ভালোবাসার ভেজা সন্ধ্যে পর্ব ২৮

#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (২৮)

“”ব্রেকফাস্টে কি খাবে? নিশ্চয় অভুক্ত পেটে বেরিয়েছো?””

মহসীনের বর্তমানভরাট কন্ঠে রিপ্তির পুরোনো স্মৃতিগুলো মিলিয়ে গেলো। মহসীন দরজাতে দাড়িয়ে আর সে বিছানায় বসে। রিপ্তি সোজা হেঁটে মহসীনের কাছে এসে দাড়ালো। ওকে অবাক করে বুক পকেটে হাত দিলো রিপ্তি। চোখে চোখ রেখে কলমটা নিজের আয়ত্ব নিয়ে মহসীনের বৃদ্ধা আঙুলটাতে লিখলো,,

“”কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলে সেদিন?””

মহসীনের শান্তদৃষ্টি আঙুলপত্রে! কিছু সেকেন্ড নিষ্পলকে লেখাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। পুরো মুখমন্ডলে আধার নেমে এসেছে। অপ্রকাশিত কারণটা অপ্রকাশ রেখেই বললো,,

“” বললে নাতো কি খাবে। একটু পর আমাকে বেরোতে হবে। জলদি বলো। আজ আমার হাতের রান্না খাওয়াবো তোমায়।””

রিপ্তির দৃঢ়কন্ঠ,,

“” এড়িয়ে যেতে চাচ্ছো মসহীন? কিন্তু আমি যে তোমায় এড়িয়ে যেতে দিবোনা। উত্তর তো তোমাকে দিতেই হবে আর সেটা এখনি।””

রিপ্তির অনড় আচরণে কিছুটা চমকিয়েছে মহসীন। তার আশেপাশে ঘুরঘুর করা সরল রিপ্তি বুঝি জেদও ধরতে পারে? এইটা তো তার জানা ছিলো না। মহসীন একগাল হাঁসলো,আড়ালে। যেটা শুধু চোখে ভেসেছে,গালেও নয় ঠোঁটেও নয়! কিন্তু রিপ্তি তো দেখে নিয়েছে। কেননা রিপ্তির চোখদুটো তো মহসীনের চোখেই স্থির। রিপ্তির তেজোদৃপ্ত চোখপানে তাকানোর সাহসটা হঠাৎ করেই মিইয়ে গেলো মহসীনের। দ্রুত চোখ সরিয়ে উল্টোপথে পা বাড়াতেই রিপ্তি পথরোধ করে বললো,,

“” আমার উত্তর না দিয়ে একচুলও নড়তে পারবেনা তুমি। তোমার ফিরিয়ে দেওয়া রিপ্তি আর এখনকার রিপ্তির মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ।””

মহসীন সামান্য বিরক্ত ঢেলে বললো,,

“” অতীত অতীতেই থাকনা,বর্তমানে কেন আনছো?””
“” অতীত যদি অসম্পূর্ণ হয় তাহলে তো বর্তমানে আসতে চাইবেই। পৃথিবীর সবসৃষ্টিই তো চাই নিজেকে স্বয়ং সম্পূর্ণা করতে। তাহলে আমার অতীত কেন অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে? তাকেও সম্পূর্ণ হতে হবে তারজন্য শুধু বর্তমান কেন ভবিষ্যতেও টেনে আনবো।””
“” কিসের অসম্পূর্ণ? তোমাকে এমনি এমনি ফিরিয়ে দেইনি,সাথে কারণগুলোও বলে দিয়েছিলাম।””
“” মিথ্যে বলেছিলে। সব মিথ্যে।””
“” কিছু মিথ্যে নয়,রিপ্তি!””

রিপ্তি এক কদম পিছিয়ে গেলো। কন্ঠে চঞ্চলতাভাব চলে এসেছে। উগ্র হয়ে বললো,,

“” সত্যিই যদি হয় তাহলে এখনো বিয়ে করো নি কেন? আমাকে যদি ভালো নাই বাসো এখনো তোমার ঘরনী আসেনি কেন?””
“” বিয়ে করা না করার সাথে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক নেই। সময় হলে ঠিক বিয়ে করে নিবো।””

রিপ্তি দ্রুত মহসীনের সান্নিধ্যে চলে এলো,চোখে চঞ্চলতাদৃষ্টি নিয়ে বললো,,

“” কবে? কবরে পা দেওয়ার পর? আমার তো বয়স বাড়ছে তোমার বুঝি কমছে? কত হলো?””
“”বিয়ের সাথে বয়সের কি সম্পর্ক? আমার ইচ্ছে হয়নি তাই করেনি,যখন ইচ্ছে হবে তখন করবো।””
“” বিয়ের সাথে যে বয়সের সম্পর্ক নেই সেটা তুমি ত্রিশে পা দিয়ে বুঝতে পারলে? আমি তো পনেরোতে পা দিয়েই বুঝেছিলাম মহসীন!””
“” তুমি আর আমি এক নই,তুমি একটা বাচ্চা মেয়ে ছিলে।””
“” সেটা বিয়ের নাম নেওয়ার পর বুঝতে পেরেছিলে? তার আগে?””

