ভালোবাসার রংধনু পর্ব -০৭

#গল্পঃভালোবাসার_রংধনু #লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্বঃ০৭

রাতে হঠাৎ করেই নিহাদের ঘুম ভেঙে গেলো।শোভা ওর দিকে ফিরেই গুটিয়ে ঘুমিয়ে আছে।বালিশের উপর চুল ছড়ানো।এক হাত মাথার নিচে দেওয়া অন্যহাতে নিচে এলিয়ে রেখেছে।নিহাদ শোভার নিচে পড়ে থাকা হাতটি ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো।

সকালে সবাই ঘুরতে ঘুরতে গ্রামের ভেতর থেকে মেইন রোড পর্যন্ত চলে আসে।একজন লোক মাথায় কাঁচের মতো দেখতে একটা বাক্সতে পিঠা নিয়ে বিক্রি করছেন।
নিবেন জামাই পিঠা?পিস মাত্র দশটাকা।জামাই পিঠা একবার খেলে আবারও খেতে চাইবেন।
নিবেন জামাই পিঠা?
সবাই কৌতুহল নিয়ে লোকটিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,কিরকম জামাই পিঠা দেখি?লোকটি ক্লান্তিমাখা হাসি দিয়ে মাথা থেকে বাক্সটি নামালেন।নিচে বসে বাক্স খুলে একটা পিঠা নিয়ে নিহাদের হাতে দিয়ে বললেন,মাত্র দশটাকা করে স্যার!
নিহাদ পিঠা হাতে নিয়ে বলল,ওহ এগুলো?এগুলোতো মা বানাতে পারে কিন্তু আমি নাম জানতামনা।সবাইকে দুটো করে দিন।সবাইকে দুটো করে পিঠা দিলো লোকটি।একেবারে মচমচে স্বাদ।সবার কাছেই ভালো লাগলো খেতে।নিহাদ প্রতিটি পিঠার দাম দিয়ে দিলে লোকটা আবারো বাক্স মাথায় তুলে চলে যায়।পিঠা নিবেন?পিঠা?জামাই পিঠা।
রিনি বলল,পিঠাগুলো অনেক মজার ছিলো।কিভাবে বানায় এগুলো?
শোভা মুচকি হেসে বলল,আমিও পারি এগুলো বানাতে মা শিখিয়েছে।রিনি উৎফুল্ল হয়ে বলল,আমাকে শেখাবে?অনেক ভাল্লাগে খেতে।শোভা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো মানে সে রিনিকে শেখাবে।দুজনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলো।যেনো কত বছর ধরে দুজন দুজনকে চেনে।মনে হচ্ছে আত্মার বন্ধুত্ব দুজনের মধ্যে।নিহাদ ব্যাপারটা খেয়াল করে প্রশান্তির হাসি দিলো।

নিহাদ,রাহুল,আশিক,শিফাত পেছনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলে।নিহাদের ফোনে কল আসতেই সে রিসিভ করে কানে ধরে।ওপাশ থেকে নিহাদের মা মিসেস সেলিনা বলে ওঠেন,তোরা যেখানে গেছিস সেখান থেকে ফিরে আয়।পরেও গিয়ে ঘোরাঘুরি করা যাবে।এখন তোর দাদি গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছে তোর বউকে দেখতে।আমরা বলেছি বউ তার বাপের বাড়িতে গিয়েছে।আমাকে হুঙ্কার ছেড়ে বলল,তাড়াতাড়ি আসতে বলতে।নিহাদ ঠিক আছে বলে লাইন কেটে দেয়।শিফাত,রাহুল,আশিকের সাথে কথা বলে সামনে গিয়ে শোভার হাত ধরে টেনে নিয়ে বলল,চলো আমাদেরকে যেতে হবে।শোভা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,এরকম টানছেন কেনো?কোথায় যেতে হবে?
নিহাদ সামনের দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলেছে।হাঁটতে হাঁটতে বলল,বাড়িতে যেতে হবে।দাদি গ্রাম থেকে এসেছে তোমাকে দেখতে।বিয়েতে আসেননি তখন নাকি উনার ডায়রিয়া হয়েছিলো।

