকেন্ডের জন্য থ হয়ে রইলো। তারপর হাসি। শব্দ হাসি। হাসির শব্দে পুরো বাসের লোক তাদের দিকে দৃষ্টিপাত ছুড়ছে।

“” হাসছেন কেন?””
“” এই তোমার রাগের কারণ? পেটে না জমিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলেই পারতে। তোমার ভুল শুধরিয়ে দিতাম।””
“” আমার ভুল শুধরানো লাগবেনা।””

রিপ্তি জানালার বাইরে তাকালো। অনুভব রিপ্তির একটা হাত নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে বললো,,

“” লাগবে। অবশ্যই লাগবে। আর কারোরটা না লাগুক আমারটা লাগতে হবে!””

রিপ্তি হাত ছুটিয়ে নিতে চাইলে অনুভব আরো চেপে ধরলো। বিরতিহীনভাবে বলতে লাগলো,,

“” হোটেলের ঐ ছেলেটা এতিম। নাম শুভ। আমি চার বছর যাবত ওখানে যাতায়াত করছি। এর একটা বড় কারণ আছে। আমার মনে হচ্ছে,শুভ এতিম নয়। ওর বাবা আছে। সেটা ঐ হোটেলের মালিক। এই ব্যাপারটা শুভ না জানলেও তার বাবা জানে।””
“” আপনি কি করে জানলেন?””
“” বুদ্ধি দিয়ে। তুমি তো শুভকে বেশ খুটিয়ে দেখেছিলে তাইনা? তাহলে এটাও নিশ্চয় দেখেছো ওর বা’হাতে আঙুল ছয়টা।””
“” আঙুল ছয়টা হয়েছে তো কি হয়েছে?””
“” হোটেলের মালিকের বা’হাতেও আঙুল ছয়টা।””
“” আঙুল ছয়টা হলো দেখে বাপ ছেলে হয়ে গেলো? আমার স্কুলের এক মেয়েরও আঙুল ছয়টা তাহলে কি ওর বাপও হোটেলের মালিক?””
“” আমি সেরকম বলিনি। আরো অনেককিছু দেখেই বলেছি। এই যেমন ধরো..””

অনুভবের কথার মাঝেই কন্টাক্টর হাজির। অল্প বয়সী ছেলে। বয়স বারো কি তেরো হবে। ভাড়া নিতে এসেছে। অনুভব মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে ছেলেটির সামনে ধরলো। রিপ্তি অনুভবের হাতের দিকে চেয়ে আছে। কব্জি বরাবর কালো তিল। তেমনি একটি তিল ছেলের হাতেও,কব্জি বরাবর। অনুভব রিপ্তিকে অনুসরণ করতেই,চপলতাসহিত বললো,,

“” এ আমার ছেলে নয়। সত্যিই বলছি!””