মহসীন খানিকটা ঘাবড়ে বললো,,

“” মানে?””
“”পরীক্ষায় ফেল করিয়ে তোমার কাছে টেনে নেওয়ার মিথ্যে ছলনা করার সময় মনে হয়নি আমি একটা বাচ্চা মেয়ে?””
“” ছলনা?””
“” হ্যা, ছলনা! আমি খুব মেধাবী না হলেও ফেল করার মতো ছাত্রী ছিলাম না। আর পরীক্ষায় আমার সব কমন পড়েছিলো। ঘন্টা পড়ার আগেই খাতা জমা দিয়েছিলাম,তবুও আমি কি করে ফেল করলাম? তুমিই ফেল করিয়েছিলে তাইনা? নিজের বানানো জালে বন্দী করবে বলে!””

চোর চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে মুখটা যেমন তামাটে বর্ণে রাঙিয়ে যায় মহসীনের মুখটাও তেমনি রূপ ধরেছে তবে কিছুটা চমকানো আর অনেকটা অবাকের লাবন্যও ছুয়েছে। রিপ্তি খানিকটা দম ছেড়ে আবার বললো,,

“” পড়ানোর নামে আমার মনে নতুন অনুভূতি জাগানোর সময় মনে হয়নি আমি বাচ্চা? নানা রকম ইঙ্গিত ইশারায় আমাকে আবেগী করে তোলার সময় মনে হয়নি আমি বাচ্চা? আমার হাতে প্রেমবাক্য লেখার সময় মনে হয়নি আমি বাচ্চা?””

মহসীন কিছু বলতে চাইলে রিপ্তি দ্রুত বললো,,

“” তুমি সবটা জেনেশুনেই তো আমাকে নিজের দিকে টেনেছিলে,তাহলে হঠাৎ করে কেন পিছিয়ে গেলে? আমার অবুঝ হৃদয়টাতে ভালোবাসার ফুল ফুটিয়ে কেন মাটিতে ফেলে দিলে? তোমার বুকটা একবারও কাঁপেনি? কেন এমন করেছিলে মহসীন? কেন? মিথ্যে বলে আমায় দুরে ঠেলে দিয়েছিলে কেন?””
“” সবটাই কি মিথ্যে ছিলো?””

রিপ্তি কান্নার কোলে ঢলে পড়তেই মহসীনের সংকোচহীন প্রশ্নে পূর্ণদৃষ্টি রাখে মহসীনের উপর।

“” মানে?””
“” আমি যে তোমার আকর্ষণ ছিলাম সেটা তো প্রমাণ হলো। তুমি নিজেই করেছো!””

মহসীনের কথা বোধগম্য হচ্ছেনা রিপ্তির। বুঝার জন্য মহসীনের মুখপানে চেয়ে আছে। যেন এই মুখের দিকে আর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই সব বুঝতে পারবে। মহসীন ঠোঁট একদিকে প্রসারিত করে বললো,,

“” আমার ভালোবাসা মিথ্যে নাকি সত্যি সেটা নাই বা তুললে। যে ভালোবাসার দোহায় দিয়ে অতীতকে বর্তমানে টেনে আনছো সেটা কি আদৌ বেঁচে আছে? যদি বেঁচে থাকে তাহলে তুমি আজ পাঁচমাসের অন্তঃসত্ত্বা হতে না! আমি যদি তোমার ভালোবাসাই হতাম তাহলে অনুভবের ছোঁয়ায় তুমি কেঁপে উঠতেনা। নিষিদ্ধ অনুভূতিতে পা রাখতে না। মাত্র তিনটে বছরে তোমার হৃদকম্পনে অন্যকারো নাম কম্পিত হতো না!””