রিনিসহ বাকিরা বিকেলে রওনা দিবে ঢাকার উদ্দেশ্যে।নিহাদ আর শোভা এখনই যাবে।রাহুলের বাড়িতে এসে ব্যাগ ঘুছিয়ে দুজনে রওনা হলো।বাসে করেই ঢাকায় ফিরবে দুজনে।শোভাকে নিয়ে কাউন্টার থেকে দুটো ঢাকায় যাওয়ার বাসের টিকিট নিয়ে কিছুক্ষণ বাস আসার অপেক্ষা করে।বাস আসতেই উঠে পড়ে তারা দুজনে।ওদের সিট মাঝখানের দিকটায় পড়েছে।দুজনে চুপচাপ বসে আছে,গাড়িতে একজন লোক তেঁতুলের আচার বিক্রি করছে।নিহাদ শোভাকে জিজ্ঞেস করলো খাবে কিনা?শোভা হ্যাঁ বলতেই নিহাদ তেঁতুলের আচার কিনে ওর দিকে বাড়িয়ে দেয়।শোভা আচার হাতে নিয়ে বলল,নিন খান।
নিহাদ শোভার কথায় অসম্মতি জানিয়ে বলল,নাহ আমি খাবোনা।পরে আর ভাত খেতে পারিনা।মুখে পুরো ঘা হয়ে যায়।
শোভা আর সাধলোনা চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে।কিছুক্ষণ পরপরই এমন এক এক্সপ্রেশন দিচ্ছে মনে হচ্ছে অমৃত খাচ্ছে।শোভার খাওয়ার ধরন দেখে নিহাদের মনেও তেঁতুল খাওয়ার ইচ্ছে জাগলো।নিহাদ দেরি না করে একটু তেঁতুল নিয়ে মুখে দিলো।কি টক!এখন এতটা স্বাদ মনে হচ্ছে না কিন্তু শোভার খাওয়ার ধরন দেখে মনে হচ্ছে এর চেয়ে স্বাদের খাবার আর পৃথিবীতে নেই।নিহাদের মুখভঙ্গি দেখে শোভা হাসলো।ও ইচ্ছে করেই এরকম করেছে যেনো নিহাদ এখান থেকে তেঁতুল নিয়ে খায়।

দুজনে পৌঁছে গেলো ঢাকায়।সেখান থেকে সিএনজি নিয়ে বাসার পথে রওনা দিলো।শোভার কাছে জার্নি করতে অনেক ভালোলাগে।অনেকে আছে জার্নি করতে পারেনা।বমি হয়,মাথা ঘুরে।শোভা বাইরের দিকে নজর বুলিয়ে চলেছে।গাড়ির গতির সাথে গাছগুলো পেরে উঠছেনা।তারা ক্রমাগত উল্টোপথে ছুটে চলেছে।শোভা বেশ উপভোগ করছে ব্যাপারটা।নিহাদ বাইরে তাকিয়ে দেখছে আর কতটুকু পথ বাকি।
অবশেষে দুজনে বাড়িতে এসে পৌঁছালো।নিহাদ শোভাকে সাবধান করে দিয়ে বলল,ঠিকমতো মাথায় কাপড় দিয়ে রাখবে।দাদি আবার এসব ব্যাপারে বেশ খুঁতখুঁতে।গ্রামের মানুষতো তাই অনেক কিছুতেই খুঁত ধরবে।শোভা ভীত চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো।বাসার ভেতর গিয়েই শোভা আগে শাশুড়ীকে সালাম করে,উনি বসার ঘরে ছিলেন।এখন ঘড়িতে বিকেল তিনটা বাজে।নিহাদ আর শোভা আসবে বলেই মিসেস সেলিনা এতক্ষণ নিচে বসে অপেক্ষা করছিলেন।দুজনকে ফ্রেশ হয়ে খেতে আসতে বললেন।দুজনে উপরে নিজেদের ঘরে চলে গেলো।ফ্রেশ হয়ে এসে খেয়ে নিলো।নিহাদ ঘরে চলে গেলো।মিসেস সেলিনা শোভাকে বললেন,দাদি শাশুড়ীর ঘরে গিয়ে উনার সাথে দেখা করে আসো।শোভাকে নিয়ে মিসেস সেলিনা আলেয়া ভানুর ঘরে গেলেন।উনি শুয়ে আরাম করছিলেন।শোভা ঘরে ঢুকে একজন বৃদ্ধ,ঢিলেঢালা কুচকানো চামড়ার নারীকে আবিষ্কার করেন।মিসেস সেলিনা ইশারা করতেই শোভা পা টিপেটিপে আলেয়া ভানুর পাশে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো।আলেয়া ভানু চোখ খুলে বললেন,কে তুমি মাইয়া?
আলেয়া বেগমের কথায় শোভা ভড়কে গেলো।কি উত্তর দিবে?ওর গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।আলেয়া বেগমের ধারালো চোখের দৃষ্টি দেখে শোভা সব গুলিয়ে ফেলছে।কথা বলছোনা কেন?বলে আলেয়া বেগম ধমক দিতেই শোভা চমকে ওঠে।মিসেস সেলিনা চটপট জবাব দিলেন,আম্মা ও আপনার ছোট নাত বউ।
আলেয়া বেগম মুখ বাঁকিয়ে নিলেন।মাইয়া কি কথা কইতে পারেনা?বস মাইয়া, এইহানে বস।শোভা ভয়ে ভয়ে বসতেই আলেয়া বেগম শোভার থুতনি চেপে ধরে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বলল,রূপতো ভালাই আছে।দেইখো এই রূপের তেজ দেখাইয়া আমার নাতিরে ছাইড়া আরেক বেডা লইয়া যাইওনা।
শোভা অবাক হয়ে আছে।কি বলছেন উনি এসব?মিসেস সেলিনার দিকে তাকাতেই দেখলো উনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন।
আলেয়া ভানু বলল,হের দিকে চাইয়া লাভ নাই।হের দিকে চাও কেন?এহন যাও আমি এট্টু ঘুমাইতাম লইছিলাম।শোভা যেনো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।ধীরে ধীরে উঠে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