রিপ্তির মুখ কাঁদো কাঁদো।

~~~

নরসিংদী পৌছুতে প্রায় সন্ধ্যা। আকাশে মেঘের ভেলা। একটু পরপর আকাশ উচ্চশব্দে গর্জন তুলছে। রিপ্তি গায়ের পথ ধরেছে। এই সময় খুব একটা রিকসা পাওয়া যায়না। তারমাঝে আকাশের অবস্থাও ভালোনা। রিপ্তি বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে আর জোরে পা ফেলছে মাটিতে।

“” রাগ কি কমেছে?””

রিপ্তি কপটরাগ নিয়ে বললো,,

“” আপনার মতো বেহায়া লোক আমি একটাও দেখিনি। এতো করে বারণ করা সত্ত্বেও পিছ ধরে আছেন।””
“” রিপ্তি ভিজে যাচ্ছো। চলো গাছের তলায় দাড়ায়। থামলে যেও।””
“” আমার ইচ্ছে আমি ভিজবো। আপনার সমস্যা হলে আপনি চলে যান।””

ঝিরঝির বৃষ্টির ফোটা রিপ্তির শরীরে বিধছে। একটু একটু করে পুরো শরীরে বৃষ্টির পানি মিশে যাচ্ছে। অনুভবের শার্টটা ভিজে গেলো। চুলগুলো কপালে বেয়ে ভ্র ছুইছুই! চোখের পাতা থেকে টপটপ পানি পড়ছে।

বাসার গেট বন্ধ। রিপ্তি অবাক হলোনা। মাতব্বরবাড়ীতে আজ দাওয়াত ছিলো। মুসলমানির। ঐ বাড়ীর ছোটছেলের মুসলমানি হয়েছে এক সপ্তাহ হবে। রিপ্তি গেট খুলতে খুলতে ভাবলো,বাবাদের তো বিকেলেই চলে আসার কথা। এখনো আসেনি যে! বৃষ্টির জন্য আটকে গেলো কি??

রিপ্তি গেট খুলে ভেতরে ঢুকলো। বাসার বড় দরজায় বড় তালা ঝুলছে। অনুভব সহজগলায় বললো,,

“” বাসায় কেউ নেই? স্যার কোথায় গেছেন? তোমাকে বলে গিয়েছে?””

রিপ্তি কোনো উত্তর দিলোনা। ব্যাগের মধ্যে চাবি খুজছে। এ রকম পরিস্থিতিতে, যাতে পড়তে না হয় তাই ভাবী প্রথম দিনই ব্যাগে চাবি ভরে দিয়েছিলো। সে তো বের করেনি। তাহলে থাকার কথা। রিপ্তির খোজাখুজির মাঝে অনুভব আগ্রহ নিয়ে বললো,,

“” তালা ভেঙে দিবো? স্যাররা কখন আসবেন? আমি কল দিবো? তুমি এখনো ফোন ইউস করোনা?””

রিপ্তি চোখ তুলে তাকালো যার মানে এই,একটু চুপ করে থাকতে পারেননা?

অনুভব চুপ করে দাড়িয়ে রইলো। এখন আর তাদের শরীরে বৃষ্টি পড়ছেনা। তবে তাদের ভেজা কাপড় থেকে টপটপ পানি পড়ে মাটি ভিজে যাচ্ছে। অনুভব দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রইলো। মুখে শান্তভাব,চোখের দৃষ্টিতে আচ্ছন্নতা। রিপ্তির মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে সে। চোখের দৃষ্টিতে এখন ঘোর মাতালতা।

রিপ্তি তালা খুলে দরজা মেললো। ভেতরে ঢুকবে তখনি অনুভব বাধা হয়ে দাড়ালো। দরজার মাঝামাঝিতে দাড়িয়ে আছে সে। রিপ্তি একটা ভ্রূ উচিয়ে বললো,,

“” কি সমস্যা?””
“” একটু হাসো না!””
“” মানে?””
“” সারাটা দিন রাগ আর মেজাজ দেখালে যাওয়ার আগে হাসিমুখে বিদায় দাও।””
“” পারবো না। সরুন আমি ভেতরে যাবো।””
“” উহু আগে দেখবো তারপর সরবো।””
“” এবার কিন্তু বেশি বেশি করছেন।””
“” আরো বেশি বেশি দেখতে না চাইলে,যা চাইছি তা দিয়ে দাও।””

মনের সব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছে রিপ্তি শুধু লিনা বাদে। এখন কি জানতে চাইবে লিনাটা কে? সেদিন কেন উনাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন? কি সম্পর্ক দুজনের মাঝে? সারাটাদিন এই প্রশ্নটা করবে করবে করেও করা হয়নি। সাহস জুগিয়ে উঠতে পারেনি। যা ভাবছে তাই হয় যদি? একি আঘাত দ্বিতীয়বার সামলাতে পারবে তো?

“” কি হলো?””

রিপ্তি অনেকটা জোর প্রয়োগে ঢুকতে চাইলো। নিজের বাসায় নিজেকে ঢুকতে হলেও বুঝি এমন যুদ্ধ করতে হয়?? রিপ্তি অনুভবকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে গেলে অনুভব ওর জামা টেনে ধরে। অজান্তেই কাধের দিকের ওড়নাসহিত জামাতে টান পড়েছে। সুতো ছেড়ার শব্দে দুজনেই চুপ। মুহুর্তেই পরিবেশ থমথমে রুপ নিলো। চলছে পিনপতন নিরবতা!

রিপ্তি পেছন না ঘুরেই দাড়িয়ে আছে। বা হাতে পিঠ ছুতেই বুকটা ধক করে উঠলো। অজানা ভয়, আসঙ্কা আর লজ্জার স্রোত বয়ছে শিরা উপশিরায়। কারো নিশ্বাসের শব্দ পাচ্ছে সে,তাহলে কি অনুভব তার দিকে এগিয়ে আসছে? রিপ্তির হাত-পায়ে কাপুনি উঠে গেলো। দৌড়ে পালাবে,তখনি দুটো হাত কোমড় জড়িয়ে ধরলো।

মুগ্ধ চোখ,ভেজা ঠোঁট
অনুভূতির ক্রন্দে
ভাসুক আবেগ,ডুবুক বিবেক
ভালোবাসায় ভেজা সন্ধ্যে!(রোকসানা)

~~~
“” এই আধরাততিরে জামাকাপুড় খুইললা শুইয়া আছস ক্যান? ভূতে ধরছেনি?””

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here