রিপ্তির শরীরটা অসার হয়ে আসছে। অজান্তেই কয়েক কদম পিছিয়ে যাচ্ছে। মহসীনকে কাঠগড়ায় দাড় করাতে গিয়ে কি নিজেই আসামী হয়ে গেলো? নিজের অজান্তে নিজেকেই জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে ফেললো? এখন সে কি করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবে? কি করে? এত বড় ভুল কি করে ঘটে গেলো? সত্যিই তো আমার ভালোবাসা তো মহসীন তাহলে তাকে ছাপিয়ে অনুভবের কাছে কি করে পৌছুলাম? তাও এতো অল্প সময়ে? এতো গভীরে! যে গভীরতার শেষ সীমানাটাও অনুভব স্পর্শ করে ফেলেছে।

রিপ্তি ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। এক চাপা অপরাধবোধ তাকে ঝাপটে ধরেছে। কলঙ্কটা তাহলে শুধু শরীরে না অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা হৃদযন্ত্রণেও লাগিয়ে ফেলেছে! বাহিরের কলঙ্কটা ধুতে গিয়ে যেভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে,পদে পদে জীবনের মর্ম বুঝতে হচ্ছে সেভাবেই কি ভেতরেরটাও ধুতে পারবে? নাকি আরো বেশি ভুগতে হবে। শেষমেষ কলঙ্কহীন হতে পারবে তো? ভেতর ও বাহিরে?

মহসীন রিপ্তির পাশে বসলো। নরমসুরে বললো,,,

“” এভাবে ভেঙে পড়োনা,রজনীগন্ধা! আমার বুকে যে খুব লাগে। উঠো,তুমি একটু বিশ্রাম করো,আমি তোমার জন্য হালকা-পাতলা কিছু বানিয়ে নিয়ে আসছি।””

রিপ্তিকে বিছানায় বসিয়ে দিলো মহসীন। এমন হৃদয়ঘাত কথাগুলো বলতে চায়নি সে তবুও কেন বলে ফেললো? তবে কি সে ঈর্ষিত? কিন্তু কেন? আজ এই দিনটার জন্য কি সেই দায়ী নয়? বেশ তো ছিলো ছোট্ট রিপ্তি,কেন গেলো তার জীবনে বিশেষ পদক্ষেপ ফেলতে? ঐটুকু মেয়ে,ঐটুকু মেয়ে বলে নিজের মনটাকে কত বোঝাতে চেয়েছিলাম,কিন্তু মন! সে কি কারো কথা শোনে? তার ধর্মই হলো অবাধ্য হওয়া। যদি কষ্ট করে বেধে রাখতে পারতাম তাহলে হয়তো মেয়েটার জীবন আজ পুর্ণতা পেতো! ভিন্নরঙে! ভিন্ননামে!