শোভা ঘরের দিকে যাওয়া ধরতেই মিসেস সেলিনা ডেকে উঠলো ওকে।শোভা পেছন ঘুরে তাকাতেই বলল,আমার সাথে এসো।শোভা শাশুড়ীর পেছন পেছন উনার ঘরে গিয়ে বসলো।মিসেস সেলিনা বললেন,শুনো তোমাকে বলে রাখি আহাদের দাদি গ্রামের মানুষ।উনি আমাকে পছন্দ করেননা।আর আমার ছেলের বউদেরও না।শোভা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,কিন্তু কেন?
মিসেস সেলিনা আবারো বলতে লাগলেন,উনি যেহেতু গ্রামের মানুষ চেয়েছিলেন তোমার শশুরকে গ্রামেরই কোনো মেয়ে বিয়ে করাতে।কিন্তু তোমার শশুর শেয়ারের ব্যবসার জন্য ঢাকায় আসা যাওয়া করতো।সেভাবেই আমাদের সম্পর্ক তৈরি হয়।তোমার শশুরকে বিয়ে করার জন্য বাড়ি থেকে বললে উনি আামর কথা জানান কিন্তু আহাদের দাদা দাদি কিছুতেই শহরের মেয়ে বিয়ে করাবেন না ছেলেকে।তখন তোমার শশুর জেদ করে আমাকে বিয়ে করে নেয়।বিয়ে করে নেয় যেহেতু এখনতো কিছু করার নাই তাই আহাদের দাদা দাদি আমাকে ঘরে তোলেন।কিন্তু কখনো মেনে নেননি।

আহাদ হওয়ার পর তোমার শশুরের ব্যবসার জন্য আমরা একেবারে ঢাকায় চলে আসি।আহাদের দাদা-দাদি গ্রাম ছেড়ে আসবেননা।বাকি ছেলেদের সাথেই থেকে গেলেন।কয়েক বছর আগে আহাদের দাদা গত হয়েছেন।আমাকে পছন্দ করেনা ঠিক কিন্তু নাতিদের প্রচন্ড ভালোবাসেন।আহাদ ও শহরের মেয়েকে বিয়ে করেছে তাই তার বউকেও পছন্দ করেননা।তোমাদের বিয়ের সময় উনি ইচ্ছে করেই অসুস্থতার ভান ধরেন।তোমার চাচি শাশুড়ী আামকে ফোন করে জানালো বলেই হেসে দিলেন মিসেস সেলিনা।তাইতো বিয়েতে গ্রাম থেকে কেউ আসতে পারেনি।
কেনো নিহাদকেও শহরের মেয়ে বিয়ে করাচ্ছি।সেজন্য রেগে গেলেন।এখন হুট করেই তোমার চাচা শশুরকে বলল,এখানে বউ দেখতে আসবে।উনার কথায় ঘাবড়াবেনা,মনে কিছু নেবেনা।আবার কখনো খারাপ ব্যবহার করোনা উনি গুরুজন।
শোভা মনযোগ দিয়ে শাশুড়ীর প্রতিটা কথা শ্রবন করে নিলো।
মিসেস সেলিনা বললেন,এখন গিয়ে রেষ্ট নাও,অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছো।
শোভা বলল,ভাবিকে দেখলাম না উনি কোথায়?
মিসেস সেলিনা বললেন,আজ শরীর ভালো নেই হয়তো ঘুমাচ্ছে।রাতে কথা বলতে পারবে এখন যাও।শোভা সম্মতি জানিয়ে চলে আসে রুমে।
শোভা আসতেই নিহাদ শোয়া থেকে উঠে বসে।এতক্ষণ কি কথা বলছিলে দাদির সাথে?শোভা একপলক তাকিয়ে বলল,আপনি ঘুমাননি?
নিহাদ বলল,ঘুমিয়েছি কিন্তু আশিকের কল আসায় ঘুম ভেঙে গেছে।
“ওহ” বলে শোভা কম্বল সরিয়ে নিহাদের পাশে শুয়ে পড়লো।নিহাদ এগিয়ে এসে শোভার চুলে নাক ডুবাতেই শোভা তড়িৎগতিতে নিহাদের দিকে ফিরে তাকায়।
আপনি আমার চুলে নাক ঘষছেন?চোখ বড় করে বলল শোভা।
নিহাদ থতমত খেয়ে এলোমেলো চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাবতে লাগলো কি উত্তর দেওয়া যায়।পরক্ষণেই সে নাকমুখ কুঁচকে বলল,ছিঃ!এত দুর্গন্ধ তোমার চুলে?আমি এতক্ষণ এই দুর্গন্ধের উৎস খুঁজছিলাম।এখন দেখছি তোমার চুল থেকেই আসছে।ইয়াক কয়দিন ধরে শ্যাম্পু করোনা।
শোভা রেগে বোম হয়ে গেছে।বলছে কিনা ওর চুল থেকে দুর্গন্ধ আসছে।কটমট দৃষ্টিতে নিহাদের দিকে তাকিয়ে বলল,দুর্গন্ধ আপনার থেকে আসছে।খচ্চর লোক!আমার চুল থেকে কি সুন্দর স্মেল আসছে।আর আপনি বলছেন দুর্গন্ধ?এতই যখন আমার চুলে দুর্গন্ধ তখন এখানে শুয়েছেন কেনো?নামুন খাট থেকে।
নিহাদ পড়লো মাইনকার চিপায়।এখন মনে হচ্ছে ওকে ঘর ছাড়া হতে হবে।কিজন্য যে এই মেয়ের চুলের ঘ্রান নিতে গেলো?

শোভাকে থামাতে নিহাদ বলল,নাহ মানে তোমার চুলে কোনো দুর্গন্ধ নেই।একটা মিষ্টি স্মেল পাচ্ছিলাম তাই স্মেল নিতেই…….
শোভা চোখ গরম করে বলল,তাই বলে আপনি আামর চুলে নাক ঘষতে আসবেন কেনো?
নিহাদ শোভার হাত দুটো মুঠোয় পুড়ে নিয়ে অধিকার দেখিয়ে বলল,তুমি আমার বউ!তাই আমি যা ইচ্ছে করতে পারি।
শোভা নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিহাদের দিকে।পরক্ষণেই হাত ছাড়িয়ে অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়লো।নিহাদ এখনো শোভার দিকেই তাকিয়ে শুয়ে আছে।
#চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here