রান্নাঘরে ঢুকার আগে ঘড়ির দিকে চোখ পড়ে মহসীনের। প্রায় দশটা বেজে গিয়েছে। সকাল শেষ হয়ে দুপুর নামবে। এতো বেলা অবধি মেয়েটা না খেয়ে আছে। আর কতক্ষণ এভাবে রাখবে? এখন তো আর সে একা নয়,তার অভ্যন্তরে আরেকটা সত্তারও বসবাস। আর দেরি করা যাবেনা। যত দ্রুত সম্ভব কিছু খাওয়াতে হবে। মহসীন বেশ কিছুক্ষণ ভেবে ফ্রিজে হাত দিলো। দুধের প্যাকেট বের করেছে। চুলায় আগুন ধরিয়ে দিলো। দাড়িয়ে থেকে উচ্চতাপে দুধটা ঠিক মতো ফুটিয়ে নিলো। মগের মধ্যে ঢেলে একটা কাঁচা ডিম ভেঙে দিয়েছে গরম দুধে। কাঁটা চামচে ঘনঘন নাড়িয়ে মিশিয়ে নিলো। ডিম মিক্স করা গরম দুধের সাথে কয়েক পিস পাউরুটি নিয়ে হাঁটা ধরলো রিপ্তির রুমের দিকে। স্বল্প সময়ে এর থেকে ভালো কিছু মাথায় আসেনি মহসীনের। এখন মেয়েটা খেলেই হয়।

~~~

বিছানার এককোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে রিপ্তি। চোখের দৃষ্টি ক্লান্ত। হবেইনা কেন? আর কত কাঁদবে এই চোখ দুটো? যখন সে কথা বলতে শিখেছিলো তখন মায়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসিয়েছে,যখন একটু বড় হলো,প্রেমনামক পোকাটা কামড়ে দিলো তখন মহসীনের জন্য বুক ভাসিয়েছে আর এখন?

“” খেয়ে নাও!””

মহসীনের কন্ঠে রিপ্তি দুর্বল দৃষ্টিতে তাকালো। পরক্ষণেই চোখ ফিরিয়ে নিলো।

রিপ্তির সামনেই বসলো মহসীন। নিজেই দুধের মধ্যে রুটি ভিজিয়ে বললো,,

“” হা করো।””

রিপ্তি আরেক পলক তাকালো মহসীনের দিকে। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিলেও সামনে এগিয়ে এসে খাওয়া শুরু করেছে। মহসীন দ্বিতীয়বারের মতো রুটি ছিড়তে নিলে রিপ্তি শান্তস্বরে বললো,,

“” আমি খেতে পারবো। তুমি এখন যাও।””
“” আমি এমনিতেও চলে যাবো। তবে খাবারটা শেষ হোক তারপর।””

রিপ্তি খাচ্ছে আর ভাবছে। পুরো ভাবনায় অনুভব আর মহসীন। একসাথে দুজনকে সংমিশ্রণ করতে গিয়ে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলছে তবুও ভাবনা কাটছেনা। কাটার মতো কি? ভালোবাসার জন্য সে দুটো ঝুকিপূর্ণ কান্ড ঘটিয়েছে। প্রথমবার বাড়ি ছেড়েছিলো দ্বিতীয়বারও বাড়ি ছেড়েছে। দুটো ঘটনা দুটো ভিন্ন মানুষের কারণে। কিন্তু দুটোই তো ভালোবাসা ছিলো! কিন্তু এতো অল্প সময়ে স্বল্প বিস্তরে দুটো মানুষ করি করে একমনে জায়গা নিলো? তাহলে কি মহসীন সত্য! ও শুধুই আমার আকর্ষণ ছিলো?

রিপ্তির ভাবনার সুতো কাটে মহসীনের হাতের স্পর্শে। মহসীন কিছু লিখছে,রিপ্তির মধ্যমা আঙুলে। লেখা শেষে বললো,,

“”আমার জরুরী কাজ আছে। যেতেই হবে। আসতে দেরি হতে পারে। সাবধানে থেকো।””
“” বাসায় আর কাউকে দেখছিনা যে!””
“” আমি একাই থাকি।””
“” তোমার বাবা-মা?”‘

মহসীন পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করলো। রিপ্তির সামনে রেখে বললো,,

“” ফোনটা সাথে রেখো!””

মহসীন চলে যাচ্ছে। রিপ্তি পেছন থেকে আগের প্রশ্নটাই আবার বললো,,

“”তোমার বাব-মা?””
“” নেই! আমি অনাথআশ্রমে বড় হয়েছি।””

~~~

মহসীন চলে যেতেই রিপ্তি গোসল সেরে নিলো। মাথার ভারটা কমেছে। শরীরের ক্লান্তভাবটা দুর হয়েছে। কিন্তু মনের? মনের ক্লান্ত আর ভারটা তো আগের চেয়ে বেড়েছে। কি থেকে কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছেনা। তবে সবকিছুকে এখন দুর্বিষহ লাগছে। কেন এমন হলো? কেন তার সাথেই হলো? উফ! আর ভাবতে পারছেনা রিপ্তি,কিন্তু না চাইলেও বারবার একি ভাবনাগুলো মাথার পুরো অংশজুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। কি করে মুক্তি পাবে সে? রিপ্তি ভেজা চুলগুলো ছেড়েই বিছানায় শুয়ে পড়লো। অন্যমনস্কতায় চোখ পড়লো হাতের অঙ্গুলিতে। এখানে তো কিছু লিখেছিলো মহসীন! পড়াই তো হলো না। পানিতে ধুয়ে যায়নি তো? রিপ্তি শোয়া থেকে বসে পড়ে। গভীরদৃষ্টি রাখে আঙুলে। ধুয়ে এসেছে অনেকটায় তবে আধোআবছা রয়ে গিয়েছে। রিপ্তি একটার সাথে আরেকটা অক্ষর জুরে জুরে শব্দ বানাচ্ছে। বেশ সময়ের ব্যবধানে একটি লাইন জুড়তে পারলো,,

“” তুমি অনুভবকে নয়,আমার অনুরূপকে ভালোবেসেছো!””

রিপ্তি খানিকটা সময় স্তব্ধতায় কাটালো। মহসীন এটা কি লিখেছে? এর মানে কি? অনুরূপ বলতে কি বুঝিয়েছে? রিপ্তি চোখ বন্ধ করে দুজনের মুখটাকেই কল্পনা করছে,কই! কারো চেহারার তো কোনো মিল নেই। তাহলে কেমন অনুরূপ? দুজন কি জমজ ভাই? সেটা কি করে সম্ভব? দুজনের বয়সের ব্যবধান তো প্রায় পাঁচ বছর হবে। তাহলে? রিপ্তি আবারও অস্থির হয়ে উঠলো। এক জঘন্যতম অস্থিরতা নিয়ে ভাবনায় ডুবে গিয়েছে সে। কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে ভাবে তো কিছুক্ষণ বসে বসে। শুয়ে বসে আরাম না পেয়ে দাড়িয়ে ভাবে,মাঝে মাঝে রুম ছেড়ে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে হাঁটাহাঁটি করে। পৃথিবীর সকল অশান্তি বুঝি আজ তার দখলে!

ভাবনা ভাবনায় যখন সে ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে তখনি এক পুরুষের ভরাট গলার হাঁসির শব্দ। ঘুমন্ত রিপ্তির চোখের পাতা কাঁপছে। অস্পষ্ট সুরে বললো,,

“” এমন লাল পাগড়িতে তোমাকে খুব বিশ্রি লাগছে,মহসীন!””
“” তাতে কি? লাল যে আমার পছন্দের রঙ,তোমার মতো। আমাদের বিয়েতে তুমি লাল বেনারশী পড়বে আর আমি লাল শেরওয়ানি সাথে লাল পাগড়ি পড়বো।””

মহসীন আরেকদফা হেঁসে নিয়ে মোটা গলায় গান ধরলো,,

বাবরি কাটা তার চুলের বাহার
মুচকি হাসি,হাসিটা যে তার
বাবরি চুলওয়ালা
ঐ লাল কুর্তাওয়ালা
দিলে বড় জ্বালা রে
পান্জাবীওয়ালা(গান)

রিপ্তির ঘুম ভেঙে গেলো। শুকনো গলা ভেজাতে ভেজাতে চারপাশটা চোখ বুলাচ্ছে। মহসীন নেই কোথাও নেই। তাহলে কি সে স্বপ্ন দেখছিলো? এতোগুলো বছরে একটিবারের জন্যও তো মহসীন স্বপ্নে আসেনি তাহলে আজ কেন আসলো? রিপ্তির চোখ চকচক করছে,সে উত্তর পেয়ে গিয়েছে। মহসীনকে ছেড়ে আসার পর স্কুলে যাওয়া-আসা ছাড়া আর কোনো কাজেই সে বাইরে বের হতো না। অপরিচিত তো দুর পরিচিতদের সাথেও কথা বলতো না তাহলে অনুভবের সাথে কেন বললো? অনুভব তো তার সাথে কথা বলতে আসেনি সে নিজে এগিয়ে গিয়ে কথা বলেছে। কেন? কারণ তার শরীরের লাল রঙটা তাকে টেনেছে,তার গানগুলো তাকে বারবার বাধ্য করেছে তার নিকটে যেতে কেননা মহসীনও হাঁটাচলায় সারাক্ষণই গুনগুন করতো। তবে হ্যা,সেদিকে রিপ্তির বিশেষ খেয়াল ছিলোনা। তাই হয় তো তার স্মৃতির পাতায় মহসীনের এই আচরনটি আচড় কাটেনা।

প্রিয় মানুষের দীর্ঘ অনুপস্থিতে তার বিশেষ কোনো গুন,বৈশিষ্ট্য অথবা অভ্যাসগুলো ভিন্ন কোনো মানুষের মধ্যে থাকলে তার প্রতি বিশেষ খেয়াল চলে আসে। এবার হোক সেটা বুঝে অথবা না বুঝে। রিপ্তিরও তাই হয়েছে। কিন্তু অনুভব কি জেনেশুনেই মহসীনের অনুরূপ সেজে তার সামনে দাড়িয়েছিলো? নাকি কাকতালীয়ভাবেই তার স্বভাব-চরিত্র মহসীনের সাথে মিলে গিয়েছে? রিপ্তির কপালে গাঢ় চিন্তার ভাজ পড়তেই কলিং বেলের শব্দ। ভাবনা জগতের এতোটাই বিভোর ছিলো যে রিপ্তি বেশ চমকে উঠেছে। নিজেকে সামলাতে কিছু সময় নিয়ে দরজার দিকে এগুলো। দরজার অপরপাশে মহসীনের মুখটা ভেসে উঠতেই রিপ্তি প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,,

“”অনুভব তোমার কি হয়?””

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here